#অসুখটা_ডিপ্রেশন#
#রুমাশ্রী_সাহা_চোধুরী#
"এই যে ডিয়ার সকাল সকাল উঠে পড়লি যে!
কি ব্যাপার ফুলশয্যা কেমন হলো?
আমরা কিন্তু কাল আড়ি পেতে একদম হতাশ হলাম বস্, শুধু মশার কামড় খেয়েই মরলাম,
ধ্যাৎ কোন সাড়াশব্দই পেলাম না। "
......'আর সাড়াশব্দ ! শুধু ঘুমশয্যা হলো আরকি। যা একখানা ঘুমন্ত পুলিশ বউ হয়েছে আমার, কতক্ষণে ঘুমোবে বাব্বা"---
--- "সে কি রে! বৌদি কোথায়?"
"এখনো ঘুমোচ্ছে।" বলে সুধীর।
সুধীর বিধবা মায়ের একমাত্র ছেলে অনেক ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছে। তারপর মা আর ছেলের খুব কষ্ট করে চলেছে। বাবার প্রাইমারী স্কুলের চাকরী টা মা পেয়ে যাবার পর কোনরকমে চালিয়ে নিয়েছিলো মা। এখন সুধীর চাকরি পেয়েছে যদিও একটু বেশি বয়েসে তবু কিছুটা সুখের মুখ দেখেছে ওরা। কাল সুধীরের বৌভাত গেছে ,ওর বৌ রমা ও চাকরী করে একটা বেসরকারী অফিসে। নিজেদের অবস্থা চিন্তা করেই চাকরী করা মেয়ে পছন্দ করেছে। ছোট থেকে কষ্ট করে বড় হওয়াতেই হোক বা অন্য যে কারণেই হোক সুধীর যেন একটু বেশিই মেজাজী। একমাত্র মা ছাড়া আর কাউকে তোয়াক্বা করেনা।
ঘরে ঢুকেই মাথাটা গরম হয়ে যায় একি এখনও পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে, এদিকে মা রাজ্যের কাজ করছে সকাল থেকে। কাল রাতেও তো যা খেল দেখালো। " এই যে শুনছো উঠে পড় আর কত ঘুমাবে, কি কুম্ভকর্ণ মাইরি।"
সুধীরের ডাকে চোখ খুলতে ইচ্ছে না করলেও তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে রমা,কাল অনেক রাত হয়ে গেছে ঘুমোতে। কদিন ধরেই বিয়ে বৌভাত এইসব নিয়ে একদম ঘুমোতে পারেনা ঠিকমত। আজ এত ঘুমিয়ে পড়েছিলো যে বুঝতেই পারেনি কখন সকাল হয়েছে।
----"যাক ঘুম ভেঙেছে তাহলে? তুমি কি গো! ফুলশয্যার রাতে লোকে কত গল্প করে, রাত জাগে। সবটাই মাটি করে দিলে। তুমি যে এত ঘুমকাতুরে জানতাম না মাইরি। আজ আমি কোন অজুহাত শুনবোনা, দরকার হলে দুপুরে ঘুমিয়ে নাও।"
শুধু হাসে রমা, কিছু বলেনা। ওদের বিয়েটা এত তাড়াতাড়ি পাকাপাকি হয়েছে তেমন ভাবে কেউ কাউকে চিনতে পারেনি। তবে এটুকু বুঝতে পারছে সুধীর খুব বদমেজাজী নাহলে এমন করে কেউ নতুন বৌ এর সাথে কথা বলে না।
