Skip to main content

সর্বজয়া

#সর্বজয়া#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#

ফ্ল‍্যাটের সরস্বতীপূজায় সকাল থেকেই খুব মজা বাচ্ছাগুলোর,কাল রাতেও ওরা খুব মজা করেছে যখন ঠাকুর এসেছে। বাপরে কি মিটিং চলছে ওদের কদিন ধরে,কি সাজানো হবে,কোন লাইট লাগানো হবে আরো কত কি প্ল‍্যানিং। আসলে এই একটা দিনই তো একটু রেহাই পাওয়া যায় পড়াশুনো থেকে। ওদের কেউ ক্লাশ ওয়ান,কেউ বা টু,থ্রি আর ফোর,ওদের মধ‍্যে সবচেয়ে বড় রুম্পি সবাই মজা করে বলে টিম লিডার। সকালবেলায় পুচকে ছেলেগুলোকে অনেক কষ্ট করে পাঞ্জাবী আর মেয়েগুলোকে শাড়ী পরাতে গিয়ে মায়েরা হিমশিম খেয়েছে। সৃজারও এক অবস্থা সুমিটাকে নিয়ে, বয়স অনুপাতে একটু বেশিই বড়সড় মেয়েটা,একদম ওর বাবার মতো হয়েছে, তাই পুচকে শাড়িগুলোও ওর হয়না। সৃজার শাড়িগুলোকে ম‍্যানেজ করে পরাতে হিমসিম অবস্থা। মেয়েদের সাজাতেই অনেকটা সময় লেগে যায় তাই মোটামুটি ভোরবেলা উঠেই মায়েদেরই তৈরী হতে হয় আগে। তবে বেশ ভালো লাগছে পুচকেগুলোকে, মন ভরে যায় দেখলে ওদের নতুন সাজে আর হলুদ শাড়ীতে, এই জন‍্যই সরস্বতীপূজোর দিন বেশ আলাদা একটা মেজাজ। কেমন যেন একটা মন ভালো হয়ে যাওয়া অনুভূতি।
     খুবই ছোট আবাসন ওদের মাত্র বারোটা ফ্ল্যাট ছোট বাচ্ছা বলতে এই ছয়টি। বাকিরা সব বড় তারা বাইরে বন্ধু বান্ধব নিয়ে বেড়াতে যায় বা কলেজে চলে যায়। ভালোভাবে পূজো হয়ে যাবার পরই শাড়ী ছাড়তে আর ঘরের কাজ সারতে অন‍্য মায়েদের সাথে সৃজাও উঠে আসে ওপরে। বাচ্ছাগুলো নিচে থাকে সবার এক বায়না," মা একটু থাকিনা গো,গল্প করবো চেয়ারে বসে। আছে তো সবাই,থাকিনা প্লিজ। এই তো বাবা আর আঙ্কেলরাও আছে। আর রুম্পিদিদিও তো আছে।"..." হুঁ তাই নাকি হাসে সৃজা,হ‍্যাঁ তোদের অনেক বড় দিদি ক্লাস সেভেনে পড়ে তাইতো। তবে সুমি এসো আগে শাড়িটা ছেড়ে নাও তারপর।"
    মেয়ের আর তর সয়না, তাই তাড়াতাড়ি শাড়ীটা ছাড়িয়ে একটা গেঞ্জি ফ্রক আর প‍্যান্ট পরিয়ে নিচে পাঠিয়ে দেয় ওকে রুম্পির সাথে সৃজা। কিছুক্ষণ বাদে ওর হাবিও উঠে আসে ঘরে। " কি গো তুমি ওপরে এলে? মেয়ে কি করছে? কে কে আছে ওখানে?" ওর হাবি অনি এসে বলে," আরে পুচকেগুলো মেতেছে গানের লড়াইয়ে তাছাড়া ওপরের মিঠুর বাবা