#শান্তিরূপেণ#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
যেদিন বাবা বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছিলো আমি আর ভাই যখন কাঁদছি তখন আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম মাকে দেখে। মা তানপুরা নিয়ে বিভোর হয়ে গাইছে,' প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে মোরে আরো আরো দাও প্রাণ।'
দুচোখ দিয়ে অঝোরে জল গড়িয়ে পড়ছিলো মায়ের। এমন শান্ত ধীর স্থির মূর্তি কোনদিন দেখিনি মায়ের।আমরা দুই ভাইবোন,
ভাই ছোট ক্লাশ ফাইভে পড়ে,আর আমার ক্লাশ এইট। হাসি মজায় আর গানে গমগম করতো আমাদের বাড়িটা। মা গান করতো আর বাবা তবলাটা নিয়ে বসে পড়তো মায়ের পাশে। আমাকে গান শেখাতো মা,আর ভাইটা বড় ছটফটে কখনো বাবার কাছে তবলার বোল তুলতো আবার কখনো মায়ের কাছে সরগম শিখতো। ও নাকি তবলা বাজাতে বাজাতে গেয়ে দিদিকে হারিয়ে দেবে।
আমি শ্রেয়া আর ভাই রাহুল। বাবা আর মায়ের দুপাশ জুড়ে থাকতাম। ছোটবেলা থেকেই মা বাবার মধ্যে খুব মিল দেখে বড় হয়েছি। মায়ের সকালে স্কুল আর বাবার দুপুরে,তাই আমাদের কোন অসুবিধে হোত না। কাউকে না কাউকে পেতাম সাথে খুব একটা একা থাকতে হত না।
আমি আর ভাই যখন পাশের বাড়ির বাচ্ছাটার সাথে খেলতাম তখন সবসময় পুতুল খেলতে গিয়ে বলতাম মা বাবা পাশাপাশি ঘুমোয় আর বাচ্ছারা পাশে। ও রাজী হত না বলতো আমি তো মা বাবার মাঝখানে শুই,তোরা ভুল বলছিস।
ছোটবেলায় আমাদের যখন প্রাইমারী স্কুল ছিলো তখন স্কুল থেকে ফিরে খেয়ে দেয়ে মায়ের পাশে শুয়ে কত গল্প শুনতাম আর তারপর একটা সময় মা কড়া পাহাড়ায় দুপুরে অঙ্ক করাতেন,আমার হাইস্কুল হয়ে গেছে,অনেকটা সময় মায়ের সাথে দেখা হয়না তবে ভাই এখনো মায়ের আদর খাচ্ছে,সামনে বার ওর হাইস্কুল হবে।
বাড়ি এসে মাকে দেখতে পেয়ে সত্যিই খুব মজা হোত। বাবা মা দুজনেই প্রাইমারী স্কুলে পড়াতো,আনন্দে আর খুশিতে বেশ কেটে যেতো আমাদের দিন। একঢাল কোঁকড়া চুলে না সেজেও মাকে যে কি সুন্দর লাগত! মনে হোত দেবী রূপে আমাদের মা,আর তেমনি মিষ্টি মায়ের গান।
এই গানের জন্য আমাদের বাড়ি আসতো অনেকেই,সন্ধ্যেবেলা বাড়ির পরিবেশটা পুরো পাল্টে যেতো। মায়ের হাতে তানপুরা আর বাবার হাতে তবলা। সেদিনের কথা আজোও বেশ মনে পড়ে আমার, একদম চোখ বুজলে সামনে দেখতে পাই। সামনেই রবীন্দ্রজয়ন্তী,মায়ের কয়েকজন ছাত্রী আমাদের পাড়াতেই থাকতো,ওরা এসেছিলো গানগুলো তুলতে। বাবার আসার সময় হতেই মা বললো,"তোরা যা এবার,কাল আবার আসবি। এখনো তো কয়েকদিন বাকি,তার মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে। আমি আছি তো।"
বাবা ফেরার আগে মা একটু ফিটফাট হয়ে থাকে,তখন এতো ভালো শাড়ি পাওয়া যেতোনা তবে তাঁত বা ছাপায় অসামান্য লাগতো মাকে। গায়ের কাছে গিয়ে বলতাম," কি মাখো গো মা,এতো মিষ্টি গন্ধ বেরোয় তোমার গা দিয়ে।'
বাগানের কোণের স্বর্ণচাঁপা গাছটা ফুলের গন্ধে ভরিয়ে রাখতো। মা প্রতিদিনই ঝকঝকে কাঁসার রেকাবিতে কয়েকটা ফুল এনে জলের মধ্যে রেখে দিতো। বাবা এসে খুব খুশি হোতো।
আমাদের দুজনেরই কাজ ছিলো বাবার সাইকেলের ঘন্টি শুনলেই ছুটে যাওয়া," কি এনেছো বাবা আজ?"
সেদিনও বাবা আসাতে আমরা ছুটে গিয়েছিলাম।বেড়িয়ে দেখি বাইরে একটা সাইকেল রিক্সা দাঁড়িয়ে,বাবা একজনকে হাত ধরে সাহায্য করছে রিক্সা থেকে নামতে। খুব অবাক লাগে,দৌড়ে আমরা যাই মাকে খবর দিতে,মা বেড়িয়ে আসে বাইরে। মাকে দেখেই বাবা বলে, " জয়া এই যে তোমাকে বলেছিলাম না,রাণুর কথা। এই যে ওকে একটু ধরে নিয়ে যেও।" দেখলাম মা এগিয়ে গেলো তাড়াতাড়ি হাসিমুখে," এসো এসো, খুব খুশি হয়েছি তুমি এসেছো বলে।"
ভদ্রমহিলার হাঁটাতে অসুবিধে আছে বুঝেছিলাম,পোলিওতে একটা পা সরু হয়ত ভালো জোর পাননা। তাই বাবা সাহায্য করছিলো এতক্ষণে বুঝলাম। মা ধরে নিয়ে গিয়ে ঘরে বসান ওনাকে,অবশ্য দেখলাম একা একা অসুবিধে করে যাতায়াত করছেন। আমরা দুই ভাইবোন তখন পর্দার আড়ালে,মা ডাকলো আমাদের বললো," প্রণাম কর পিসিমা হন।" সম্পর্ক তৈরীতে মায়ের জুড়ি ছিলোনা,বাবার কলিগরা কাকু আর পিসি। মায়ের কলিগরা মাসি। উনি আমাদের ডেকে ভাব করে নিলেন তারপর ব্যাগ থেকে চকোলেট বার করে হাতে দিলেন। মা অবশ্য বললো এসবের কি দরকার।
ততক্ষণে বাবা একটু ফ্রেস হয়ে ঘরে এসেছে," জয়া রাণু আজ এসেছে তোমার কাছে গান তুলবে বলে,ও গান গায় তবুও একটু দেখিয়ে নিতে এলো,আর বোলোনা আমাকেও দলে টেনেছে। এবার তবলা ছেড়ে আমাকেও গাইতে হবে,সবার আবদার।"
মিষ্টি হেসে মা বলেছিলো," ভালোই তো,এই তো জব্দ। কত ভালো গান গাও তুমি অথচ আমি পারলাম না তোমায় আমার সাথে বাড়িতে ছাড়া বাইরে গাওয়াতে। যাক ওরা পেরেছে।"
গান শুরু হয়,মায়ের সাথে সাথে বাবা ও রাণুপিসিমাও গাইতে শুরু করে 'আমি পথভোলা এক পথিক এসেছি।'.....পুরানো সেই দিনের কথা। আরো দুএকটা গান। ভাই বসে বসে চকলেট খেলেও আমার যেন কেন ভালো লাগলোনা,যে গানগুলো বাবা আর মা একসাথে গাইতো তার মাঝে অন্য কাউকে গলা মেলাতে শুনে।
বেশ কিছুক্ষণ থেকে রাণুপিসিমা চলে গেলেন,বলে গেলেন আরেকবার এলেই হয়ে যাবে মোটামুটি তৈরি। মা বললো," তুমি তো বেশ গাও,তোমার সবটাই তৈরি আছে। ঠিক হয়ে যাবে।"
বাবা পৌঁছে দিয়ে এলো রাণুপিসিমাকে রিক্সা করে। রিক্সায় ওদের পাশাপাশি বসতে দেখে আমার কেন যেন একটু অস্বস্তি হলো। মায়ের মুখে তখনো হাসি।
এর মধ্যে রাণুপিসি আরো দু তিনদিন এসে গেছেন আমাদের বাড়িতে। মাকে দেখে আর মায়ের গোছানো সংসার দেখে মুগ্ধ হয়ে বলতেন," সত্যি সিদ্ধার্থদা, জয়া বৌদির কোন তুলনা হয়না,আর তেমন মিষ্টি আপনার ছেলেমেয়ে দুটো। এত বাধ্য দেখাই যায়না। বৌদি তোমাদের বাড়ি এলে মনে হয়না আমি আর আমার ভাড়া বাড়িতে ফিরে যাই। আসলে তো মাসদুয়েক হলো এই চাকরিটা পেয়ে আমার এখানে আসা। বাড়ি বলতে তো তেমন কিছুই নেই আর এই অচল বোন তো ভাইদের বোঝা। মা বাবাও নেই,তাই তোমাদের বড় আপন লাগে গো।"...