সবে বৌভাত কাল গেছে এখনও বাড়ীতে কিছু লোকজন আছে। তবুও শাশুড়ি বললেন,"এই যে বৌমা এত বেলা পর্যন্ত ঘুমোলে চলবেনা,আমাদের কোন রান্নার লোক নেই, রান্না আমি নিজেই করি। মা ছেলে অনেক কষ্ট করেছি। এখন লোক বাড়লো তোমাকেও তো সাহায্য করতেই হবে। আমাকে আবার স্কুলেও বেরোতে হয়। আর তুমিও তো বেরোবে।"
চুপ করে থাকে রমা, রমা এমনিতেই কম কথা বলে। তারপর মাত্র একদিন আগেই এ বাড়ীতে এসেছে, তাই চুপ করে থাকাই ভালো। দুপুরে একটু ঘুমোনোর চেষ্টা করেছিলো রমা কিন্তু সবার মধ্যে হাসি ঠাট্টা গল্পে খুব একটা সুবিধে হলোনা। না ঘুমোলে ওর শরীর খারাপ করে। কি যে করবে? রাতে ঘরে ঢুকতে বেশ দেরী হয়ে গেলো, "বাব্বা এতক্ষণে তোমার হলো, আজ কিন্তু আর অজুহাত দিয়োনা ডার্লিং।" নতুন মানুষের কাছে আজ পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ,ঘুম পেলেও ঘুমকে দূরে সরিয়ে সুধীরের দৃঢ় আলিঙ্গনে নিজেকে সঁপে দেয় রমা। সুধীরের যেন তবু মনে হয় রমাকে যেন পুরোপুরি পাচ্ছেনা, কেমন যেন ক্লান্ত রমা।
সুধীর ঘুমিয়ে পড়লে আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে হাতব্যাগ থেকে ওষুধ দুটো বার করে খেয়ে শুয়ে পরে রমা। বেশ কয়েক দিন ওষুধ খাওয়া হচ্ছেনা অথচ ডাক্তারবাবু বলেছেন ওষুধটা যেন বাদ না পরে প্রতিদিন রাতে ঠিক ঘুমোনোর আগে খেতে হবে। ঘুমিয়ে পড়ে রমা,সকালে সুধীর ডেকে দেয় যদিও কিছুটা মেজাজ ঠান্ডা সেদিন। তবুও বলে ,"একটু তাড়াতাড়ি ওঠার অভ্যেস করো, মা কোন সকাল থেকে রান্নাঘরে। তবে এইকদিন ঠিক আছে সবারই ছুটি কিন্তু এরপরে তো বেরোতে হবে আমাদের।"
বিয়ের পর আবার কাজে ফেরে রমা,
সবাই ভীড় করেছে ওর চারপাশে। খুব সুন্দর লাগছে সবাই বলে । আজকাল সুযোগ পেলেই ডেস্কে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে রমা। কোলিগরা হাসাহাসি করে ,"কি রে বর একদম রাতে ঘুমোতে দিচ্ছেনা তাইতো?" হাসে রমা,সত্যিই তাই, ঘুমোতে ঘুমোতে অনেকটা রাত হয়ে যায়। তারপর সকালে শাশুড়ির হাতে হাতে কাজ করে আসতে হয়। আবার রাতে রুটি তরকারী বানানোর দায়িত্ব তারই। তারমাঝে প্রায়দিন অফিস থেকে ফিরে একটু ঘুমিয়ে পড়ে ও, তাতেও শাশুড়ী বলেন ," কি অলুক্ষুণে বউ বাপু সন্ধ্যেবেলা পড়ে পড়ে ঘুমায়!"