মানে মেসোমশাইও তো আছেন ওদের সাথে ওনারই আইডিয়া ওটা যা করে হোক এক যায়গায় বসিয়ে রাখা দুষ্টুগুলোকে। ভদ্রলোক খুব ভালো যদিও আগে আলাপ ছিলোনা,আগে তো বাইরে  থাকতেন এখন শুনলাম কাছাকাছি একটা ফ্ল্যাট কিনেছেন। মাঝে একবার সৃজা ঢুঁ মেরে এলেও মেয়েকে আনতে পারলোনা নিশ্চিন্ত হলো যাক সবাই আছে। আধঘন্টা বাদে ওপরে উঠে এলো সুমি। গালটা বেশ লাল,মুখটা যেন কেমন অদ্ভুত লাগছে। " কি রে চলে এলি যে? হয়ে গেলো?" ....কোন উত্তর দেয়না মেয়ে ফ্রকটা ছেড়ে একটা ফুলপ‍্যান্ট আর গলাবন্ধ গেঞ্জি পরে। " সুমি ঠান্ডা লাগছে না কি রে?ফ্রকটা ছাড়লি কেনো?" ...."এমনি ভালো লাগছেনা,ওটার গলাটা খুব বড়। কি যে সব পচা পচা জামা কেনো মা, সরু ফিতে,স্লিভলেস,গলা বড়। আমার একটুও পরতে ভালো লাগেনা মা।" ...." সত‍্যি কি যে মুশকিল হয়েছে তোর জামা কাপড় কেনা! নতুন গুজরাটি লেহেঙ্গাটা পড়ে রইলো,কি শখ করে কিনেছিলাম। তখন তো আরো পুচু ছিলি। আমার কি শখ ছিলো পিঠে ফিতে বাঁধা ফ্রক পরাবো মেয়েকে। তো বাবা তোর জেদের কাছে আমি হার মানলাম। কিছুতেই পরাতে পারলাম না। তোর স্কুলের ছুটির দিন কি সুন্দর সুন্দর ফ্রক পরে বেড়োয় তোর বন্ধুরা। কত স্টাইলিশ লাগে দেখতে। আর এই হয়েছে এক মেয়ে আমার!"
.......আমার ভালো লাগেনা মা,ঐসব ড্রেসগুলো, তুমি আর পিঠখোলা জামা আনবেনা আমার জন‍্য।" মনে মনে হাসে মা খুব পাকু হয়েছে তো,যাক ভালো সবে এখন ক্লাশ থ্রী তবে বয়সের তুলনায় বেশ বাড়ন্ত চেহারা তবুও মজা করে বলে ," এই যে পাকাবুড়ি যখন বড় হবি তখন মা বারণ করলেও ঐ পেট বার করা আর পিঠ বার করা জামা পরে বেরোবি।তখনও কথা শুনবিনা আমি বারণ করলেও যেমন এখন শুনছিসনা।" 
     সুমির ছোট্ট শরীরে একটু একটু করে আসছে বড় হওয়ার লক্ষণ। কারো সামনেই আর খালি গায়ে বেরোতে চায়না। কিছু জিনিস বোধহয় শেখাতে হয়না বাচ্ছারাও নিজের থেকে একটু একটু করে বোঝে ওরা বড় হচ্ছে,আগের থেকে বদলাচ্ছে। তবুও একদম সরল সাধাসিধে শিশুমন তাইতো ওরা বিশ্বাস করে সবাইকে ওদের সরল মন দিয়ে। জামা প‍্যান্ট বদলালেও কিছুই যেনো ভালোলাগেনা সুমির অদ্ভুত একটা কষ্ট হয় শরীরে আর মনে,কান্না পায় তবুও কাঁদতে পারেনা। এর মাঝেই মা এসে ডাকে," ঝগড়া করে এলি নাকি রুম্পির সাথে? গোমড়া মুখ কেনোরে?"