......." চলে এসো,যখনই মন খারাপ হবে তোমার দাদার সাথে। বিকেলটা তো আমি বাড়িতেই থাকি। ভালোই হবে,আমিও একটু গল্প করে বাঁচবো।"
বাবার স্কুলের কবিপ্রণামের দিন আমরা সবাই মিলেই গেলাম। রাণুপিসিকে দেখে মা বললো," বাহ্ বেশ লাগছে দেখতে তোমায় রাণু।"
......" খুব চিন্তা হচ্ছে বৌদি ঠিকমত গানগুলো গাইতে পারবো কিনা?"
...." সব ঠিক হবে,তোমার দাদা তো আছেই তোমার সঙ্গে।"
বাবাকেও বেশ ভালো লাগছিলো। বাবার জামাকাপড় মা সব ঠিক করে দিতো। তাই পাঞ্জাবী আর পায়জামাতে বাবাকেও খুব ভালো লাগছিলো। খুব ভালো গান গাইলো,বাবা আর পিশি। বাবাকে তবলা বাজানোর বাইরে এই প্রথম গাইতে শুনলাম। দুটো গানের পর স্কুলের স্যারেরা ধরলেন আরেকটা গান শোনাতে। পিসিকে খুব চিন্তিত মনে হলো, বাবাকে দেখলাম ওনাকে কিছু বলতে। তারপর গান শুরু হলো,' আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ। বাবা যেন একটু বেশিই ভালো গাইলো,মা কে আর বাবাকে প্রায় শুনেছি এই গানটা একসাথে গাইতে। তাই কেমন যেন মেলাতে পারলাম না। আসলে মনে হত ঐ গানটা শুধুই মা বাবারই গান। মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম,মায়ের হাসিমুখটা কেমন যেন হয়ে গেছে। অদ্ভুত এক মনখারাপের ছায়া সেখানে,তাহলে কি মায়েরও আমার মতোই মনে হচ্ছে এই গানটা শুধু মা আর বাবারই গান। মনটা কেমন যেন খারাপ হয়ে গেলো।
অনুষ্ঠান শেষে বাবা আমাদের রিক্সায় তুলে দিয়ে বললেন," তোমরা যাও আমি রাণুকে পৌঁছে দিয়ে একটু বাদেই আসছি।"
বড় চুপচাপ লাগলো মাকে,জিজ্ঞেস করলাম তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে মা। " এই তো ভালো আছি,বোকা মেয়ে,শুধু মায়ের জন্য চিন্তা।"
রাণুপিসি মাঝে মাঝে আমাদের বাড়ি আসতো,আমার সেদিনের গানের পর আর কেনো জানিনা ভালো লাগতো না পিসিকে। শুধুই মনে হত আমাদের মাঝে কেউ চলে আসছে। মাকে একদিন বলাতে মা বলেছিলেন," মন ছোট করতে নেই,মেয়েটা ভালো করে হাঁটতে পারেনা। কোন আপনজন নেই। এখানে আসে একটু ভালোবাসা পেতে।"
এরপর কেটে গেছে প্রায় মাস ছয়েক, সেদিন আমার ছুটি ছিলো,আমি আর ভাই দুপুরে ঘুমোচ্ছি। হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে যায়,কলি কাকিমা এসেছে মনে হয় কথা শুনছি। অরুণকাকু বাবার স্কুলেই চাকরি করেন। এই ছোট মফস্বল শহরে সবার সাথে সবার ভালো সম্পর্ক আর যাতায়াত তাই কাকিমা সময় পেলেই চলে আসে। আমি পাশের ঘরে যাবো বলে পর্দার কাছে দাঁড়াই শুনতে পাই," জয়াদি এবার একটু দেখো,এতোদিন তোমায় তেমনভাবে কিছু বলিনি। আচ্ছা তোমার চোখে কি কিছুই পড়েনি। নাকি তুমি বুঝেও কিছু বলোনা। স্কুলে সবাই কানাকানি করছে। তুমি এবার সিদ্ধার্থদার সাথে কথা বলো আর দেরি করোনা। স্কুলের পিকনিকে তো.. থাক সেকথা তোমায় বলবোনা। তোমার কষ্ট হবে। সবাই দেখছে,তেমন কিছু বলতে পারছেনা।"
....." মন খারাপ কোরোনা কলি,জোর করে কাউকে আটকে রাখা যায়না গো। যদি সত্যি আমার ভালোবাসার জোর থাকে তাহলে তোমার দাদা কোথাও যেতে পারবেনা। সবসময় ওর কি ভালো লাগে ওর যা পছন্দ তাই তো করে এসেছি। তাই ওর পছন্দের মানুষটাকে যে আমিও আপন করে নিয়েছিলাম। ভাবতে পারিনি রাণুর আমার সংসারের আসল মানুষটাকেই দরকার হবে।"
আগে কি কথা হয়েছিলো শুনিনি,পরে যে কথাগুলো কানে এলো তাতে একদলা কান্না গিলে আবার এসে ভাইকে জড়িয়ে ধরে ভাইয়ের পাশে এসে শুয়ে পড়লাম। সবে বড় হচ্ছি তখন,শুধু বুঝলাম একটা ভাঙন আসছে আমাদের এই ছোট্ট হাসিখুশি ভরা সংসারে।
কলি কাকিমা চলে যাবার কিছুক্ষণ বাদে মা এসে ডাকে,"ওঠ তোরা প্রায় সন্ধ্যে হয়ে আসছে আর কত ঘুমোবি?"