রমা ছোট থেকেই চুপচাপ কারো মুখে মুখে কখনোই কথা বলেনা। তার ওপর ওর মাধ্যমিক পরীক্ষার সময় যখন মায়ের ক্যানসার ধরা পরলো আর মা অনেক কষ্ট পেয়ে এক বছরের মধ্যে চলে গেলো সাঙ্ঘাতিক শোকে মেয়েটা যেন কেমন হয়ে গিয়েছিলো। একটা বছরও নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। অনেক কষ্টে ওকে স্বাভাবিক করতে পেরেছেন ওর বাবা আর পিসিমা। তার জন্য সাইক্রিয়াটিক ডাক্তারও দেখানো হয়েছে। এখনও খুব বেশি মানসিক চাপ হলে রমা নিতে পারেনা। তবে ডাক্তার বলেছেন ভয়ের কিছু নেই ওষুধ গুলো খেলেই ও ঠিক থাকবে। ডিপ্রেশন এখন ঘরে ঘরে। পাত্রপক্ষের যখন পছন্দ তখন আর দেরি করেননি রমার বাবা। রমা বলেছিলো ওদের জানাতে ওকে প্রত্যেকদিন ওষুধ খেতে হয় , বাবা রাজি হননি,"এটা জানানোর মতো ব্যাপার নয় মা, এখন এই অসুখ ঘরে ঘরে,তুই তো চাকরিও করছিস।" "কিন্তু বাবা----"
তুই থাম দেখি,একবার বদনাম হয়ে গেলে কে তোকে বিয়ে করবে। আমরা চলে গেলে তোর ঐ প্রাইভেট চাকরি দিয়ে সব চলবে মা? আপত্তি করিসনা আমাদের নিশ্চিন্ত হতে দে।"
বিয়ের পর এইভাবেই দিন এগোতে থাকে, রমা একটু খেতে ভালবাসে কিন্তু ওর শ্বশুর বাড়ীতে দুটোর বেশি পদ কোনদিন হয়না, কোনদিন রাতে বা দুপুরে একটু বেশি রান্না করলেই মুখ শুনতে হয় শাশুড়ীর,"শোন আমার ছেলেটা এমনিতেই মোটা। আমরা চিরকালই একটা দুটো পদ খেয়ে কাটিয়েছি অত সামর্থ্যই ছিলোনা বাপু, একেই তো তোমার মিষ্টি খাওয়ার সখ প্রায়দিনই মিষ্টি আনছো। এরপর যদি ছেলেটার প্রেসার সুগার ধরে আমি কার মুখ চেয়ে রইবো শুনি। মেয়েমানুষের অত নোলা ভালোনা।"
সুধীরের আজকাল বেশ বিরক্ত লাগে মাঝে মাঝে। রমাকে দেখতে যদিও ভালো কিন্তু একদম সাজগোজ করতে জানেনা, এমন কি শাড়ীটাও ভালো করে পরতে পারেনা। অদ্ভুত চুপচাপ,রাগ করলেও কোন হ্যাতক্যাত নাই। এ কেমন পাবলিক ভাই,একদম যেন ঠান্ডা মিয়োনো!শুধু ঘুমাতে পারলেই বাঁচে।
সেদিন রাতে রমাকে ওষুধ খেতে দেখে ফেলে সুধীর।"কি ওষুধ খাচ্ছো তুমি? এর আগেও একদিন দেখেছি কিছু বলিনি। দেখি দেখি,বাচ্ছা না হওয়ার ওষুধ নাকি?" ...."না না কি বলছো এসব, এই ওষুধটা আমি খাই এটা হজমের"। " সেকি প্রতিদিন হজমের ওষুধ খেতে হবে কেন এই বয়সে"...." তুমি ঘুমোও এখন, অত চিন্তা কোরনা"। এই বলে ব্যাপারটা তখনকার মত চাপা দেয় রমা।
