#হলুদ_শাড়ী#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
"কি গো সরস্বতী ঠাকুরটা কখন কিনতে যাবে শুনি? সারাদিন পেপার নিয়ে বসে থাকা। যত বয়েস বাড়ছে ভীমরতি বাড়ছে।"
গিন্নীর গর্জনে চমকে ওঠেন মোহিতবাবু। অগত্যা কিছু করার নেই, উঠতেই হলো। যো হুকুম বলে প্যান্ট শার্ট গলিয়ে গুটি গুটি রওনা দিলেন কুমোরটুলির দিকে। দরদাম করে পছন্দ করে ছোটখাটো সর্বসুলক্ষণা সরস্বতী নিলেন। মনে মনে ভাবলেন বেশ ভালোই হয়েছে ঠাকুরটা, এবার খুব একটা দাম বাড়েনি গতবারের থেকে। বাড়ীর গিন্নীর পছন্দ হলেই হলো ভাবতে ভাবতেই টানা রিক্সা ডেকে মাকে কোলে করে নিয়ে একেবারে বাড়ীতে।
কর্তার আওয়াজ পেয়েই উলু দিয়ে আর শঙ্খ বাজিয়ে মাকে ঘরে তুলে বেশ খুঁটিয়ে দেখে সরমা বললেন," বাহ্ বেশ সুন্দর পছন্দ করেছো ঠাকুর, মুখটা খুব সুন্দর আর পরনের হলুদ শাড়ীতে বেশ মানিয়েছে।"
গিন্নীর হলুদ শাড়ীর কথায় মোহিতবাবুর ষাটের মনটা হঠাৎ ছুটে গেলো ফেলে আসা বাইশের বসন্তের দিকে। পাড়ার সরস্বতী পূজোর দিন অঞ্জলি দেওয়ার সময় হঠাৎ চোখটা আটকে গেছিলো হলুদ শাড়ী পড়া একটা নতুন মুখের দিকে। এর আগে কখনো দেখেননি, কিন্তু কি আশ্চর্য সুন্দর মুখখানা। সরস্বতী মায়ের দিকে চোখ না গিয়ে বার বার চোখ আটকে যাচ্ছিলো সেই হলুদ শাড়ীর দিকে। অঞ্জলির মন্ত্রও সেদিন ভুলভাল বলেছিলেন তাই বোধহয় মা সরস্বতী রেগেমেগে চোখে সর্ষে ফুল দেখিয়ে ছেড়েছিলেন।
পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছিলেন মেয়েটির নাম মালবিকা, মোড়ের মাথার যে বাড়ীতে নতুন ভাড়া এসেছে ওনাদের ভাগ্নী হয়। বেড়াতে এসেছে মামাবাড়ীতে সরস্বতীপূজো উপলক্ষ্যে। প্রথম দেখাতেই পুরো ফিদা হয়ে গেলেও মালবিকা তখন নেহাতই ছেলেমানুষ তাই দু একটা চোরা চাউনি ছাড়া আর তেমন কিছু পাননি ওই তরফ থেকে। তবুও আলাপ জমাতে চেষ্টা করেছিলেন, কিছুটা আলাপ জমেছিলো ওই বন্ধুদের মাধ্যমে। কিন্তু তা আর বেশিদূর এগোতে পারেনি, মালবিকা চলে গিয়েছিলো পাটনাতে।
তখনকার দিনে ঐসব মোবাইল ফোন টোন ছিলোনা তাই আর যোগাযোগ হয়নি। তবুও মনের কোণে মাঝেমাঝেই উঁকি মারতো মালবিকার হলুদশাড়ী পরা মিষ্টি মুখটা। পরের বছর সরস্বতী পূজোয় আবার এসেছিলো মালবিকা। মুগ্ধ হয়েছিলেন মোহিত, আরও সুন্দর হয়েছে মালবিকা একদম সদ্য ফোঁটা ফুলের মত। যথারীতি অঞ্জলি দেওয়ার সময় মালবিকার হলুদ শাড়ী আর লম্বা চুলেই মনটা আটকে গিয়ে আবার ভুলভাল মন্ত্র বললেন মোহিতবাবু।