......বাবা এখনো আসেনি মা?
মায়ের মুখটাতে এক অদ্ভুত বিষাদের ছাপ দেখেছিলাম।..." এসে পরবে,তোদের তো পড়তে বসতে হবে। বাবা হয়ত কোথাও গেছে।"
আসলে তখন মোবাইল ফোনও ছিলোনা,যে খবর পাওয়া যাবে। বাবা ফেরে বেশ দেরিতে। আমি ভাইকে নিয়ে পাশের ঘরে শুয়ে পড়ি। রাতে বাবার সাথে মায়ের কি কথা হয়েছিলো জানিনা,সকালে মায়ের চোখদুটো বড্ড লাল লেগেছিলো মনে হয়েছিলো সারারাত মা বোধহয় ঘুমোয়নি,খুব কান্নাকাটি করেছে।
সকালে মা যথারীতি স্কুলে চলে গেলো। আমার সাথে বাবার দুয়েকটা কথা হলো,কেন জানি আমার বাবার সাথে কথা বলতেই ইচ্ছে করছিলো না খুব রাগ হচ্ছিলো মাকে কষ্ট দিচ্ছে বলে। আমি ভাই আর মায়ের চেয়ে বাবার কাছে রাণুপিসি বড় হলো। বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে এসে দেখলাম মা শুয়ে আছে,বললো শরীরটা ভালো লাগছেনা। কয়েকটা বাচ্ছা আসে মায়ের কাছে গান শিখতে ওদের না করে দিতে বললো।
আমার কেমন যেন আশ্চর্য লাগলো ভাবতেই পারলামনা মা সন্ধ্যেয় রেওয়াজ করবেনা। বাগানের ফুলের গাছগুলো থেকে ফুল তুলে আজ আর কেউ ঘরের কোণ সাজায়নি। আজ মায়ের সন্ধ্যেবেলায় শাড়ি ছাড়া হয়নি,হয়ত সে প্রয়োজন ফুরিয়েছে। আমি ভাইকে সামলালাম ও সামনের মাঠে খেললো আমি দাঁড়িয়ে শুধু ভাবলাম আমি থাকবো মায়ের সাথে।
বাবা অনেকটা রাতে ফিরলো। এরমাঝে পাশের বাড়ির ঠাম্মা এসে বলে গেলেন," সিধুটার কি এই বয়সে ভীমরতি হলো না কি রে? এইজন্যই পুরুষমানুষকে আলগা দিতে নেই। খাল কেটে কুমীর ঢুকিয়েছিলি বাড়িতে। ছিঃ এমন সোনার চাঁদ ছেলেমেয়ে দুটো আর এমন লক্ষ্মীমন্ত বৌ ফেলে ঐ খোঁড়া মেয়েটার মধ্যে কি দেখলো কে জানে। সবাই তো কানাকানি করছে। তুই কড়া করে ধর। ঐ মেয়ের সাথে কথা বল।"
.....মা শুধু ম্লান হেসে বলে," দেখছি মাসিমা,আসলে কি করবো আমি নিজেই জানিনা। জোর করে কি কাউকে আটকে রাখা যায়?"