রমার কয়েকদিন ধরেই শরীরটা ভালো নেই, এই নিয়ে অফিস করছে। সুধীর রাতে কাছে টেনে নিলে সাড়া দিতে পারেনা। ...."কি ব্যাপার বলতো? প্রায়ই তো শুনি শরীর খারাপ এমন করে কিভাবে চলবে? কালই যাবে ডাক্তারের কাছে আর কি ওষুধ খাচ্ছো তাও বলবে।"...চিন্তায় ভালো করে ঘুম হয়না রমার। ডাক্তার দেখে বলেন মনে হচ্ছে রমা কনসিভ করেছে, কতগুলো টেস্ট করতে বলেন। রিপোর্ট পজেটিভ আসে। সুধীর খুশি শুধু শাশুড়ীমা বলেন ," ও তো নিজেকেই সামলাতে পারেনা কি করে যে বাচ্ছা সামলাবে, তার ওপর মাও নেই। আমার এবার সবদিক সামলাতে নাভিশ্বাস উঠবে, এখনো দুবছর চাকরি আছে।"
রিপোর্টগুলো নিয়ে ডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে যায় সুধীর রমাকে। ডাক্তারবাবু সব দেখে প্রেসক্রিপশন করার আগে রমাকে জিজ্ঞেস করলেন ও কোন ওষুধ খায় কিনা তাহলে জানলে সুবিধে হয়। রমাকে চুপ করে থাকতে দেখে সুধীর বলে,"তুমি যে রোজ রাতে ওষুধ খাও তা বলো, কি ওষুধ?" চুপ করে থাকতে পারেনা রমা সন্তানের কথা ভেবে। ব্যাগের থেকে প্রেসক্রিপশানটা বার করে দেয় রমা। ডাক্তারবাবুকে একটু চিন্তিত দেখে সুধীর বলে," কি ওষুধ ডাক্তারবাবু?"......"আসলে উনি বাইপোলার সিনড্রোমের সাইকিয়াট্রিক পেশেন্ট। এই ওষুধগুলো ওনাকে রেগুলার খেতে হয়।"......"মানে কি বলছেন? সাইক্রিয়াটিক প্রবলেম। কই তুমি তো আগে কখনও বলোনি।"
রমার অসহায় মুখটা দেখে ডাক্তারবাবু বলেন, "কোন ব্যাপার না,আপনি চিন্তা করবেননা, আরো কতগুলো টেস্ট হোক, মেডিসিন খান। হোপফুলি হেলদি বেবি হবে।"
বাড়ী এসে দক্ষযজ্ঞ শুরু করে সুধীর সমস্ত রাগ পরে রমার বাবার ওপর ,ইচ্ছে করে পাগল মেয়েকে চাপিয়েছে ওর ঘাড়ে। পাগলমেয়ের পাগল বাচ্ছাই হবে,আবার কি। এই দুই পাগলকে নিয়ে ওকে চলতে হবে সারাজীবন। তক্ষুণি শ্বশুরকে ফোন করে যাচ্ছেতাই বলে মা ছেলে। আর রমার অপমানের তো শেষ রইলোনা, মিথ্যেবাদী, মিচকে শয়তান, সেয়ানা পাগল সব উপাধিই জুটলো। ডাক্তারবাবু সব টেস্টের রিপোর্ট দেখে ও.কে বললেও সুধীর বার বার জানতে চাইলো বাচ্ছাটা পাগল হবে কিনা? ডাক্তারবাবু বললেন অনেকসময় জেনেটিক হয় এই রোগ, তবে এখনই কিছু বলা যাচ্ছেনা।
তবুও সুধীর রমাকে চাপ দিতে থাকে আ্যবরসন করানোর জন্য। কিছুতেই রাজী করানো যায়না ওকে। রমা আরও বেশি চুপচাপ হয়ে গেছে কখনও অফিসে যায় কখনও যায়না, নিজের রান্না ছাড়া কারো হাতে খায়না প্রতিদিনই মন্দিরে যাচ্ছে ওর সবসময় একটা ভয় সুধীর আর ওর মা বাচ্ছাটাকে মেরে ফেলবে।
