Skip to main content

#কভার_পেজ#

#ভার_পেজ#

#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#

"বাই মলি মা"
----"আয় বাবা,দুগ্গা দুগ্গা।"
"সত‍্যি মম্ , তুমি কোনদিন পাল্টাবেনা।"
সেই ঠাকুমা দিদিমাদের মতো। নাহ্ ঠাকুমা কেন বলছি? গ্ৰ‍্যানিও কি মড ছিলো ! এক্কেবারে আপটুডেট।
একি! এমনভাবে কেউ মায়ের সাথে কথা বলে ? বিরক্ত হয় রিক।
রিক ন‍্যানির বেষ্ট ফ্রেন্ড, আর ওর মমের একেবারে ন‍্যাওটা ফ‍্যান। মালবিকাকে মলি মা বলে ডাকে। ওদের বাড়ীর দুটো বাড়ী পরেই থাকে। ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছে, বাবা ব‍্যাবসার কাজে মাসের মধ‍্যে প্রায় কুড়িদিন বাইরে থাকেন। বাড়ীতে বয়স্ক ঠাকুরদা ঠাকুমা, তাই বাড়ীতে মন টেকেনা রিকের। ন‍্যানি ওর ছোটবেলার খেলার সাথী।সৌরভ আর রিকের বাবা ছোটবেলার বন্ধু। তাই ওর মা চলে যাবার পর চব্বিশ ঘন্টার মধ‍্যে আঠেরো ঘন্টা মালবিকার কাছেই থাকতো। হয়ত নিজের সন্তানের থেকেও ওর সাথে বন্ডিং বেশি। ওর আবদারেই তো ন‍্যানির জন্মদিনে হাজার একটা কন্টিনেন্টাল ডিশের মধ‍্যেও নিজের হাতে ফুলকো লুচি,আলুর দম আর নারকোল দিয়ে মিষ্টি মিষ্টি ছোলার ডাল বানাতে হয় মালবিকাকে।
    আগেই জিজ্ঞেস করে ,"ফুলকো লুচি আছে তো?আমি কিন্তু একদম গরম খাবো।"
---"আচ্ছা বাবা তাই হবে।"

"কখন ফিরবি?"
"বলতে পারছিনা, দেরি হতে পারে। আমি জানিয়ে দেবো। প্লিজ বার বার করে ফোন করে বিরক্ত কোরনা। আমার ক্লাস থাকে।"
চুপ করে যায় মালবিকা,মেয়ের কাছে অনেকটা পিছিয়ে পরা ব‍্যাকডেটেড মা। অবশ‍্য এই শিক্ষাটা হয়ত কিছুটা ওর বাবার কাছেই পেয়েছে ন‍্যানি। বাবা মাকে সবসময় আন্ডার এস্টিমেট করে এই দেখেই বড় হয়েছে ও । আর কেন জানিনা ন‍্যানিরও মনে হত ওর মম ওদের পরিবারে একদম বেমানান। অনেকটা পিছিয়ে পড়া। যদিও এমনটা হয়না সবসময়, মেয়েরা মায়েদের পক্ষেই থাকে। মালবিকা কষ্ট পায় ন‍্যানির ব‍্যাবহারে, তবুও ভালবাসা দিয়ে আগলে রাখে মেয়েকে। নজর রাখে সংসারের ছোট্ট ছোট্ট ভালোমন্দের দিকে। মেয়ের বন্ধু না হতে পারলেও সঙ্গী হওয়ার চেষ্টা করে।
     সৌরভদের পরিবারে  চিরকালই বেমানান ছিলো মালবিকা। তবুও বাবার মৃত বন্ধুকে বাবার কথা দেওয়ার খাতিরে বাধ‍্য হয়েই বিয়ে করে ছিল সৌরভ মালবিকা কে। খুবই সাধারণ মধ‍্যবিত্ত ঘরের বাংলা মিডিয়ামে পড়া মালবিকা। ডানাকাটা সুন্দরী নয় কিন্তু অদ্ভুত একটা স্নিগ্ধতা আছে মালবিকার চেহারায়। তবে সেসব অনেক আগের কথা ,এখন মালবিকা বাইশ বছরের ন‍্যানি(নৈঋতা)র মা।
  ছোট থেকেই বাপির কাছে শুনেছে ন‍্যানি," ওহ্ মলি ! তোমার মিডল্ ক্লাশ মেন্টালিটি দিয়ে আমার প্রেটি ডল কে মানুষ করোনা। ও হবে আমাদের সোসাইটির মত কইয়ে বলিয়ে স্মার্ট। তোমাকে তো এত বছরেও না পাল্টাতে পারলাম  আমি, না মম্। সেই লক্ষ্মীমন্ত শাঁখা পলা পরা গৃহবধূ হয়ে রয়ে গেলে। অনেকদিন তো এসেছো এই বাড়ীতে তবুও সেই ঘরকুনো রয়ে গেলে। আর সাজগোজ করলেই বা কি?আমাদের পার্টিতে তোমাকে কোনদিনই প্রেজেন্ট করতে পারলাম না।
  কি যে দেখেছিলেন বাবা তোমার মধ‍্যে কে জানে? ছোটবেলার বন্ধুর মেয়ে। তারপর তো অতীনকাকু চলে যাওয়ার পর বাবা আর দেরীই করেননি তোমাকে আমাদের বাড়ীতে  আনতে। মমের আমার কারো কথাই শোনেন নি। "
   শাশুড়িমা আর সৌরভের কাছে এমন কথা যে কতবার শুনেছে মালবিকা তার ঠিক নেই।এক এক সময় অপমানে চোখ ভরে জল আসতো ভাবতো সব ছেড়ে কোথাও চলে যাবে ওদের মুক্তি দিয়ে। শুধু কাকুর জন‍্য কোথাও যেতে পারেনি। পরে যদিও বাবা বলতো ওনাকে মালবিকা,ওর মা বাবা সবই ছিলেন শ্বশুরমশাই।
    মালবিকা কে উনি ডাকতেন বুড়ি বলে ,যে নামে ওর বাবা ডাকতেন। বলতেন ,"বুড়ি শোন সংসার বড় আজব জায়গা,কেউ তোকে এক চুল জায়গা ছাড়বে নারে। নিজের জায়গা তোকেই করে নিতে হবে। ভয় পাসনা মা,আমি তো আছি। শুধু মনে রাখবি....'যে সয় সে রয়'। হার মানিস না তোর জয় হবেই। "
     তারপর থেকে আর কখনই ভাবেনি হেরে গিয়ে ফিরে যাবার কথা। নিজেকেও একটু একটু করে পাল্টে নিতে চেয়েছে এ বাড়ীর মতো। কখনও বিদেশি রান্নার ক্লাশ করেছে কখনও বা স্পোকেন ইংলিশের কোর্স করেছে। তবুও নিজের মাটির গন্ধ আর স্বভাব পালটাতে পারেনি, হয়ত বা কখনও চায়নি। সৌরভের শয‍্যাসঙ্গিনী হলেও বন্ধু হতে বা পছন্দের হতে পারেনি। এক বাড়ীতে বাস করা দুটো মানুষের মধ‍্যে যেন এক অদৃশ‍্য পাঁচিল। যদিও শ্বশুরমশাই কড়া দৃষ্টি রাখতেন মালবিকার যেন কোন অযত্ন না হয়। বাবা মা হারা মালবিকার কাছে এটাই অনেকটা।
           শাশুড়িমা তো কথায় কথায় বলতেন, "এমন বৌ দিয়ে শুধু সংসারই চালানো যায়। তবে সংসার তো এতদিন আমার কাজের লোকেরাই দিব‍্যি চালিয়েছে।  এমন বৌকে সোসাইটিতে ইন্ট্রোডিউস করানো যায়না, কোন ম‍্যানার্সই তো জানেনা। সৌরভ এর স্বভাব ,কথা বার্তা সবই মায়ের মত। তবু বাবার হাতে পুরো বিজনেসের চাবিকাঠি তাই হয়ত বাবার বিরুদ্ধে যেতে পারেনি।
যেমন তোমার পছন্দ! আগাগোড়াই মিড্লক্লাশ রয়ে গেলে।" শ্বশুর মশাই হেসে বলতেন ,"ডলি কোন একদিন বুঝবে ,বুড়ি আমার খাঁটি হিরে।"

"হিরে না আরো কিছু, বন্ধু দিয়েছে একখানা অচল ব‍্যাকডেটেড মেয়েকে তোমার ঘাড়ে চাপিয়ে, ভালো মানুষ পেয়ে।"
     মালবিকার কোল জুড়ে ফুটফুটে মেয়ে যখন এলো তখন কত স্বপ্ন দেখেছিলো ওই পুতুলটাকে ঘিরে। খুব সাধ ছিলো নিজের মনের মত করে ওকে মানুষ করবে। হয়ত মেয়ের হাত ধরেই ওদের সম্পর্ক টা সুন্দর হয়ে যাবে।কিন্তু সৌরভ আর শাশুড়ীমা তা হতে দেয়নি। প্রথমে ট্রেন্ড নার্স তারপরে গভর্নেসের তত্ত্বাবধানে বড় হয়েছে ন‍্যানি। মেয়েকে কাছে পাবার জন‍্য ছটফট করতো মালবিকা। ও নাকি ঠিকমত যত্ন নিতে পারবেনা। তাই হয়ত মা মেয়ের বন্ডিংটা কখনই তৈরী হলনা।একটু বড় হলে যখন মালবিকা ওর কাছে শুয়ে শোনাতে চেয়েছে মনীষীদের ছেলেবেলা। " ন‍্যানি ঠোঁট উল্টে বলেছে ওহ্ মাম্মা আমার ট‍্যাব আর গেমস গুলো দাও। এই মনটোনাস স্টোরি আমি শুনবো না।
 ----- -ও গ্ৰ‍্যানি--দেখোনা।"

তবুও মালবিকা একটুখানি চেষ্টা করেছে নিজের অস্তিত্বটা আর ভালোলাগাকে সঙ্গে নিয়ে বাঁচতে।মেয়েদের তো সত‍্যিকথা বলতে নিজের বাড়ী বলতে কিছু হয়না এই কথাটা হয়ত খুব বেশি করেই বুঝেছিল মালবিকা। প্রতি পদক্ষেপে ওকে বোঝানো হত ও কতটা বেমানান আর অযোগ‍্য। হয়ত সহ‍্যশক্তিটা অনেক বেশি বলে মালবিকা টিকে গেছে এই বাড়ীতে।

ওদের বাপের বাড়ীর একতলাতে পথশিশুদের নিয়ে একটা স্কুল চালাতো বিয়ের আগে। স্কুলটা এখনো আছে,ওটাই ওর একমাত্র প্রাণভরে শ্বাস নেবার যায়গা তাই মাঝে মাঝেই সংসার সামলে সেখানে যেতে হয় মালবিকাকে।
সৌরভ বলে,"ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো।"
       ন‍্যানির জন‍্য মালবিকা বেশিরভাগ বাড়ীতেই থাকতো,কিন্তু ন‍্যানি একটু একটু বড় হওয়াতে মালবিকা বুঝতে পেরেছে ওর মাকে খুব একটা দরকার নেই। তবুও ন‍্যানির পাশে থেকেছে সবসময় নজর রেখেছে মেয়ের দিকে।
শ্বশুরমশাই বলতেন ,"নিজের ইচ্ছে গুলোকে মরতে দিসনা বুড়ি,সংসার কে যত দিবি সংসার ততই চাইবে। এর মাঝে একটু নিশ্বাস নিয়ে নিবি 'মা'। ইচ্ছের পাখনাটা মেলে দে আকাশে।"

-------এর মাঝেই শাশুড়ীমা হঠাৎ করে অজ্ঞান হয়ে পড়লেন একদিন ভোরবেলা,সেরিব্র‍্যাল আ্যটাক।মালবিকা না দেখলে হয়ত সেদিন ওনাকে বাঁচানোই যেতোনা। প্রাণে বাঁচলেও এক দিকটা প‍্যারালাইজড হয়ে যাওয়াতে ওনার সেবা যত্নের সব দায়িত্ব মালবিকাই নিলো। মলিকে সহ্য করতে পারতেন না যে মানুষটা, আজ যেন মলিকেই তার বেশি দরকার। ওনার আশীর্বাদ ও পেয়েছে মলি মারা যাবার আগে। হয়ত বা বুড়ি যে সত‍্যি খাঁটি হিরে ছিলো তাও বুঝেছিলেন।
       মা চলে যাওয়ার পর একদিনের জ্বরে বাবাও হঠাৎ চলে গেলেন।মালবিকা দ্বিতীয়বার বাবা হারা হয়ে আর নিজেকে সামলাতে পারেনি। বাবার সঙ্গেই কাটতো তার সারাদিন,আদর আর প্রশ্রয়ের জায়গা তো একটাই ছিলো। শুধু একটা কথাই কানে বাজতো ,"বুড়ি,ইচ্ছের পাখনাটা  মেলে দে আকাশে।"
   দেখতে দেখতে চব্বিশটা বছর কোথা দিয়ে কেটে গেছে। সত‍্যিই বোধহয় 'যে সয় সে রয়।' মলিও তাই অনেক যুদ্ধ জিতে আজ বাইশের ন‍্যানির মা। যদিও জীবন যুদ্ধ হয়ত কোনদিন থামেনা।
     এখন বাড়ীতে ওরা তিনটি প্রাণী,সৌরভ বছরের প্রায় আটমাস বিদেশে থাকে অফিসের কাজে। মালবিকা আর সৌরভের জগৎ এত বছরে কখনও মেলেনি। তবে এখন সৌরভ অনেকটা সংযত,মলিকে কথায় কথায় অসম্মান করেনা। হয়ত মেনে নিতে বাধ‍্য হয়েছে। ওরা দুজনে দুজনের জগত নিয়ে থাকে। আর ন‍্যানি থাকে ওর মত, ওর যত আবদার বাপির কাছে। মা কে আনডারএস্টিমেট করে। মাকে খুব একটা দরকার হয়না । স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটি সব জায়গা তে একটাই পরিচয় নৈঋতা বাসু ডটার অফ ফেমাস বিজনেসম‍্যাগনেট সৌরভবাসু। এমনকি ফেসবুকের কভার পিকচারেও বাপি। বন্ধুরা মায়ের কথা বললে বলে,"সি ইজ শাই অফ ক‍্যামেরা, ডিয়ার"।
          মালবিকা অনেকটা নিশ্চিন্ত যে সৌরভ দেশে না থাকলেও রিক সবসময় ন‍্যানির সাথে থাকে। সত‍্যি কি যে ভালো ছেলে রিক! অথচ একটু মায়ের আদর পাবার জন‍্য কেমন ছটফট করে।মালবিকা উজাড় করে ওর আদর দিয়ে বড় করেছে ওকে ন‍্যানির পাশাপাশি।
         মালবিকার এখন অনেক অবসর তাই তার ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোটা আরও বেড়ে গেছে।যদিও সৌরভ আর ন‍্যানি কারো মাথাব‍্যাথা নেই ওর ফুলিশ জব নিয়ে।

        "কচিমুখ"-- এখন মালবিকার সব কিছু, ওর বাপেরবাড়ির পুরোটা জুড়ে ওদের কর্মকান্ড চলে। ভারত আর পশ্চিমবঙ্গের প্রত‍্যন্ত এলাকাতেও ওদের কাজ দুঃস্থ শিশুদের জন‍্য। অনেক শিক্ষিত ছেলেমেয়ে যুক্ত কচিমুখের সাথে। আরো একজন আছে মলি মায়ের ভালোবাসার ন‍্যাওটা রিক।
       রিক আর ন‍্যানি দুজনেই মাস্টার্স করছে জার্নালিজম নিয়ে। তার ফাঁকে কচিমুখের অনেকটাই সামলায় রিক যদিও সবটাই ন‍্যানির অজানা। মালবিকার আশ্চর্য লাগে রিককে দেখে, কি ঝকঝকে স্মার্ট,মডার্ণ অথচ ভদ্র নম্র। ইশ এমন যদি ন‍্যানিটা হত! একটু কাছে আসতো!
           কচিমুখের মেলগুলো রিক চেক করে। ও ইউনিভার্সিটি যাবার আগে বেশির ভাগ একবার ঢুঁ মেরে যায়, যেদিন সময় পায়না সেদিন বিকেলে বা রাতে। কচিমুখের লোগো থেকে প্রোগ্ৰামিং অনেক কিছুই রিকের করা। আরও প্রচুর ছেলেমেয়ে আছে ওদের সাথে। কাজের প্রয়োজনে মালবিকাকেও অনেকটা পরিচিত হতে হয়েছে প্রযুক্তির সাথে। দরকারে মেল বা হোয়াটসআ্যপে যোগাযোগ ওকেই করতে হয়।কখনও বা বিদেশি গেষ্টরা এলে ঝরঝরে ইংরেজীতে কথাও বলে তাদের সাথে। তবে মালবিকার এইসব কর্মকান্ডের খবর রাখার কোন উৎসাহ নেই সৌরভ আর ন‍্যানির।
    হঠাৎই সেদিন সকালে রিকের ফোন,'মলি মা,তুমি এক্ষুণি কচিমুখে এসো তোমায় খুব দরকার।"
---"হঠাৎ কি হলো? কোন সমস‍্যা?ন‍্যানিটা এখনো ঘুমোচ্ছে,একটু বাদে যদি যাই।'
---"খুব আর্জেন্ট গো ফোনে বলা যাবেনা তুমি চলে এসো"
-"আচ্ছা বাবা আসছি"।
কচিমুখে ঢুকেই এক অদ্ভুত নীরবতা চারিদিকে, অন‍্যদিন কচি সবুজদের কলকাকলিতে মুখর থাকে কচিমুখ।আজ কি হলো? কোন বিপদ আপদ হয়নি তো? তার ওপর রিকের জরুরী তলব, চিন্তার কথা।
     বড় দরজা পেরিয়ে মালবিকা যেই ভেতরে ঢুকেছে কচিমুখের সবাই আর বাচ্ছারা একসাথে বলে ওঠে, "কনগ্ৰ‍্যাচুলেশন--"। চমকে ওঠে মালবিকা,তার আগেই রিক এসে মালবিকাকে জড়িয়ে ধরে একচক্বর ঘুরিয়ে দেয়।
"ওরে বুড়ো বয়সে কি হাড় ভাঙ্গবি? কি হয়েছে বলনা রে? "
    "ও মলি মা তুমি তোমার সমাজসেবামূলক কাজের জন‍্য এবার রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পাচ্ছো গো? হ‍্যাটস অফ্ ম‍্যাম্।"
    সবাই খুব খুশি তার মাঝেও যেন মালবিকা একটু বিব্রত। সে তো কোনদিন নাম যশ পাবার জন‍্য সমাজসেবা করেনা। জীবনের সব কাজই দায়িত্ব নিয়ে ভালবেসে করে এসেছে।
    "তুমি খুশি হওনি মলি মা?"----
"আমি তো কোন স্বীকৃতি চাইনি বাবা,সবার ভালবাসাই আমার জীবনের অনেক পাওয়া।"
    "তোমার ইনভিটেশন লেটার আসছে, আমি তো যাবোই।"
     "আচ্ছা সে হবে, তুই কিন্তু বাড়ীর কাউকে কিছু বলিস না। বাবা থাকলে খুব খুশি হতেন কিন্তু আর কারো কাছে আমার বনের খেয়ে মোষ তাড়ানোর কোন কদর নেই।"---হেসে ফেলে মালবিকা।
    "একদম না,এটা এখন টপ সিক্রেট হা হা তারপর দেখো।"
     রাতে বাড়ি ফিরে কচিমুখের জন‍্য সে পুরস্কার পাচ্ছে ভেবে ভালোলাগে মালবিকার।একটু একটু করে নিজের হাতে গড়ে তোলা তার স্বপ্ন সত‍্যি পাখনা মেলেছে । কিন্তু কচিমুখ ছাড়া তার আর কোন আপনজন নেই যাদের সাথে সে তার আনন্দ ভাগ করে নিতে পারে। কারণ সৌরভ আর ন‍্যানির কাছে ও মোস্ট অর্ডিনারি হাউসওয়াইফ। মেয়েরা নাকি মায়েদের বন্ধু হয় বড় হলে,কিন্তু ন‍্যানির কাছে তার অতিসাধারণ মা হয়ত হীনমন‍্যতার কারণ। যাকে সোসাইটিতে ইন্ট্রোডিউস করা যায়না।
       দেখতে দেখতে মালবিকার দিল্লী যাবার দিন এগিয়ে আসছে। সৌরভ এখনও ফেরেনি হয়ত নেক্সট মান্থে ফিরবে। বিমলা মাসিই ভরসা,ন‍্যানি একা থাকবে। কি যে করবে কে জানে? যা অগোছালো আর মেজাজী মেয়ে। ওকে কি যে বলে যাবে?
        ন‍্যানি রাতে ডিনার টেবিলে বসে জানালো ওরা ইউনিভার্সিটি থেকে প্রোজেক্ট এর কাজে মুম্বাই যাবে নেক্সট উইকে। "বাপি জানে"? মালবিকা জিজ্ঞেস করে। সৌরভকে বলেছে জানালো ন‍্যানি। "অতদূরে যাবি একা?" "হোয়াট? একা কেন?আমাদের গ্ৰুপের সবাই যাচ্ছে আর তোমার আদরের রিক তো আছেই, আমার বডিগার্ড।"
    মনে মনে বেশ চিন্তায় পরে মালবিকা,ওই সময় তো ওর দিল্লী যাওয়ার কথা। রিক তো বলেছিলো সাথে যাবে। রিক চলে গেলে কি করে হবে? মনটা খারাপ হয়ে যায়। কই রিক তো কিছু বললো না। খুব অসহায় লাগে মালবিকার।
     পরদিন রিককে বলে, "আমি যাবো নারে দিল্লী,তুই তো আমায় কিছু বলিসনি যে তোরা মুম্বই যাচ্ছিস।" ------"ওহ্ মলি মা ডোন্ট ওরি আমি ঠিক পৌঁছে যাবো একটুও ভেবোনা,কচিমুখের অনেকেই তো যাচ্ছে তোমার সাথে। আমি যাবোনা তা হয়? এবার তো একটু হাসো।"
     মালবিকার যাবার কয়েকদিন আগেই ন‍্যানিরা বেরোলো। কাল মালবিকা যাচ্ছে , সাথে কচিমুখের কয়েকজন। কেমন যেন মন খারাপ করে মালবিকার, ভীষণ একা লাগে। সৌরভ ফোন করেছিলো ,ওকে ও বলতে পারেনি কিছু।খুব ইচ্ছে করছিলো বলতে, তবু এক সংকোচ জড়িয়ে রাখে মালবিকাকে। শুধু কচিমুখের ব‍্যাপারে দিল্লী যেতে হবে জানিয়েছে। সৌরভ হাসতে হাসতে বলেছে," ওরে বাবা দিল্লী!বনের মোষ তাড়াচ্ছো ভালো,তোমার আর চিন্তা কি? তবে বাড়ীটা একটু দেখো। এখন তো ন‍্যানিটা ও নেই"।
রাতে ভালো করে ঘুম হয়না মালবিকার বড় অস্থির লাগে।
    দিল্লীতে এসে রিকের সাথে কথা হয় ,ও রাতের ফ্লাইটে এসে পৌঁছবে । "ডোন্ট ওরি মলি মা আমি থাকবো তোমার খুব কাছাকাছি।" সকালে ওরা সবাই চলে আসে প্রোগ্ৰামে,কিন্তু রিক টা কেন যে এলোনা অথচ ফোনেও পাওয়া যাচ্ছেনা, নট রিচেবল বলছে। খুব দুশ্চিন্তা হয় মালবিকার। হঠাৎই এদিক ওদিক তাকাতেই নজর পরে ওই তো রিক,মনটা খুশি হয়ে যায় মালবিকার। কিন্তু রিকের পাশে তো অনেকেই তার মাঝে কাকে দেখছে ও, ন‍্যানি! চমকে ওঠে মালবিকা ।
    রিকদের দিল্লী আসাটা সিডিউলেই ছিলো কিন্তু মলিমাকে কিচ্ছু বলেনি ও। ন‍্যানি কেও বুঝিয়েছিল অত কিছু মম কে বলতে হবেনা। শুধু শুধু টেনশন করবে। প্রোগ্ৰামের ভি আই পি পাশটা ওরা পেয়ে গেছিলো সিনিয়ার জার্নালিস্ট দাদার কাছ থেকে। সবটাই রিকের উর্বর মস্তিষ্ক প্রসূত। মলিমা ন‍্যানি কেউ কিছু জানেনা। ওরা বন্ধুরা মিলে খুব মজা করে অনুষ্ঠান দেখছে, ছবি তুলছে। এর মাঝেই মালবিকাকে মেসেজ করে রিক।
      পুরস্কার দেওয়া শুরু হয়েছে, খুব নার্ভাস লাগছে মালবিকার ন‍্যানিকে দেখার পর থেকে।  মালবিকার নাম ঘোষণা করা হলো, হাততালিতে স্বাগত জানালো সবাই শুধু ভূত দেখার মত চমকে উঠলো ন‍্যানি। কাকে দেখছে ও ? যাকে ছোটথেকে ব‍্যাকডেটেড ছাড়া আর কিছুই ভাবেনি।ওর মম মালবিকা রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পাচ্ছে ,এটা কি স্বপ্ন! বন্ধুরা ন‍্যানিকে কনগ্ৰাটস জানায় ওদের গ্ৰেট সারপ্রাইজ দেওয়ার জন‍্য। এক ঝলকের জন‍্য রিকের চোখে চোখ রাখে ন‍্যানি। রিকের মুখে দুষ্টু হাসি।
        মালবিকা ঝরঝরে ইংরেজীতে খুব ছোট করে বক্তব‍্য রাখলো উপস্থিত সবাইকে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানিয়ে কচিমুখের উদ্দেশ‍্য নিয়ে। রিক তাকিয়ে দেখে ন‍্যানি একরাশ বিস্ময় আর মুগ্ধতা নিয়ে ভিডিও করছে। নিজেকে ধরে রাখতে পারেনা যেন ন‍্যানি,অদ্ভুত এক ভাললাগা আর শ্রদ্ধায় মনটা ভরে যায়। ছোট্ট থেকে যাকে দেখেছে রান্নাঘরের আড়ালে বা কোমরে আঁচল জড়িয়ে ঘর গোছাতে সেই মাকে যেন মেলাতে পারেনা ন‍্যানি। অথচ কি সুন্দর স্নিগ্ধ লাগছে মমকে , মার্জিত স্মার্ট । এমন করে বোধহয় কোনদিন আগে মাকে দেখেনি, হয়ত বা দেখতে চায়নি। কোনদিন তো মায়ের মনের খবর রাখেনি।ন‍্যানির মোবাইল আর ক‍্যামেরাবন্দী আজ শুধু মালবিকা হয়ত হৃদয়বন্দীও। আজ যে শুধু মালবিকার দিন। আজ মালবিকা সম্মানীয়া অতিথি।
          রিক আর ওর বন্ধুরা অনুষ্ঠানের শেষে মালবিকাকে ঘিরে ধরে। কিন্তু মালবিকার চোখ দুটো শুধুই যেন ন‍্যানির দিকে। ওতো বাড়ীতে কাউকে কিছু বলেনি ,ন‍্যানি যে কি করবে কে জানে? কোন সিনক্রিয়েট করবে নাতো? কিন্তু ন‍্যানিটা বেশ দূরে দাঁড়িয়ে কাকে যেন ফোন করছে,হয়ত সৌরভকে। রিক যে মলি মায়ের থট রিডার। তাই শুধু মালবিকার খুব কাছে এসে গলা জড়িয়ে ফোনটা দেখায়, কি দেখছে মালবিকা! আজ যে নিজের চোখদুটোকে বিশ্বাস হয়না। সত‍্যিই কি আজকের সম্মান মালবিকাকে ফিরিয়ে দিয়েছে ওর প্রাপ‍্য! এই জন‍্যই কি সব মেয়ের নিজের পায়ে দাড়ানো দরকার,এই কথাটা আজ খুব ভালো করে বুঝতে পারে ও।
         ন‍্যানি ফেসবুক স্ট‍্যাটাস আপডেট করেছে একটু আগেই , ওর কভার পিকচারে আজ শুধুই মালবিকা...."মাই মম ইজ দ‍্য বেষ্ট।"
"...এই যে আরও আছে এত তাড়াতাড়ি চোখের জলে আবছা দেখলে হবে? এই দেখো..."
   ঝাপসা চোখে মালবিকা দেখে আজ সৌরভ আর ন‍্যানির কভার পিকচারে শুধুই মালবিকা। এর মাঝেই কখন যে ন‍্যানিটা এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরেছে বুঝতেই পারেনি। ন‍্যানির আদরে মেয়ের অনেক না বলা কথাই বুঝতে পারে মালবিকা। ভেজা চোখ নিয়ে রিকটা সরে যাচ্ছিলো। মালবিকা হাত বাড়িয়ে বলে," এই দুষ্টু কোথায় পালাচ্ছিস?"
      

      -সমাপ্ত-

  

    

  

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...