#কুশিক্ষা##রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
সাম্যর স্কুলের প্যারেন্ট টিচার মিটিং সেরে তাড়াতাড়িই ফিরে এসেছিলো নেলি ছেলেকে নিয়ে,আজ আর অফিসেও যাওয়া হয়নি। সাম্যকে নিয়ে ড্রাইভ করে পার্কিংয়ে গাড়িটা রেখে শপার্স স্টপে ঢোকে।
...." মাম্মা আমি আইসক্রীম খাবো।"
ঢোকার মুখেই ছেলের বায়না।..." খাবে তো,অনেক কিছু খাবো আমরা। আগে একটু শপিং করেনি দেন খাবো,আর কি কি খাবে আমার চ্যাম্প,শুনিতো?" এই বলে ছেলেকে খুব আদর করে দেয় নেলি।
বডিকেয়ারের কাউন্টারে আসে নেলি,অনেকদিনই দরকার কিন্তু কেনা হচ্ছেনা। " এক্সকিউজ মি আমাকে ওয়ান স্কিন কালার আর একটা...আচ্ছা একটু দেখান প্লিজ, আমি দেখে নিচ্ছি, 34c ব্রা দিন।"..."হ্যাঁ ম্যাম্ দিচ্ছি,এই কালার অপশনগুলো আছে এই সাইজে। আপনি ট্রাই করেও দেখতে পারেন।"
...." মনে হয় লাগবে না,ওকে আমি দেখে নিচ্ছি। আচ্ছা এগুলো ফুল কভারেজ তো?"একটা খুলে দেখে নেলি।..." হ্যাঁ ম্যাম একদম।"
...." আমাকেও দেখাও মাম্মা। কেমন ব্রা আমি দেখবো, ব্রা কি গো?" হঠাৎই বলে ওঠে পুচকে সাম্য।
একটু অস্বস্তিতে পড়ে সেলস গার্লটি মনে মনে ভাবে এইটুকু বাচ্ছা কি পাকা দেখো,আজকাল টিভির জন্য বাচ্ছাগুলো এতো পেকেছে। হঠাৎই আশ্চর্য হয়ে যায় মেয়েটি,ততক্ষণে নেলি সাম্যকে কোলে তুলে নিয়েছে।
....." ও তুমি দেখবে ব্রা এই যে দেখো,আমি কিনছি। ব্রা একটা ইনার,তুমি গেঞ্জি পরোনা শার্টের ভেতর। লাইক দ্যাট আমিও এটা পরি,এটা আমার ইনার। আচ্ছা এবার আমি চয়েস করি কোনটা নেবো দেখি।"
....যেমন পাকাছেলে আর তেমন মা,ওর থেকে একটু বড় আমার ছেলে, কোনদিনই শুনিনি এমন কথা বলতে। দেখতেই পায়না কোথায় থাকে এগুলো। মাও তেমন একটা চারবছরের বাচ্ছাকে বোঝাচ্ছে ব্রা কি। মনে মনে ভাবলো মেয়েটি। কাউন্টারে পে করে নেলি সাম্যর হাত ধরে এগিয়ে যায়,ব্যাগের কাউন্টারে,একটু নেড়ে চেড়ে দেখে নতুন কোন স্টক এসেছে কিনা।
.......হাতটা ধরে টানে সাম্য,মা চলোনা এবার আইসক্রীম খাবো।
টুকটাক অনেক কিছু খেয়ে আর শপিং করে মা ছেলে একদম গাড়ি স্টার্ট করে বাড়িতে। দরজা খুলে দেয় অপলামাসি নেলির অল ইন ওয়ান। সাম্যকে অপলামাসিকে হ্যান্ডওভার করে একটু নিশ্চিন্ত হয় ও। যাক এবার পুরোটা বুঝে নেবে মাসি। বিছানায় শুয়ে একটু রিল্যাক্স করে মোবাইলটা হাতে নিয়ে। নোটিফিকেশনগুলো দেখে এক এক করে। সত্যি কিসব যে ঘটছে আজকাল আর ভালো লাগেনা। এর মাঝেই সাম্য এসে হাজির," মাম্মা আমায় ড্রেসচেঞ্জ করিয়ে দাওনা।"
....." আমি তো করাচ্ছিলাম আবার ছুটে চলে এলে কেনো মায়ের কাছে। আচ্ছা চলো আমরা একটু বারান্দায় যাই।"
....." মাসি তুমি অন্য কাজ থাকলে করে নাও,তবে রে দুষ্টু দেখি দেখি এইতো।"
মা আর ছেলে মেতে ওঠে খেলায়। নেলি সিঙ্গেল মাদার,ভালো লেগেছিলো একজনকে কিন্তু বিয়েটা শেষপর্যন্ত হয়নি। সে ভালোবাসা কবেই হয়ত ধুয়ে মুছে গিয়েছিলো অলকানন্দার জলে। আসলে হয়ত ভালোবাসাটা একতরফা ছিলো,রায়ানের বাড়িতে এক দুবার গিয়েছিলো ওদের কলেজে পড়ার সময় অন্য বন্ধুদের সাথে। ওর মায়ের ঠিক পছন্দ হয়নি নেলিকে সেটা ওনার কথাতেই বুঝেছিলো," তুমি কি এমনি ছোটবেলা থেকে? রায়ান বলছিলো বড্ড ডানপিটে আর মেজাজি। কলেজের ছেলেরাও নাকি তোমায় ভয় পায়। হাত আর মুখ দুটোই চলে। তা নিজের একটু যত্ন করোনা কেন, মা কিছু বলেন না?