...." তুই ওর বৌ তুই জোর করবি না তো কে জোর করবে শুনি। দরকার হলে মামলা করবি।"
মা হার মেনেছিলো,মামলা মা করেনি। কলি কাকিমা আর অরুণকাকুও এক কথা বলেছিলো। পাশের ঘর থেকে শুনেছিলাম মা বলছিলো," আমাদের বিয়েটা যে মন্দিরে হয়েছিলো ঠাকুরপো, মা বাবা মরা মেয়ে আমি। মামারা বিয়ে দেবেননা বলে মন্দিরে বিয়ে করেছিলাম তারপর একটা ছোট অনুষ্ঠান। তখন অত রেজেষ্ট্রী ছিলোনা,পরে ওকে বলেছি। ও তেমন মাথা ঘামায়নি। সবসময় বলতো ছেলেমেয়েরা বড় হচ্ছে এখনো ভয় পাও আমি ছেড়ে যাবো। আর রেজেষ্ট্রী হলেই বা কি ছিলো ঠাকুরপো। যার মন থেকে আমি মুছে গেছি তার শরীরটাকে জোর করে আটকে।"
বেশ কয়েকদিন মা স্কুলেও যায়নি,গান করতেও বসেনি। আমাদের বাড়িটা একটা নিরানন্দপুরী হয়ে গিয়েছিলো। সেদিন বিকেলে হঠাৎই মায়ের হাতে দেখলাম তানপুরাটা,মনটা ভরে গিয়েছিলো খুশিতে। মা আবার গান গাইবে,অনেকদিন বাদে মাকে দেখলাম শাড়িটা ছেড়ে খুব সুন্দর একটা শাড়ি আলমারী থেকে বার করে পরতে। আজ বাগানের ফুলগুলো কি সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে মা ,দেখে মনটা ছুঁয়ে গেলো।
মা একের পর এক গান গেয়ে যাচ্ছে,খুব ভালো লাগছে। মনে হলো যেন সব ঠিক চলছে আবার হয়ত সব ঠিক হয়ে যাবে। বাবা ফিরলো একটু দেরি করে মা তখন যেন সমস্ত শক্তি দিয়ে তানপুরাটাকে জড়িয়ে ধরে আছে। বাবাকে খুব গম্ভীর দেখাচ্ছিলো,বাবাকে আলমারি খুলতে দেখলাম। কি যেন খুঁজছে,একটু বাদে দেখি বাবা একটা ব্যাগে জামাকাপড় গোছাচ্ছে,মনটা অদ্ভুত একটা ভয়ে আর কান্নায় অন্ধকার হয়ে গেলো। ভাই জিজ্ঞেস করছিলো বাবাকে," কোথায় যাচ্ছো বাবা? ব্যাগ গোছাচ্ছো কেনো?"
.....বাবা ওকে একটু আদর করে বললো," তোরা ভালো থাকিস আমি কয়েকদিনের জন্য একটু বাইরে যাচ্ছি।"
..." কবে আসবে বাবা? আমার জন্য একটা গাড়ী আর ব্যাট বল আনবে তো?"
ভাইটা সত্যিই বোকা,কিছুই বোঝেনা শুধু আমার সাথে ঝগড়াই করতে পারে। আমিই শুধু বুঝতে পারলাম বাবা চলে যাচ্ছে এখান থেকে একেবারেই। আর তাই হয়তো মা আজ তানপুরাকে আগলে বাঁচতে চাইছে। কোনসময় এই তানপুরাই ওদের ভাব করিয়েছেলো। তবলা আর তানপুরার ভাব হতে হতে দুটো মানুষ এসেছিলো কাছাকাছি। আজ ভেঙে গেলো তবলা তানপুরার যুগলবন্দী।
মায়ের কোলের কাছে হাঁটু মুড়ে বসে আমি কাঁদছি বাবা যে চলে গেলো মা,তুমি কিছু বলবেনা। সত্যিই তো জয়ার কিছুই বলার নেই,অনেক কান্না অনেক অনুরোধ অনেক বুঝিয়েও সিদ্ধার্থকে আটকাতে পারেনি। তাই দুচোখে অঝোর ধারা বইয়ে জয়া গাইছে,' মোরে আরো আরো দাও প্রাণ। আজ যে জয়ার বড় বেশি প্রাণশক্তি দরকার শ্রেয়া আর রাহুলকে একা বড় করার জন্য। সিদ্ধার্থকে মুক্তি দিয়েছে জয়া, সাজানো সংসার পেছনে ফেলে সিদ্ধার্থ এগিয়ে গেলো নতুন ঠিকানায় এক প্রতিবন্ধী একলা মেয়েকে অবলম্বন দিতে,কেনো যেন ওর কোন অনুশোচনা হলোনা শুধু মনে হলো জয়াকে তো জীবনের সব কিছুই দিয়ে এসেছে,ছেলেমেয়ে বাড়ি আর যা আছে সবটাই। রাণুও যে বড় অসহায় ওকে ছাড়া।
সিদ্ধার্থ আর রাণুর বিয়েটা আইন মেনেই হয়ে গিয়েছিলো। নতুন সংসারে সিদ্ধার্থ কেমন আছে মাঝে মাঝে মনে হত জয়ার,কিন্তু কখনো সেই খবর নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। সিদ্ধার্থও আর আসেনি কখনো,জয়াই শর্তটা দিয়েছিলো।
আমার আর ভাইয়ের সাথে কখনো দেখা করেছে বাবা,ইচ্ছে হয়নি কথা বলতে। বাবা অনেক দূরে চলে গেছে এটা খুব ভালো করে বুঝতে পেরেছিলাম। ভাইটা ছোট তাই বাবার দেওয়া খেলনাগুলো নিয়ে এসেছিলো,মা শুধু বলেছিলো," আর আনিসনা,আমি আছি তো যা লাগবে বলিস কিনে দেবো।"
এরপরে আর নেয়নি ভাই,আমি আর ভাই দেখতে দেখতে কেমন বড় হয়ে গিয়েছিলাম। মাও মানিয়ে নিয়েছিলো নিজের জীবনে,তবে আশ্চর্য লাগতো মাকে সিঁদূর পরতে দেখে। পাশের ঠাম্মা এসে বলেছিলো," ঠিকই করেছিস,মন্দিরের সিঁদূর না মুছে।"...."মাসিমা আসলে ছেলেমেয়েদের খারাপ লাগবে তাই ।"
হঠাৎই একদিন কলি কাকিমার কাছে শুনেছিলাম বাবা আর এই শহরে থাকেনা। ওরা ট্রান্সফার নিয়ে চলে গেছে এখান থেকে। মাকে বলতে শুনেছিলাম," আর বোলোনা ভাই ওসব কথা থাক,কোথায় গেছে আমার জানার কোন কৌতূহল নেই।"
সত্যি আমরা আর বাবার কোন খবর রাখিনি,বাবাও আমাদের সাথে আর কোন যোগাযোগ রাখেনি। মায়ের মুখে কোনদিন শুনিনি বাবার কথা। বাবার ব্যবহার করা জিনিসগুলোও মা সরিয়ে ফেলেছিলো এমনকি ছবিগুলোও। বাবা নামটা হারিয়ে গিয়েছিলো আমাদের জীবন থেকে। বড় হয়ে গিয়েছিলাম আমরা বাবাকে ছাড়াই, মাও একটু একটু করে বয়সের দিকে। অনেক ঝড়ঝাপটা সামলে মায়ের চাকরিটার জন্যই আমি আর ভাই ভালো পড়াশোনা শিখে দুজনেই চাকরি পেলাম। মায়ের মুখে এক অদ্ভুত জয়ের আনন্দ। ভালো খবর পেলেই মা বলতো," আমি পেরেছি তাইনা,তোদের ভেসে যেতে দিইনি।"
আমি ভালোবেসেছিলাম সৌম্যকে ওদের বাড়ি থেকে বিয়ের কথা বলছিলো আমি তখন এম .এ পড়ছি। মা ভীষণ আপত্তি করেছিলেন," চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত আমি বিয়ে কিছুতেই দেবোনা।"
আমি একটু ভয় পেয়েছিলাম," মা ওর বাড়ি থেকে যদি অন্য মেয়ের সাথে ওকে বিয়ে দিয়ে দেয়?"
....." তাহলে বুঝবি তোর কপালে ও ছিলোনা,তোর ভালোবাসায় জোর নেই। আগে স্বাবলম্বী হয়ে নে শ্রেয়া। তোরা তো আমাকে দেখেছিস।"
মায়ের কথা মত আমার চাকরি পাওয়ার পর বিয়ে হয় শাশুড়ি মা বলেছিলেন," ওর বাবাকে যদি একটু খবর দেওয়া যেতো। উনি এলে ভালো হত।"
....মা হেসে বলেছিলো, " আমি আছি তো দিদি,ওর বিয়ের কোন ত্রুটি হবেনা। তবে রেজেষ্ট্রীটা কিন্তু বিয়ের দিনই হবে।"
স্বামী,সন্তান নিয়ে এখন আমার সুখের সংসার। মা রিটায়ার করার আগে ভাইয়ের বিয়েটাও হয়ে গেলো। ভাই পছন্দ করেছিলো চাকরি করা মেয়ে। মা খুব খুশি হয়েছিলো,তাই আমরা সবাই মিলে ভাইয়ের বিয়েটা ভালো করেই দিয়ে দিলাম। উৎসবের দিনগুলোতে মা কেমন যেনো আনমনা হয়ে যেতো হয়ত প্রতিক্ষণেই একজনের কথাই মনে হত,বাবা। বাবার মুখটাও ধীরে ধীরে আবছা হয়ে গিয়েছিলো আমাদের কাছে।
মায়ের জগতে মা থাকে,টুকটাক লেখালেখি আর গান। এখনো কয়েকটা বাচ্ছা আসে মায়ের কাছে শিখতে গান। গানকে অবলম্বন করে মা নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছে। কবিগুরু ভরসা দিয়েছেন মাকে তাঁর সঙ্গীতসুধায়। আমি মাঝে মাঝে যাই সময় পেলেই মায়ের কাছে মেয়েকে নিয়ে,ক্লান্ত শরীরটা একটু ফেলি মায়ের কোলে,মা মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
সেদিন,মায়ের কাছে গিয়ে দেখি মা নেই। ভাই বৌ বললো মা ওরা বেরোনোর আগেই বেড়িয়ে যাচ্ছে কদিন ধরে বলছে কাজ আছে। হয়ত অফিসের কোনো কাজ হতে পারে। আমারও তাড়া ছিলো তাই আর থাকতে পারিনা।
কয়েকদিন বাদে ভাই ফোন করে একটু সময় নিয়ে আসতে বলে খুব চিন্তার সাথে জানায় মা এখনো ফেরেনি,মায়ের ফোনটা সুইচড অফ। কোথায় গেছে বুঝতে পারছেনা। সত্যিই তো অনেকটা রাত হয়ে গিয়েছে,শাশুড়িমাকে বলি মায়ের শরীরটা ভালো নেই ওবাড়ি যেতে হবে। বরকে বলি পুরো ব্যাপারটা, ও আমাকে পৌঁছে দেয়। আমরা চিন্তায় এদিক ওদিক করতে থাকি,ভাই গিয়ে দাঁড়ায় রাস্তার মোড়ে। অনেকক্ষণ বাদে মা আসে,তখন প্রায় এগারোটার বেশি বেজে গেছে। বড্ড ক্লান্ত আর বিধ্বস্ত লাগছিলো মাকে দেখতে। ভাই আর আমি মাকে জিজ্ঞেস করি,কোথায় ছিলো মা এতক্ষণ। " আমি আসছি,তোরা একটু অপেক্ষা কর।"
সেদিন ঘরে আমি, মা আর ভাই,মা বলতে শুরু করলো হঠাৎই একদিন পেনশন নিতে গিয়ে বাবার এক বন্ধুর সাথে দেখা হয়ে যায় ব্যাংকে। উনি বলেন," বৌদি আপনার সাথে খুব দরকার ছিলো আমি যেতাম আপনার কাছে। আপনি একবার কাল আমার সাথে যাবেন এক জায়গায়। এখনই কিছু বলছিনা।"
....." মনে যদিও একটা সন্দেহ এসেছিলো তবুও না করতে পারিনি ওনাকে তাই রাজি হয়ে যাই। আমাদের এখান থেকে অনেকটা দূরে বাসে করে যেতে প্রায় ঘন্টাখানেক লাগে আমিও যাইনি কখনো সেই জায়গায় আগে, সেখানে আমাকে নিয়ে যান। খুব ছোট একটা বাড়ি,দরজাটা ভেজানোই ছিলো। বিছানার সাথে মিশে যাওয়া চেহারাটা দেখে আঁতকে উঠেছিলাম। হঠাৎই কানে এসেছিলো কথাটা,বৌদিকে এনেছি রাণু দেখো। আর বুঝতে অসুবিধে হয়নি। কিন্তু খুব রাগ হচ্ছিলো তোর বাবার বন্ধুর ওপর। রাণু এটা! চেনাই যাচ্ছেনা,কাকে দেখছি আমি। হঠাৎই মনে হলো তোদের বাবা কোথায়,তবে কি? একটু মনটা কেমন হয়ে উঠেছিলো। হঠাৎই শুনি রাণু ভবেশদাকে বলে বাইরে যেতে।
