#বন্ধুত্ব_হোক_এমনি#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
সারাদিন মোবাইলে চোখ রাখাই হয়নি শুধু আ্যনসারিং ছাড়া, খুব চাপ ছিলো। ফেরার পথে গাড়ীর পেছনের সীটে শরীরটাকে এলিয়ে দেয় সিদ্ধার্থ। শরীরটা জুড়িয়ে যায় বেশ ভালোলাগে এই অবসরটুকু উপভোগ করতে। প্রথমে ফেসবুকে চোখ রাখে," ইশশ্ কি সব ছবি! এতেই পাঁচশো লাইক। ওহ্ আজ আবার ছবি আপলোড করেছে কবীর, বিন্দাস্ আছে দুবাইয়ে, নো চিন্তা ভাবনা, ছেলেটাও বেশ বড় হয়ে গেছে। তবুও এখনও বেশ হ্যান্ডসাম আছে। ওর বউ নিকিতাও বেশ সুন্দরী। সত্যি ফেসবুক টা বেশ ভালো মাধ্যম, অনেকের খবর পাওয়া যায়,দূরের বন্ধুদের সাথে হাত মিলিয়ে বেশ আড্ডা দেওয়া যায় এক ছাদের তলে। বাড়ীতে তো নিশার জন্য ফেসবুক খোলাই যায়না। এখনো নিশা আপডেটেড হতে পারেনি, তেমন দুষ্টু হয়েছে ছেলেটা!সব দিকে নজর। একবার বাড়ীতে গেলে ফোনটা দখল করে বসে থাকে।
নিশার অদ্ভুত সন্দেহ যে ফেসবুক খুব একটা ভালোনা। হোয়াটসআ্যপে বেশি থাকা মানে প্রেমে থাকা," মাঝে মাঝেই বলে ওহ আজকাল স্কুলে কয়েকটা মায়ের কোন কাজ নেই সারাদিন ফেসবুক করছে, কার সাথে কি করে বেড়াচ্ছে কে জানে। তাও ভালো তুমি ওগুলো করোনা।
.....সিদ্ধার্থ বলে," তাতে কি তুমিও ফেসবুকে একটা আ্যকাউন্ট খোলো না, তোমার বোনও তো আছে, ভালোই হবে। আমিও একটু কথা বলতে পারবো শালীজির সাথে।
....."হুঁ তাহলেই হয়েছে তোমার ছেলেকে আর দেখতে হবেনা। গোল্লায় যাবে ছেলেটা। এমনিতেই তো দুষ্টুর শিরোমণি সারাদিন গেম খেলতে পারলেই বেঁচে যায়।আমি এই বেশ আছি গো। আর তুমিও তো ওইসব করোনা। আমার একটুও ভালো লাগেনা,আর আমার সময়ই বা কোথায় ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর। এমনিতেই তো সারাদিন বাড়ী থাকোনা, কতক্ষণই বা পাই তোমাকে।"
গৃহশান্তির কথা ভেবে বাড়ীতে ফেসবুক হোয়াটসআ্যপ করেনা সিদ্ধার্থ। পুরো ডেটা কানেকশন অফ করে রাখে। নিশা জানেনা ও ফেসবুক আর হোয়াটস আ্যপ করে। বাধ্য হয়ে শালীকেও ব্লক করে রাখতে হয়েছে। সবচেয়ে আগে গৃহশান্তি।
অফিসে যাওয়ার পথে আর ফেরার সময় কিছুটা সময় পাওয়া যায় । কখনও অফিসে ফ্রী থাকলে সেই সময়টুকুই একটু নেট ঘাঁটাঘাটি করে সিদ্ধার্থ। হোয়াটস আ্যপটা খোলে, অনেক ম্যাসেজ এসে বসে আছে। প্রচুর জোক্স, ভিডিও, গল্প আরও কত কি। সব সময় সবগুলোতে চোখ রাখাও হয়না। লাইক দিয়ে বা স্মাইলি দিয়ে ছেড়ে দিতে হয়। মেসেজের শেষে চোখটা আটকে যায় হঠাৎ, আননোন নাম্বার! একটা খ্রিষ্টমাস আর নিউইয়ারের সুন্দর গ্ৰীটিংস। ডি পিটা দেখে সিদ্ধার্থ, বেশ ভালো দেখতে ভদ্রমহিলাকে। দেখেতো বেশ ইয়ং লাগছে, ডি পি টাওখুব সুন্দর। উত্তর দেয় সিদ্ধার্থ, জানতে চায় কিভাবে উনি ওর ফোন নাম্বার পেলেন। প্রায় সাথে সাথেই উত্তর আসে সিদ্ধার্থ কিছুদিন আগে অফিসিয়ালি ওদের একটা উপকার করে, তখনই নম্বরটা নিয়েছিলো। মনে করতে পারেনা সিদ্ধার্থ, প্রতিদিন কত মানুষই আসে অফিসে সবার কথা মনেও থাকেনা।