নাহ্ অনেক হয়েছে এবার আর দেরী নয়। মালবিকাকে বলতেই হবে মনের কথা যেমন করেই হোক। সামনাসামনি বলার সাহস পাননি যদি রাগ করে।অনেক চেষ্টা করে খুব সুন্দর করে মনের কথা জানিয়ে একটা চিঠি মানে প্রেমপত্র লিখলেন সাহস করে। এ যুগের ছেলে হলে হয়ত মুখের সামনে গিয়ে কারো তোয়াক্কা না করেই বলে আসতো মনের কথা। নিজের ছেলেকেই তো দেখছেন দিনরাত মা বাবার সামনে প্রেমিকার সাথে গুজগুজ করছে ফোনে। আজ এই হোটেলে খেতে যাচ্ছে তো কাল ওখানে, পরশু কোন শপিং মলে। লাজলজ্জার বালাই নেই। শুধু সরমা রাগ করে বলে এখনো বাড়িতে আনতে পারেনি।
সুন্দর করে লেখা প্রেমপত্র মালবিকার মামাতো ভাইকে চকোলেট আর ফুচকা ঘুষ দিয়ে, ওর হাতে দিয়েছিলেন। কিন্তু কপাল খারাপ থাকলে যা হয়, শেষরক্ষা হলোনা। চিঠি পড়লো মালবিকার মামার হাতে, কেস পুরো জন্ডিস আর কেলেঙ্কারির একশেষ,বাবা ভীষণ বকেছিলেন। মালবিকাকে ভুলে যেতে হয়েছিলো, কারণ ওর মামারা ওই বাড়ীটা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন।
প্রথম ভালোলাগা বোধহয় ভোলা যায়না তাই বাইশের প্রেমে পড়া এখনো নষ্টালজিয়া হয়ে উঁকি মারে জীবনে।
"কি গো ভর সন্ধ্যেয় বসে স্বপ্ন দেখছো নাকি। চা টা পড়ে থেকে থেকে ঠান্ডা হয়ে গেলো।"
গিন্নীর ডাকে আবার বর্তমানে ফিরে আসেন, না এসে উপায় কি?
"শোন কাল অনেক কাজ, যা যা বলেছি সব সকাল থেকে করে রাখবে। আমাকে যেন আর বেশি বলতে না হয়। তোমার ছেলেকে দিয়ে তো আর কোন কাজ হবেনা। আর সন্ধ্যেবেলার কথা মনে আছে তো? কাল পুরুতমশায় ঠিক সময়ে এলেই হয়।"
গিন্নীর কথা শুনে চমক ভাঙে মোহিতবাবুর সত্যি তো কাল সন্ধ্যেবেলাতে তো একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। কাল তো ছেলের মেয়ে দেখতে যাওয়া। দেখতে যাওয়া ঠিক বলা যায়না।দেখাশোনার পালা ওরা অনেকদিন আগেই মিটিয়ে দিয়েছে, ঐ আর কি ফর্মালিটি রক্ষা করা, দিনক্ষণ দেখা এই।
সকাল সকাল পূজো মিটে যাওয়ার পর বারান্দায় চেয়ার পেতে বসছেন, পাড়াতেই একটা স্কুল আছে। সব মেয়েরা কি সুন্দর শাড়ী পরে যাচ্ছে,বেশ লাগছে। নিজেদের ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যায়। মা সকালবেলা হলুদ মাখিয়ে স্নান করিয়ে দিতেন, তারপর সারাদিন শুধু মজা আর মজা। সেদিন পড়তেও বসতে হতনা তাই পোয়া বারো। বছরে দুটো দিন মেয়েদের দেখতে বেশ লাগে, দুর্গাঅষ্টমীর দিন আর সরস্বতীপূজোর দিন। সরমার আবার হলুদ রঙ একদম পছন্দ না বললেই বলে," কালো মানুষ এই বয়সে হলুদ পরবো ক্ষেপেছো নাকি?"
গিন্নীর কথা ভাবতে ভাবতেই গিন্নী হাজির, হিন্দীতে একটা প্রবাদ আছে শুধু মনে মনে ভাবলেন আর কিছু বললেন না। বললেই একেবারে কুরুক্ষেত্র বাধবে।
......."ঠিক ধরেছি, তুমি এখানে, এই বয়সেও মেয়ে দেখার শখ! ধন্যি পুরুষমানুষ গো তোমরা। বলি খাওয়া দাওয়া করতে হবেনা নাকি?"
.... "আহা অমন করে বলছো কেন? তোমায় বলেছিনা আমার দুটো দিন মেয়েদের দেখতে খুব ভালো লাগে। যতদিন বাঁচবো ততদিন দেখবো।"
গিন্নীর জ্বালায় কি আর বসার উপায় আছে, প্রায় চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে গেলো। কথা না শুনে যায় বা কোথায় ওরাই তো এখন অন্নদাত্রী উরিব্বাবা।
বিকেল হতে হতেই তোরজোড় শুরু হয়েছে গিন্নীর মেয়ের বাড়ীতে যাবার জন্য। ছেলে যাচ্ছেনা, আজ কর্তা গিন্নীই যাবেন। যাইহোক সরমা বেশ পরিপাটি হয়ে তৈরী হয়েছে, শাশুড়ি বলে কথা। সরমাকে সাজলে বেশ ভালোই দেখায় এখনো, নিজেও তৈরী হয়ে পা বাড়ালেন গিন্নীর সাথে। ছেলে একটু টিপস দিয়ে দিলো কি কি বলতে হবে, এখন তো নিজেদের সাক্ষ্মীগোপালের মত অবস্থা।
মেয়ের বাড়ীর আদর আপ্যায়ন ভালোই, ওদের বাড়ীতেও পূজো হয়েছে তাই মেয়ের বাবা, পিশি, কাকু এরা সাদরে আপ্যায়ন জানালেন ওদের। সবার সাথে গল্প চলছে জমিয়ে তবে মেয়ে তখনো আসেনি। যদিও ছেলের কাছে অনেকবার ছবি দেখেছে মেয়ের।
মেয়ের মা এতক্ষণ আসেনি তবে এবার এলেন একেবারে চা মিষ্টি নিয়ে আর মেয়েকে সাথে নিয়ে। হবু বেয়াইমশাই পরিচয় করিয়ে দিলেন আমার স্ত্রী মালবিকা। হালকা হলুদ শাড়ী আরো একবার দোলা দিলো মোহিতবাবুর মনে। এবার আর মনে নয়,দোলা লাগলো বুকে। বুকের বাঁদিকটা কেমন যেন চিন চিন করে উঠলো। যদিও অনেক বছর বাদে তবুও মালবিকাকে চিনতে ভুল হয়না মোহিতবাবুর, প্রথম প্রেম তো!
হালকা চিমটি কাটে সরমা,"কি গো? মেয়ে এলো যে দেখো। হাঁ করে মেয়ের মাকে দেখছো কেন?" ফিসফিস করে বলে ।
মালবিকা চায়ের কাপটা এগিয়ে দেন মোহিতবাবুর দিকে। মালবিকা চিনতে না পারলেও মোহিতবাবুর মন তখন চলে গেছে পুরনো দিনে। অবশ্য মালবিকার না চেনাই ভালো।এখনো মুগ্ধ হলেন মালবিকাকে দেখে। হবু বৌমার বদলে চোখটা আটকে রইলো হবু বেয়ানের দিকে।
তবে এবার মনে মনে জিভ কেটে মা সরস্বতীকে বললেন ," বুড়ো বয়সে এসে একি দোটানায় ফেললি মা, বেছে বেছে মালবিকার মেয়েকেই আমার ছেলের বৌ করতে হলো?
বাইশের বুকের তখন কষ্টটা তখন সহ্য হয়েছিলো, এবার এইবয়সে সহ্য হবে কি?"
তবুও মনে মনে মা সরস্বতীকে একটা পেন্নাম ঠুকে বললেন," নাকের বদলে নরুণ দিলি মা,যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলাম একসময়, সে এবার থেকে হলুদ শাড়ী পরে চোখের সামনেই থাকবে জীবনের বাদবাকী সরস্বতী পূজোর দিনগুলোতে। হাজার হোক সম্পর্কটা তো খুব মিষ্টি!"
সমাপ্ত:-
.
Comments
Post a Comment