রমা এখন মানসিক ভাবে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত আর এই সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিলো সুধীর। রমাকে বাপের বাড়ী দিয়ে আসে, বলে আসে এমন পাগল বৌ নিয়ে তার সংসার করা সম্ভব নয়। রমাকে আ্যসাইলামে দিতে হয়, ওর বাবা হিমসিম খান মেয়েকে নিয়ে। এদিকে চাকরির যায়গা থেকেও চাপ আসছে ওর আর ছুটি নেই সমানে উইদাউট পে হচ্ছে। বেশ কিছুদিনের চিকিৎসায় ভালো হয় রমা, ওর খুব ফুটফুটে একটা ছেলে হয়। কিন্তু ততদিনে সুধীর ডিভোর্সের নোটিশ পাঠিয়েছে।রমার বাবা একদিন অনেক অনুনয় বিনয় করে সুধীরকে আসতে বলেন ছেলে দেখতে ভেবেছিলেন ছেলের মুখ দেখে সুধীর হয়ত সব ভুলে যাবে। কিন্তু নিজের যায়গা থেকে এক পাও সরেনা সুধীর।কোর্টে দৌড়োদৌড়ি মানসিক চিন্তা এইসব করে বাচ্ছার দিকে তেমন মন দিতেই পারেনা রমা। দুর্ভাগ্য ওর পেছন ছাড়েনা, একদিনের জ্বরে ছয়মাসের বাচ্ছাটা চলে যায়। আশ্চর্য সেদিনও অদ্ভুতরকম শান্ত ছিলো রমা শুধু বলেছিলো ও বাচ্ছাটাকে ঠিকমত বড় করতে পারবেনা তাই ভগবান ওকে নিয়ে নিলেন।
ডিভোর্স পেতে কোন অসুবিধাই হলোনা সুধীরের। সব দিক দিয়ে অযোগ্য প্রমানিত হলো রমা। শুধু রমা ভাবলো, "কই শুভ্রাদির বরও তো বাইপোলার সিনড্রোমের পেশেন্ট, দুবার হসপিটালাইজড ও হয়েছে। তবুও কি সুন্দর স্বামীকে আগলে রেখে দুই সন্তান নিয়ে সংসার করছে। তবে ওর সংসার করা হোলনা কেন? ও মেয়ে বলে? এই অসুখ যদি সুধীরের থাকতো ও কি ফেলতে পারতো?"
রমা আবার অফিস করছে। অফিসের সবারই খারাপ লাগছে ওর কথা ভেবে ,সত্যি কি কপাল মেয়েটার! বাচ্ছাটাকেও ধরে রাখতে পারলো না এত কিছু করেও। ডিভোর্সের পর আশ্চর্য হয়ে যায় সবাই রমা আবার পুরনো পদবী ব্যাবহার করছে কিন্তু ওর হাতে এখনও শাঁখা পলা, কপালে সিঁদুর। কিছু বলতে পারেনা কেউ ওর মানসিক অবস্থার কথা ভেবে, যাক হয়ত এটাতেই ওর শান্তি।
ডিভোর্সের প্রায় দুমাস বাদে একদিন হঠাৎ করে সুধীরের অফিসে রমা,কেন যে সুধীরকে একবার খুব দেখতে ইচ্ছে করছিলো। পাশের টেবিল থেকে আওয়াজ দেয় সুমন্ত তোর এক্স এসেছে রে। অপ্রস্তুত হয়ে যায় সুধীর ,বাইরে বেড়িয়ে আসে রমাকে নিয়ে। "কি দরকার এখানে? আমার মাথা খেতে এসেছো এখানে?আমার কি কোন সম্মান নেই। আবার বিয়ে করেছো নাকি? এখানে কি, আর কোনদিন এখানে এসোনা। আমার জীবনটা নষ্ট করে দিলো একেবারে।".শিশুর মত সরলতায় রমা উত্তর দেয়,......"খুব দেখতে ইচ্ছে করছিলো তাই। আমি বিয়ে করিনি।"
...."তাহলে কার্টুনের মতো এখনো সধবা সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছো কেন? পাগলের কান্ড যত্তসব।" বেড়িয়ে আসে রমা, সুধীরের মনে ওর জন্য কোন যায়গাই নেই, তবে কি ঐ দুবছরে ওদের মধ্যে শুধু দৈহিক সম্পর্কই হয়েছিলো!
অফিসের শুভ্রাদি ওকে অনেক বুঝিয়েছিলেন শাঁখা পলা খুলে আনম্যারেড মেয়ের মত থাকতে নতুন করে জীবন শুরু করতে। শোনেনি রমা, এই রোগের পেশেন্টরা এমনিতেই একগুঁয়ে হয়। মাঝে দুটো বছর কেটে গেছে ,অফিসের একটা কাজে পাঠিয়েছে রমাকে কিন্তু যায়গাটা যে তার শ্বশুরবাড়ীর কাছাকাছি বুঝতে পারেনি রমা। কাজ শেষে ফেরার সময় পুরনো বাড়ীটার সামনে এসে পা আটকে যায় রমার। ওর ফেলে যাওয়া সংসার কেমন আছে একবার দেখে যেতে খুব ইচ্ছে করলো যদিও সুধীর এখন অফিসে তবুও মা নিশ্চয় আছেন। বেল বাজায় রমা, দরজা খুলে দেয় একজন অপরিচিত বৌ। রমার তাকে চিনতে অসুবিধে হলেও বৌটির হয়নি এক ঝলক দেখেই বুঝেছে এই সুধীরের আগের বৌ।....."ইয়ে মানে আমি,মা আছেন?..."আপনি ভেতরে আসুন, মা একবছর আগে মারা গেছেন। আমাদের বিয়ের কিছুদিন আগেই। ও তো এখন নেই অফিসে গেছে। একটু চা করি?"
....না আমি চা খাবোনা, এইদিকে একটু এসেছিলাম,আজ যাই। আপনি আমাকে চিনবেন না। আমি রমা মানে...."
"আমি জানি, মায়ের আলমারী পরিস্কার করতে গিয়ে পেয়েছি আগের আ্যলবাম আর সেখানেই ছবি দেখেছি। মা মারা যাওয়াতে খুব তাড়াহুড়ো করে দোষ কাটিয়ে আমাদের বিয়েটা হয়। আমি সুধা।"
"আজ আসি".....
"একটা কথা বলবো আপনার কিছু জিনিস এখানে রয়ে গেছে।"
রমা হেসে বলে ওগুলো থাক, এই বাড়ীতে অনেক কিছুই রয়ে গেছে আমার।"
ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করে সুধা"একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?আপনিও কি বিয়ে করেছেন?
কোন উত্তর না দিয়ে তাড়াহুড়ো করে বেড়িয়ে আসে রমা ট্রেন ধরার জন্য। প্রশ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সুধা। রাতে সুধীরের আদরের মাঝে হঠাৎই বলে ফেলে সুধা," জানো আজ একজন এসেছিলো , রমাদি।" চমকে ওঠে সুধীর, প্রচন্ড রেগে যায় সুধার ওপরে,"তুমি এতো কিছু জানলে কি করে?ওই পাগলীটার এখানে কি দরকার? মহা সেয়ানা তো! আমাকে একটুও শান্তি পেতে দেবেনা উঃ। ঢুকতে দাওনি তো ওটাকে এখানে।" সুধীরের উগ্ৰমূর্তি দেখে আর কথা বাড়ায় না সুধা পুরো ব্যাপারটা চেপে যায়। তবে বুদ্ধিমতী সুধার এটুকু বুঝতে অসুবিধে হয়না রমা এখনও সুধীরের নামেই সিঁদুর পরে। হায়রে অবুঝ মন, সত্যি রমাদি পাগলি। ক্ষেপে যায় সুধীর,"মুডটাই দিলে নষ্ট করে যাতা"
সারা রাস্তায় সেদিন অদ্ভুত একটা ঘোরে ফিরেছে রমা। বাথরুমে ঢুকে শাওয়ারের তলায় দাঁড়িয়ে হুর হুর করে জল ঢালে। নাহ আজ শ্যাম্পু করে সব সিঁদুরটাই তুলে ফেলবে।কিন্তু পারলোনা রমা ড্রেসিং টেবিল এর সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়ে সিঁথিতে সিঁদুর দিলো রমা। রাতে কিছু খেতে পারলোনা, ঘুমের ওষুধ খেয়েও ঘুম এলোনা। মনে পড়ে গেলো ওর নতুন বিয়ের পরের দিন গুলোর কথা। সুধাকে কত পরিপূর্ণ লাগছিলো অথচ তার সব হয়েও আজ কিছুই নেই। আজ বাচ্ছাটার কথাও খুব মনে হচ্ছে রমার, কি ফুটফুটে বাচ্ছাটা!সুধীরের কথা ভেবে ওকেও যত্ন করতে পারেনি । "ভগবান এতো কিছু শুধু কি আমার জন্যই তোলা ছিলো?"
কদিন আবার গভীর অবসাদে ডুবে যায় রমা, আবার ডাক্তার ওষুধের ডোজ বাড়ানো চলে। প্রায় পনেরো দিন বাদে আবার আসে অফিসে, ছুটি ছাটাও প্রায় শেষ এবার উইদাউট পে হতে হলো। তবুও যদি চাকরি টা বাঁচে, শুভ্রাদি অনেক ঐ জিজ্ঞাসা করে জানতে পারেন সুধীর আবার বিয়ে করেছে। "তুই আর কেন এই চিহ্নগুলো বয়ে বেড়াচ্ছিস? এবার এগুলো তুলে ফেলে দে, ছেলেটা যখন আবার বিয়ে করেছে। সত্যি আমি তো তোর জামাইবাবুর বাইপোলার সিনড্রোম থাকা সত্ত্বেও তাকে দিব্যি ভালবেসে এই পঁচিশ বছর সংসার করছি। মানুষ কতটা নীচ হতে পারে।" তবে রমাকে একচুলও সরানো যায়না তার যায়গা থেকে।
মাঝে কেটে গেছে আরও চারটে বছর তবে এই কবছরে অকালে রমার চুল গুলো পেকেছে, সুগার ,প্রেসার ধরেছে। রমা দীক্ষা নিয়েছে একটু শান্তির খোঁজে ওর বাবাও মারা গেছেন এখন অবলম্বন বলতে পিসিমা, রমার আর সংসার করা হয়নি। ওর বাবা শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করেছেন,কেউ এগিয়ে আসেনি। তবুও রমা এখনও বাচ্ছার জন্মদিনে পায়েশ করে গোপালকে ভোগ দেয় , আশ্রমের বাচ্ছাদের খাওয়ায়।
রবিবার অনেক বেলায় ওঠে রমা, রাতে ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুতে হয় ওকে। তারপর উঠেই বা কি এমন কাজ ? রান্নার লোক যা হোক একটা কিছু করে যায় ,মাত্র তো দুটো প্রাণী ও আর ওর পিসিমা। সবে চা খেয়ে বসেছে এমন সময় বেল টা বাজে। এখন আবার কে এলো বিরক্ত হয়ে দরজা খোলে রমা, দরজা খুলে স্তব্ধ হয়ে যায় রমা হয়ত বা কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলে। তারপরেই সুধীরের কথা শোনার পরে খুব উত্তেজিত হয়ে যায় নিজেকে সামলাতে পারেনা।রমার প্রচন্ড চিৎকারে ছুটে আসেন পিসিমা, এত বছরে কোনদিনই বোধহয় রমাকে এত উত্তেজিত হতে কেউ দেখেনি। পিসিমা দেখেন দরজার ঠিক বাইরে দাঁড়িয়ে সুধীর ,তবে সুধীরের এমন পোশাক কেন? ওর মা তো শুনেছেন, অনেকদিন আগেই মারা গেছেন। পিসিমা কে দেখে আরো চেঁচাতে থাকে রমা ওর সারা শরীরটা থর থর করে কাঁপছে, "ওই জানোয়ারটাকে এখান থেকে বার করে দাও এক্ষুণি, আমার মত একটা পাগলের কাছে ওর কি দরকার? ও আমাকে তাড়িয়েছে, আমার বাচ্ছাটাকে বাঁচতে দেয়নি। আবার বিয়ে করে পশুটা ওই বৌটাকেও বাঁচতে দেয়নি। কেন এসেছে এখানে? আমি কি নিজের বাড়ীতে একটু শান্তিতে থাকতে পারবো না।" আজ বোধহয় রমার সবটুকু জমে থাকা দুঃখ উগড়ে দেওয়ার দিন।
পিসিমা রমাকে ভেতরে পাঠিয়ে যেটুকু জানতে পারেন তা হলো, সুধীরের বৌ সুধা অনেক চিকিৎসার পর বাচ্ছাটার জন্ম দিলেও মারা যায় হসপিটালেই। সুধার শরীর ক্রমাগত খারাপ হচ্ছিলো মারা যাওয়ার আগে সুধীরের হাত ধরে বলে গেছে ,"রমাদির মত এত ভালো বোধহয় তোমাকে কেউ বাসেনি। খুব দুঃখী আমার দিদিটা, যদি আমার কিছু হয়ে যায়, আমার মেয়েটাকে ওকে দিয়ো। আমার তো বাপের বাড়ীতে কেউ নেই। হয়ত আমার থেকেও বেশি ভালবাসা দিয়ে মানুষ করবে।" সুধীরের আগের তেজ আর নেই, এখন অনেকটা দিশাহারা আর একা সুধীর। বৌ এর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী সুধীর ওর মেয়েটার দায়িত্ব রমাকে নিতে বলতে এসেছিলো। বাচ্ছাটার বয়স সবে দশদিন আয়ার কাছে রেখেছে ওকে, কিন্তু সুধাকে দেওয়া কথার জন্যই এখানে আসা ওর। সুধীর যেন অদ্ভুত রকম এক পাল্টে যাওয়া মানুষ, ও আজ শুধুই শ্রোতা। আজ রমা বক্তা,এতদিনের জমে থাকা রাগ অভিমান সব আগ্নেয়গিরির তরল স্রোতের মত বেরোচ্ছে। রমা ঘর থেকে চেঁচাতে থাকে, "পাগলের কাছে এসেছে বাচ্ছা মানুষ করতে দিতে। এখানে কেন? আবার বিয়ে করতে বলো ওকে। "
পিসিমা ফিরে যেতে বললেন সুধীরকে, রমাকে কিভাবে সামলাবেন ভেবে হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায় ওনার ,এতোটা ভায়োলেন্ট হতে দেখেননি কখনো মেয়েটাকে।
সুধীর এগিয়ে যায়, জানালায় দাঁড়িয়ে রমা,ও এতক্ষণ খেয়ালই করেনি ওদের বাড়ীর একটু আগে ট্যাক্সিটা দাঁড়িয়ে।হঠাৎ একটা বাচ্ছার কান্না আসে রমার কানে, পিসিমা আটকাতে পারেননা রমাকে। পাগলের মতো ঘর থেকে ছুটে বেড়িয়ে যায় রমা, সুধীরকে একঝটকায় সরিয়ে দিয়ে আয়ার কোল থেকে বাচ্ছাটাকে নিয়ে পরম স্নেহে আঁকড়ে ধরে। আজ বোধহয় সত্যিই জয় হলো রমার অন্ধ ভালবাসার।
পিসিমা হাতজোড় করে নমস্কার জানান ঠাকুরকে, হয়ত অলক্ষ্যে থাকা সুধাকেও যার সাহায্যে হয়ত রমা আবার ফিরে আসবে স্বাভাবিক জীবনে। থাকুক না সবার মনে এমন সহানুভূতি এই মনের রোগটার জন্য। একটু সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিলে ক্ষতি কি?
সমাপ্ত-
Comments
Post a Comment