......হাতদুটো বাড়িয়ে আমাকে ডাকে রাণু," বৌদি তোমার সোনার সংসারে আমার নজর পড়েছিলো,সিদ্ধার্থকে আমি আলাদা করেছিলাম তোমার থেকে তাই ভগবান আমাকে একদিনের জন্যও শান্তি দেননি। আজোও সেই পাপ ভোগ করছি আমি। আর হয়ত বেশিদিন আমার নেই তবুও ভগবান আমার শেষ ইচ্ছে রেখেছেন তাই হয়ত তোমার সাথে দেখা হলো। ওকে কত বলেছি,ও বলেছে তোমার সামনে কোনদিন দাঁড়াতে পারবেনা। "
"রাণুকে দেখে আর ক্ষমা না করে থাকতে পারিনি কিন্তু কিছুতেই মেলাতে পারিনি আমার ফেলে আসা সতেরো বছরের হিসেব। তোর বাবাকে দেখেছিলাম ওখানেই, ধারে দেনায় জর্জরিত এক বৃদ্ধকে,বয়সের তুলনায় আরো দশবছর বয়েস বেড়ে গেছে যেন। সেদিনের সেই ছটফটে গান পাগল মানুষটাকে মেলাতে পারিনি। তারপর থেকে তোদের লুকিয়ে মাঝে মাঝেই গেছি ওখানে,সাহায্য করেছি সাধ্যমতো। আজ রাণু চলে গেলো। ওকে দাহ করে আসতে অনেকটা দেরি হয়ে গেলো। ফোনটা যে কখন সুইচড অফ হয়ে গিয়েছিলো বুঝতেই পারিনি।"
মা আমাদের দুই ভাইবোনের জীবনের সবটা ছিলো কখনো মাকে আমরা সন্দেহ করিনি,আসলে মা আমাদের দেখা চাক্ষুষ দেবী। আজ মনে হলো মা কোথা থেকে এতো ধৈর্য আর সহ্যশক্তি পেলো। হঠাৎই আমার মুখ থেকে বেড়িয়ে আসে বাবা কোথায় থাকলো?
মা হাসে," কেনো ওদের বাড়ি আছে তো? ঠাকুরপোদের বলে এসেছি একটা লোকের ব্যবস্থা করে দিতে। আর তারপরে কোন আশ্রমে চলে যাবে যদি একান্তই না থাকতে পারে একা। চিরকালই তো একা থাকতে ভয় পেতো। তাইতো আমার কোথাও যাওয়া হোতনা।"
মা চায়নি বাবাকে আনতে,তবুও মায়ের চোখের কথাগুলো যেন আমাদের বুঝতে অসুবিধে হয়নি। ভাইবৌয়ের সাথে কথা বলে আমরা বাবাকে সতেরো বছর বাদে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম মায়ের কাছে। অনুতপ্ত ,পরাজিত বাবা মাথা নীচু করে এসে দাঁড়িয়েছিলো মায়ের সামনে জীবনের শেষবেলায়।
বাইরের ঘরটায় বাবা থাকে এখন,মা নিয়মিত তানপুরা নিয়ে ভেতরের গায় এখনো,' মোরে আরো আরো দাও প্রাণ।' বাবার তবলায় আর বোল ওঠেনা,কবে ফেঁসে গেছে অযত্নে। মা সেটাকে বাইরের ঘরে বার করে দিয়েছিলো। চাঁপাগাছটায় এখনো ফুল ফোঁটে। গাছটাও বুড়ো হয়েছে। সবই হয়ত আছে একরকম শুধু সতেরো বছরে সুরটা কেটে গেছে যা হয়ত আর কোনদিন জোড়া লাগবেনা। মায়ের যত্নে বাবার চেহারাটা ফিরেছে অনেকটা, তবে বাইরের ঘরের লক্ষ্মণরেখা পার হয়ে বাবা কখনো সতেরো বছর আগে ছেড়ে যাওয়া ভেতরের ঘরে ঢোকেনা হয়ত এটাই অলিখিত প্রায়শ্চিত্ত।
দুর্গাপূজার অঞ্জলি দিতে গিয়ে আমার জয়া মায়ের মুখটা বার বার মিলে মিশে যাচ্ছিলো মা দুর্গার মুখের সাথে।
যা দেবী সর্বভূতেষু শান্তিরূপেণ সংস্থিতা .
যা দেবী সর্বভূতেষু শ্রদ্ধারূপেণ সংস্থিতা
যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা .
চন্ডীপাঠের সাথে সাথে কানে আসা মন্ত্রগুলো যেন মনে হলো সবটাই আমার মায়ের জন্যই। ভালো থেকো তুমি মা।
সমাপ্ত:-
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment