#সারোগেসি#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
"হ্যালো?
উফ্ আবার ফোনটা কেটে দিলো!
এখনো ব্যাস্ত?
ব্যাস আর কি ভয়েস কলের একঘেঁয়ে উত্তর দান শুরু। যাচ্ছেতাই।
সত্যি এই ছেলেটাকে নিয়ে আর পারা যায় না। সারাদিন রুগী, চেম্বার। ইনফার্টিলিটি ক্লিনিক এইসব নিয়ে মেতে রয়েছে। মহা কাজ পাগল ছেলে, একবার কাজের মধ্যে থাকলে বাড়ীর কথা ভুলে যায় একদম। এইতো সেদিন পাশ করে বেরোলো যেন মনে হয়। তবুও এর মধ্যেই বেশ নাম করেছে ছেলেটা।
ছেলে ফোন না ধরাতে বিরক্ত হলেও ওর কথা ভাবলেই মা হিসেবে সত্যিই গর্ব হয় নন্দিনীর। পোষ্ট গ্ৰ্যাজুয়েশন এর সময় গাইনিতেই স্পেশালাইজেশন করলো ধৃতিমান। একটু আপত্তি করেছিলো নন্দিনী কিন্তু ছেলের উৎসাহ দেখে আর না করতে পারেনি। কেন যেন এক অদ্ভুত টান ছিলো ওর এই বিষয়টার ওপর অথচ অনেক ছেলেই গাইনোকোলজি নিতে চায়না।
হয়ত পছন্দের বিষয়ে পড়াশোনা করেছে তাই এত প্রতিষ্ঠা পেয়েছে এই বয়সেই।
নন্দিনীর আর সৌমেন্দুর বিয়ের প্রায় আটবছর বাদে ওদের কোলে এসেছিলো ধৃতি। কলেজ পেরোতেই বিয়ে হয়ে গিয়েছিলো নন্দিনীর শোভাবাজারের রক্ষণশীল অভিজাত পরিবারে। বিয়ের দুবছর পার হতে না হতেই বাড়ীর সবার কথার বাণে বিদ্ধ হয়ে দিন কাটতো নন্দিনীর। ছেলেপুলে কেন এখনো হচ্ছেনা সেটাই ছিলো মূল আলোচনা। যদিও সৌমেন্দু সব সময় পাশে ছিলো নন্দিনীর। চারবছর পার হওয়ার পরও নানা চিকিৎসায় যখন নন্দিনী মা হতে পারলোনা তখন কখনও সামনে অথবা পেছনে শুনতে হত ও বাজা মেয়েমানুষ।
দিদি শাশুড়ী তো প্রায় বলতেন," শোন লো বাজা মেয়েমানুষকে শুভ অনুষ্ঠানে থাকতে নাই। তোর তো হাতের জলই শুদ্ধ না।" কখনও বা শ্বশুর মশায় বাইরে বেরোনোর সময় ওকে বলতেন ,"সবাই যখন শুভ কাজে বেরোয় তুমি বেরিয়োনা বাপু।"
সবচেয়ে খারাপ লেগেছিলো সেদিন, যেদিন ওর ছোট জায়ের সাধের অনুষ্ঠানে ওকে থাকতে দেওয়া হয়নি।
সৌমেন্দুর কাছে রাত্রে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলো সেদিন,"আমি কিছু চাইনা গো, তুমি যেখান থেকে পারো আমাকে একটা সন্তান এনে দাও। এই মানসিক যন্ত্রণা আমি আর সহ্য করতে পারছি না গো। সারাদিন কিছু খাওয়াদাওয়াও করেনি ও। সৌমেন্দু শুধু বলেছিলো,"আমি তো আছি নন্দিনী তোমার সাথে, তোমার চিন্তা কি? একটুও ভেবোনা। ভগবান নিশ্চয় কোন একটা সমাধান করে দেবেন।"
মানসিক অশান্তিতে যখন বিপর্যস্ত নন্দিনী ঠিক সেই সময় সৌমেন্দুর লন্ডনে যাওয়ার সুযোগ এসে যায়। সুযোগটা হাতছাড়া করেনি সৌমেন্দু যদিও বাড়ীর বেশ আপত্তি ছিলো বৌ নিয়ে বিদেশে যাওয়াতে, তবুও নন্দিনীকে যে ওকে ভালো রাখতেই হবে। কারণ বিয়ের সময় ছোটবেলায় মা বাবা হারানো নন্দিনীর দাদুকে ও কথা দিয়েছিলো নন্দিনীকে ভালো রাখবে। নন্দিনীর দাদু আর সৌমেন্দুর দাদু বন্ধু ছিলেন।
এক ঝলক শান্তির হাওয়া এসেছিলো নন্দিনীর জীবনে লন্ডনে থাকার দিনগুলোতে। অনেকবছর বাদে নন্দিনী আবার খুঁজে পেয়েছিলো নিজেকে। তবুও মাঝে মাঝেই মনে হত চারবছর বাদেই তো আবার ফিরতে হবে দেশে। তখন কি হবে?
বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা শুরু হয় নন্দিনীর,সৌমেন্দু আর নন্দিনীর সব পরীক্ষা হলো। ওখানকার আধুনিক প্রযুক্তির সব চিকিৎসায় চলতে শুরু করলো।
ওখানে বেশ কিছু বন্ধু হয়ে গিয়েছিলো সৌমেন্দু আর নন্দিনীর। তারা অনেকেই বিদেশী আবার কেউ কেউ ভারতীয় বা বাংলাদেশি। উইকএন্ডে প্রায়ই যেতো ওরা একে অপরের বাড়ীতে। সৌমেন্দুর অফিসের একটি আ্যংলো মেয়ে এলিন প্রায়ই ওদের বাড়ীতে আসতো। সৌমেন্দুকে ও বিগ ব্রাদার বলতো। নন্দিনীর সন্তান ছিলোনা আর এলিনের সন্তান থেকেও ছিলোনা। খুব মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিলো এলিন একা একা লড়াই করতে করতে। সেপারেশনে আছে ওরা কিন্তু বাচ্ছাটাকে কিছুতেই ওর স্বামী ওকে দিচ্ছেনা।
আর্থিক জোর খুব বেশি না থাকায় ও ভালো ল ইয়ার রাখতে পারছেনা। নিজেদের সন্তান না থাকলেও সৌমেন্দু আর নন্দিনীর খুব কষ্ট হত এলিনকে দেখে। বাচ্ছাটাকে কাছে পাবার জন্য খুব ছটফট করতো এলিন।
সৌমেন্দুর এক বন্ধুর সাহায্যে ভালো একজন ল ইয়ার ওরা ঠিক করে দিয়েছিলো এলিনের পক্ষে। সব রকম সাহায্য করে ফিরিয়ে দিয়েছিলো ছোট্ট মিষ্টি ইভকে এলিনের কাছে।
এখনো ভাবলে স্পষ্ট দেখতে পায় সেইদিনটা, এলিন কি পরম কৃতজ্ঞতায় জড়িয়ে ধরেছিলো সৌমেন্দু আর নন্দিনীকে। মেয়েকে কাছে পেয়ে যেন জীবন পেয়েছিলো মেয়েটা। নিজের সন্তান না থাকলেও নন্দিনী অনুভব করেছিলো সন্তান ফিরে পাওয়ার আনন্দটা কত গভীর হতে পারে।
এদিকে নন্দিনীর আর সৌমেন্দুরও চিকিৎসা চলছে তখন। অনেক পরীক্ষার পর জানা গেলো নন্দিনীর জরায়ু কৃত্রিমভাবেও ভ্রূণ সংস্থাপনের জন্যও উপযুক্ত নয়। টেষ্টটিউব বেবির অপসন টা কাজ করলোনা। খুব হতাশ লাগে আবার নন্দিনীর, সৌমেন্দুর কাজ শেষ হয়ে গেলে দেশে ফিরলেই আবার তো শুনতে হবে পুরনো কথাগুলো,বাজা ,অপয়া, তোমার তো আর ছেলেপুলে হলোনা।
আ্যডপ্ট করাতেও বাড়ীর কারো মত নেই। তাহলে হয়ত বাচ্ছাটাকে শুনতে হবে কার রক্ত শরীরে বইছে কে জানে?
ডাক্তাররা বললেন একমাত্র উপায় সারোগেসি যদি এমন কাউকে পাওয়া যায় যার গর্ভে প্রতিস্থাপন করা হবে ওদের শুক্রাণু আর ডিম্বাণু। তাহলেই একমাত্র সন্তান হওয়া সম্ভব ওদের। আশাকরা যায় আইভিএফ পদ্ধতিতেই সাকশেসফুল হবে ওরা। এরজন্য দরকার একজন বায়োলজিকাল মাদারের। কারণ নন্দিনীর ইউটেরাস সাপোর্ট করতে পারছেনা।এছাড়া আর কোন উপায় দেখছেন না।
তখনও দেশে খুব বেশি প্রচলন হয়নি সারোগেসির। তাছাড়া কাকে ওরা রাজী করাবে ওদের সন্তানের বায়োলজিকাল মাদার হতে।
আশা হারিয়ে ফেলে নন্দিনী আর সৌমেন্দু। কে রাজি হবে? কাকে পাবে ওরা সারোগেসির জন্য। আর কোনদিনই ওদের জীবনে সন্তান আসবেনা হয়ত।
অদ্ভুত ভাবে এগিয়ে এসেছিলো সেদিন এলিন বলেছিলো,"তোমাদের জন্য আমি আমার মেয়েকে পেয়েছি, বিগ ব্রাদার না থাকলে আমার পাশে আমি কি ইভকে পেতাম। বেবি না থাকার কষ্ট আমি বুঝি গো। আমি হবো তোমাদের বেবির সারোগেটেড মাদার। সিস্টারের চোখের জল আমার ভালো লাগেনা। যীশু ঠিক তোমাদের দুঃখ দূর করবেন।"
আশ্চর্য হয়ে যায় নন্দিনী আর সৌমেন্দু, সত্যিই কি ভালো কাজ করলে আনএক্সপেকটেড রিওয়ার্ড পাওয়া যায়? তবুও দ্বিধা কাটেনা সৌমেন্দুর এলিন একা ডিভোর্সি মেয়ে, যদি ওর বদনাম হয়। যদিও নন্দিনী ততক্ষণে তার অন্ধকার জীবনে আলোর স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে।
সৌমেন্দু বলে,"কিন্তু এলিন তোমাকে সবাই কি বলবে? সবাই জানতে চাইবে তোমার এই প্রেগন্যান্সি কিভাবে এলো কারণ তুমি একা থাকো। তাছাড়া ইভকে কে দেখবে?"
হেসে উত্তর দেয় এলিন ," ব্রাদার এটা বিদেশ, ইন্ডিয়া নয়। কেউ কিছু বললে আমি বলবো আমি সারোগেসি করছি টাকার জন্য। ইভকে তো আমাকে বড় করতে হবে। আর ইভকে দেখার জন্য আমি আর সিস্টার দুজনেই আছি, নো প্রবলেম। তোমাদের ডক্টর আগে আমাকে এক্সামিন করুক এত ভেবোনা ও কে।"
ডাক্তার পরীক্ষা করে দেখেন এলিনকে, সব
ও কে বলেন। অনেক টেষ্ট এর পরে এলিনের গর্ভে প্রতিস্থাপন করেন ডাক্তার ওদের শুক্রাণু আর ডিম্বাণু। দিন গোনা শুরু হয়ে যায় ওদের। ওদের আ্যপার্টমেন্টের পাশের আ্যপার্টমেন্টেই এনে রেখেছে ওরা এলিন আর ইভকে। নন্দিনী তো একমূহুর্ত চোখের আড়াল করেনা এলিনকে। আর ইভ যেন একটা ছোট্ট মিষ্টি পরী ওদের জীবনে। ভালো ভালো ডিশ রান্না করছে নন্দিনী,এলিন কি খাবে,কখন ওষুধ খাবে। চেক আপ করানো,ওর রেষ্ট হচ্ছে কিনা সব দায়িত্ব নন্দিনীর।
এরমাঝে সৌমেন্দু জানিয়েছিলো বাড়ীতে নন্দিনী মা হতে চলেছে। এখন ভাবে নন্দিনী ভাগ্যিস তখন ভিডিও কল,ভিডিও চ্যাট ছিলোনা তাহলে আর দেখতে হতনা। শোভাবাজারের বাড়িতে ঝড় উঠে যেত।
যেদিন এলিন বললো বেবি মুভ করছে, এলিনের পেটে হাত দিয়ে সমস্ত মন শরীর আর ভালবাসা দিয়ে নন্দিনী অনুভব করলো ওদের সন্তানের অস্তিত্ব। অপেক্ষার শেষে এলিনের কোল আলো করে এলো সৌমেন্দু আর নন্দিনীর স্বপ্ন ওদের পুত্রসন্তান। এলিন যখন ছেলেকে তুলে দিলো নন্দিনীর কোলে সেদিন ওদের তিনজনের চোখেই ছিলো আনন্দের অশ্রু। নন্দিনীর সেদিন দেবী মনে হয়েছিলো এলিনকে। এলিনের ও মনে হয়েছিলো হয়ত স্বার্থক জন্ম তার।
নন্দিনীর সেদিনের সেই ছেলে আজকের নামকরা গাইনোকলজিস্ট ধৃতিমান। ধৃতির যখন একবছর বয়স তখন ওরা বিদেশ থেকে চলে আসে। এলিন যদিও কখনও কোন দাবী রাখেনি ধৃতির ওপর তবুও ধৃতিকে ভীষণ ভালোবাসত। জন্মের পর তো ওর বুকের অমৃতসুধাই ধৃতিকে সুস্থ রেখেছিলো। বেশ অনেকদিন ধৃতিকে ব্রেষ্ট ফিড করিয়েছিলো এলিন। ইভও খুব খুশি ছিলো লিটল আ্যন্জেলকে পেয়ে।
ওদের দেশে আসার কদিন আগে থেকেই খুব মন খারাপ করছিলো এলিনের। সৌমেন্দু আর নন্দিনীরও খুব খারাপ লাগছিলো এলিন আর ইভের জন্য। কিন্তু সৌমেন্দুর কাজ শেষ তাই আসতেই হলো। নন্দিনীর ও হয়ত সুপ্ত ইচ্ছে ছিলো দেশে ফিরে নিজের মত করে সন্তান মানুষ করা। এলিনের আপত্তি সত্ত্বেও নন্দিনী আর সৌমেন্দু সবরকম ভাবে গুছিয়ে দিতে চেয়েছিল এলিনের ইভের জীবন। সত্যিই এলিনের মহানুভবতার কাছে ভালবাসা আর শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে যায় ওদের।
ধৃতিকে নিয়ে ফিরে আসে ওরা, এক ঝলকেই যেন নন্দিনীর ওই বাড়ীতে বেড়ে গেলো অনেকটাই কর্তৃত্ব। ভালোবাসারও কোন ঘাটতি হলোনা, সবাই মাথায় তুলে রাখলো ওকে। শুধু নিন্দুকেরা মুখ বেকিয়ে আড়ালে বললো বিদেশে গিয়ে এককাড়ি টাকা খরচা করে বাচ্ছা নিয়ে এলো। টাকার তো আর অভাব নাই। খুব ঘটা করে পার্টি দিয়েছিলো সৌমেন্দু, নন্দিনী সেদিন রানীর মত ধৃতিমানকে কোলে নিয়ে অতিথি আপ্যায়ন করছিলো। এইভাবেই নন্দিনীর মুখ লুকিয়ে থাকার দিন শেষ হয়েছিলো।
ধৃতি বড় হবার পর অবশ্য ওরা আলিপুরে নতুন ফ্ল্যাটে চলে এসেছিলো। সৌমেন্দুর সাথে মেলে বা ফোনে যোগাযোগ হত এলিনের। ধৃতি যখন ছোট ছিলো তখন ফোনে মাঝে মাঝে নন্দিনীর সাথেও কথা হত। তবে ধৃতি বড় হবার পর একটু সাবধানী হয় ওরা। তবে ধীরে ধীরে যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে যায় ওদের সাথে এলিনের।
ধৃতি বরাবরই খুব ভালো ছাত্র ছিলো। নিজের পছন্দের বিষয় নিজেই বেছে নিয়েছিলো। লন্ডনে গিয়ে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে এসেছে। আর ওদেশে পড়াশোনার সব সুযোগই ছিলো ধৃতির কারণ জন্মসূত্রে ওতো ওই দেশেরই নাগরিক।
ধৃতি যখন লন্ডনে তখন খুব মনে হয়েছিলো নন্দিনীর এলিনের কথা। ইশ কতদিন দেখা হয়নি এলিনের সাথে অথচ একসময় ওর মত পরমাত্মীয় ওদের বোধহয় আর কেউ ছিলোনা। সৌমেন্দু বলেওছিলো," যাবে নাকি আমাদের ফেলে আসা অতীতে?ছেলেটা তো ওখানেই আছে। আমরাও একবার ঘুরে আসি ওখান থেকে। পুরনো ঠিকানায় একবার খুঁজে দেখবো এলিনকেও। অনেকদিন কোন যোগাযোগ নেই।"
কিন্তু কখনই নন্দিনী জানাতে চায়নি ধৃতিকে ও সারোগেটেড বেবি। সৌমেন্দু যদিও বলেছিলো," এবার ওকে বলো এখন তোমার ছেলে বড় হয়েছে। কি হয়েছে নন্দিনী এখন তো এদেশেই এভাবে বেবি হচ্ছে।"
এলিনকে খুব ভালোবাসলেও কোথায় যেন একটু দ্বিধা ছিলো নন্দিনীর। তাই বলেছিলো,"কি দরকার গো অতীতকে আবার সামনে আনার, থাকনা।"
কিন্তু সৌমেন্দু পুরোটা দেখে যেতে পারেনি। হঠাৎই চলে গেছিলো সৌমেন্দু,তবে ততদিনে দেশে ফিরে এসেছিলো ধৃতিমান। নন্দিনীর বারবার মনে হয় আজকের ধৃতিকে দেখলে কত খুশি হত সৌমেন্দু। বড় একা লাগে নন্দিনীর তাই দিনের মধ্যে বেশ কয়েকবার ফোন করে ছেলেকে। এখনও বিয়েতে রাজী করানো গেলোনা ছেলেটাকে।
ছেলে ফোন না ধরলে প্রচুর মান অভিমানের পালা চলে মা ছেলের। ধৃতিমান বলে,"আচ্ছা মা,তুমি যদি সারাদিন ছেলে ছেলে করো, ছেলেকে আগলে রাখতে চাও ,তাহলে একবার ভেবে দেখতো কত মা সন্তানের জন্য ছটফট করছে তাদের কোলে সন্তান এনে দেবো কি করে বলতো? সন্তান না থাকার কি কষ্ট তুমি তো জানো মা।"
আনমনা হয়ে যায় নন্দিনী সত্যি তো এটা তো ভেবে দেখেনি কখনও। মনে পড়ে যায় ধৃতি আসার আগের সেই দুর্বিসহ দিনগুলোর কথা। গর্ব হয় ছেলের জন্য।
ধৃতি প্রায় প্রতিমাসেই বিদেশে যায় কখনও বা দুবারও যেতে হয়। ঐ সময় টা আরো একা লাগে নন্দিনীর। মাঝে মাঝেই ছেলেকে বলে, "অনেক হলো, এবার একটা বিয়ে কর তো। আমার আর একা একা সময় কাটেনা। আর তুই বাইরে চলে গেলে আরো বোর লাগে।"
........"ও সব ভুলে যাও মা, বিয়েটা হয়ত আমার আর করা হবেনা। কাজ করবো, না বিয়ে।" বলেই হেসে ফেলে ধৃতি।
..."ওসব আমি শুনছিনা সামনে বছরই আমি তোর বিয়ে দেবো।" বললো নন্দিনী।
....."তবে আর কি এখন তুমি মাথা খারাপ করছো এরপর বৌ জ্বালাবে। আমার কাজের কি হবে?"
ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে নন্দিনী হেসে বলে ,"পাগল ছেলে।"
মায়ের সাথে কথা বলতে বলতে হঠাৎ জিজ্ঞেস করে ধৃতি, "আচ্ছা মা এখন তো আমি ডক্টর। তোমার কাছে শুনেছি তোমার বিয়ের আটবছর বাদে আমি হয়েছি। তোমার কি প্রবলেম ছিলো গো?"
চমকে ওঠে নন্দিনী হঠাৎ এমন প্রশ্ন করছে কেন ছেলে?" সে অনেক কথা,কেনো রে হঠাৎ জিজ্ঞেস করছিস?এর আগে তো কখনো জানতে চাসনি।"
"নিজের জন্ম,ছোট্টবেলাটা জানতে ইচ্ছে করে মা,আমার প্রফেসনটা তো এখন এটাই মায়ের কোলে সন্তান তুলে দেওয়া। বলোনা মা"।
....অনেক কষ্ট পেয়েছি বাবু মা হতে পারছিনা বলে। কত পরীক্ষা,ওষুধ, অপারেশন শরীর যেন আর নিতে পারতোনা। তারপর লন্ডনে গিয়ে বাইরের চিকিৎসায় তুই এলি। আর ভাবতে ইচ্ছে করেনা সোনা,তোকে পেয়ে সব কষ্ট ভুলে গেছি। আর মনে করতে চাইনা।"
...."বাইরে কি ট্রিটমেন্ট হয়েছিলো তুমি জানো?"
নন্দিনীর অদ্ভুত লাগে এতো খুঁটিয়ে কি জানতে চাইছে ছেলে। বলবে ওকে পুরোটা। তবুও মুখটা আটকে যায়, উত্তর দেয়,"নারে অত ডিটেলসে বলতে পারবোনা। তোর বাবা থাকলে বলতে পারতো পুরোটা।"
চুপ করে যায় ধৃতিমান একটু হাসে মায়ের দিকে তাকিয়ে। বুঝতে পারে মা বলতে চায়না।
মাঝে কেটে গেছে প্রায় একবছর নন্দিনী ভীষণ ব্যাস্ত ছেলের মেয়ে দেখতে। ম্যাট্রিমনি সাইটে গাদা গাদা বায়োডেটা আসছে তারমাঝে সিলেক্ট করা যেন খড়ের গাদায় সূঁচ খোঁজা। ওর কাজপাগল ছেলের তো কোন মাথা ব্যাথা নেই।
আর ধৃতিমান ব্যাস্ত ওর নতুন ক্লিনিক নিয়ে। লন্ডনে ডক্টর রিচার্ডসন নতুন ক্লিনিক ওপেন করছেন, তার অনেকটা দায়িত্ব ধৃতির। ছেলে আগে থেকেই বলে রেখেছে এবার ক্লিনিকের ওপেনিং এ মাকে যেতেই হবে কোন কথাই শুনবেনা ও। আপত্তি করলেও কোন আপত্তিই টেকেনি নন্দিনীর, ছেলের জেদের কাছে।
প্রায় তেত্রিশ বছর বাদে লন্ডনে পা দিলো নন্দিনী ধৃতিমানের হাত ধরে। বড় মনে পড়ছে আজ সৌমেন্দুর কথা। কতই না খুশি হত মানুষটা আজ থাকলে। সৌমেন্দুর সাথে কাটানো বিদেশের মূহুর্ত গুলো জীবন্ত হয়ে ওঠে চোখের সামনে। আজ কত কথা মনে পরে যাচ্ছে। ওরা এয়ারপোর্ট থেকে সোজা ধৃতির আ্যপার্টমেন্টে এসেই ওঠে। সব ব্যাবস্থা আগে থেকে করাই ছিলো। ছেলে জিজ্ঞেস করে,"মা তুমি কি আজ একটু বেরোবে?তাহলে চলো,কাল থেকে আমি খুব ব্যাস্ত থাকবো।'
ছেলের সাথে বেড়িয়ে পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করলো নন্দিনী এমনকি ওদের পুরনো আ্যপার্টমেন্ট ও দেখালেন ধৃতিকে। আজ খুব মনে পড়লো এলিন আর ইভের কথা।
ক্লিনিক ওপেনিং এর দিন ধৃতি নন্দিনীকে নিয়ে গেলো সাথে। সবার সাথে আলাপ করিয়ে দিলো নন্দিনীকে। ডঃ রিচার্ডসন এর সাথে আলাপ করিয়ে দেয় ধৃতি," He's my Sir, my inspiration,my philosopher and guide." একটু চমকে ওঠে নন্দিনী এইতো সেই ডক্টর!তাহলে উনিই ধৃতির স্যার এইজন্যই মনেহয় ছেলেটা এতো ভালো হয়েছে। যেন মনে হয় ওনার চিকিৎসায় ছিলো ও । নিশ্চয় উনি চিনতে পারেননি নন্দিনীকে,সেটাই স্বাভাবিক।
এবার ওপেনিং সেলিব্রেশনের সময় যাকে খুব যত্ন করে জড়িয়ে ধরে গাড়ী থেকে নামালো ধৃতিমান তাকে দেখে নন্দিনীর মুখে আর কোন কথা সরলো না শুধু দুচোখ ভিজে গেলো জলে। এলিন.....এ কি করে সম্ভব। উত্তরটা ধৃতিই দিয়ে দিলো,আলাপ করিয়ে দিলো মায়ের সাথে,"মিসেস রিচার্ডসন, ডক্টর রিচার্ডসনের লাইফ পার্টনার। আমার আরেক মা, উনি আমার কাছে দেবীর মত। এইদেশে থাকাকালীন অনেক যত্ন করেছেন আমাকে।"
এতদিন বাদে দুজনের দুজনকে চিনতে একটুও অসুবিধে হয়নি। গত তেত্রিশ বছর এলিনের ছায়া দেখেছেন ধৃতির মধ্যে তবুও কি এক সঙ্কোচে ভয়ে কারো কাছেই বলতে পারেননি এলিনের কথা।
আজ এলিনের দৃঢ় আলিঙ্গনে আবদ্ধ নন্দিনী, অনেকদিন বাদে এক বোন আরেক বোনকে খুঁজে পেয়েছে। ধৃতি মাকে জিজ্ঞেস করে হেসে,"উনি কি তোমার পরিচিত?" মাথা নাড়ে নন্দিনী চোখে জল নিয়ে। এলিনের মুখে শুধু মিষ্টি হাসি। নন্দিনী জানতে পারে ডক্টর রিচার্ডসনের রিকোয়েস্টে ও আরো একবার সারোগেসি করে, এই ভাবেই পরিচয় বাড়ে ডক্টরের সাথে। ওনার স্ত্রীর মৃত্যুর পর ওদের বিয়ে হয়। ইভ সুইজারল্যান্ডে ওরও বিয়ে হয়ে গেছে।
ওপেনিং ক্যান্ডেল জ্বালাতে নন্দিনীর সাথে এলিনকেও ডেকে নেয় ধৃতি। ওর আ্যনাউন্সমেন্টে চমকে ওঠে নন্দিনী। আজ নন্দিনীর সাথে এলিনকেও মাতৃত্বের স্বীকৃতি দেয় ধৃতি। বলে ওর দুই মা একসাথে মিলে ওপেন করবে সেই ক্লিনিক যা আজ থেকে হাসি ফোটাবে হাজার হাজার মায়ের মুখে।
গর্বে বুক ভরে যায় নন্দিনীর মনে হয় কতজন্মের পুণ্যফলে এমন সন্তান পাওয়া যায় যে নিজের মায়ের সাথে সারোগেটেড মাদারকেও তার যোগ্য সম্মান দিয়েছে।
এলিনের সাথে কথা বলে নন্দিনী জানতে পারে মারা যাবার কিছুদিন আগে ছেলের হাতে ওর জন্মের সময়ের পুরো ফাইলটাই তুলে দিয়েছিলো সৌমেন্দু। জানিয়েছিলো ওর বায়োলজিকাল মাদারের কথা। ডক্টর রিচার্ডসন আর ম্যামকে আগে থেকেই চিনতো ধৃতি ,তাই খোঁজ পেতে খুব একটা অসুবিধে হয়না। কিন্তু তবুও ধৃতি চায়নি নন্দিনীকে আহত করতে, মায়ের সাথে কথা বলে ও বুঝেছিলো নন্দিনী হয়ত সন্তানের কাছে এই সত্যিটা আড়াল করতে চায়। তাই এই পরিকল্পনাটা পুরোটাই ছিলো ওর।
সৌমেন্দুর অসম্পূর্ণ কাজ আজ পুরোপুরি সম্পূর্ণ করলো ধৃতিমান তার দুই মাকে মিলিয়ে দিয়ে। নন্দিনীর চোখে জল, ধৃতির মুখে বিজয়ীর হাসি। সে মাতৃত্বকে দিতে পেরেছে তার যোগ্য সম্মান।
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment