Skip to main content

#পিয়ালের ছন্দে শিমূল#

       #পিয়ালের_ছন্দে_শিমূল#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#

"কি রে.…. কি হলো!

দাঁড়িয়ে আছিস কেন গোলুবাবা?

পা ফেল, এই তো হচ্ছে ঠিক ,অন‍্যেরা যেমন করে করছে দেখে নে। এই দাঁড়া তোকে শিমূলের পাশে দাঁড় করিয়ে দি। শিমূল গোলুকে একটু দ‍্যাখতো।"

এক, দুই, তিন এই বলে আবার শুরু করে ছন্দা।

ছোট্ট ছোট্ট পায়ে ঘুঙুর বেঁধে পিয়াল স্টেপ মেলানোর চেষ্টা করছে। মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখছে মাঝে মাঝে ।

পিয়াল....ছন্দার গোলুবাবা, ওর ছেলে। মাত্র তিন বছর বয়স ওর , এই সবে স্কুলে যাচ্ছে। ছন্দার মোটামুটি সারাদিনই কেটে যায় নাচের স্কুল নিয়ে। পিয়াল যাতে একা হয়ে না যায় তাই ওকে সাথে নিয়ে আসে ছন্দা। ছোট্ট পিয়ালেরও মায়ের আঁচল ধরে ঘুরতে ঘুরতে কখন যেন নাচের স্কুলটাই আনন্দের জগত হয়ে গেছে।
কিংশুক বলে, "পিয়ালকেও দলে টানলে ছন্দা। ছেলেটা কোথায় মেসি,সৌরভ হবে তা নয়তো ওকে নাচের তালিম দিচ্ছো।"
     ....." কি যে বলোনা! তুমি দেখোনি ছোট্ট থেকে ওর কিরকম নাচের ইচ্ছে!সমানে পায়ে বিট দিতো,যখন আমি প্র‍্যাক্টিশ করতাম।"