চোখের কোলটা একটু ভিজে গিয়েছিলো নেলির আসলে তো ওর মা বাবা দুজনেই ছোটবেলায় মারা গেছে। মাসির কাছে মানুষ। মাসি ভালোবাসে ঠিকই কিন্তু তবুও মায়ের আদর খুব মিস করে নেলি। মাসির বাড়িতে অনেক কাজকর্মও ওকে করে দিতে হয়। তাই অন্য মেয়েদের থেকে একটু বেশিই লড়াই করে বাঁচে। ছেলেদের সাথে পাল্লা দিয়ে হৈ হৈ করে, কখনো ফুটবল ক্রিকেট খেলতে গিয়ে মারামারি করে আসে।
আন্টির ওকে পছন্দ নয় জেনেও তবুও একটু আলাদা ঢঙে একদিন রায়ানকে বলতে চেয়েছিলো ভালোবাসার কথা ওর মতো করে একটা ছোট্ট চিরকুটে,
" আইলাইনারে চোখ সাজাইনা,
লিপস্টিক পরিনা দুঠোঁট ভরে।
তবুও তোর জন্য কাজল পরবো
যদি নিস আমায় আপন করে।"
"কবি হলি কবে থেকে রে? বাইক চালাস,মাঝে মাঝে হাতও চলে তা জানি। কিন্তু গোপন প্রেমের কথাখানি এইভাবে চিরকুটে করিস কানাকানি তা তো জানতাম না।"
লজ্জায় পরে মিথ্যে কথাই বলে ফেলে," আরে না না,এই লাইনগুলো হঠাৎই মনে এসেছিলো লিখে ফেলেছিলাম। ধুস্ আমাকে দেখে মনে হয় আমি প্রেমে পড়তে পারি? তোকে জাষ্ট দেখাচ্ছিলাম।"
...." ওহ্ তাই বল আমি ভাবলাম তোর মাথায় আবার প্রেমের ভূত চাপলো নাকি? যাক্ বাঁচা গেলো।"
মনটা সত্যিই খারাপ হয়ে গিয়েছিলো ভেবেছিলো কেনো যে আগ বাড়িয়ে চিরকুটটা দিতে গেলো! ইস্ না দিলেই পারতো।
ওদের ফাইনাল ইয়ারের পর,রায়ান বি.টেকে চান্স পেয়ে পড়তে চলে যায়। নেলির রেজাল্ট অতটা ভালো হয়নি তাই কলকাতাতে মাস্টার্স হলোনা। বাইরে করতে যেতে হোলো। মাসি বাধা দেয়নি,তাছাড়া ও বেশ কতগুলো টিউশান পড়াতো,কিছু জমানো টাকাও ছিলো। এম. এস.সি পার্ট টু করতে করতে অনেকগুলো চাকরির ইন্টারভিউ দিয়েছিলো নেলি। ছোট থেকেই এটা বুঝেছিলো ওকে কিছু করতে হবে,নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। রায়ানকে ভালো লাগতো তাই হয়ত হঠাৎই ওর লেখা প্রথম কবিতাটা দিয়ে চিরকুটটা পাঠিয়েছিলো। আসলে ওকে বোধহয় ছেলেরা বন্ধু বলেই ভাবে। বান্ধবী বলে ভাবতে পারেনা। কলেজের কতগুলো ছবি,আর রায়ানের একটা সিঙ্গেল ছবি শুধু থেকে গিয়েছিলো ওর পার্সোনাল ফাইলে।
নতুন জায়গায় অনেক বন্ধু হয়ে গিয়েছিলো আবার। চাপা পড়ে গিয়েছিলো আগের বন্ধুরা,খুব ভালো লাগতো কলকাতার বাইরে এই বিশ্ববিদ্যালয়টা। এই সুযোগে ড্রাইভিংটাও শিখে নিয়েছিলো নেলি,আরো টুকটাক কোর্স করে নিয়েছিলো। শুধু আর প্রেমের পাঠশালায় কখনো যায়নি,হয়ত বা মনে বিষম চোট পেয়েছিলো। বুঝেছিলো ঐসব প্রেম ট্রেম ওর দ্বারা হবেনা।
পার্ট টু র কিছুদিন পরেই সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার ডিপার্টমেন্টে একটা ভালো চাকরি হয়ে গিয়েছিলো। অবশ্য চেষ্টা করছিলো অনেকদিনই,যাক অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়েছিলো,অন্ততপক্ষে আর কারো বোঝা হয়ে থাকতে হবেনা। মাসিও খুব খুশি হয়েছিলো শুনে বলেছিলো," আমাকে ভুলে যাবিনা তো,ছোট থেকে একেবারে নিজের হাতে করে মানুষ করেছি। ".... সবটাই বুঝেছিলো নেলি,সত্যিই মাসির ঋণ এ জীবনে শোধ করার নয়। তাই এখনো মাসির জন্য যতটা পারে করে,আর্থিকভাবে আর নিজের পক্ষে যতটা সম্ভব।
প্রথম পোষ্টিং হয়েছিলো পুরুলিয়ায়,নিজের পিছুটান না থাকায় খুব একান্তভাবে কাজটা করতো নেলি,পেশার জন্য ঘুরতে হত মাঝে মাঝে প্রত্যন্ত গ্ৰামগুলোতে। অনেক আদিবাসী মেয়ে আর বাচ্ছাদের নিয়ে ওদের কর্মকান্ড,কাজ করতে করতে ওখানেই হঠাৎ জিপ নিয়ে যাওয়ার সময় জঙ্গলে কান্না শুনেছিলো একটা। এগিয়ে গিয়ে আবিষ্কার করেছিলো সদ্যজাত বাচ্চাকে,না কোন আদিবাসী বাচ্চা নয়,হয়ত কেউ এই অবাঞ্ছিত শিশুটাকে ফেলে গিয়েছিলো কলঙ্কের ভয়ে এই জঙ্গলে। অনেক জিজ্ঞাসাবাদ আর থানাপুলিশ করে কোন হদিস পাওয়া যায়নি ওর বাবা মায়ের। কেউ আসেনি অধিকার চাইতে বাচ্ছাটার।
কেমন যেন মায়ায় পড়ে গিয়েছিলো নেলি বাচ্চাটার,চোখের আড়াল করতে ইচ্ছে করতো না। নিজের মা বাবা না থাকাতে খুব বুঝেছিলো,মা বাবার আদর ছাড়া বড় হওয়া কতটা কষ্টের।
.....কিছুদিন অপেক্ষা করার পর রুলস এন্ড রেগুলেশন ফলো করে ও বাচ্চাটাকে আ্যডপ্ট করে নিয়েছিলো। আত্মীয়স্বজন আর মাসিও ছি ছি করেছিলো বলেছিলো একেই তো এতোদিন বিয়ে হয়নি,চাকরির জন্য যাও বা বিয়েটা হোত কোথা থেকে একখানা ছানা জুটিয়ে বসলো। কার না কার পাপ নিলো,নিজের করে। কেউ কেউ ফিসফিসও করলো কে জানে এই বাচ্চাটার পেছনে আবার কোন সিক্রেট আছে কিনা। গায়ে মাখেনি নেলি,একা একাই মানুষ করেছে ওকে মাসির সাহায্যে। সত্যি কি যে মিষ্টি ছেলেটা!একেও লোকে জঙ্গলে ফেলে দিয়ে যায়!
সমাজ সংসার অনেকেই ফিসফিস করলেও পাত্তা দেয়নি নেলি,নিজের পুরোটা দিয়েছিলো ছেলেকে,ওর মতই স্পষ্টবক্তা করে মানুষ করার চেষ্টা করেছিলো ছেলেকেও। আর এখন তো কলকাতায় চলে এসেছে ট্রান্সফার হয়ে। এইভাবে দেখতে দেখতে কেটে গেলো বেশ কয়েকটা বছর। এর মধ্যে প্রমোশনও হয়েছে নেলির।
যদিও এখন নিয়ম হয়ে গেছে, ফাদার্স নেম ছাড়াই বাচ্চার আ্যডমিশন হতে পারে তবুও ছেলেকে বড় স্কুলে ভর্তি করতে বেশ সমস্যা হলো নেলির। এখনই যাতে ছেলেকে কেউ খুব একটা বিরক্ত করতে না পারে তাই চেনা গন্ডীর বাইরেই ফ্ল্যাটটা কিনেছে। আর তেমন চেনা কারো সাথে রিলেশন রাখেনি। মা ছেলে আর মাসি মিলে হৈ হৈ করে কেটে যায় ওদের দিন,মাঝে মাঝে ছেলেকে নিয়ে খাবার দাবার গুছিয়ে চলে যায় সবুজের কোলে। ছেড়ে দেয় ছেলেকে মাঠে ফুটবল খেলতে,কখনো কখনো নিজেও নেমে পড়ে থ্রি কোয়ার্টার জিন্স পরে ছেলের সাথে। জমিয়ে হুটোপাটি করে দুজনে মিলে,অপলা মাসি বসে বসে হাসে," তুমি পারোও বটে,আগের জন্মে বোধহয় ছেলে ছিলে।".... হাসতে হাসতে বলে নেলি," এই জন্মেই বা ছেলেদের চেয়ে কম কিসে গো?"
সত্যিই তো ঘরে বাইরে একা হাতে সব সামলায় মেয়েটা,তার ওপর ওই দুষ্টুর শিরোমণি ছেলে। যেমন বকবক করে মাথা খায় আর তেমনি হাতেপায়ে দুষ্টু। সারাক্ষণ প্রশ্ন ঘুরছে মাথায়,এটা কি আর ওটা কি। আর সব দিকে চোখ,কে কি করলো কোথায় গেলো কোথায় কোনটা আছে সব দিকে নজর।
দেখতে দেখতে ক্লাশ সিক্স হয়ে গেলো ছেলের,ওকে নিয়ে চাপও বেড়েছে নেলির। মোটামুটি ওর পড়াশোনার সবটাই সামলায় ও। ভালো রেজাল্টও করেছে ছেলেটা পরীক্ষায়। দিন যায়,ঋতু পরিবর্তনও হয় নিজের মত। কিন্তু নেলির জীবনে আর বসন্তের ছোঁয়া লাগেনি। তাই সবটা জুড়েই ছেলে আর ছেলে। এর মাঝেই হঠাৎ করে হেভি ব্লিডিং শুরু হয়েছে নেলির,বেশ কয়েকদিন শরীরটা খুব খারাপ। ডঃ দেখিয়েছে,কয়েকটা টেষ্ট করতে বলেছে। ছেলেটা তো অস্থির করছে তার মধ্যে,"কেন তুমি শুয়ে আছো। কি হয়েছে,এগুলো কি?তুমি এতো বার টয়লেটে যাচ্ছো কেনো? তোমার কি লুজ মোশন হয়েছে?"
......" মাসি তুমি দেখেছো তো? কি অবস্থা ছেলেটার একদম প্রশ্নের ঝুড়ি।"
..." আর কি বোঝাও ছেলেকে এবার কি হয়েছে। আসলে তুমি ছাড়া ওর তো কেউ নেই তাই সব নজরটা তোমার দিকে দিয়েই আছে সারাক্ষণ।"
"আয় তো এদিকে দুষ্টু,আয় তোর সাথে গল্প করি।"....." তুমি অফিস যাচ্ছোনা কেনো মাম্মা,তুমি তো বলেছো আমার বাবা নেই গড আমাকে দিয়েছে তোমায়,তুমিও কি গডের কাছে চলে যাবে? কি হয়েছে তোমার?"
সংক্ষেপে ছেলেকে একটু বুঝিয়ে বলে নেলি,এমনটা মেয়েদের হয়। তবে ডাক্তারের ওষুধে সুস্থ হয়ে যায় নেলি,এখনি অপারেশন করলেন না ডাক্তার,শুধু বললেন কিছুদিন চেক আপে থাকতে। আবার অফিসে যাচ্ছে নেলি,শুধু এখন ফুটবল খেলার সময় অতো দৌড়োদৌড়ি করেনা। একটু বুঝে চলে,অপলামাসিই এখন বকা দেয়।
কয়েকমাস পার হয়ে গেছে,নেলির অফিসে কাজের চাপ এখন যথেষ্ট বেশি,মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে ওঠে,একটু ছুটি পেলে বাইরে ঘুরে আসা যেতো,একেবারে দমবন্ধ জীবন। সেদিন হঠাৎই অফিসের মধ্যে ছেলের ক্লাশটিচার ফোন করে সেদিন ছুটির আগে একটু দেখা করতে বলে,কি একটা জরুরী কথা আছে বলে। অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে স্কুলে চলে আসে নেলি। ক্লাশটিচারের কাছে যা শুনে,তাতে একটু অদ্ভুত লাগলেও খুব একটা আশ্চর্য হয়না নেলি বরং ছেলের কথা ভেবে ভালোই লাগে। জানতে পারে সাম্যর পাশে বসে যে মেয়েটি তার স্কার্টে রক্তের দাগ দেখে,ওকে আর জায়গা থেকে উঠতে দেয়নি সাম্য নিজেই গিয়ে ক্লাশটিচারকে বলে কথাটা। উনি তো আশ্চর্য হয়ে যান শুনে,যে কথাগুলো অনেকসময় এই বয়সের একটা মেয়েও সবসময় জানেনা সেকথাটা ও জানলো কি করে? তারপর উনি এসে সবটা ম্যানেজ করেন,মেয়েটা কান্নাকাটি করছিলো আর ভয়ও পেয়েছিলো,ওর মা নেই তাই এভাবে কেউ ওকে শেখায়নি। সবশেষে উনি বলেন,"না আমি আপনাকে ডাকলাম এইজন্যই যে আপনার ছেলে এইসব শিখলো কি করে,একটু বেশি তাড়াতাড়ি সব শিখে ফেলছেনা,আপনার কি মনে হয়?".....
সত্যি আজ একটা অন্য রকম অনুভূতি হলো নেলির। সাম্য একটা মেয়েকে লজ্জার হাত থেকে বাঁচিয়েছে। " আসলে ম্যাম,আমিই ওকে বলেছি এই ব্যাপারটা নিয়ে। একটা সময় ওর কৌতূহল মেটানোর জন্য বলতে হয়েছে।"
....." আপনি তো সিঙ্গেল মাদার,একটু সময় দিন ভালো করে ছেলেকে। আর বেশি আ্যডভানসড লেশনস না দেওয়াই ভালো। ঠিক আছে আমি ব্যাপারটা প্রিন্সিপালের কাছে বলিনি। আসলে অন্য বাচ্ছাদের সাথে যেন এসব ডিসকাস না করে। এখন ওকে নিয়ে যান।"
টিচারের ব্যাপারটা ভালো না লাগলেও নেলির ভালো লাগলো,ওর ছেলে যে ব্যাপারটা নিয়ে কাউকে না বলে হাসাহাসি না করে এইভাবে ক্লাশটিচারকে বলে ম্যানেজ করেছে। " কি রে এতো চুপচাপ কেনো রে? কি খাবি বলতো? রোল নেবো,তুই তো খুব ভালোবাসিস এগচিকেন রোল।" ...." তুমি রাগ করোনি তো মাম্মা,আসলে তোমার মত ওরও স্কার্টটায় রেড ...তাই তো আমি ডাকলাম ম্যামকে,ওর কষ্ট হয়েছে বুঝতে পারলাম। " এসব আর বন্ধুদের বলোনা,তাহলে ও লজ্জা পাবে আর ম্যামও বকবে। আচ্ছা,এবার তো একটু হাস। দুষ্টু ছেলে একটা,কি সব কান্ড যে ঘটাস!"
ছেলে আর সংসারের সমস্ত কিছু সামলে,মনটা মাঝে মাঝে চায় একটু নির্জনতা শুধু নিজের জন্য। জাস্ট একটু কোয়ালিটি টাইম,শুধু একদম একান্ত।একটা সময় বন্ধু বান্ধবের সাথে যোগাযোগ রাখতে চেয়েছিলো,তবে আজকাল যেন মনে হয় সবাই বড় বেশি ব্যস্ত। অনেকেই সাফল্যের শীর্ষে,তার মাঝে ঐ একটাসময় ফেসবুকে আ্যকাউন্ট খোলার পর পরই খুব জানার ইচ্ছে ছিলো সবার কে কতটা ভালো আছে,কার জীবন কতটা সফল। সাম্য বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে নানান প্রশ্নের জবাব এড়ানোর জন্য সরে এসেছে নেলি,সোশ্যাল মিডিয়া থেকে। তবে হোয়াটস আ্যপটা ছাড়েনি,ওটা রাখতেই হয় অফিসের দরকারে। নেলি খুব রিসেন্টলি একটা ব্লগ খুলেছে,ওর নিজের ছোট্ট ভালোবাসা,নাম 'চিঠি'..সময় পায়না বেশি।কখনো অফিসের ফাঁকে,জমানো ছোট ছোট কথাগুলো লিখে ফেলে নিজের মত করে...
"মেঘ জমানো মনে আজ
রোদ্দুরের হঠাৎ উঁকি।
ভালো থাকাটাই যে অভ্যেস,
তাইতো ভালো থাকি।"
অনেকেই,মানে এখনকার নতুন জেনারেশন ভালোবাসে ওর লেখা। তবে পুরোটাই ছদ্মনামে লেখা। কখনো বা মনের গহনের গোপন প্রেম উঠে আসে লেখায়। আসলে মানুষ বোধহয় মনে মনে চিরপ্রেমিক।
" প্রেমের চিরকুট ছিঁড়ে ফেলেছি
ভালোবাসার সাথে করেছি আড়ি।
বেশ আছি তাই নিজের প্রেমে,
ঠিকানা ভুলেছি তোর বাড়ির।"
এমনই কত এলোমেলো কথা ছড়িয়ে যায় নেলির মন থেকে 'চিঠি' ব্লগে। ছোট ছোট এলোমেলো কথা ছড়িয়ে যায় ঐ নিরুদ্দেশে ভেসে ভেসে,হয়ত বা স্বপ্ন সাজায় অচিনদেশে। এই কম সময়ে বেশ অনেক ফলোয়ার্স ওর ব্লগে।
দিন চলে যায় নিজের ছন্দে,সময়কে আঁকড়ে,কখনো বা পাল্লা দিয়ে ভেসে ভেসে। হঠাৎই একদিন ছেলে বায়না ধরলো," মাম্মা আমাকে একটু মাঞ্চুরিয়ান করে দেবে, রিনিকে খাওয়াবো। "......চোখের কোলে একঝলক দুষ্টুমি খেলে যায় নেলির," এই রিনিটা কে শুনি? তোর গার্লফ্রেন্ড নাকি? আগে বল তো।"
...." মাম্মা তুমি একদম ভুলে যাও আরে সেদিন তো ওরই স্কার্টে...আমার পাশে বসে। "
......" ওর নাম তো ঋদ্ধি বলেছিলি।"
...." হুঁ এটা ওর নিক নেম,এই নামটায় ডাকলে ও খুব খুশি হয়।"
অপলামাসি সব গুছিয়ে দিলো,খুব যত্ন করে মাঞ্চুরিয়ান রান্না করে আলাদা বক্সে গুছিয়ে দিলো নেলি।
স্কুল থেকে এসে খুব খুশি ছেলে,রিনি খুব ভালোবাসে মাঞ্চুরিয়ান। তাই খুব খুশি হয়ে খেয়েছে,বলেছে অনেকদিন বাদে এমন ভালো টিফিন খেলো। মনটা ভালো লাগে নেলিরও। মাদার্স ডের দিন সকালে তো একদম অবাক নেলি,জড়িয়ে ধরে ছেলেকে। কি সুন্দর একটা কার্ড বানিয়েছে ছেলেটা,ওর কচি হাতে লেখা," মাই মাম্মা,মাই বেষ্ট ফ্রেন্ড। লাভ ইউ মাম্মা💝"
মনটা ছুঁয়ে গেলো নেলির,হয়ত অনেকসময় এই ভালোবাসাগুলো মনকে চুপিচুপি দিয়ে যায় একটা ভালোলাগার ছোঁয়া। আজ নেলি আবার একটা ভালো টিফিন আর দুটো ক্যাডবেরি গুছিয়ে দিলো সাম্যর ব্যাগে। " টিফিনটা খেয়ে নিস,রিনিকেও দিস্। আর ক্যাডবেরিও ভাগ করে খাস। একাই সবগুলো খেয়ে ফেলিসনা।"..অফিসে বেড়োনোর আগে গলাটা জড়িয়ে ধরে আদর করে যায় ছেলেকে। স্কুল থেকে ফিরে খুব খুশি ছেলে,রিনির খারাপ মনটা আজ ও ভালো করে দিয়েছে,টিফিন আর চকোলেট খাইয়ে,রিনি নাকি হ্যাপি মাদার্সডের কিসি পাঠিয়েছে নেলিকে।...." তোকে একটা কিসি,এইইই আর একটা রিনির জন্য।"
সাম্যর ইউনিট টেস্টটা হয়ে গেলো,ভালোই করেছে ছেলেটা,আসলে নেলি একটু খেলার ছলে ওকে পড়তে দেয়। হঠাৎই নেলিকে দিন সাতেকের জন্য অফিসের কাজে একটু বাইরে যেতে হলো,খুব খারাপ লাগছে ছেলেকে ফেলে এইভাবে যেতে,কিন্তু এতোগুলো দিন আ্যবসেন্ট করানো কোনমতেই সম্ভব নয়। " এতো ভেবোনা,আমি তো আছিই। এর আগেও তো একবার তোমাকে দুদিনের জন্য যেতে হয়েছিলো। ও তো ছিলো দিব্যি। " অভয় দেয় অপলামাসি।
মনটা খারাপ হলেও কিছুই করার নেই যেতেই হলো নেলিকে,সাম্যরও মনটা খারাপ হলো। যাক এবেলা ওবেলা ফোন করে কোনরকমে কাটলো দিনগুলো,ছেলেটাও বলছে," আর ভালো লাগছেনা,মিস ইউ মাম্মা।"
...." এই তো রে,আমি তো একদিন বাদেই ফিরছি। মাসিকে একটু দে তো কথা বলি,তোকে কাল একটা ভালো টিফিন বানিয়ে দিতে বলবো।"
অপলামাসির সাথে কথা বলে নেলি জানতে পারে ছেলের মন খারাপ,ওর কেনো বাবা নেই জিজ্ঞেস করছিলো," ওকে একদিন বলেই ফেলো এবার সবটা,বড় হচ্ছে নিশ্চয় বুঝতে পারবে।" সত্যিই মনটা একটু ভারী হয়ে যায় নেলিরও ফোনটা রাখার পর,কিভাবে যে বলবে ছেলেকে সবটা,যে ওকে ও পেয়েছিলো,আর তারপর আ্যডপ্ট করেছে। অথচ বলতে তো হবেই একদিন। সত্যিই তো বড় হচ্ছে ও,হয়ত বন্ধুরাও কিছু বলে।
যাক্ আর তো দুদিন বাদেই যাচ্ছে,তারপর একটু ভেবে আস্তে আস্তে ওকে বুঝিয়ে বলা যাবে। পরের দিন বিকেল থেকেই মনটা খুশি খুশি হয়ে গেলো নেলির,সত্যি মা না হয়েও এক অদ্ভুত অনুভূতি,মনটা ছটফট করছে ছেলেটার জন্য। আগে অফিস হয়ে তারপর বাড়ি যাবে,ওখানে প্রোজেক্ট ওয়ার্ক জমা দিয়ে তারপর। ততক্ষণে সাম্যও ফিরে আসবে স্কুল থেকে,খুব খুশি হবে নিশ্চয় মাকে দেখে।
কলকাতা পৌঁছেই মাসিকে একটা ফোন করে বাড়ির খবর নিয়ে নেয়,ছেলে ভালোভাবে চলে গেছে স্কুলে জানতে পারে। অফিসে পৌঁছে কাজ সামলাতে সামলাতে অনেকটা দেরিই হয়ে গেলো। হঠাৎই মোবাইলটা বেজে উঠলো,স্ক্রীনে চোখ রেখে একটু আশ্চর্য হয় নেলি,সাম্যর ক্লাশ টিচার একটু আশ্চর্য হয়,কোন বিপদ হলোনা তো?
..." ইয়েস ম্যাম গুড আফটারনুন বলুন,এনি প্রবলেম?"..বলে ফোনটা ধরে নেলি। ওপার থেকে একটু জরুরী তলব হয়,স্কুলে যাবার জন্য। নেলি জানতে চাইলে উনি জানান সব ঠিকই আছে,একটা প্রবলেম আ্যরাইজ করেছে তাই আজই একবার আসতে হবে। অগত্যা,এদিকের কাজ মিটিয়ে রওনা দেয় নেলি স্কুলে, না জানে আজ আবার কি হয়েছে।
আজ একেবারে ডাক পরেছে প্রিন্সিপালের ঘরে,ক্লাসটিচারও আছেন,সাম্যকে দেখতে পায়না নেলি,জানতে চায় কি হয়েছে। ক্লাশটিচার জানান একটু অপেক্ষা করতে আরেকজন গার্জেন আসবেন,উনি এলে কথা শুরু হবে। প্রিন্সিপাল একটু অন্য ব্যাপারে কথা বলতেই,প্লিজ কাম ইন কথাটা কানে আসতেই তাকায় নেলি। মাঝে কেটে গেছে প্রায় ঊনিশটা বছর তবুও অনেক পরিবর্তনের মধ্যেও একঝলক তাকিয়ে চিনতে পারে রায়ানকে। হঠাৎ এখানে কেন ও,হাজার প্রশ্ন এসে ভীড় করে মনের মধ্যে।
চোখাচোখি হতে মুখটা অন্যদিকে ফেরায় নেলি,রায়ান নিশ্চয় ওকে চিনতে পারেনি। ক্লাশটিচার শুরু করেন আজ ফাদার্সডে ছিলো,অবাক হয় নেলি। সত্যি এই দিনগুলো ওর মাথায় থাকেনা,আসলে জীবনে কোনদিন তো এগুলোর স্বাদই পায়নি,আর অফিসের কাজে আরো মনে নেই। ঋদ্ধি,আর সাম্যর খুবই ফ্রেন্ডশিপ দুজনে পাশাপাশিই বসে,দুজনেই পড়াশোনায় ভালো, তবে আজ দুজনের মধ্যে গন্ডগোল চূড়ান্ত। সাম্য একটা ছবি এনেছিলো,বলেছে ওর বাবার ছবি। ঋদ্ধি বলেছে এটা ওর বাবার ছবি,এই নিয়ে কান্নাকাটি ঝগড়া করেছে ঋদ্ধি।শেষ পর্যন্ত ক্লাশটিচারের কাছে কমপ্লেন করেছে।
হতবাক হয়ে যায় নেলি,ভাবতেই পারেনা সাম্য কি করেছে। মুখ থেকে বেড়িয়ে আসে," আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনা ম্যাম।"
...." সেই জন্যই তো আমরা এমন সিঙ্গেল মাদারদের চাইল্ডকে আ্যডমিশন করাতে চাইনা। আমি তো ভাবতেই পারছিনা এমন একটা পিকুলিয়র প্রবলেমের কথা। "
নেলির হঠাৎই চোখ যায় রায়ানের দিকে,ও এবার আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে আছে নেলির দিকে। ঠোঁটের কোণে সেই হাসিটা। শুধু মুখটা একটু ম্লান।
...." ম্যাম ছবিটা একটু দেখতে পারি? আর সাম্যকে যদি একবার ডাকতেন।"
...." সিওর এই নিন,সাম্য আর ঋদ্ধি দুজনকেই ডেকে দাও তো।"
ছবিটা হাতে নিয়ে,আশ্চর্য হয়ে যায় নেলি। সাম্য এটা কি করে পেলো? এটা তো ফাইলে ছিলো,তবে কি কোনভাবে পড়ে গিয়েছিলো?
ততক্ষণে ছবিটায় একটু উঁকি দেয় রায়ানও,লজ্জা পায় নেলি। ভাবতেই পারেনা এমন সিচুয়েশন আসতে পারে জীবনে কোনদিন।
সাম্য ততক্ষণে,মাথা নিচু করে মায়ের পাশে দাঁড়িয়েছে আর ঋদ্ধি ওর বাবার পাশে। নেলি একটু জোরে বলে ওঠে,"এটা কোথায় পেয়েছিস? কেনো এনেছিস?"
প্রিন্সিপাল ওকে থামান," ওর সাথে আমি কথা বলেছি। আপনি যদি একটু বলেন এটা কার ছবি ভালো হয়। "
আজ স্পষ্ট কথা বলা নেলিও কেমন যেন আনস্মার্ট হয়ে গেছে। কি বলবে ভাবছে।
হঠাৎই রায়ান কথা বলে,আশ্চর্য হয়ে যায় নেলি...." আমি বলছি ম্যাম,আসলে সাম্যর মাম্মা আর আমি কলেজে একসাথে পড়তাম। এটা সত্যি সত্যিই আমার ছবি,কলেজের কোন একটা অনুষ্ঠানে তোলা,তারপর অনেক বছর কোন যোগাযোগ নেই ওর সাথে। আমিও জব নিয়ে স্টেটসে চলে যাই বিয়ে করি,ঋদ্ধি হয়। কিন্তু ঋদ্ধি র চারবছর বয়েসে হঠাৎই আমার মিসেস মারা যান। আমি ফিরে আসি দেশে,তারপর থেকে ও আমার মায়ের কাছেই মানুষ।"
......অদ্ভুত একটা হাসি দেখতে পায় প্রিন্সিপালের মুখে," তাহলে হঠাৎ সাম্য ফাদার্স ডে তে আপনাকে ওর বাবা বলছে কেনো?"
"ম্যাম হয়ত এটা চাইল্ড সাইকোলজি,ঋদ্ধি যেমন মায়ের কথা ভাবে তেমন ও ভাবে বাবার কথা,তাই বন্ধুদের দেখানোর জন্য ছবিটা কোনভাবে পেয়ে নিয়ে এসেছিলো।"
নেলিকে আবার শুনতে হয় মাঝে মাঝেই নানা সমস্যা হচ্ছে সাম্যকে নিয়ে,এরপর ওদের হয়ত অন্য কথা ভাবতে হবে।
সেদিনের মত স্কুল থেকে বেড়িয়ে আসার পর হঠাৎই গেটের বাইরে সাম্যর কাছে দৌড়ে আসে ঋদ্ধি, হাতটা ধরে ওর। এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে সাম্যর গাল বেয়ে,ভয়ে কুঁকড়ে আছে ছেলেটা,সত্যি মাম্মা খুব রাগ করেছে আজকে। এতটা রাগ করতে কোনদিন দেখেনি মাকে।
..." আন্টি তুমি ওকে বোকোনা,সরি রে। পাপা আমাকে সব বলেছে। "
......রায়ান এগিয়ে আসে একদম দাঁড়ায় নেলির সামনে," কি রে এতোটা পাল্টে গেলি কি করে?আমার মেয়ে তোর ছেলের সাথে ঝগড়া করেছে বলে আমাকেও চিনতে চাইছিস না।"
...." আসলে বন্ধুত্বের সুতোটা বোধহয় কেটে গেছে অনেকদিন আগে। তাই কি দরকার জোড়া দিয়ে, খুব মিষ্টি মেয়ে রিনি। চল সাম্য,উবার এসে গেছে।"
....." তাহলে ছবিটা রেখে দিয়েছিস কেনো?যদি সুতোটাই কেটে যায়? আস্তে আস্তে পাশ দিয়ে বলে যায় রায়ান।"
......ব্লাশ করা মুখটা মোটাফ্রেমের চশমায় আড়াল করে উবারে উঠে যায় নেলি সাম্যর হাত ধরে।"
.....ঊনিশ বছর আগেকার স্মৃতি একটু একটু করে ছুঁয়ে যায় দুজনেরই নিঃসঙ্গ জীবনে। দোলা দিয়ে যায় একটু একটু করে টুকরো পুরোনো কথাগুলো। সেদিনের পুরোনো চিরকুটের সাথে আজকের একটু ফেড হয়ে যাওয়া ছবিটা অনেকটা পরিস্কার চিত্র রেখে যায় রায়ানের মনে।
ভয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকা সাম্যকে কোলের কাছে টেনে নেয় নেলি,কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পরে সাম্যর গাল বেয়ে," আর কক্ষণো এমন করবোনা মাম্মা,সরি মাম্মা। আমাকে ভালোবাসবে তো? বলনো গো।"
ছেলেকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে কপালে একটা কিসি দেয় নেলি,আগলে রাখে একদম বুকের মাঝে।
বাড়িতে গিয়ে জামাকাপড় ছাড়িয়ে,একটু খাইয়ে ছেলেকে নিয়ে একদম এসি চালিয়ে ঢুকে পড়ে ঘরের মধ্যে।"এদিকে আয় তো আর মন খারাপ করিসনা,তোকে একটা গল্প বলি শোন,একদিন আমি জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম হঠাৎই কান্না শুনলাম একটা ছোট্ট বাচ্ছার দেখি,কে যেন একটা মিষ্টি বাচ্ছাকে রেখে দিয়ে গেছে জঙ্গলে। কাঁদছে আর কাঁদছে হাত পা ছুড়ছে। আমি গিয়ে সেই মিষ্টি বাচ্ছাটাকে কোলে তুলে নিয়ে খুঁজতে থাকি কারা ওকে ফেলে গেছে। কিন্তু কাউকে দেখতে পাইনা। তারপর জিপে করে পুচকুটাকে নিয়ে আসি। অনেকদিন ধরে কেউ যখন আর খোঁজ নিলোনা পুচকুটার তখন আমিই নিয়ে নিলাম ওই ছোট্টটাকে আমার ছেলে করে।"
এতক্ষণ সাম্য চুপ করে শুনছিলো এবার কথা বললো," মাম্মা ঐ বাচ্ছাটা কি আমি? তাই তুমি বলো আমাকে গডের কাছ থেকে পেয়েছো। তাই কি আমার পাপা নেই?"