তবুও কৌতূহলী হয়ে জানতে চায় হঠাৎ এতদিন বাদে উনি মেসেজ করলেন কেন? ভদ্রমহিলা অনেক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন ওনাদের উপকার করার জন্য, একথাও বললেন ওনার স্বামীও খুব প্রশংসা করেন সিদ্ধার্থের। ভালো লাগলো সিদ্ধার্থের কজনই বা মনে রাখে এখনকার দিনে উপকার।
এর মাঝেই বাড়ীর কাছাকাছি পৌঁছে যায় সিদ্ধার্থ। নেটটা অফ করে দেয় সেদিনের মত, অনেকসময় রাত জেগে কোন মুভি দেখলে নিশা আর ছেলে ঘুমিয়ে পড়ার পর নেট অন করে একবার নোটিফিকেশন গুলো দেখে নেয়।
পরেরদিন অফিসে দুপুরের দিকে নেট অন করে সিদ্ধার্থ । ভদ্রমহিলাকে নেটে অনলাইনে দেখে, আর একটা গুডমর্ণিং মেসেজও দেখতে পায়। রিপ্লাই দেয় গুড আফটারনুন। হয়ত বা স্বভাবজাত কৌতূহলে আলাপ শুরু হয়, প্রথমে ইংরেজীতে,বাহ্ ভদ্রমহিলা বেশ শিক্ষিতা এবং রুচিসম্পন্না। ভালো লাগে সিদ্ধার্থের, বেশ ম্যাচ করে যায় ওর কেমেষ্ট্রীর সাথে।
প্রথমেই কোন মহিলার বয়স জিজ্ঞেস করা যে ভীষণ অভদ্রতা তা জানে সিদ্ধার্থ। অনেকে খুঁটিয়ে নাড়ি নক্ষত্র জানতে চাইলেও অনেকে বিরক্ত হয়, অনেক লোকের সাথে মিশে এই ম্যানার্সটা জানে সিদ্ধার্থ। তাই অন্য গল্পগুলোই চলে দুজনের মধ্যে বেড়ানো, মুভি দেখা , খাওয়া দাওয়া টুকটাক অনেক টুকরো কথা ।
তবুও তো একটা কৌতূহল থেকেই যায় বয়স সম্বন্ধে,আজকাল তো অনেকেই নিজের ছবি লাগাননা।ভদ্রমহিলার পাশ আউট ইয়ার কায়দা করে জানতে চায় সিদ্ধার্থ। অন্য কেউ হলে জানেনা কি করতো তবে ভদ্রমহিলা ভীষণ সরল এবং পজেটিভ তাই বলেন সবটাই। সিদ্ধার্থর আশ্চর্য লাগে, উনি প্রায় পাঁচবছরের বড় ওর থেকে কিন্তু বোঝাই যায়না ছবি দেখে। তবে কি এটা পুরনো ছবি?অত কথা জিজ্ঞেস না করাই ভালো। খারাপ লাগতে পারে ওনার।
একটু একটু করে আলাপ বাড়তে থাকে, নেট চ্যাটিং এ একটা অদ্ভুত নেশা আছে আর এইজন্যই মনে হয় এখন সবারই মোবাইল ছাড়া চলেনা। এখন মোবাইলময় জগৎ, তবুও ভালো নিশাটা এখনো ওই স্রোতে গা ভাসায়নি। সেই জন্যই মাঝে মাঝে নিশার বাড়াবাড়িতে বিরক্ত লাগলেও কিছু বলেনা।
এই তো সেদিন খুব দুঃখ করে রজত বলছিলো ওর বৌ নাকি সারাদিন ড্রেস চেঞ্জ করছে ,সেল্ফি তুলছে আর পোষ্ট করছে, অফিস থেকে ফিরে এককাপ চা পাওয়ার জন্য হা পিত্যেশ করে বসে থাকতে হয়। বেশীরভাগ দিন রান্নাও করেনা ভালো করে। শুনে তাজ্জব লাগে।
সবদিন গাড়ী আনা হয়না, বেশিরভাগদিনই চাটার্ড বাসে আসে সিদ্ধার্থ। আজকাল সকালে বাসে সীট পেলেই নেটটা অন করে প্রতিদিনই গুডমর্ণিং মেসেজটা পাঠায় তনুজা। এতদিনে ওর অনেককিছুই জানা হয়ে গেছে সিদ্ধার্থর। ওর সবটাই ছিলো খোলা বইয়ের মত কিন্তু সিদ্ধার্থ পার্সোনাল ব্যাপার বেশি শেয়ার করতো না কখনোই। কি দরকার অত কিছু বলার তার থেকে আড্ডা মারাই ভালো।
তনুজা একটু বেশি কথা বলে, সিদ্ধার্থকে পেলে মন ভরে কথা বলতে চায়। ওর এক ছেলে,বেশ বড় হয়ে গেছে পুণাতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। সারা দুপুর একাই থাকে ও, মনে হয় মোবাইল হাতে করেই বসে থাকে। কারণ ওকে তো সবসময় অন দেখে।
স্বামী আর ছেলের প্রশংসায় পঞ্চমুখ তনুজা। মাঝে মাঝে বিরক্ত লাগে সিদ্ধার্থর এত যদি বর বর আর ছেলে ছেলে তাহলে অন্য পুরুষমানুষের সাথে এত কিসের কথা বলার আগ্ৰহ। এখনকার মহিলা , পুরুষ সবাই যেন খুব একা। অথচ একসময় মা কাকিমাদের দেখেছে সারাদিন সময়ই পেতোনা কাজ সামলে। এখন মোবাইল হয়েছে একটা অবসেশন। নাকি এটাই ক্রেজ, "গাছেরও খাবো আর তলারও কুড়োবো।"
আজকাল সারাদিনই অফিসের সময়টুকু টুকরো কথা হতেই থাকে দুজনের। সিদ্ধার্থ খুব মেপে কথা বলে কিন্তু তনুজার কথা যেন শেষ হয়না। তবে খুব মার্জিত তনুজা, কখনও কোন খারাপ কথা বলেনা। সিদ্ধার্থ মাঝে মাঝে ননভেজ জোকস আর হট ভিডিও পাঠায় তনুজাকে। তনুজার একটু অস্বস্তি হয়, তবুও তেমন কিছু বলেনা শুধু হাসে। আপনি থেকে এখন ওরা তুমি হয়ে গেছে।
তনুজার অদ্ভুত একটা চ্যাটিং এর নেশা হয়ে গেছে। আসলে ওর একা জীবনে সিদ্ধার্থ একঝলক নিশ্বাস,হয়তবা ভালোলাগা।ও অপেক্ষায় থাকে, মাঝে মাঝেই দেখে সিদ্ধার্থ অনলাইন কিনা। যেদিন কথা হয়না, সেদিন খুব খারাপ লাগে । সারাদিন মুড অফ থাকে।
তনুজার স্বামী খুব ভালো মানুষ, ওকে মনে হয় চোখের মণি করে রাখে কিন্তু খুব একটা সময় দিতে পারেনা। সারাদিনই ব্যাস্ত থাকতে হয় অফিসের কাজে। সকাল থেকে রাত্রি অফিস করেই কেটে যায়। তনুজা মাঝে মাঝে অভিযোগ করে,"আমি তো এখন তোমার ঘরকি মুরগী তাই ডাল বরাবর হয়ে গেছি তাইনা? সারাদিন হাঁপিয়ে উঠি ঘরের মধ্যে। আগে তবুও ছেলেটা ছিলো।এখন তো একদম বেকার।"একাকিত্বই বোধহয় তনুজাকে বেশি কষ্ট দেয়, অন্য কিছুর অভাব নেই।
সিদ্ধার্থ বোঝে, মানুষ এখন বড় একা একটু কথা বলার জন্য ছটফট করে তনুজার মত মাঝবয়সী মহিলারা, যাদের এখন আর করার মত তেমন কিছু নেই। মাঝে মাঝে তনুজাকে ফ্লার্ট করে সিদ্ধার্থ, ভালোই লাগে একটু ডিজিটাল প্রেম প্রেম খেলা খেলতে একঘেঁয়ে দাম্পত্যের ফাঁকে। হয়ত তার সাথে নিজের ইম্প্রেসন এখনো মহিলাদের কাছে কতটা সেটাও হয়ত পরখ করে দেখে। ভালোই লাগে মাঝে মাঝে তনুজাকে ইগনোর করে দেখে ওর সিদ্ধার্থর প্রতি টান কতটা। একটু ন্যাকা ন্যাকা চ্যাট করতে ভালোই লাগে। খেলাটা বেশ জমেছে, ফ্রি টাইমপাশও হচ্ছে।