  কিংশুক খুব বেশি বাধা দিতে পারেনা। ছন্দা এই নাচের স্কুলটা না চালালে ওদের যে কিভাবে চলতো কে জানে। কিংশুকের দাদারা বাবা হঠাৎ মারা যাবার পর একরকম গলাধাক্বাই দিয়েছিলো ব‍্যাবসা আর সম্পত্তি থেকে। ভাগ‍্যিস ছন্দার বাপের বাড়ীর একতলায় ওর নাচের স্কুলটা ছিলো।বিয়ের আগে থেকেই স্কুলটা চালাতো ছন্দা। স্কুলটার নাম "ঝুমুর"।
এই নিয়ে বৌদিদের টিপ্পুনির অন্ত ছিলোনা।---"তোমার বউ সারাদিন ধৈ ধৈ নৃত‍্য করে বেড়াবে আর সংসারের কাজ কে সামলাবে শুনি। তোমার তো পড়াশুনা কিছুদিন আগেই শেষ হলো , একটা ভালো চাকরি বাকরি না জুটিয়ে বাবার ব‍্যাবসার ভরসায় বিয়ে করে ফেললে। দাদা বৌদিরা খেটে মরবে আর ওনারা নেচে বেড়াবেন। এবার থেকে হেঁসেলের দায়িত্ব নিতে বলো বৌকে।"
একটা সময় মুখ বুঁজে সহ‍্য করতো ছন্দা কিংশুকের আর শ্বশুর মশাই এর মুখ চেয়ে। নাচের স্কুল মোটামুটি বন্ধ হতে বসেছিলো। শুধু শনি, রবিবারের বিকেলের ক্লাশটা নিতো ও। কিন্তু শ্বশুরমশায় মারা যাবার পর দাদারা যখন বললো এই বাড়ীতে থাকলে ওদের দাসানুদাস হয়ে থাকতে হবে মাথা উঁচু করে প্রতিবাদ করে বেড়িয়ে এসেছিল ছন্দা ছোট্ট পিয়ালকে কোলে নিয়ে কুন্তলের হাত ধরে।
কুন্তলেরও কাজ জোগাড় হয়ে যায় একটা আ্যড এজেন্সিতে। আঁকার হাতটা বরাবরই ভালো কুন্তলের।
ছন্দা আর কুন্তলের এখন সুখের সংসার। ছন্দা যদিও একমাত্র মেয়ে, তবুও ওরা একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে বাপের বাড়ীর পাড়াতেই। পিয়াল স্কুলের সময়টুকু ছাড়া কখনও থাকে দিম্মার কাছে, তবে বেশিরভাগটাই থাকে মায়ের কাছে। নাচও শেখা হয় আর সবার আদরও খাওয়া হয়।
     দিন পার হয়ে যায় নিজের নিয়মেই। একটু একটু করে বড় হচ্ছে পিয়াল। নাচলে পিয়ালের সারা শরীর যেন কথা বলে, পায়ের তালে জাদু ছড়ায়। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে ছন্দা, এই কি ওর সেই গোলুবাবা! সময়ের সাথে সাথে কি সুন্দর টানটান ধনুকের মত চেহারা হয়েছে পিয়ালের। মনে মনে হেসে ফেলে ছন্দা ইশ্ মায়ের নজর যেন লেগে না যায়।
  আর তেমনি সুন্দর তৈরি হয়েছে শিমূল, ও পিয়ালের চেয়ে বছর তিনেকের বড়। ছোটবেলায় মা মারা যাওয়াতে দাদু দিদার কাছে মানুষ। ওর বাবা  ওকে অপয়া বলে মনে করতেন, ওকে জন্ম দিতেই গিয়েই ওর মা মারা যায় সেই জন‍্য। বাবা আবার বিয়ে করেছেন,চাকরিসূত্রে এলাহাবাদে থাকেন। শিমূলের মা ছন্দার ছোটবেলার বন্ধু, এক স্কুলে পড়েছে ওরা একসঙ্গে নাচ শিখেছে। নাচ শিমূলের রক্তে। ছন্দাই হাত ধরে ওর নাচের স্কুলে এনেছিলো তিন বছর বয়সে। শিমূল আর পিয়াল কে এখন আরো ভালো যায়গায় তালিম নেওয়াচ্ছে ছন্দা।
  কি সুন্দর সুন্দর সব নাচ ইনোভেশন করছে ওরা এই ছোট্ট বয়সে। শিমূলও যখন নাচে , ওর নাচের জাদুতে যেন হাজার শিমূল আর পলাশের রঙ ছড়ায় প্রকৃতিতে। ছন্দার নাচের স্কুলের খ‍্যাতি এখন চারদিকে, প্রচুর ছাত্রছাত্রী। বিভিন্ন যায়গায় ওরা অনুষ্ঠান করে। পিয়াল আর শিমূলের নাচ দেখে সবাই মুগ্ধ।
     পিঠোপিঠি দুই ভাইবোনের মত বড় হয়েছে ওরা। পিয়াল যখন প্রথম পায়ে তাল দিতে শিখলো তখন শিমূল ছিলো ওর গাইড,"ও গোলুভাই এই যে এই পায়ে আগে তাল দে দেখি। এই দেখি দেখি তোর আঙুলটা, হ‍্যাঁ এই তো এটা পতাকা ,আর এই যে অর্ধপতাকা, আর এইটা কনিষ্ঠা। হাঁ করে দেখতো পিয়াল এখনও শিমূল পেছনে লাগে ওর,"এই গোলু প্রণাম কর,আমি দিদি হই কিন্তু,তোকে এতকিছু শেখালাম!"........" এই শিমূলফুল একদম গোলু বলবিনা, আমি পিয়াল। ছোট বেলায় মা আমাকে গোলু বলতো।"
........"হু এখনও তুই গোলু, আমার মোটু মোটু ভাইয়া।"
......"ও মা দেখোনা ,
ও আমাকে গোলু আর মোটা বলছে। আমি কি এখনও মোটা? "
ছন্দা হেসে ফেলে ওরে বাবা আর পারিনা, "শিমূল ওকে ক্ষেপাস না মা,যা অভিমানী ছেলে আমার। আর এই যে পিয়ালবাবু শিমূল কিন্তু তোর প্রথম গুরু।"
   তবুও ভালো সময় হয়ত সবসময় মানুষের জীবনে থাকেনা,হঠাৎ করে মারা গেলেন শিমূলের দিদু, ওর দাদু আর শিমূলকে নিজের কাছে রাখতে সাহস পেলেননা। দেখতে দেখতে বড় হয়েছে শিমূল এবছরেই আঠেরোতে পা রেখেছে। তাই ওর বাবাকে খবর পাঠালেন। শিমূল কেঁদে অস্থির দাদু ওকে কোথায় পাঠাচ্ছে বাবাকে এত বছরের মধ‍্যে খুব বেশি বার চোখেই দেখেনি। বাবা তো ওকে দেখতেই পারে না।
    এদিকে পিয়ালকে কিছুতেই সামলাতে পারছেনা ছন্দা। ছোট্ট থেকে দুজনে পাশাপাশি বড় হয়েছে। ছন্দা হারাতে চলেছে একজন প্রতিভাবাসম্পন্ন নৃত‍্যশিল্পীকে, একদম ছোট্ট থেকে নিজের হাতে গড়ে তোলা শিমূলকে। একদম মায়ের স্নেহে বড় করেছে মেয়েটাকে। কিন্তু ওর দাদুকে কিছুতেই রাজী করানো গেলোনা। উনি যার মেয়ে তাকে ফেরত দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চান।
    চোখের জল, বায়না কিছুতেই কাজ হলোনা। বাবার সাথে এলাহাবাদে চলে যেতেই হলো শিমূলকে। শুধু ছন্দা আর কিংশুক ছিলোনা সেদিন ওরা পিয়ালকে নিয়ে দীঘা চলে গিয়েছিলো। শুধু ছন্দার সেবার সমুদ্রের জলটা খুব ফ‍্যাকাশে রঙের লেগেছিলো। ছেলের ছোট্ট হয়ে যাওয়া মুখটা একটুও ভালো লাগেনি ছন্দার। ভেতরে ভেতরে হারানোর যন্ত্রণা ওকে কুঁড়ে খাচ্ছিলো।
  তবুও সময় নিজের ছন্দে বয়ে যায়। ছন্দার নাচের স্কুল চলতে শুরু করলো নিজের গতিতে। শুধু মাঝে মাঝে মেয়েটার জলেভেজা শুকনো মুখটা মনে পড়ে। বাবাকে অনেক অনুরোধ করে দুএকবার ফোন করেছিলো শিমূল। কিন্তু ওর নতুন মায়ের ইন্ধনে আর তা সম্ভব হয়নি। এর মধ‍্যে ওর দাদুও মারা গেলেন। তবুও ওরা আসতে দেয়নি শিমূলকে। "সত‍্যিই মেয়েটার সব প্রতিভা শেষ হয়ে গেলো,হায় ভগবান কি ভালো নাচতো মেয়েটা!"..
......"আচ্ছা মা একবার চলোনা এলাহাবাদে শিমূলফুলের জন‍্য বড্ড মন কেমন করছে।"
....."নারে গোলু মেয়েটাকে আর কষ্ট দিসনা। আমরা গেলে ওর দুর্দশা আরো বাড়বে।"
    মাঝে কেটে গেছে আরোও পাঁচটা বছর সময় হয়ত সব ভুলিয়ে দেয়। পিয়ালের এখন দেশবিদেশ থেকে ডাক আসে। এতবছরে অনেক কৃতী ছাত্র ছাত্রী বেড়িয়েছে ছন্দার "ঝুমুর" থেকে।
   পিয়াল নাচের পাশাপাশি প্রচুর সোশ‍্যাল ওয়ার্ক করে। অনেক রিহ‍্যাব সেন্টারে ওদের অনুষ্ঠান থাকে। ওখানকার কিছু ডাক্তারও পিয়ালের গুনমুগ্ধ। এরকম কয়েকটি সেন্টারে এখন রোগীদের মিউজিক থেরাপিও দেওয়া হয়। ডাক্তারদের ধারনা বেশ ভালো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। অনেক পেশেন্ট ভালোও হচ্ছে, চিকিৎসায় সাড়া দিচ্ছে।
  পিয়াল অসাধারণ নাচে,ওর সারা শরীর কথা বলে, বসন্তের রঙ ছড়িয়ে পরে চারিদিকে। বছরে অনেক বারই বিদেশে যেতে হয় ওদের । সব কিছুর মধ‍্যেই মা আর ছেলের বার বার মনে পড়ে শিমূলের কথা। মাঝে মাঝেই গল্প হয় শিমূলের।
    এই কয় বছরে শিমূলের সাথে কোন যোগাযোগ হয়নি। ওর দাদু বেঁচে থাকতে মাঝে মাঝে খবর পেতো ওর। এটাও শুনেছে এখন বাবা ওকে ভালোবাসে, যদিও নতুন মায়ের ভয়ে তেমন কিছু সহানুভূতি দেখাতে পারেনা। নাচের স্কুলে ভর্তি করতে চেয়েও পারেনি। ওখানে ওর আরো দুই ভাইবোন আছে। যদিও এগুলো সবই অনেক পুরনো খবর। কিছু মানুষের স্মৃতি এমনই উজ্জ্বল হয়ে থাকে জীবনে। শিমূলও কি ভাবে ওদের কথা? হয়ত বা ভাবে...
   বিশ্ববঙ্গ সম্মেলনে ওদের অনুষ্ঠান থেকে ফেরার পথে দিল্লীতে "ঝুমুরের" একটা অনুষ্ঠান ছিলো। পর পর বেশ কয়েকটা অনুষ্ঠানের পর ওখানকার একটা রিহ‍্যাব সেন্টারে ওদের সেদিন রাতে পারফরমেন্স ছিলো। কিন্তু সেদিন ছন্দা আর পিয়ালের সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেলো ওখানে শিমূলকে দেখে। অপূর্ব সুন্দরী শিমূল এখনও  রূপের ছটায় বসন্ত রঙ ছড়ায়। এই বেশ কবছর পরেও একটুও চিনতে অসুবিধা হয়না শিমূলকে।
   কিন্তু শিমূল আজ হুইলচেয়ারে বসে থাকা এক প্রতিবন্ধী। ছন্দা আর পিয়াল সবসময় অনুষ্ঠানের আগে ওদের কাছে যায়, চেষ্টা করে নৃত‍্য দিয়ে ওদের ঘুমিয়ে পড়া অনুভূতি গুলোকে জাগিয়ে তুলতে। পিয়ালকে অত‍্যন্ত স্নেহ করেন ওখানকার সিনিয়র অর্থপেডিক সার্জেন ডঃ রুস্তম।
   শিমূলকে জড়িয়ে ধরে ছন্দা আর পিয়াল পরম স্নেহে। কত কথা কত স্মৃতি যেন উছলে পড়ে। দুচোখ ভরে যায় জলে। পিয়াল বলতে থাকে,"শিমূল ফুল তুই কাঁদিসনা, আবার তুই হাঁটবি পা ফেলবি। নাচবি সারা স্টেজ জুড়ে। এবার আমি তোকে নাচ শেখাবো।"
   কান্নায় ভেঙে পড়ে শিমূল কেমন অদ্ভুত চুপচাপ হয়ে গেছে মেয়েটা। ছন্দা শিমূলের কাছে থাকে, আজ শিমূল পরম নির্ভরতায় ছন্দার হাতটা ধরে রেখেছে শক্ত করে। পিয়াল শিমূলের কেশ হিস্ট্রি জানতে পারে ডঃ রুস্তমের কাছ থেকে, ওর মা ওকে দিয়ে দোতলায় বালতি বালতি জল তোলাতো। একদিন সিঁড়িতে সাবানজল ফেলা ছিল অসাবধানে শিমূলের পা পিছলে ও পড়ে যায় সিড়ি থেকে। স্পাইনাল কর্ডের ইনজ‍্যুরিতে ওর নিচের দিকটা পুরো অবশ হয়ে যায়। এখন ফিজিওথেরাপি চলছে, কিছুটা ইমপ্রুভ করলেও পুরো ঠিক হতে কতদিন লাগবে বলা যাচ্ছেনা। ওর বাবা এক বন্ধুর সাহায‍্যে অনেক চেষ্টায় এখানে রেখে গেছেন। প্রায়ই আসেন মেয়েকে দেখতে। তবে এতটা খরচের ভার কতদিন বহন করতে পারবেন বলা যাচ্ছেনা।
   অনুষ্ঠান শুরু হলো, সব পেশেন্টদের সাথে আজ হুইলচেয়ারে শিমূলও। প্রথমে ছন্দা আর পিয়াল একসাথে সেই নাচটা করলো যেটা একসময় শিমূল করতো। তারপর পিয়াল শিমূলের সাথে পারফর্ম করা নাচগুলো করলো ওদের ট্রুপের একটি মেয়ের সাথে। ছন্দা তখন বসে আছে শিমূলের পাশে ওর হাতটা ধরে। অদ্ভুত উত্তেজিত দেখায় শিমূলকে। কখনও চোখ দুটো জ্বলছে আবার কখনও যেন চোখে জল। আবার কখনও আনন্দে হাসছে। হাতের মুঠোটা শক্ত হয়ে ওঠে। ছন্দা মাথায় হাত রেখে বলে," তুই আবার নাচবি। পারবি তুই আমি বলছি।" শিমূলের চোখ তখন পিয়ালের পায়ের ভঙ্গিমায় আটকে।"
    হঠাৎ যেন এক অদ্ভুত ঝাঁকুনি অনুভব করে ছন্দা পিয়ালের শরীরে , হুইলচেয়ারটা দুলে ওঠে শিমূলের ধাক্বায়। আশ্চর্য হয়ে যায় ছন্দা। কি হলো মেয়েটার?শিমূলের গলা দিয়ে বেড়িয়ে আসে জোরে একটা আওয়াজ ,'আমি পারবো'।..... "তোকে যে পারতেই হবে সোনা। আবার ছন্দের ঢেউ তুলতে হবে।"
  দিল্লী থেকে ফেরার আগেই ছন্দা শিমূলের কাছ থেকে সব জানতে পারলো, নতুন মা তাকে ভালো না বাসলেও বাবা ভালোবাসতো। বাবা মনেপ্রাণে চায় ও সুস্থ হয়ে উঠুক। কিন্তু এতোটা খরচ বাবা কতদিন চালাতে পারবেন জানেনা ও। হয়ত এইভাবে সারাজীবন কেটে যাবে। নিজের ভবিষ‍্যত ভেবে শিউরে ওঠে শিমূল।
   পিয়াল আর ছন্দার কয়েকদিন ফিরতে দেরী হলো তবে সঙ্গে নিয়ে এলো একঝাঁক ভালবাসায় জড়িয়ে শিমূলকে খুব যত্ন করে।
কলকাতার সবচেয়ে ভালো রিহ‍্যাব সেন্টারগুলোতে অনেক অবদান আছে পিয়ালের, তবে ওরা শিমূলকে বাড়ীতেই রাখলো। চিকিৎসার পাশাপাশি এক্সপার্ট ফিজিওথেরাপি চলতে লাগলো। তার সাথে পিয়ালের ডান্স আর মিউজিক থেরাপি। শিমূল ছোট বাচ্ছাদের নাচ শেখাতে শুরু করলো। সত‍্যি অবাক হওয়ার মত কথা, হুইলচেয়ারে বসে নাচ শেখানো! ওর নির্দেশগুলো নেচে দেখাতো পিয়াল। ও বসে বসে দেখতো, মুখে বলতো বোঝাতো। কখনও বা হাতের মুদ্রা গুলো ঠিক করে দিতো।
  অভিজ্ঞতায় পিয়াল শিখেছিলো পছন্দের কাজ মানুষকে ভালো রাখে। সুস্থ ও সক্রিয় করে আত্মবিশ্বাস জাগায়। নিজেকে সমাজের চোখে, নিজের চোখে বোঝা না বানিয়ে আত্মবিশ্বাস নিয়ে বাঁচা জীবনের মূল মন্ত্র।
  ছোট্ট গোলু একসময় শিমূলের দেওয়া মন্ত্রে পা ফেলা শিখে আজ পিয়াল হয়ে তালে, ছন্দে, আনন্দে ভরিয়ে দিচ্ছে সবার মন। আজ শিমূল শিখছে পিয়ালের কাছে বাঁচার মন্ত্র। সত‍্যি এতটা অবলম্বন যদি শিমূলের মত সবাই পেতো।

              মাঝে কেটে গেছে একটা বছর, শিমূল ফুলের ম্লান হয়ে যাওয়া রঙ আবার একটু করে উজ্জ্বল হচ্ছে, ছন্দা আর পিয়ালের চেষ্টায়।

          শিমূল ছন্দা আর পিয়ালের হাত ধরে পা ফেলছে একটু একটু করে। নাচের মধ‍্যে সারাক্ষণ থেকে আর বেশিদিন নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকতে পারেনা ওর অসাঢ় পা দুটো।
                             শুধু পিয়াল কেন অম্লানদা ও খুব পরিশ্রম করছে এই একটা বছর। অম্লানদার ফিজিও সাপোর্টে এতদিন আছে শিমূল। মাঝে মাঝে অদ্ভুত মুগ্ধতা লক্ষ‍্য করে পিয়াল অম্লানদার চোখে। অম্লানদা কি ভালোবাসে শিমূল ফুলকে? হয়ত বা যদিও কোনদিন মুখ ফুটে কিছু বলেনি।

ওর বাবাও আসেন মাঝে মাঝে। অদ্ভুত পরিবর্তন হয়েছে ওনার মধ‍্যে। ছন্দা আর পিয়ালকে এখন ওনার পরম আত্মীয় বলে মনে হয়।
   সেদিন নাচে মগ্ন পিয়াল, ওদের বার্ষিক অনুষ্ঠানের মহড়ায়। শিমূল মুগ্ধ হয়ে দেখছে দূরে বসে। হঠাৎ শিমূলের দিকে নজর পরে নাচ থেমে যায় পিয়ালের, কারো সাহায‍্যে নয় শিমূল উঠে দাঁড়িয়ে পা ফেলছে নিজেই, নাচের ভঙ্গিমায় যেন ডুবে আছে। হয়তবা কষ্টও হচ্ছে চোখে জল গড়িয়ে পড়ছে পিয়াল আর ছন্দা দূর থেকে দেখে আশ্চর্য আর মুগ্ধ হয়ে।  ওরা কেউ বাধা দেয়না ওকে ,থাকনা আজ নিজের আনন্দে মেয়েটা।
            নাচের চেষ্টায় মগ্ন শিমূল আজ দিশাহারা আনন্দে, নিজের অক্ষম পাদুটোকে আবার ছন্দে ফেরানোর আনন্দে। আর শিমূল ফুলের লাল রঙ দেখে মুগ্ধ ছন্দা আর পিয়াল।
   হঠাৎ পিয়ালের চোখে চোখ পড়াতে লজ্জা পেয়ে যায় শিমূল, বলে ওঠে,"গোলু দেখ আমি পেরেছি। তোর শেখা নতুন নাচগুলো শেখাবি তো?"
হেসে ফেলে পিয়াল,"আবার গোলু! নিশ্চয় শিমূল  ফুল। তোর গুরুদক্ষিণা তো পাওনা রয়ে গেছে, ছোটবেলায় আমায় নাচ শিখিয়েছিলি মনে নেই?"
    কৃতজ্ঞতায় জল ভরে আসে শিমূলের দুইচোখে। ওর মত কত প্রতিভা নষ্ট হয়ে যায় জীবনের চোরাপথে। কজনের ভাগ‍্যে এমন গোলুভাই আছে যে এভাবে আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে আবার ফিরিয়ে আনতে পেরেছে তাকে জীবনের মূল স্রোতে। নাহলে হয়ত সারাজীবন হুইলচেয়ারেই কেটে যেত নিভে যাওয়া আলোর বুদবুদ দেখতে দেখতে।
             সেবারের বার্ষিক অনুষ্ঠানটা হয়তো সব চেয়ে সেরা ছিলো ওদের জীবনে। ছন্দা আর পিয়ালের ছন্দে একটা নিভে যাওয়া দীপ আবার জ্বলে উঠলো আপন আনন্দে। স্টেজ আলো করে তখন শিমূল বসন্তের রঙ ছড়িয়ে দিয়ে নাচছে,"আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে।"
©ইচ্ছেখেয়ালে শ্রী

সমাপ্ত-
    
  

    

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...