"কি হবে পাপা নিয়ে? আমি কি তোকে ভালোবাসিনা?আমার তো আর কেউ নেই সোনা। তোর তো মাম্মা আছে। আমার তো মাম্মাও নেই।"
মায়ের মাথাটা দুহাত দিয়ে নিজের বুকের কাছে ধরে বলে,"আমি তো আছি মাম্মা তোমার চ্যাম্প।"
ছেলেকে বুকের কাছে আগলে বড় হাল্কা লাগে নেলির,আজ যেন একটা বড় পাথর নেমে গেছে ওর মনের থেকে। হয়ত এই ঘটনাটার খুব দরকার ছিলো।
গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে বড় আনমনা লাগে রায়ানের , প্রথমে দেখে তো মারকুটে নেলিকে চিনতেই পারেনি, নীল সিফন আর স্ট্রেইট চুলে এক অন্য নেলি। সিঙ্গেল মাদার! কি সমস্ত ডিশিসন নেয় মেয়েটা।আসলে মেয়েটা বরাবরই এমন,সবসময় একটু অন্যকিছু করতে চায়। রিনিকে একা সামলাতে ওর মা চলে যাবার পর রীতিমত হিমসিম খেয়েছে,তবুও তো ওর মা আছেন মানে রিনির ঠাম্মু অনেকটা সামলান মেয়েকে। তবুও মায়ের জায়গাটা বোধহয় কেউই নিতে পারেনা,তাই বড্ড মুডি হয়েছে মেয়েটা। নেলির ছেলেটাও তো তেমনিই।" পাপা সাম্য ভালো না! আন্টি আমাকে মাঞ্চুরিয়ান বানিয়ে খাওয়ায়।"
....." এই যে রিনি তুই যে অন্যের টিফিন খাস একথা তো ঠাম্মুকে বলিসনি। আজ কিন্তু আমি বলে দেবো।"
...." না না পাপা বলোনা,ঠাম্মু খুব বকবে তাহলে। "
...." তাহলে আর ঝগড়া করবি না তো সাম্যর সাথে,ওরও তো পাপা নেই। তোর যেমন মাম্মা নেই। কে জানে আজ বেচারা কতো বকা খাচ্ছে। ওর মাম্মা যা রাগ করেছে।"
...." না পাপা আর করবোনা,ঝগড়া গো,তুমি তো ওর আঙ্কেল। আচ্ছা পাপা আন্টিটা তোমার ক্লাশমেট ছিলো তাই না? আন্টি আমাকে মাঝে মাঝে ক্যাডবেরি পাঠায়,মাদার্স ডেতেও পাঠিয়েছিলো।"
....." ওরে পাকাবুড়ি,আর তুই ফাদার্সডে তে ওর সাথে মারামারি করছিস?"
...." সরি পাপা,ও কেনো তোমাকে ওর পাপা বলছিল,তাইতো।"
আবার ভাব হয়ে যায়,সাম্যর সাথে রিনির। এরমাঝেই একদিন সাম্য বলে," মাম্মা রিনি তোমার মোবাইল নম্বর চাইছিলো,বলছিলো আঙ্কেল দিতে বলেছে,দেবো। তোমার ফ্রেন্ড তোমার সাথে কথা বলতে চায়। বাট আমি দিইনি, তুমি বলেছোনা কারো পার্সোনাল নম্বর দিতে নেই উইদাউট কনসেন্ট।"
একগাল হেসে বলে নেলি," এই তো আমার চ্যাম্পের বুদ্ধি হয়েছে।আচ্ছা দিস পরে আমি বলে দেবো যেদিন।"
মনে মনে একসময় খুব অভিমান হয়েছিলো রায়ানের ওপর,সেই মেঘ কাটেনি পুরোপুরি আজও নেলির মন থেকে। এতোদিন কখনো খোঁজ নেয়নি,সত্যিই বোধহয় মানুষ সুযোগসন্ধানী। না না আর কোন বন্ধু নয়। এই বেশ ভালো আছে ওরা ওদের ছোট্ট জগতে।
কিন্তু সবটা এমন হোলোনা,রিনির উৎপাতে বেশ কয়েকদিনের মধ্যেই ফোননম্বরটা দিতেই হলো সাম্যকে।
......অফিসের মাঝেই একটা ছোট্ট মেসেজ," এতো দিন লাগলো,নম্বরটা দিতে। আ্যঙ্গরি ওম্যান ইমেজটা একরকম আছে। আমিরে রায়ান,সেদিন তো কথাই বললিনা।"
তখনই কোন রিপ্লাই দেয়না,এ নির্ঘাত চ্যাম্পের কাজ,দাঁড়া তো। "তোর কাছে মাম্মার চেয়ে ফ্রেন্ড বড় হলো?".... " রিনিটা খুব ন্যাগিং করছিলো মাম্মা।"
......" আর তাই তুই আমায় বিট্রে করলি।" আর কিছু বলতে পারেনা সাম্যর মুখটা দেখে সত্যিই হাসি পেয়ে যায়।
হোয়াটস আ্যপে সেদিন মেসেজটা পেয়ে মনের মধ্যে একটা রঙবেরঙের প্রজাপতি নাচানাচি করেছিলো হঠাৎই নেলির। রায়ান লিখেছে," আইলাইনার আর লিপস্টিকে কিন্তু বেশ দেখায় তোকে।"
.......এটা কি বন্ধুত্ব,নাকি ভালোলাগার একলা ছাদে শুধুই স্মৃতির অনুরণন। না না ছেলেগুলোই এমন,এখন যেহেতু একা হয়ে গেছে,বয়সটা চল্লিশ ছুঁই ছুঁই তখন আবার ফিরতে চায় মনকেমন করা বিকেলবেলায়। একদম নো এন্ট্রি,কিছুতেই আর ঢুকতে দেবেনা ঐ হদ্দ পাজি বদমাশটাকে,হয়ত ওর জন্যই ও আজোও সিঙ্গেল। চিঠি ব্লগে ওর লেখাটায় 2k লাইক পড়লো।
" বিকেলবেলায় ছাদের কোণে
একলা থাকাটাই যে অভ্যেস।
নিজের মধ্যে প্রেম খুঁজে পাই,
এই হয়ত আছি বেশ।"
হোয়াটস আ্যপ স্ট্যাটাসে লেখাটা দেয় নেলি, রায়ান টেক্সট করে," কার লেখা রে? আমার কাছেও এসেছিলো লেখাটা,দারুণ রোমান্টিক। "
খুব একচোট রেগে যায় নেলি,এখনো রোমান্স খোঁজে,এরমধ্যেই বৌকে ভুলে গেলো।
রিনির অনেক আবদারে ওর বার্থডেতে যেতেই হলো সাম্যকে নিয়ে নেলিকে,সত্যিই যখন
মায়ের ল্যামিনেশন করা বড় ছবিটার সামনে দাঁড়িয়ে মেয়েটা,আই লাভ ইউ মাম্মা বলে কেকটা কাটলো,চোখটা ভিজে গেলো নেলির,মন ছুঁয়ে গেলো রায়ানের দিকে তাকিয়েও,এক অসহায় বাবা ছাড়া আজ আর কিছু মনে হলোনা।
রায়ানের মা অবশ্য মনে করতে পারলেন না নেলিকে,সেই দাপট আর ওনার নেই। শুধু বললেন," শুনেছি তোমার মনটা খুব বড়,কি মিষ্টি দাদুভাইটা,আমার দিদিভাইতো সারাক্ষণ ওর কথা বলে। দুজনের খুব ভালো বন্ধুত্ব।
আসলে নেলির একগুঁয়েমি ভাবটা এখনো যায়নি,তাই মনে রঙ থাকলেও হাল্কা রঙের শিফন আর হোয়াইট শার্টই বেশি ভালো লাগে। "মাম্মা,মাম্মা আজ আমি পুলকারে যাবোনা,আমাকে স্কুলে ছেড়ে দাওনা প্লিজ।"...." এই বুড়ো ছেলে,আমার অফিস নেই নাকি রে।"..অগত্যা যেতেই হলো ছেলেকে নিয়ে,গাড়িটাও গ্যারেজে অগত্যা উবারই ভরসা। স্কুলের সামনে হঠাৎই দেখা হয়ে গেলো রায়ানের সাথে। মেয়েকে ছাড়তে এসেছে,সাম্যর সাথে সাথে একটু আদরের জন্য রিনিও এগিয়ে আসে।
আদর পেয়ে মুখটা উজ্জ্বল হয়ে যায় মেয়েটার। ওদের দুজনের এগিয়ে যাওয়া তাকিয়ে দেখে নেলি গেটের বাইরে থেকে। " অফিসে যাবি তো,চল তোকে ড্রপ করে দি।"....না করতে পারেনা নেলি,ফ্রন্ট ডোরটা খুলে দেয় রায়ান ওর পাশের সীটে বসে নেলি। হাল্কা করে মিউজিকটা চালিয়ে দেয়। অদ্ভুতভাবে নেলির আর সেদিন অফিসে যাওয়া হয়না,ধরা পরে যায় রায়ানের চোখের মনকেমন করা রিকোয়েষ্টের কাছে। "চলনা যাই আজ আবার পুরোনো স্মৃতিতে,ডুবুরী হয়ে ডুব মারি ঝুপ করে।" চা,আলুকাবলি আর কফিহাউসের আড্ডায় নেলির ঊনিশবছর ধরা পরলো আবার চল্লিশ ছুঁই ছুঁই বিকেলে।
অনেকদিন বাদে আজ অফিস বাঙ্ক করা দুই পুরোনো বন্ধু ভেসে গেলো মনের চোরাগলিতে একটুকরো অতীতের গন্ধ নেওয়ার সন্ধানে।
স্কুল ছুটির সময় রিনি আর সাম্য তো খুব খুশি। তবুও দুই দুষ্টুর চোখে চোখে একটা হাসির ছোঁয়া খেলে গেলো,সেটা চোখ এড়ালো না নেলির। সাম্য আর নেলিকে ড্রপ করার সময় কিছুতেই ভিজে বর্ষায় কফিটাকে আ্যভয়েড করতে পারলোনা। অপলামাসিও জমজমাট বাড়িতে খুব খুশি। একরাশ খুশির বেলুন হাওয়ায় উড়িয়ে অনেকদিনবাদে বাবা আর মেয়ে ফিরে এলো বাড়িতে।
মাসছয়েক বাদে সাম্য আর রিনি একসাথে স্কুল আ্যবসেন্ট করেছে। ডাইরিতে লেখা ম্যারেজ সেরিমনিতে পার্টিসিপেট করার জন্য। "তোমাদের তো মেডিক্যাল সার্টিফিকেট লাগবে,ভেরি স্ট্রেঞ্জ দুজনের সেম নাম্বার অফ ডেইজ আর সেম কজ!"......" এনেছি ম্যাম সার্টিফিকেট।"
......" ওকে আফটার ক্লাশ একটু বাইরে আসবে তো।" আসলে মনুষ্যচরিত্র বড়ই কৌতূহলী। কারণটা জেনে খুব একটা আশ্চর্য হলেননা ক্লাশটিচার। হয়ত একটু অন্যরকম ফিলিংসও হলো,তবে ব্যাপারটা প্রিন্সিপাল অবধি না যাওয়াই ভালো,উনি হয়ত বলবেন কুশিক্ষা।
নেলিকে রাজি করাতে হিমসিম খেয়েছিলো রিনি আর সাম্য। রায়ান আর ওর মাও বলেছিলেন। মুখের ওপর বলেই দিয়েছিলো নেলি," এই শোন আমি তোদের বাড়ি গিয়ে থাকতে পারবোনা চ্যাম্পকে নিয়ে,তাছাড়া অপলামাসি তো আছেই।"..... রায়ান চুপ করে গেলেও ওর মা বলেছিলেন," আচ্ছা ঠিক আছে,দিভাই আর রায়ানই থাকবে তোমার ওখানে। শুধু ওদেরকে নিয়ে উইকএন্ডটা কাটিয়ে যেয়ো আমাদের সাথে। দিভাই,দাদুভাইকে না দেখে থাকি কি করে। বড় নিশ্চিন্ত লাগছে আমার?".....আর কিছু বলতে পারেনি নেলি,মাথা নিচু করে ফেলেছিলো আর রায়ানের সাথে চোখাচোখি হওয়াতেই হেসে ফেলেছিলো।
কখন যে পুরোনো প্রেম বন্ধুত্ব আর মাতৃত্ব সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিলো বুঝতেই পারেনি নেলি। ওদের ছোট্ট রিসেপসনের দিন পুরোনো বন্ধুরা মজা করে বলে গেলো," সত্যি নেলি,কি গুডলাক তোর,সব কিছু একদম রেডিমেড পেয়ে গেলি। এই যে চ্যাম্প আর আ্যঞ্জেল মাম্মা আর পাপার কাছে একদম ক্লোজ দাড়াও, এই তো,বেষ্ট ফটো ইন দ্য ওয়ার্লড। রিনির হাতদুটো তখন জড়িয়ে ধরে আছে নেলিকে,আর সাম্য রায়ানকে।
নেলির ব্লগের ওয়ালে পোষ্ট হলো.....
"চুপকথারা ছুঁয়ে গেলো,
মনে লুকোনো ভালোবাসা।
আমার প্রেমেরা হারিয়ে পথ
তোর মনে আজ বাঁধলো বাসা।"
তবে রায়ানের বায়ো দেখে,হেসে ফেললো নেলি,"তোর মনে ছিলো!"...." থাকবেনা কেনো,আইলাইনার আর লিপষ্টিকে কিন্তু রিয়েলি দারুণ"...."এই যে আর নয় চুপ"..মিষ্টি হেসে ঠোঁটে আঙুল ছোঁয়ায় নেলি। হানিমুনে নয় ঠিক সবাইকে নিয়ে একটা ছোট আউটিং শিলংএ। ওখানকার
কুয়াশা ঢাকা মেঘের চাদর ছড়িয়ে দিলো একরাশ ভালোবাসার ওম দুটো একলা মনে। রিনি আর সাম্য তখন হোটেলের ঘরে দাদান,ঠাম্মু আর অপলামাসির সাথে খেলায় ব্যস্ত।
সমাপ্ত:-
.
'
Comments
Post a Comment