সেই তো ছেলের পড়া, পরীক্ষা, বাজার আর দাম্পত্য কলহ এক ঘেঁয়ে জীবন। এরমাঝে তনুজার সাথে টুকরো চ্যাটিং বেশ ভালো। খুব ইমোশনাল তনুজা, এমন খুব একটা দেখা যায়না এই বয়সে, কিছুটা অভিমানীও। তবে সেল্ফি পাঠাতে বললে খুব একটা রাজী হয়না তনুজা। অনেক বলার পর সেদিন একটা সেলফি পাঠালো সত্যি বেশ ভালো দেখতে তনুজাকে। দারুণ প্রশংসা করে সিদ্ধার্থ,"ইশ্ এখনো তুমি কি হট,আমি তো ফিদা হয়ে গেলাম। চোখ সরাতেই পারছিনা।" ফটাফট দুএকটা লাভ, কিশ আর হাগের ইমেজ পাঠিয়ে দেয়। ভেতরটা কেঁপে ওঠে কেমন যেন তনুজার এমন কথা হয়ত কোনদিনই শোনেনি। আর এই বয়সে এতটা কমপ্লিমেন্ট কে আর দেবে। বর সময় পায়না আর ছেলে তো ভালো করে কথাই বলেনা। তাই সিদ্ধার্থর সাথে চ্যাট করাটা একটা অদ্ভুত নেশা হয়ে গেছে,মনটা ভালো হয়ে যায়।
সিদ্ধার্থ খুব দেখা করতে চাইছে তনুজার সাথে, তনুজার খুব আপত্তি ছিলো দেখা করাতে। ও শুধু বলে বন্ধুত্বটাই তো বেশ, দেখা করার আবার কি আছে? দেখা হলেই হয়ত কথা শেষ হয়ে যাবে। আমাকে দেখার পর তোমার মনে হবে বান্ধবীটা একটা মিডএজ বুড়ি, হা হা হা তারচেয়ে এই বেশ আছি।" তাছাড়া বাড়ীতেই কি বলেই বা যাবে ও? যদিও কেউ থাকেনা বাড়ীতে তবুও যদি ওর বর ফোন করে জানতে চায় কিছু? তবুও শ্যামের বাঁশী বোধহয় আর ঘরে থাকতে দেয়না।
সেদিন আগে থেকেই বরকে বলে রাখে একটু শপিং এ বেরোবে। যদিও বর বলছিলো একা যাবার কি দরকার, উইকএন্ডে সময় করে নিয়ে যাবে। আসলে ছেলে চলে যাবার পর ইদানীং আর একা কোথাও বেরোয়না খুব একটা। " আচ্ছা ঘুরে এসো তাড়াতাড়ি, বাড়ি এসে একটা কল করে দিয়ো" বললো শুভ। খারাপ লাগলো তনুজার সত্যি হয়ত সময় দিতে পারেনা কিন্তু কত কেয়ারিং মানুষটা। তবুও সেই অমোঘ আকর্ষণ আর আটকে রাখতে পারলোনা তনুজাকে।
ওরা দেখা করে একটা কফিশপে,কথা বলে বেশ ভালো লাগে সিদ্ধার্থর সত্যিই ভালো মেয়ে তনুজা, একদম যেন নিষ্পাপ সুন্দর মুখখানা এখনো। কে বলবে ওর এত বড় ছেলে। তবে খুব বকবকিয়া মাষ্টার। সারাক্ষণ কথা বলতে চায়।হয়ত অনেকটা দুঃখ ওর ভেতরে চাপা পড়ে আছে ছেলেকে নিয়ে,ছেলেটা অদ্ভুত ভাবে পাল্টে গেছে, ওর জীবনে যেন আর মায়ের কোন অস্তিত্ব নেই।
কথায় কথায় জানতে পারে খুব সুন্দর ছবি আঁকতে পারে তনুজা। এছাড়াও কবিতা লেখা আর আবৃত্তি অনেক গুণই আছে তনুজার। রান্নাতো ফাটিয়ে করে। মাঝে মাঝেই ওর পাঠানো বিভিন্ন ডিশের ছবি দেখে হোয়াটসআ্যপে। কত গুণ এভাবেই চাপা পড়ে যায় সংসারের ঘানি টানতে টানতে। নিশাটাকে কত চেষ্টা করেছিলো গান শেখাতে। এতোই সংসারী যে কিছুই করানো গেলোনা। কদিন প্যা প্যা করেই ব্যাস সব বন্ধ।
সিদ্ধার্থ তনুজাকে বলে,"তোমার এত কোয়ালিটি এভাবে নষ্ট করছো, আবার শুরু করো। শুধু শুধু ছেলের জন্য মন খারাপ করে নিজেকে হারিয়ে ফেলছো।"
.......তনুজা হাসে,"এই বয়সে আবার, আর ধৈর্য নেই বাবা। এই বেশ ভালো আছি।"
....."তোমার হাবি কিছু বলেনা?
...."ও খুব সাপোর্ট করে আমায়। আমার দুঃখটা বোঝে।"
....."আর আমি? আমার সাথে কথা বলার জন্য ছটফট করো কেন? আমি কে?" হাসে সিদ্ধার্থ।
....." তুমি আমার ভালো বন্ধু। তোমার সাথে কথা বলতে ভালো লাগে।"
......"প্রেমে পড়ে যাওনি তো আমার শ্রীরাধিকা?"....একটু হেসে জিজ্ঞেস করে সিদ্ধার্থ।
তনুজাও হেসে ফেলে,"প্রেমের কথা তো তুমিই বেশি বলো, আমি বলিনা। আমার বয়েই গেছে প্রেমে পড়তে এই বয়সে।"
সেদিন বাড়ী ফেরার পথে বড় মন কেমন করে সিদ্ধার্থর একটা অদ্ভুত অপরাধবোধ আসে মনে," নাহ্ কাজটা মনে হয় ভালো করলোনা ও, তনুজা খুব ভালো মেয়ে একদম বাচ্ছাদের মত নরম মনটা ওর। এটা কি করছে ও, এই সম্পর্কটা নেহাত একটা মজা, শুধুই চ্যাটের নেশা। সত্যিই কি কোন ভালবাসা আছে এই সম্পর্কে, শুধুই একটা অভ্যাস।"
সত্যিইতো এইরকম কোন রিলেশনে ও জড়িয়ে পড়ে তাহলে তো নিশাটাকেও ঠকানো হবে। নিশা যদি এমন কিছু করতো তাহলে ওকি মানতে পারতো? ঠিক নয় ,কাজটা একদমই ঠিক হচ্ছেনা মনে হয় ওর।
তনুজার মন ছুঁয়ে যায় সিদ্ধার্থ, দেখে মনে হয় কতদিনের চেনা।অদ্ভুত এক নির্ভরতা খুঁজে পায় ওর মধ্যে, কিন্তু সিদ্ধার্থ নিজের পরিবারের কথা কখনই তেমনভাবে বলতে চায়না কেন? অভিমান হয় তনুজার কেমন যেন পর পর ভাব। সত্যিই তো কোনদিন তেমনভাবে প্রেম করারই সুযোগ পায়নি খুব কম বয়সে বিয়ে হয়ে গিয়েছিলো ওর। তাহলে কি এই বয়সে প্রেমে পড়তে ইচ্ছে করছে? না না ছিঃ ছিঃ এসব কি ভাবছে, এমন কথা ভাবাও পাপ। খুব ভালো বন্ধু হয়ে থাক সিদ্ধার্থ। অন্য কিছু না, সিদ্ধার্থকে অনলাইনে না দেখলে ওর খুব খারাপ লাগে। কখনো চিন্তাও হয় খুব সারাদিন অন না দেখলে। সিদ্ধার্থ যেন ওর পরিবারেরই একজন হয়ে গেছে। অনেক সমস্যাও শেয়ার করে তনুজা ওর সাথে। এমন কেউ যাকে মনের কথা বলা যায়। একবারও তনুজার মনে হয়না ও কোন বিপদে পড়তে পারে। শুধু ভাবে বন্ধুত্বটা যেন এমনি থাকে চিরকাল। একদিন তো বলেই ফেললো,"ইশ্ আমরা যদি ফ্যামেলি ফ্রেন্ড হতে পারতাম!একদিন মিসেসকে আর ছেলেকে নিয়ে এসোনা বাড়ীতে।"
হাসে সিদ্ধার্থ ," তাই নাকি, তোমার হাবি কিছু বলবে না?"
....."আরে না, ও তো তোমাকে চেনে,তুমি না থাকলে তো আমাদের লোনটাই পাওয়া হোত না।"
অবাক হয়ে যায় সিদ্ধার্থ সত্যি খুব সরল মনটা ওর,তবে এতো সরল হওয়া বোধহয় ভালোনা। এরাই জীবনে ঠকে আর ধাক্বা খায়।
দেখা করার পর থেকে সিদ্ধার্থ কেমন যেন কথা বলা কমিয়ে দিয়েছে। মাঝে মধ্যে দুএকটা ছবি পাঠায় তাও সব দিন নয়। মনটা খারাপ হয়ে যায় খুব কোন কাজেই মন দিতে পারেনা, টেক্সট করলে রিপ্লাই পায়না। অনেকক্ষণ বাদে বলে বিজি ছিলাম।
চকোলেট ডে ছিলো সেদিন, তনুজা একবাক্স চকোলেট নিয়ে আবার দেখা করেছিলো সিদ্ধার্থের সাথে ওর অফিসের কাছাকাছি একটা ক্যাফেতে। সিদ্ধার্থের ব্যস্ততা ছিলো তাই খুব একটা বেশি কথা হয়নি সেদিন।
শুধু সিদ্ধার্থ বলেছিলো," তুমি এত নেট নির্ভর জীবন করে বেঁচোনা,আর আমাকে ভুল বুঝোনা। আমি আছি, হয়ত একটু ব্যস্ত থাকি। নিজের ভালোলাগাগুলোকে বাঁচিয়ে রাখো তনুজা। কোন মানুষকে অবলম্বন করে কেন বাঁচবে জীবনে।"
....."তাহলে আমাদের মধ্যে এতদিন যে কথাগুলো হয়েছিলো।"
....."তুমি কি পারবে তোমার হাবিকে ছেড়ে আমার কাছে চলে আসতে?"
মাথা নীচু করে তনুজা সত্যি তো শুভকে ছেড়ে ও থাকতে পারবেনা। আর এই বয়সে ছেলের কাছেই বা কি করে মুখ দেখাবে। ভাবতেই পারেনা, মাথাটা ঘুরে যায়।
হাসে সিদ্ধার্থ,"আমিও পারবোনা আমার ফ্যামিলিকে ছাড়তে। এটাই সত্যি, খুব বাস্তব। সংসারটা আমাদের অভ্যেস আর চ্যাটিংটা নেশা। তাই নেশাকে জয় করতে শেখো। নিজেকে ভালো ক্রিয়েটিভ কাজে ইনভলভ্ করো। আমি চাই তুমি ভালো থাকো।"
বাড়ী ফিরে আসে তনুজা, ঐ একটু শপিং এ বেড়িয়েছিলো তার ফাঁকেই দেখা করা একটু। খুব রাগ হয় সিদ্ধার্থের ওপর। হাই, হ্যালো করে একসময় কত গল্প করেছে এখন যেই দেখেছে ও নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে তখন পালাতে চাইছে, ইগনোর করছে তনুজাকে। দুদিন রাগ করে কথা বলেনা,সিদ্ধার্থ বুঝতে পারে রাগ হয়েছে তনুজার। একটা দুটো ইমেজ আর ভিডিও পাঠায়। তনুজার মন ভালো হয়ে যায় মিস্ করে সিদ্ধার্থকে। তবুও যেন কোথাও একটা আলগা আলগা ভাব ভালো লাগেনা তনুজার।
এইসব নিয়ে একটু মান অভিমান করাতে সিদ্ধার্থ বেশ কড়াভাবে এমন কিছু কথা বলে মন ভেঙে যায় তনুজার। মনে সারাক্ষণই ঘুরতে থাকে কথাগুলো, খুব রাগ করে একটা মেসেজ করে সিদ্ধার্থকে। সিদ্ধার্থ কোন রিপ্লাই দেয়না। তারপর আর কোন যোগাযোগ হয়নি ওদের। হয়ত দুজনেই ভেবেছে দুজনের কথা কিন্তু কেউই কথা বলেনি।
সিদ্ধার্থ হয়ত বুঝতে পেরেছিলো তনুজাকে এভাবে ফ্লার্ট করাটা উচিৎ হয়নি, তনুজা এই ইগনোরেন্স টা নিতে পারবেনা জেনেও করেছিলো যাতে তনুজা আর কষ্ট না পায়। আরো বেশি ডিপ্রেসড না হয়ে পড়ে। খারাপ লেগেছিলো সিদ্ধার্থর খুব। কয়েকদিন অনলাইনে আর তনুজাকে দেখতে পায়নি সেদিনের ঘটনাটার পর।
তনুজা কেঁদেছিলো খুব একা একা,সিদ্ধার্থ বোধহয় নতুন করে চিনতে শেখালো ওকে জীবনের মানে। এতো খেলা খেললো কেন ও? এরাই বোধহয় ছদ্মবেশী বন্ধু, আসলে সবাই স্বার্থপর। তবুও নিজেকে নতুন করে গুছিয়ে নেবার চেষ্টা করেছিলো আবার। কি এমন ছিলো সিদ্ধার্থ, বন্ধু ছাড়া? হয়ত ভগবান সবটাই ভালোর জন্যই করেন। এই আঘাতটা হয়ত দরকার ছিলো ঘুরে দাড়ানোর জন্য।
তাই সম্পর্ক গুলো আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরেছিলো তনুজা।নিজেকে শাসন করেছিলো,বুঝিয়েছিলো। স্বামীকে আরো বেশি কাছে টেনে নিয়েছিলো। অপরাধবোধে ভুগেছিলো ঐ মানুষটাকে ঠকানোর জন্য। মিথ্যে কথা বলে সিদ্ধার্থর সাথে দেখা করার জন্য। কাজের মধ্যে ডুবিয়েছিলো নিজেকে আরও বেশি করে।ছুঁড়ে ফেলে মোবাইল ভালোবেসেছিলো নিজেকে আর পরিবারকে।
নিজের হারিয়ে যাওয়া ভালোলাগা গুলোকে একটু একটু করে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিলো জীবনে। আলগা দেওয়া সংসার আর সম্পর্ককে বেঁধেছিলো ভালবাসার বাঁধনে। তবে কখনোই ব্লক করেনি সিদ্ধার্থকে এখনকার ছেলেমেয়েদের মত।
প্রায় মাসখানেক পর আবার হোয়াটসআ্যপে ফিরেছিলো তনুজা। দুজনেই হয়ত দুজনের লাস্ট সিনের সময় দেখতো, কিন্তু আর কথা বলেনি।
প্রায় মাসছয়েক বাদে হঠাৎ একদিন ফেসবুক খুলে সিদ্ধার্থ দেখে তনুজা ফেসবুকে আ্যকাউন্ট খুলেছে আ্যড ফ্রেন্ডে নাম দেখে ওর। প্রোফাইলে উঁকি মারে সিদ্ধার্থ, দেখে তনুজার ইউরোপ ট্রিপের ছবি। আরও বেশি সুন্দরী আর ব্যক্তিত্বময়ী লাগছে তনুজাকে।
তনুজার রান্না এখন ইউটিউবে, আবৃত্তিগুলো কখনো ইউটিউবে আর ফেসবুকে। প্রচুর ফলোয়ার্স ওর। একসময় তনুজা কথা বলার অপেক্ষায় বসে থাকতো এখন তনুজার একটু মেসেজের অপেক্ষায় বসে থাকে অনেকেই।
সম্পর্কের টানাপোড়েন বোঝে তনুজা। ফেসবুক হোয়াটসআ্যপে আলাপের লিমিট কতটা রাখতে হয় সবটাই তার জানা। এখন আগের ইমোশনাল বিহেভগুলো মনে করলে রীতিমত হাসি পায় তনুজার।
তবে বুকের মধ্যে মাঝে মাঝে খচখচ করে যন্ত্রণাটা, অপমান করে সিদ্ধার্থকে অতগুলো কথা না বললেই পারতো। সিদ্ধার্থর জন্যই তো মোড় ঘুরেছে ওর জীবনের। সব খারাপের হয়ত একটা ভালো দিক থাকে। সিদ্ধার্থর হয়ত সেদিন খুব খারাপ লেগেছিলো কিন্তু কোন উত্তর দেয়নি।
সিদ্ধার্থর কাছে ফোন একটা ফোন আসে প্রায় একবছর বাদে একটা আননোন নম্বর থেকে," হ্যালো, কে বলছেন?" কি আশ্চর্য! কোন কথা নেই অথচ ফোনটা ধরে আছে। সিদ্ধার্থ হঠাৎই বলে ওঠে ,"তনুজা"। ওপাশ থেকে সেই আবেগী গলাটা শোনা যায়," কি করে বুঝলে? আমি জানি তুমি ব্যস্ত তবুও বেশি সময় নেবোনা। শুধু একটা কথা বলবো। সরি সেদিনের মেসেজের জন্য।"
....."অমন করে বোলোনা তনুজা। আমি তোমায় একটু বাদে ফ্রী হয়ে কলব্যাক করছি ওকে।"
প্রথমেই তনুজা অনেক দুঃখ প্রকাশ করে সেদিনের মেসেজটার জন্য। সিদ্ধার্থকে অনেক কথাই রাগের মাথায় বলেছিলো। সিদ্ধার্থ বলে," দোষটা তো আমারই তনুজা, তুমি আলাপ করতে চেয়েছিলে, বন্ধু হতে চেয়েছিলে। আমি তোমায় ফ্লার্ট করেছিলাম। তারপর তোমায় যখন দেখলাম, তোমার সরল নিষ্পাপ মুখটা দেখে কেন যেন খুব অপরাধবোধ হয়েছিলো। সব খেলা বোধহয় সব সময় ভালো লাগেনা। তুমি সিরিয়াস হচ্ছো দেখে আমি সরে যাই।"
......তনুজার গলাটা একটু ভারী হয়ে যায় হয়ত দুফোঁটা জলও জমে চোখের কোণায়," তবুও বলে তোমায় ধন্যবাদ দেওয়ার ভাষা নেই আমার। তোমার জন্যই হয়ত সম্পর্কগুলো আবার নতুন করে চিনেছি, ভালোবেসেছি। আসল নকলে ভেদ করতে শিখেছি। নিজের প্রতিভাগুলোকে আবার খুঁজে পেয়েছি। দুঃখের আগুনে নিজেকে পুড়িয়ে আমি এখন খাঁটি সোনা। তোমার প্রতি আমি চিরকৃতজ্ঞ।
মনটা ভরে যায় সিদ্ধার্থর তবুও এই ছোট্ট জীবনে হয়ত একটা ম্যাজিক টাচ দিতে পেরেছে তনুজার জীবনে। এখনকার ফেসবুক প্রেমের মত আরও বেশি কোন খারাপ ক্ষতি করেনি তনুজার, যদিও প্রথমে ব্যাপারটা ফান মনে হয়েছিলো কিন্তু পরে ভগবানই হয়ত সুবুদ্ধি দিয়েছিলো ওকে।তনুজার মত একটা সরল সাধাসিধে ভালো মানুষের সাথে গেম খেলতে ইচ্ছে হয়নি।
বহুদিন বাদে সিদ্ধার্থর সাথে কথা বলে তনুজারও খুব ভালো লেগেছিলো, কাউকে আঘাত করে খারাপ কথা বলা ওর স্বভাব নয়।তাই তনুজারও আজ বড় হাল্কা লাগে নিজেকে, একটা ভারী বোঝা নেমে যায় বুক থেকে।
ওদের মিষ্টি বন্ধুত্বটা এখনো আছে, যদিও ওদের মধ্যে আর নিয়ম করে কথা হয়না। এখন আর তনুজাকে সিদ্ধার্থকে মেসেজ করার জন্য বাইরের বারান্দায় বেড়িয়ে আসতে হয়না। সিদ্ধার্থ ফোন করলে শুভর সামনেই ফোন ধরে তনুজা। কখনো শুভই ফোনটা এনে দেয় রান্নাঘরে, মিষ্টি হেসে বলে,"তোমার বন্ধু তনু, এই নাও।"
তনুজা মনে মনে বলে বন্ধুত্বগুলো এভাবেই থাক বেঁচে চিরকাল, অবৈধ কিছু নয়।
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment