#পটলার দুগ্গাপূজা#
রুমাশ্রী সাহা চৌধুরী#
প্রত্যেকদিনের মত আজও নাড়ুদার দোকানে পেটাই পরোটা আর চা খাচ্ছিলো পটলা। আজ দুগ্গা সপ্তমী চারিদিকে বেশ পূজা পূজা গন্ধ ,তাই বাড়ী থেকে বেশ মাঞ্জা দিয়ে বেড়িয়েছে। গায়ে লাল কালো ডোরাকাটা গেঞ্জি আর ছেঁড়া জিন্স, এবছর নাকি হাই ডিমান্ড। অনেক দরদাম করে ধর্মতলার ফুটপাথ থেকে কিনেছে। এমনিতেই পটলাকে পেশার জন্য ছোট চুল রাখতে হয়,তবুও এবার কায়দা মেরে পেছনের চুল এক্বেবারে প্রায় চেঁছেই ফেলেছে পটলা আর সামনে ছোট্ট টেরি। ঠিক ঘটের মাথায় আম্রপল্লব।
সক্কাল সক্কাল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাঞ্জা দিতে দেখে মুখ ঝামটা দেয় বুচকি,"ঐ মুখপোড়া কাটবি তো লোকের পকেট তা এত হিরো মার্কা সাজ কেন শুনি? আজ যদি খালি হাতে ফিরেছিস মুখে নুড়ো জ্বালিয়ে দেবো হতচ্ছাড়া।" ...'রাগ করিস না বুচকি দুগ্গা পূজার দিন নতুন জামা আর চোখে সানগ্লাস যদি না দিই পাবলিক তো পকেটমারই ভাববে।"যদি অন্য কিছু করিস মুখপোড়া,আমার কানে খবর আসে তব্বে না মশার কামড়ে রাতভর শুইয়ে রাখবো বারান্দায় এই বলে রাখলাম।"
পেটাই পরোটা খেয়ে লোকাল ট্রেন ধরে পটলা আসছে কলকাতায়। লোকাল ট্রেনে একটু চেষ্টা চরিত্তির করছিলো হাতসাফাইয়ের এক ছোকরার পকেট থেকে একটা মানিব্যাগ হাফিসও করলো কিন্তু ধুস্ এখনকার লোকজন কি ভিখিরি মাইরি। রাজ্যের কার্ড দিয়ে ব্যাগ ভর্তি এগুলো নিয়ে কি করবে? আর পড়ে আছে মাত্র কুড়ি টাকা,ছ্যা ছ্যা। একবার কার্ড নিয়ে বিশু ওস্তাদের সাথে এ টিএম এ ঢুকেছিলো। ওরেব্বাস সিকিউরিটি গার্ডের হাতে মার খেতে খেতে বেঁচেছিলো আরেকটু হলেই পুলিশে দিত মাইরি। তবুও যা বউনি হলো তাই ভালো।
ট্রেন থেকে দমদমে নেমে খালপাড়ের বস্তির দিকে চলে যায় প্রথমেই। ওইখানে টুনি থাকে, পটলার টাইমপাশ,কিন্তু হেভ্ভি সেয়ানা।পটলাকে দেখে টুনির মা গজগজ করতে থাকে,"হতচ্ছাড়া বিয়েআলা শয়তান মদ্দ জ্বালিয়ে খাচ্ছে ছুড়ি টাকে।জানিয়ে দেয় টুনি কাস্টমারের বাড়ি গেছে ফেসিয়াল করাতে,তারপর হাবুর সাথে সাউথে যাবে ঠাকুর দেখতে ফিরতে রাত হবে।
মটকাটা গরম হয়ে যায় টুনির মায়ের দাঁত খিঁচানো আর চোপা শুনে। ওখান থেকে বেড়িয়ে ধর্মতলার বাসে উঠে পড়ে পটলা ভেবেছিলো ভিড়ের মধ্যে একখানা মোবাইল হাতাবে। টুনি একখানা বড় ফোন চেয়েছে পূজায়, না দিতে পারলে হাবুর সাথেই ঘুরবে বলে দিয়েছে। আজকালকার ছেলেমেয়েগুলো সবসময় এমন করে ফোন হাতে নিয়ে জপের মালার মত টিপছে যে হাতানোই মুশকিল। দুগ্গা দুগ্গা করে একজন মাঝবয়সী মহিলার ব্যাগ কেটে হাতের ম্যাজিকে পার্সটা বার করে নেয় চটজলদি। এবার দৌড়ে নেমে পড়ে বাস থেকে। ব্যাগ খুলেই দেখে মান্ধাতা আমলের একটা রঙচটা কেলে ফোন,গাদাগুচ্ছের কাগজ,শুকনো জবাফুল আর খুচরো দিয়ে মাত্র একশো টাকা। মনটাই তেতো হয়ে যায়, আজকাল সব কটা পাবলিক সেয়ানার হাতবাক্স, কেউ ক্যাশ সাথে রাখেনা। শুধুমুদু একখানা ফুটানির ডিব্বাতে ক্ষয় হয়ে যাওয়া লিপিষ্টিক আর আয়না নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ছ্যা ছ্যা ঘেন্না ধরে গেলো।
বিরক্ত হয়ে পটলা মেট্রোতে ওঠে,মেট্রোতে হাতসাফাই করে নেমে যাওয়া সহজ নয় ধরা পড়লে কেলিয়ে বৃন্দাবনে পাঠিয়ে দেবে। তবুও দেখা যাক যদি কিছু হাতানো যায়। আজ খুব ভিড় মেট্রোতে,ঠেলতে ঠেলতে টুক্ করে ভিড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ে পটলা। এদিক ওদিক হাত চালাতেই একটা ঢাউস ব্যাগে হাত পড়ে। যেই ব্লেডটা মেরেছে অমনি ধারালো নখ দিয়ে হাতে কে যেন খামচে দেয় আর কানটা মুলে দেয়।উরিব্বাস কানটা পটাশ করে ওঠে কঁকিয়ে ওঠে পটলা,তাকিয়ে দেখে বুচকি ফিল্ডে নেমে পড়েছে একটা বোরখা পরে। কি জাহাবাজ মেয়ে মাইরি, আর হবেই না কেন জাত পকেটমার হারুমাস্তানের মেয়ে বুচকি।
মেজাজটা খিঁচড়ে যায় পটলার ,শেষে বুচকির ব্যাগেই ব্লেড মারলো! আজ কপালে নির্ঘাত শনি নাচছে। কানে হাত বোলাতে বোলাতে নেমে পড়ে।
মেট্রো থেকে নেমে এখানে ওখানে ঢুঁ মারতে মারতে পৌঁছে যায় সন্তোষ মিত্তির স্কোয়ারে। ওখানের মা দুগ্গা নাকি এবার সোনার শাড়ি পড়েছে। দুগ্গা দেখে চোখ কপালে উঠে যায় পটলার," উরিব্বাস্ কত্ত সোনা মাইরি! চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে।" কিন্তু এ সোনা শুধু দেখেই সুখ।লোভ করতে নেই। লোভ করলে এক্কেবারে পেটে ত্রিশূল ঢুকে যাবে। "মা, মাগো ক্ষমা ঘেন্না করে দিস অপরাধ নিসনে ।" এই বলে হাতজোড় করে নমস্কার করে প্যান্ডেল থেকে বেড়িয়ে আসে।
ওহ্ পেটে ছুঁচো ডন মারছে ,নাকে আসে রোলের গন্ধ। রোলের দোকানে লাইন দেয় দশজনের পেছনে,রোল খাবে কি, রাগে গা পিত্তি জ্বলে যায়। শয়তান হাবুটা এখানে রোলের দোকান দিয়েছে,আর পাশে দাঁড়িয়ে ঢলানি টুনিটা রোল বেলছে কি সাজের বাহার! হাসতে হাসতে ঢলে পড়ছে হাবুর গায়ে। এই নাকি সাউথে ঠাকুর দেখতে যাবে। এখানে এসে রোল বেলছে আর ফস্টিনস্টি করছে , চারশো বিশ ছুড়ি একটা। এই রোল গলা দিয়ে নামবেনা ,ভাগ্যিস টুনিটা দেখেনি এখনও, রাগে গজগজ করতে করতে ওখান থেকে কেটে পড়ে পটলা। একপ্লেট চিকেন পকোড়া কিনে চিবোতে চিবোতে হাঁটা মারে শিয়ালদার দিকে। ট্রেনে বসে কান মাথা ঝাঁঝাঁ করতে থাকে ।
দমদম আসতেই নেমে পড়ে পটলা, স্টেশনে ঘোরাঘুরি করতে থাকে আজ কিছু বড় দাও না মারলে বুচকি পেছনে ঝাঁটা মেরে বারান্দায় শুইয়ে রাখবে মশার কামড়ে। নাঃ তেমন ভীড় হচ্ছেনা কামরা গুলোতে। বিড়ি ধরায় পটলা, "উরিব্বাস প্ল্যাটফর্মে বেশ ভিড় জমেছে মাইরি ,ঠাকুর দেখে ফিরছে সব। মনেহয় এবার টেরেনে ভালো ভিড় হবে"। ভিড়ে ঠাসা ট্রেন এসে দাঁড়ায় দমদমে,পটলাও দৌড়ে যায় ভিড় কামরাটার দিকে, দেখতে পায় ঠেলাঠেলি করে সবাই উঠছে সুযোগের অপেক্ষায় ছিলো পটলা, পেছন থেকে পটাশ করে টান মারে একজন মহিলার কানের দুল ধরে, কান থেকে দুল ছিঁড়ে পটলা দৌড় লাগায় , চিৎকার করে পাবলিক চোর চোর ততক্ষণে ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে আর পটলাও পগার পার।
আড়ালে গিয়ে পটলা পরখ করে দেখে দুলটা সোনার, সিটি গোল্ড না। সে খুশি হয়ে যায় , যাক সব ভালো যার শেষ ভালো। পরের একটা ট্রেন ছেড়ে বাড়ির পথ ধরে পটলা। পথে বাংলা মাল খেয়ে পুরো বাদশা হয়ে বস্তিতে পা রাখতেই চমকে উঠলো পটলা ,শাশুড়ির কান্না আর বুচকির খিস্তি শুনে। কান পাতে পটলা, বুচকি যা নয় তা বলে গালাগাল করছে, ' যে শুয়োর দমদম টেশানে হারুমাস্তানের বৌ, পটলার শাশুড়ি আর আমার মায়ের দুল ছিনতাই করলো, সে বেঁচে যাবে ভেবেছ?তুমি কেঁদোনা মা সবকটাই তো বাবার চ্যালা তোমার দুল ঠিক এনে দেবে বাবা। ব্বেশি চালাকি ,ব্যাটারা ঘুঘু দেখেছে ফাঁদ দ্যাখেনি!'
বাইরে থেকে যেটুকু পটলার মটকায় ঢুকলো তা হলো এই ,শালির বাড়ি থেকে ফেরার পথে কে যেন শাশুড়ির কান ছিঁড়ে সোনার দুল নিয়ে গেছে দমদম স্টেশনে লোকাল ট্রেনে ওঠার সময়।ততক্ষণে নেশা কেটে গেছে পটলার, বাড়িতে না ঢুকে এক দৌড়ে চলে আসে গঙ্গার ঘাটে। দুল দুটো গঙ্গায় ফেলে দিয়ে ভাবছে এবার নিজেকে বেসজ্জন দেবে কিনা? আকাশের দিকে হাততুলে পেন্নাম করে পটলা বলে," বচ্ছরকার দিনে শেষে এমনি বেইমানি করলি মা? "
Comments
Post a Comment