           উত্তর দিতে পারেনা মাকে, আসলে কোনদিন কোন খারাপ কথা বলেনি মাকে। এই কথাটা খুব খারাপ কথা ওর ছোট মন ওকে বলে, কেনো যে তখন মায়ের কথা শুনে ওপরে উঠে আসেনি এখন মাকে কিছু বললেই মা বকবে ঘরে বন্ধ করে রাখবে হয়ত আর খেলতেই দেবেনা। সত‍্যিই তো মাকে কি করে বলবে মিঠু আন্টির বাবা ঐ দাদুটা কেনো যে ওভাবে চেপে ওকে জড়িয়ে ধরে আদর করার সময় বার বার হাতটা  ওর বুকে দিচ্ছিলো। ফ্রকটা টেনে ওপরে তুলতে চাইছিলো হাত দিয়ে চেপে। কেমন যেন ভয় করছিলো ওর, দাদু কি প‍্যান্টুটে হাত দেবে নাকি?অস্বস্তি হলেও চট করে নিজেকে ছাড়াতে পারছিলোনা। আসলে দাদুই তো প্ল‍্যান দিয়েছিলো গানের লড়াইটা খেলার।  সুমি আর রুম্পি ভালো খেলছে বলে ওদের বার বারই পিঠে হাত দিয়ে আদর করছিলো। কিন্তু জড়িয়ে ধরাতেই যেন কেন ওর মনটাকে শরীরটা বললো তুই সরে যা দাদুটা ভালো না। ও কি করবে ভাবতেই,রুম্পি হঠাৎই হাতটা ধরে টেনে নামায় চেয়ার থেকে সবার সামনেই চেঁচিয়ে ওঠে আর এক বকুনি দেয়।" কখন থেকে বলছিনা,ওপরে চল আর ভালো লাগছেনা খেলতে, খেলবো না।" বলে এক ধাক্বা লাগায়,"চল এবার বাড়ীতে। গিয়ে চেঞ্জ করে ফ্রকটা ছেড়ে ফেল।" সত‍্যি কেনো যে সব কথা মা বাবাকে বলা যায়না। কি বলবে কিভাবে বলবে কিছুই বুঝতে পারেনা। আসলে মিঠু আন্টিরা নতুনই এসেছে ফ্ল্যাটে কিন্তু খুব ভালো আন্টিটা তবে ঐ আন্টির বাড়িতে কোন ছোট বাচ্ছা নেই।মাকে খুব বলতে ইচ্ছে করলেও বার বার ভয় হচ্ছে যদি মা বকে। তাছাড়া ওর দাদুও তো ঐ দাদুটার মতোই,দাদু যখন আসে ওদের বাড়িতে তখন ওর ফ্ল্যাটের সব বন্ধুরা,আর রুম্পি দি একদম ওর দাদুর কোল ঘেঁষে বসে কত গল্প শোনে। আর ওদের বায়নায় দাদু যখন ভূতের গল্প বলে তখন তো ওরা ভয়ে একেবারে দাদুর কম্বলের ভেতরে ঢুকে বসে থাকে। আর দাদু মুচকি হেসে আরো ফিসফিস করে গল্প বলতে থাকে। ওহ্ তারপর যে কি অবস্থা! দাদুকেই হাত ধরে সবকটাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে হয়। দাদুর কথা ভাবতেই মনটা ভালো হয়ে যায় সুমির, দাদু মানেই একঝুড়ি আবদার,যখন তখন ফুচকা আইসক্রীম আর আলুকাবলি খাওয়া। দাদু মানেই দলবেঁধে  চিড়িয়াখানা আর শীতে সার্কাসে যাওয়া। মা ও তখন একটুও বকতে পারেনা।বাড়িতে যেন বসে তখন পুরো আনন্দের মেলা,একগাদা গল্পের বই আনে দাদু সাথে করে। কি মিষ্টি গন্ধ পাওয়া যায় নতুন বইগুলোর মলাট থেকে,আর তেমন সুন্দর মলাটের ছবিগুলো। দাদুর কথা মনে করে খারাপ হয়ে যাওয়া মনটা একটু ভালো করলো সুমি। মনে শুধু জাগলো একটাই প্রশ্ন, আচ্ছা সব দাদুরা একরকম হয়না কেনো? মা সবসময় বলে এখন মেয়েদের খুব বিপদ চারপাশে দুষ্টু লোক ঘুরছে তাই খুব সাবধানে থাকতে হবে কিন্তু এই প্রথম বোধহয় বাড়িতেই দুষ্টু লোক দেখলো সুমি।
              দুপুরে নীচে খাওয়াদাওয়ার আয়োজন ছিলো।" মাম্মা ও মাম্মা ওঠ সোনা, ঘুমিয়ে পড়লি নাকি চল খেতে হবে তো।" মেয়েকে নিয়ে নীচে নামে সৃজা। সবাই একটু একটু করে আসছে,প্রথমে বসলো বাচ্ছারা,সুমি আর রুম্পি পাশাপাশি বসে খেলো,দূরে দাঁড়িয়ে দেখে সৃজা আর মনে মনে ভাবে বাব্বা কি ভাব দুটোতে, পাশাপাশি বসে দুজনে একটু একটু করে কথা বলছে। যাক  তাহলে ঝামেলাটা মিটলো,ঐ তো মেয়ের মুখে হাসি ফুটেছে। অন‍্য বাচ্ছাদের সাথে সুন্দর বসে খিঁচুড়ি খাচ্ছে , মাঝে মাঝে মায়েরা এসে তদারকি করছে। ওদের খাওয়ার পর ফ্ল্যাটের বড়রা বসে,তখন রুম্পি বায়না করে পরিবেশন করার জন‍্য। অন‍্য বাচ্ছারাও কিছু করার জন‍্য বায়না করে। মায়েরা রাজী হয়ে যায় সত‍্যিই তো কাজ শিখতে হবে ওদেরও তাই উৎসাহ দেওয়া উচিত। বাচ্ছাদের এইভাবেই তো এগিয়ে আসতে দিতে হয় এটা খুব বিশ্বাস করে সৃজা। গ্লাসে বেশ সুন্দর করে জল দিলো সুমি। গ্লাস গুলো দিলো বুবান আর বিট্টু। সত‍্যি কি সুন্দর মিলেমিশে ওরা কাজ করছে। আসলে আজকাল তো অনেকেরই সিঙ্গল ইস‍্যু তাই এই আন্ডারস্ট্যান্ডিং গুলো যদি এভাবেই আসে। সত‍্যিই তো সৃজার ছোটবেলা মেলেনা সুমির সাথে। কি সাঙ্ঘাতিক দস‍্যিপনা করতো ওরা,একদম পাড়ার ছেলেদের সাথে সমান তালে পাল্লা দিয়ে। চুটিয়ে মজা আর খেলা,শীতে খিঁচুড়ি ডিমের চড়ুইভাতি ওহ্ সে এক কান্ড সবার বাড়ি থেকে একটু একটু করে চাল ডাল আর তেল দিয়ে রান্না আর কলাপাতাতে খাওয়া সাথে ডিমের অমলেট। বাড়ীর উঠোনে রবীন্দ্রজয়ন্তীতে ডাকঘর নাটক অভিনয় করা সবাই মিলে। মনে হলেই এখনো আনন্দ আর শুধুই আনন্দ হয়। সরস্বতীপূজো মানে তো আরেক খুশির ঝলক। সারারাত জেগে মায়ের শাড়ী দিয়ে প‍্যান্ডেল তারপর সকালে গায়ে তেল হলুদ মেখে স্নান করে হলুদ শাড়ী পরে এলোচুলে অঞ্জলি দিয়ে ফুলকো লুচি আর পায়েশ দিয়ে সকালে খেয়েই একছুটে স্কুলে যাওয়া। মা অঞ্জলি দেওয়ার পর পায়েশ খাওয়াতেন সবসময় বলতেন সিদ্ধিলাভ হয় পায়েশ খেলে যেমন গৌতমবুদ্ধের হয়েছিলো। তারপর শুধু আড্ডা তবে একটু বড় হওয়ার পর স্কুলের পূজোর ফল কাটা সাজানো কত কাজ করতে হোত। এর মাঝেই ছিলো একটু ভালোলাগা আর ছোট্ট ছোট্ট রোমান্টিক অনুভূতি। শুধু মায়ের কড়া অর্ডার ছিলো সন্ধ‍্যের আগে বাড়ী ঢুকতে হবে। তখন সত‍্যিই এতোটা ভয় আর নিরাপত্তাহীনতা ছিলোনা। সেকাল আর একাল ভাবলেই যেন কেমন আনমনা লাগে সৃজার। এখন শুধুই ভয় আর ভয়। মেয়েকে চোখে চোখে আগলে রাখা। মেয়ের কাছে তো বলতেই পারেনা সব দুষ্টুমির কথা। ছোটবেলার কথা মনে হতেই একঝলক মিষ্টি হাওয়া উড়ে এলো সৃজার চোখেমুখে। মনটা খুশি হয়ে গেলো।
          ছেলেরা খেতে বসেছে,ওহ্ বাবা রুম্পিটা তো বেশ পাকা গিন্নী হয়েছে! ওর মাকে বাড়িতেও হেল্প করে শুনেছে। রুম্পির মা কেমন যেন আলগা দিয়ে মানুষ করে মেয়েকে ছোটথেকেই নাকি নিজের কাজ করতে অভ‍্যেস করিয়েছে। আজকাল একটা একটা বাচ্ছা সবার কি করে যে মেয়েটাকে দিয়ে কাজ করায়! হাতে গরম খিঁচুড়ি আর হাতা নিয়ে পরিবেশন করছে,সত‍্যি মেয়েগুলো কখন যে বড় হয়ে যায় বোঝা যায়না। মনটা একটু আনমনা হয়ে যায় সৃজার সুমির দিকে তাকিয়ে। হঠাৎই একটা আঃ শব্দ কানে আসতেই মুখ ফেরায়। ওহ্ ইশ্ সত‍্যিই তো রুম্পি কি পারে সামলাতে ! হাজার হোক বাচ্ছা মেয়ে,ওর মাও শোনে ওর বায়না। এক হাতা গরম খিঁচুড়ি একদম তিনতলার মেসোমশাই মানে মিঠুর বাবার পাজামায় ফেলেছে। নিশ্চয় জ্বালা করছে খুব। সবাই ছুটে আসে,একটু বিরক্ত হয় মিঠুও।" খুব জ্বালা করছে বাবা? সত‍্যি কি যে কান্ড! এই যাওনা একটু বরফ নিয়ে এসো।" মেসোমশায়ের মুখটা দেখে সত‍্যিই খারাপ লাগে সৃজার। রুম্পি এটা কি করলো,ওর মা তো খুব বকুনি দিচ্ছে মেয়েকে হঠাৎই নজর পরে রুম্পির দিকে সৃজার। একি! রুম্পির মুখটা যেন একটা জয়ের হাসিতে উজ্জ্বল বিন্দুমাত্র অনুতাপ আর দুঃখের চিহ্ন নেই,যেন এক অদ্ভুত আনন্দে চকচক করছে মুখটা, মায়ের বকুনির তোয়াক্বা না করে সুমির মুখের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। মনে মনে হতবাক লাগে সৃজার, সত‍্যিই আজকাল ছেলেমেয়েদের কি মানসিকতা। বিন্দুমাত্র অপরাধবোধ বা সহানুভূতি নেই খারাপ কাজ করে। মায়ের বকাবকিতে ছোট্ট করে সরি বলে ওখান থেকে সরে যায় বাচ্ছাগুলোর সাথে। পেছন ফেরে সৃজা,কানে আসে রুম্পির গলাটা আর হাসি আর ছোট্ট কথা "ডান্"।
         আসলে তখনও রুম্পির পিঠটা জ্বালা করছে,দাদুর আদরে, আর সুমির সাথে কি হয়েছে পুরোটাই তো ওর চোখের সামনে ঘটেছে। যদিও বাবান,বিট্টু আর দুটো ছোট ভাই বুঝতে পারেনি কি হয়েছিলো। ভেতরটা কেমন যেন ফুঁসছিলো রুম্পির বুঝতে পেরেছিলো মা বাবাকে দিয়ে নয়,ওর অপমানের জবাব ওই দেবে একদম নিজের মতো করে। আর সুমির জবাবটাও দেবে,সুমিও তো একটু একটু করে বড় হচ্ছে আর কেউ যেন ওর নরম শরীরে থাবা বসাতে না পারে সেটা ওকে বোঝাতে হবে।
         " কেমন হলো রে? দুষ্টু লোকেদের এমন করেই শাস্তি দিতে হয় জানিস,এই যে গোলু গোলু তুলতুলি।" আদর করে সুমিকে তুলতুলি বলে ডাকে রুম্পি।
  চোখের সামনে অদ্ভুত এক কান্ড দেখে কেমন যেন চমকে গেছে সুমি। আজ সকালের পর থেকে কি সব যে হচ্ছে এখানে,আর ভালোলাগেনা। তবে আজ সত‍্যি রুম্পিদির জন‍্য ওর মনে অদ্ভুত এক ভালোবাসা জাগলো, মনে হোলো টিভিতে দেখা সাহসী মেয়ে দিদিটা। যাদেরকে রিপাবলিক ডে তে টিভিতে দেখায়।
          বাড়িতে এসে সুমিও বকা খেলো সৃজার কাছে," এই যে খুব পাকা হচ্ছিস না দিন দিন, রুম্পিটা সত‍্যিই কেমন যেনো আ্যডামেন্ট হয়ে গেছে,কত বড় একটা কান্ড ঘটালো অথচ কোনো তাপ উত্তাপ নেই। আড়ালে গিয়ে হাসছিলো তোকেও তো দেখলাম হাসতে। এরপর আর বেশি রুম্পির সাথে মিশতে হবেনা তোকে। ও ডাকতে এলে আমি বারণ করে দেবো। পাকা মেয়ে একটা।"
        মনটা কেমন যেন অন্ধকার হয়ে যায় সুমির,রুম্পিদিদি কেনো এমন করলো কি করে মাকে বলবে। সত‍্যিই তো ওর বাড়ীর দাদু,মামু আর কাকানরা কতো ভালো সবাই ওকে কতো ভালোবাসে। এই ফ্ল্যাটের আঙ্কেল,দাদাভাইরা সবাই কত কত ভালো।তাহলে এই দাদুটা এমন কেন? কে দেবে ওর প্রশ্নের উত্তর।
       বিকেলে ওকে আর নীচে নামতে দেয়না সৃজা, রুম্পিরা ডাকতে এলে ওদের ফিরিয়ে দেয়, ইশ্ কেন যে তুলতুলিটা এলোনা মনটা কেমন যেনো করে ওদের। আড্ডা আর খেলাটা ঠিক জমেনা ওদের,তাই আবার পুচকেগুলো ডাকতে আসে। অনি বিরক্ত হয়," কি ব‍্যাপার সৃজা মেয়েটা পূজোর দিন মুখটা ছোটো করে বাড়িতে বসে। ওকে একটু নামতে দাও নীচে। তোমার যে কখন কি হয় বুঝিনা!এই বাচ্ছাগুলোই তো এই ফ্ল্যাটটার প্রাণ।"
         অগত‍্যা মেয়েকে তৈরী করে নীচে পাঠায় সৃজা অনিই দিয়ে আসে,আর নিজেও বসে থাকে সৃজার কড়া আদেশে। একটু বাদেই তো আরতি হবে। "
   রুম্পি সুমির কাছে শুনে বুঝতে পারে ওকেই আন্টিকে বলতে হবে ব‍্যাপারটা। সত‍্যিই তো তুলতুলিটা একদম বাচ্ছা এখনো।
        পরের দিন রুম্পি আর ওর মা আসে সৃজার কাছে। প্রথমে ওর মা শুরু করলেও রুম্পি গুছিয়ে বলে পুরোটা। হাতের মুঠোটা শক্ত হয়ে যায় সৃজার চোখদুটোতে আগুন ঝরে শুধু মনটা বড্ড খারাপ হয়ে যায় মেয়েটার দিকে তাকিয়ে। আজ সত‍্যিই ওর নতুন করে দ‍্য বেষ্ট মনে হলো রুম্পিকে। সত‍্যিই রুম্পিটা বড় হয়েছে, ভাগ‍্যিস ও ছিলো। নাহলে যে কি হোত! তবে মিঠুকে বলতে হবে,ও কিছুতেই ছাড়বেনা।" আন্টি একটা কথা বলবো,তুমি শুনবে বলো।"...." আচ্ছা বল সোনা,আমি তো আর মাথা ঠিক রাখতে পারছিনা।"
......" একটু ভরসা করোই না আমাদের ওপর। আমরা এক ফ্ল্যাটে থাকি, মিঠু আন্টি কি আর মুখ দেখাতে পারবে একথা শুনে। হয়ত বিশ্বাসও করতে পারবেনা। বদনামটা আরো ছড়াবে। সম্পর্কগুলো নষ্ট হবে গো। কতদিন তোমরা আমাদের এইভাবে আমাদের প্রোটেক্ট করবে। আমাদেরও তো বাইরে বেরোতে হবে, এইভাবেই খারাপ ভালোর মধ‍্যে বড় হতে হবে। আমি তো দাদুকে পানিশমেন্ট দিয়েছি আমার মতো করে। এরপর কিছু খারাপ করতে হলে দাদু একবার ভাববে।"
      অবাক হয়ে যায় দুই মা, দুজনেই ওদের ছোট্ট দুর্গাটাকে দুচোখ ভরে দেখে। সমাজের অশুভশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন‍্য হাতে তুলে নিয়েছে ওর ছোট্ট ত্রিশূল,এক হাতা গরম খিঁচুড়ি। প্রতিবাদ করেছে,শাস্তি দেবার সাহস দেখিয়েছে একদম ওর নিজের বুদ্ধিতে আর নিজের মত করে।হয়ত বা একটু নিশ্চিন্তও হয়।
         আর রুম্পির সাথে খেলতে বাধা দিতে পারেনা সৃজা সুমিকে। মেয়ের ঘটনার পর সৃজাই হয়ত এখন অনেকটা পরিণত মা হয়েছে। আসলে মানুষের শেখা সত‍্যিই কখনো থেমে থাকেনা,বাচ্ছাদের সাথে মায়েরাও একটু একটু করে হয় পরিণত।একটু একটু করে বড় হচ্ছে তুলতুলি আর অন‍্যরাও।
এরমাঝেই শুনলো একদিন বিট্টু নাকি বাবাকে মায়ের পক্ষ নিয়ে কি বলেছে,এই নিয়েও ওর বাবা নাকি অনিকে বলেছে ,"আর বোলোনা কি অবস্থা ভাবো,নিজের গিন্নির অকাজের অভিযোগ জানাতেই ছেলেটা ফোঁস করে ওঠে সারাদিন মা এতো করে তার উপরেও অভিযোগ করো, কেন আর কি করবে মা। এই জন‍্যই তো মেয়েদের এতো অসম্মান,মাকে ছাড়া চলেনা তোমার আবার মাকে যা খুশি বলো। এই সব ওই রুম্পিটার জন‍্য বুঝেছো। বেশি স্বাধীনচেতা হলে এমনই হয় অবস্থা। বুঝবে পরে ওর মা বাবা। আমার ছেলেটারও মাথাটা খাচ্ছে।"
           বিট্টুর বাবার অভিযোগের কোন উত্তর দিতে না পারলেও মনে মনে রুম্পিকেই সাপোর্ট করে অনি। ভালোলাগে হয়ত অনেকটা,বিট্টুটা মাকে বুঝছে,সম্মান করছে আর সহানুভূতি রেখেছে মনে। চ‍্যারিটি বিগিনস আ্যট হোম।
           দিন দিন যেন বড্ড ডানপিটে হয়ে উঠছে রুম্পিটা,তবে সত‍্যিই দেখলে ভালো লাগে। ওর মা বাবাকে বুঝিয়ে পড়াশোনার বাইরে যে আরো কত কি শেখে, আর তার সাথে পাল্লা দিতে চায় সুমিটাও। কখনো শিখতে চায় যোগা,কখনো বা ভর্তি করার জন‍্য বায়না করে ক‍্যারাটে ক্লাসে। দেখতে দেখতে সুমির ক্লাস সেভেন। রুম্পি এখন ইলেভেনে পড়ে,একদিন ওর কাছেই বলে সৃজা," কি ব‍্যাপার রে,তোকে তো আজকাল দেখতেই পাইনা।  তোর মা বলে সারাক্ষণ নাকি ব‍্যস্ত থাকিস। আর তোকে দেখে সুমিটার শুধু বায়না,এটা শিখবো ওটা শিখবো রুম্পিদি করছে তো। আমি তো ছুটোছুটি করে আর পারছিনা। তাছাড়া এরপর উঁচু ক্লাশ হবে,কখন এতো কিছু করবে বলতো?"
         সৃজা হয়ত ভাবেনি রুম্পি এভাবে উত্তরটা দেবে," ওমা তুমি ছুটোছুটি করবে কেন, নিজের প্রোটেকশন নিজেই করবে তুলতুলি। আচ্ছা আন্টি অন‍্য প্রাণীরাও তো বাচ্ছাদের একসময় ছেড়ে দেয় স্বাবলম্বী হওয়ার পর। বাইরের দেশগুলোতেও বাচ্ছাদের একটা বয়েসের পর স্বাবলম্বী করার চেষ্টা করা হয়। শুধু বোধহয় আমরা ভারতীয়রাই মেয়েদের সামনে হাজারটা না এনে তুলে ধরি। মেয়েরা কিছু করতে পারবেনা, মেয়ে মানেই সে হ‍্যান্ডিক‍্যাপড,মেয়ে মানেই কোন প্রোটেক্টিভ প্রপার্টি এমন কেনো? আমি চাই তুলতুলিও একা একা একটু করে ঘরে বাইরে স্বাবলম্বী হোক। বুঝুক ভালোমন্দের পার্থক‍্য। যেমন সেদিন বুঝেছিলো দাদুর টাচ টা ব‍্যাড্। আসলে প্রকৃতির নিয়মেই বাচ্ছারা অনেক কিছু বুঝতে শেখে,আগুনে হাত দিলে হাতটা পুড়বে এটাও শেখে। তাই তুলতুলিও শিখবে আর আমাদের ফ্ল্যাটের ভাইয়াগুলোও শিখবে বাঁচতে শেখা আর বাঁচতে দেওয়া দুটোই জরুরী।"
             আশ্চর্য হয়ে যায় সৃজা,কি করে এতোটা পরিণত হলো মেয়েটা,তবুও বলে" কিন্তু কি করে ছাড়বো বলতো সোনা, যা ঘটনা ঘটছে চারদিকে। ..." একটু হাসে ভারতীয় নারীদের তোমরা জননী রেখেছো ভীতু করে সাহসী করোনি, আমাকে ক্ষমা কোরো কবিগুরু তোমার কথাটাকে একটু আমার মতো করে নিলাম।ঠিক আছে ওকে একটু সময় দাও ও ঠিক পারবে। প্রথমে সাইকেল চালিয়ে যাবে,তারপর আমার মতো স্কুটি আর তারপরে একদম বড় গাড়ী।"
               সৃজা স্বপ্ন দেখলো,স্বপ্ন দেখালো আজকের নির্ভয়া প্রজন্ম যাদের শেখা দরকার প্রতিবাদ আর প্রতিরোধ কেমন করে করতে হয় সমাজের ভালো মানুষগুলোর সাথে হাত মিলিয়ে। গুডটাচ আর ব‍্যাডটাচের মধ‍্যে বড় হওয়া এক উজ্জ্বল চকচকে মুখই বোধহয় রুম্পির মত আরো অনেকে,যারা প্রস্তুত নিজেকে বাঁচানো আর বাঁচতে দেওয়ার লড়াইয়ের ময়দানে স্বাধীনভাবে চলতে, আর অনেককে চলতে শেখাতে। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে এক অভয়া নারী ভবিষ‍্যত প্রজন্মের আরেক সর্বজয়ার দিকে যে নিজেকে আর তার চারপাশকে একটু একটু করে বদলানোর স্বপ্ন দেখে নিজের মতো করে। মনে মনে ভালবাসা ভরা একরাশ আশীর্বাদ উপচে পড়ে ওর দুচোখ দিয়ে," এভাবেই এগিয়ে যা, জয়ী হ জীবনযুদ্ধে, আমরা আছি তোদের সাথে সবসময়।"

সমাপ্ত:-
          
             
          

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...