Skip to main content

ম‍্যালিগন‍্যান্ট যখন ভালোবাসা

#ম‍্যালিগন‍্যান্ট_যখন_ভালোবাসা#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#

"কি মানুষ গো তুমি?কথায় বলেনা, 'স্বভাব যায়না মরলে' সেই অবস্থা আরকি,আমার সামনে দাঁড়িয়ে এখনো হাঁ করে মেয়ে দেখো। আরেকটু হলেই তো হোঁচট খেতে । ভগবান এই লোকটা কি কোনদিন শোধরাবে না ,ডাক্তার দেখাতে এসেও!" কনুই দিয়ে একটা গুঁতো মারে রাজেনকে পল্লবী।
             যেতে যেতে আবার পেছন ফেরে রাজেন,নাহ্ আর দেখা যাচ্ছেনা। এখনো যেন ঘোর কাটছে না, ভাবতেই পারিনি চেন্নাই আ্যপেলোতে ডাক্তার দেখাতে এসে এভাবে ওকে দেখতে পাবে। পল্লবী আবার বজ্রদৃষ্টিতে তাকায় ওর দিকে। তাই কিছু না বলে একমাথা চিন্তার জট নিয়ে এগিয়ে যায়। কিন্তু মনটা ভীষণ অস্থির লাগে,হঠাৎ এখানে এতোদিন বাদে দেবযানীকে দেখলো মনে হওয়াতেই হঠাৎ মনে হলো চোখের ভুল নয় তো? একঝলক দেখাতেই হঠাৎ দৃষ্টিটা চলে গিয়েছিলো ওর বুকের দিকে। কিন্তু তাড়াহুড়োতে কিছুই ঠাহর হোলোনা‌।
        গজগজ করতে থাকে পল্লবী,"মেয়েমানুষ দেখলেই আদেখলাপনা শুরু হয়ে যায়। শুরু হয়ে যায় শরীর মাপা। ধন‍্য চোখ তোমার। নয় নয় করে তো দুখানা বিয়ে করলে, এখনো শখ মেটেনি।"
            পল্লবীর মুখের কাছে ভুলেও খাপ খুলতে সাহস পায়না রাজেন। সেকেন্ড ম‍্যারেজ ওর পল্লবীর সাথে,তাই খুব বেশি ঘাটাতে পারেনা।
               কিন্তু যাকে দেখলো সে কি দেবযানী? দেবযানীর তো বাঁচার কথাই ছিলোনা। আজ যাকে দেখলো তাকে মেলাতে পারেনা ছয় বছর আগে দেখা দেবযানীর সাথে। মাথা ভর্তি হাল্কা কালার করা স্টেপস কাট চুল, একদম টানটান সুন্দর আকর্ষণীয় চেহারা,একটু মোটা হয়েছে,সেই কাঠ কাঠ ভাবটা একদম নেই। পরনে আধুনিক পোশাক। যে মানুষটার সাথে চারবছর সংসার করেছে তাকে চিনতে কি এতোটা ভুল হবে?
                 দেবযানীদের বাপের বাড়ীর পাড়ায় একটা বাড়ীর প্রোমোটিং এর ব‍্যাপারে প্রায়ই যেতো রাজেন। সেখানেই দেবযানীকে দেখে প্রেমে পড়েছিলো। মাঝে মাঝেই দুচাকা বা চারচাকা নিয়ে ঢুঁ মারতো ওই পাড়াতে। দেবযানী তখন কলেজে পড়ে। রাজেনের প্রস্তাব প্রথমে নাকচ করলেও ধীরে ধীরে রাজেন মন জয় করে নেয় দেবযানীর। ওর বাবা আর দিদি খুব আপত্তি করেছিলো এই বিয়ের,বার বার বলেছিলো আরেকটু পড়াশোনাটা এগিয়ে নিয়ে যেতে। আসলে ওর দিদি চাকরি করে,জামাইবাবু ইঞ্জিনিয়ার। তাই কেউই চায়নি মা মরা দেবযানী নিজের পায়ে না দাঁড়িয়ে বিয়ে করে।
            এককথায় ওদের প্রস্তাবকে উড়িয়ে দিয়ে রাজেন বলেছিলো," কিচ্ছু চিন্তা করবেন না মেসোমশায়,আমার যা টাকা ও একজন্ম কেনো,সাতজন্ম বসে খেতে পারবে। আর বাড়ীতে কেই বা আছে মা ছাড়া। আমাদের বাড়ীর বৌরা চাকরি বাকরি করেনা। বাড়ীর বৌ আবার চাকরি করবে কি?"
             অগত‍্যা মেনে নিয়েছিলেন ওর দিদি আর বাবা। ধূমধাম করেই বিয়েটা হয়ে গিয়েছিলো ওদের। বিয়ের পর বেশ ভালোই কাটছিলো,সুখের অভাব খুব একটা কিছু ছিলোনা। শুধু মাঝে মাঝে ওদের খোঁচা মারা কথায় খুব খারাপ লাগতো দেবযানীর। তবে শান্ত স্বভাবের দেবযানী  তেমনভাবে প্রতিবাদ করতো না কখনোই।
            পল্লবীর সাথে হসপিটাল থেকে হোটেলের দিকে যেতে আনমনা হয়ে যায় রাজেন,মেলাতে পারেনা ওর একসময় ঘাড় ধাক্বা দিয়ে বিদায় করা অতীতের সাথে বর্তমানকে। দেবযানী কি ওকে চিনতে পেরেছিলো? না না,ও তো তাকায়ইনি ওর দিকে। একজনের সাথে কথা বলতে বলতে হঠাৎই একটা দামী গাড়ীতে উঠে গেলো।
              ভালোবেসে দেবযানীকে বিয়ে করলেও কিছুদিনের মধ‍্যেই মরে গিয়েছিলো সেই ভালোবাসা। যখন বিয়ের দুবছর বাদেও কোন সন্তান এলোনা ওদের ঘরে।...."কি ব‍্যাপার বলতো? তোমার কি কোন রোগ আছে নাকি? আমরা তো কোন বাধা নিষেধ রাখিনি তবে,এতোদিন কোন খবর আসছে না কেন? মা সব সময় একটা নাতি নাতনির জন‍্য অস্থির হচ্ছে। শুধু বলে,"আর কতদিন বাঁচবো।"
           ......দেবযানী হাসতো বলতো," কেন? তোমার এতো প্রেমের কি হলো?এখনই মাঝে কাউকে এনে ভাগ বসাতে চাও।" বলে আরো ঘনিষ্ঠ হয় রাজেনের।
......" তোমার ওই কেঠো চেহারায় কি আছে শুনি, কতদিন আর এই চেহারার মোহে থাকবো।"
......রাগ না করে দেবযানী বলতো,"একসময় তো তুমিই বলতে," দেবী কি হট আর সেক্সি তুমি।" এর মধ‍্যেই সব শেষ!"
          এইভাবেই কেটে গিয়েছিলো আরও একটা বছর,তারমাঝেই ওরা ডাক্তার দেখানো শুরু করেছে। তেমন কোন সমস‍্যা নেই বলেছেন ডাক্তার, শুধু কয়েকটা পরীক্ষা করতে বলেছেন। সন্তান হবার আশ্বাসও পেয়েছে। তবুও নানারকম খোঁচামারা কথা চলতেই থাকতো। রাজেন মাঝে মাঝেই রাতে ড্রিংঙ্ক করে বাড়ী ফিরতো। ওদের এইসব বাড়ীঘর বানানোর লাইনে নাকি এমন হামেসাই খেতে হয়। ওর মাও সাপোর্ট করতেন," কি করবে, কি সুখ আর পেলো ছেলেটা!"
              হঠাৎই একদিন পুরী যাবার প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলো রাজেন।খুব খুশি হয়েছিলো দেবযানী অন্তত কয়েকটা দিন একটু নিশ্বাস ফেলবে। কতদিন বাইরে বেরোনো হয়না, রাজেনকে ওর দিদি কতবার বলেছে বেঙ্গালুরু ঘুরে যেতে। কিছুতেই রাজী হয়নি ও। কতদিন সেভাবে ওদের কাছাকাছিও আসা হয়না। শাশুড়িমাও খুশি,ওনার জগন্নাথ দর্শন হবে। বার বার করে বললেন দেবযানীকে পূজোটা যেন ভালো করে দেয়। যদি জগন্নাথ দেব মুখ তুলে চান, বংশধর আসে বাড়ীতে।
             মাথা নীচু করে দেবযানী, এই তিনবছর সাড়ে তিনবছরে যে কতবার শুনেছে এই কথাগুলো। সত‍্যিই মাঝে মাঝে অপরাধবোধ হয়। খুবই চাপা স্বভাবের মেয়ে দেবযানী তবুও একদিন দিদিকে বলে ফেলেছিলো কথাটা। বকুনি খেয়েছিলো নিজের কাজের জন‍্য," কতবার বলেছিলাম ওইরকম একটা ছেলেকে বিয়ে করিসনা। তখন তো শুনলিনা। সত‍্যি এরা এখনো কোন যুগে পড়ে আছে! বাচ্ছা হচ্ছেনা,সেটাও বৌয়ের দোষ,অথচ ভালো করে নিজের চিকিৎসাও করাবেনা। নিজে থাকবে ধরা ছোঁওয়ার বাইরে। এখানে আসতে বললাম তাও এলি না। বাবাও তো এখন এখানে, একবার আসতেই পারতিস। এই জন‍্যই মেয়েদের নিজের পায়ে দাঁড়ানোটা খুব জরুরী।"
             সত‍্যিই তো দোষটা পুরোপুরি ওর,এভাবেই হয়ত চাওয়া পাওয়ার খাতায় হিসেব করতে করতে ভালোবাসা উবে গিয়ে যান্ত্রিক হয়ে যায় জীবনটা।
            অনেকদিন বাদে পুরীতে এসে এক ঝলক মুক্তির আশ্বাস পেয়েছিলো দেবযানী,মনভালো করা দিগন্তবিস্তৃত সমুদ্র দেখে ছেলেমানুষ হয়ে গিয়েছিলো মনটা। রাজেনকেও অনেকদিন বাদে খুব রোমান্টিক লেগেছিলো,যেন ফিরে এসেছিলো পুরোনো দিনগুলো। রাতে হালকা নীল নেটের পোশাকটা পরে হালকা নীলচে আলোয় বাথরুম থেকে চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে ঢোকে ঘরে। যখন দুজনে দুজনের খুব কাছাকাছি,হয়ত অনেকদিন পরেই। আসলে আজকাল তো রাতে বেশিরভাগই ড্রিঙ্ক করে ফেরে রাজেন। তাই সেদিন খুব ভালো লাগে দেবযানীর , অনেকদিনবাদে রাজেনকে এভাবে কাছে পেয়ে। হঠাৎই দেবযানীর শরীর ছুঁতে ছুঁতে হারিয়ে যাওয়া রাজেন একটু চমকে ওঠে,দেবযানী যন্ত্রণায় কঁকিয়ে ওঠাতেই।
....' কি হলো আবার? এখনো তোমার ব‍্যাথা লাগে,আমি ধরলে। যাহ্ বাবা,এই বলে হয়ত একটু জোরেই বুকে চাপ দেওয়াতেই যন্ত্রণায় আবার আঃ শব্দটা বেড়িয়ে আসে দেবযানীর মুখ থেকে। আলো জ্বালিয়ে দেখে রাজেন, হাত দিয়ে অনুভব করে ওর বুকের শক্ত ডেলাটা," এই শক্তটা কি?কতদিন এমন আছে? সত‍্যি প্রায় কিছুদিন আগেই অনুভব করেছে দেবযানী ওর বাঁদিকের ব্রেষ্টে একটা শক্ত মত, খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু চাপ পড়াতে যেন বেশিই কষ্ট পাচ্ছে। বকাবকির অন্ত রাখলোনা রাজেন,"কত রোগ লুকিয়ে যে চেপেছো আমার ঘাড়ে কে জানে?"
          ভাগ‍্য বোধহয় পেছন ছাড়েনা,তাই পুরীর সুখও সইলোনা ওর কপালে। কলকাতা ফিরে ডাক্তার দেখানো হলো,আর তার সাথে চললো মা আর ছেলের নানা কথা। চুপ করে থাকতো দেবযানী,একটা ভয় দানা বেঁধেছিলো মনে। কিছুই ভালো লাগতোনা। পরীক্ষাতে জানা গেলো ওটা টিউমার, পরীক্ষার রিপোর্ট দেখে ডাক্তাররা বললেন ম‍্যালিগনেন্ট হতে পারে,তবে হয়ত অপারেশনের পরে ঠিক হয়ে যাবে।কিন্তু দেবযানীর লেফ্টসাইডের ব্রেষ্ট বাদ যেতেও পারে,তবে এখনই কিছু বলা যাচ্ছেনা। দেখতে হবে কতটা ছড়িয়েছে।
             সব শুনে ধৈর্য হারায় রাজেন," কিসের মোহ আর আছে শুনি তোমার ওপর? একটা ছেলেপুলে থাকলেও ভাবতাম যে আমার বাচ্ছার মা।ঐ কেঠো চেহারা তারপর আবার বুকটাও কেটে বাদ যাবে,হায় ভগবান!"
            মাটির সঙ্গে মিশে গিয়েছিলো দেবযানী,বুঝেছিলো ওর সঙ্গে কেউ নেই। হয়ত এইভাবেই মরতে হবে তিলে তিলে। এগিয়ে এসেছিলেন বাবা সন্তান তো । শ্বশুরের ঘাড়ে বৌকে চাপিয়ে দায় সেরেছিলো রাজেন। তখন দেবযানী শুধুই বাবার মেয়ে। ওর দিদি তখন মুম্বইয়ে ,ওরা কেউই দেবযানীকে সরিয়ে দেয়নি,বাবার পাশে দাঁড়িয়েছিলো দিদি। টাটা মেমোরিয়ালে চিকিৎসা চলছিলো দেবযানীর মাঝে মাঝে টাকা পাঠিয়ে কর্তব‍্য সারতো রাজেন। যতটা সম্ভব রেখে অপারেশন করেছিলো ডাক্তাররা। বুকের ক্ষত আর মনের ক্ষতে তিলে তিলে শেষ হয়ে যাচ্ছিলো দেবযানী। রাজেনকে ফোন করলে ভালো করে কথাও বলতোনা। ওর দিদি চাপ সৃষ্টি করায় একবার এসেছিলো,দেবযানীর তখন কেমো চলছে,চুলগুলো পড়ে গেছে মাথার।
           হাড় বেরোনো, চুলছাড়া দেবযানীকে দেখে আতঙ্কে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো রাজেন। দেবযানী কাতরমুখে তাকিয়েছিলো একটু সহানুভূতি পাবার জন‍্য। কলকাতায় ফিরে এসেছিলো রাজেন,মাঝে মাঝেই আঁতকে উঠতো দেবযানীর মুখটা মনে করে। একটু সহানুভূতিও ছিলোনা দেবযানীর জন‍্য, এর নামই বোধহয় জীবন ভাবলেও লজ্জা হয়। রাজেন আর আসেনি,এসেছিলো ডিভোর্সের চিঠি। আধমরা দেবযানী হয়ত পুরোটাই মরে গিয়েছিলো সেদিন।
           যাকে এইসময় পাশে পাওয়ার দরকার সেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো। তবে কি রাজেনের কাছে ওর শরীরটাই সব ছিলো? মনের কোন বাঁধনই তৈরী হয়নি কোনদিন! বিপদের সময় বোধহয় খুব বেশি করে মানুষ চেনা যায়। কিন্তু সবাই তো এমন হয়না,ওর সাথে কেন এমন হলো?
                  তবুও ভেঙে পড়েনি দেবযানী,লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলো। ভালোবেসেছিল হাড় জিড়জিড়ে ন‍্যাড়ামাথা দেহটাকে। বাবা আর দিদির কথা ভেবে নিজের চোখের জল নিজে মুছে ভুল থেকেই শিক্ষা নিয়েছিলো বেশি করে।
                 একটু একটু করে সেরে উঠছিলো দেবযানী,মুছে ফেলছিলো দেহের আর মনের ক্ষত। প্রথমে লম্বা চুল উঠে নতুন চুল বেরোনোতে করে দিয়েছিলো বয়েজ কাট, আর শাড়ীর বদলে দিদির বায়নায় আধুনিক পোশাকে এসেছিলো। বুকের ক্ষত ঢাকতো ডাক্তারের নির্দেশমত প‍্যাডেড নরম ব্রা তে। মাঝে মাঝে কাটা বুকটাতে হাত বোলালে একটু কষ্ট হলেও আবার একটু একটু করে হারানো সৌন্দর্য ফিরছিলো শরীরে।
                   দিদি এর মধ‍্যে অনেকগুলো কোর্স করিয়েছে ওকে। দিদির একতলার ফ্ল্যাটটাতে একটা ছোট্ট ক্রেশ চালাতো দেবযানী। সময় শিখিয়েছে ওকে মেয়েরা কেবল পুরুষের মন জয় করার জন‍্য পৃথিবীতে আসেনি,তাদের অনেক কিছু করার আছে জীবনে। সহযোদ্ধা হয়ে চলতে হবে পুরুষের পাশাপাশি,স্বাবলম্বী করে তুলতে হবে নিজেকে। আত্মবিশ্বাস অটুট রাখতে হবে ,ভালবাসতে হবে নিজেকে।
                     রাজেন ছেঁটে ফেলেছিলো দেবযানীকে নিজের জীবন থেকে। ডিভোর্সের কিছুদিন বাদেই বিয়ে করেছিলো পল্লবীকে। কিন্তু সন্তান সুখ কপালে জোটেনি। হার্টের চিকিৎসা করাতেই আসা এখানে। তবে দেবযানীকে দেখার পর কেমন যেন অস্থির লাগে রাজেনের হয়ত র্ষাও হয়। ফুরিয়ে যাওয়া ,শেষ হয়ে যাওয়া একটা অধ‍্যায় আজ কেমন একটা সম্পূর্ণ উপন‍্যাসের রূপ নিয়েছে।

        "তোমার হয়েছে কি শুনি? হসপিটাল থেকে ফিরেই কেমন যেন আনমনা হয়ে আছো। বাড়ীতে তো সারাক্ষণ তোমার মায়ের টিকটিক লেগেই আছে। ভাবলাম এখানে একটু ঘুরবো ডাক্তার দেখানো হলে। আর আমার কাঞ্জিভরম শাড়ী কিন্তু চাইই একটা।" বকবক করতে থাকে পল্লবী। বিছানায় শুয়ে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করে রাজেনের সাথে। " ইশশ্ এখনো সুন্দরী মেয়ে দেখলে গিলতে থাকো,এদিকে তোমার তো কিছুই নেই। বাচ্ছা হবে কোথা থেকে। রোগের ডিপো একটা। কপাল আমার!টাকার লোভে বাবা ঝুলিয়ে দিলো একটা বুড়োর ঘাড়ে।"
                 অন‍্যদিন হলে হয়ত মেজাজ দেখাতো একটু, সেদিন আর কোন উত্তর দিতে ইচ্ছে করলোনা রাজেনের। এমন খোঁটা প্রায়ই দেয় পল্লবী। ভগবান হয়ত অপমান এইভাবেই ফিরিয়ে দেন।
            পরদিন সকালে কাজের ছুতোয় একটু হোটেল থেকে বেরোয় রাজেন,পল্লবীকে তৈরী হতে বলে। গতকাল যেখানে দেবযানীকে দেখেছিলো সেখানে গিয়ে দাঁড়ায়।
               প্রায় পনেরো মিনিট ঘোরাঘুরির পর হঠাৎই দেখে লাল পাড় নীল কাঞ্জিভরম শাড়ী পরে মাথায় ফুল দিয়ে দেবযানী এগিয়ে আসছে গাড়ী যেখানে পার্ক করা হয় সেদিকে। চমকে ওঠে রাজেন,লাবণ‍্যে ঢলঢল করা দেবযানীকে দেখে। ওর দুহাতে ধরা দুটো মিষ্টি বাচ্ছা মেয়ে বছর তিনেকের কাছাকাছি হবে হয়ত বয়স। সব কথা হারিয়ে যায় নিঃস্ব রাজেনের পূর্ণ দেবযানীকে দেখে। রূপ,লাবণ‍্য আর মাতৃত্বে ঝলমল করছে দেবযানী।
                গাড়ীতে বাচ্ছাদের বসিয়ে,উঠে বসতে যায় দেবযানী।এগিয়ে আসে রাজেন, ডাকে," দেবী একটু, দাঁড়াও।"
        মুখ ফিরিয়ে তাকায় দেবযানী ঘুরে দাঁড়ায় রাজেনের মুখোমুখি,একটু চমকে ওঠে। চোখের নীচে কালি পড়ে যাওয়া রাজেনের ক্ষয়াটে চেহারাটা দেখে করুণা হয়। তবুও জোরালো গলায় বলে...
......"আপনি ভুল করছেন,সেই হাড় জিড়জিড়ে ন‍্যাড়ামাথা বুক কাটা কেঠো দেবী কবেই মরে গেছে। আমি এখন নতুন জীবনে লড়াই করে আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকা এক নারী। যে নিজেকে ভালোবাসে সম্মান করে আর সবাইকে ভালো থাকার মন্ত্র শেখায়।"
             গাড়ীতে উঠে কাঁচটা তুলে দেয় দেবযানী এসি অন হয়ে যায়। এগিয়ে যায় গাড়ী, ওর আহত কাটা ব্রেষ্টটার কাছে আদর করে জড়িয়ে থাকে ওর দুই সন্তানকে,রাধিকা আর বসুধা। চোখে জ্বলে ওঠে আগুন হয়ত সেই আগুনে কবেই পুড়িয়ে ফেলেছে ওর অতীতকে।
                  এক সময় ওর ক্রেশেই আসতো রাধিকা আর বসুধা, ওরা দুই যমজ বোন, ওদের তখন বছর খানেক বয়েস। ওদের মা হঠাৎই মারা যান বাচ্ছাদুটোকে জন্ম দেবার পর,হাই সুগার ছিলো। ওদের পিসি ডক্টর কৃষ্ণমূর্তি বিয়ে করেননি, বাবা একটা অফিসে চাকরি করেন। তাই বাধ‍্য হয়েই একটু বড় হওয়ার পরই ওদের ক্রেশে দিতে হয়েছিলেন। ওদের ফ্ল্যাটটা দিদির বাড়ীর কাছেই।
              অন‍্য বাচ্ছাদের মধ‍্যে ওরা যেহেতু সবচেয়ে ছোট দেবযানী হয়ত একটু বেশিই স্নেহ দিতো। কখনো বা ওদের আদর করে পেতো না পাওয়া মাতৃত্বের আস্বাদ। বাচ্ছাদুটোর সাথে একটা অদ্ভুত বন্ধন হয়ে গিয়েছিলো ওর।
                    প্রস্তাবটা ডক্টর কৃষ্ণমূর্তিই ওর দিদিকে করেছিলেন। অনেক ভাবনা চিন্তা করে দেবযানী আবার বাঁধা পড়েছিলো এক নতুন সম্পর্কের বাঁধনে। শুধু পরিচয়টা একটু পাল্টে গিয়েছিলো । দেবযানীর প্রথম পরিচয় ও এখন রাধিকা আর বসুধার মা,তারপর স্ত্রী। হয়ত মাতৃত্বের অঙ্গীকার অস্বীকার করতে পারেনি দেবযানী। ডক্টর কৃষ্ণমূর্তি এখন চেন্নাই আ্যপেলোতে।
              দেবযানী নিজে বাঁচতে শিখেছে, বাঁচতে সাহায‍্য করেছে ওর মত অনেককেই। আজ ওর কাউন্সিলিং ক্লিনিক প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ মেয়েকে বাঁচার স্বপ্ন দেখাচ্ছে এইভাবে যে.... একটা পা,হাত,ইউটেরাস বা ব্রেষ্ট বাদ চলে গেলে মানুষ মরে যায়না। বাঁচার জন‍্য চাই মানসিক সাহস তাই নিজেকে আর এই পৃথিবীকে ভালোবেসে লড়াই করে বাঁচতে হবে।
              রাজেনের মুখটা দেখে আজ শুধু করুণা হয় দেবযানীর। সেদিন ৮ই মার্চ "বিশ্বনারী দিবস"।দেবযানীর ক্লিনিকে একটা বড় অনুষ্ঠান হয়। তাই রবিঠাকুরের কবিতার লাইনগুলোই যেন বেশি করে মনে পড়লো,
       'নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার. কেন নাহি দিবে অধিকার. হে বিধাতা? নত করি মাথা. পথপ্রান্তে কেন রব জাগি. ক্লান্তধৈর্য প্রত্যাশার পূরণের লাগি. দৈবাগত দিনে। শুধু শূন্যে চেয়ে রব? '

            নারী বোধহয় নিজের ভাগ‍্য জয় করার মন্ত্র সত‍্যিই শিখেছে। অন্তত দেবযানী শিখেছে তার জীবন থেকে আর শেখাচ্ছে। তাই পুরুষকে চায় সে বন্ধু হিসেবে ,চলতে চায় পাশাপাশি সহযোদ্ধা হয়ে,প্রতিপক্ষ হয়ে নয়।
       মনেপ্রাণে পজেটিভ দেবযানী আজ রাজেনকে মনে মনে প্রশংসা করে বললো, ভগবান যা কিছু করেন হয়ত ভালোর জন‍্যই। রাজেনের দুর্ব‍্যবহারই হয়তো দেবযানীকে আরও বেশি মানসিক জোর পেতে সাহায‍্য করেছে।
             রাজেনের আজ নিজেকে সর্বস্বান্ত মনে হোলো। অনেক প্রশ্নের ভীড়ে দাঁড়ানো পিতৃসুখে বঞ্চিত রাজেনের সামনে ঝলমল করতে লাগলো দেবযানীর সুখী মাতৃত্ব।

         সমাপ্ত:-
            
 
               

             

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...