#হীরের_টুকরো#
রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী
"মা আজকে ব্রেকফাষ্ট টা আমি বানিয়ে দিই,তুমি একটু শুয়ে থাকো আজ। ও মাম্মা কি গো,কাল তো বলছিলে তোমার হাতে ব্যাথাটা আবার বেড়েছে। সারাদিন খুঁজে খুঁজে এতো কাজ করোনা, এই বয়েসটা কিন্তু একদম ভালোনা তাই সারাদিন সংসার আর বাবার সাথে ঝগড়া না করে একটু নিজের দিকে নজর দাও। নাহলে আজ হাত ব্যাথা কাল পা ব্যাথা লেগেই থাকবে। কাল যে জেলটা লাগিয়ে দিয়েছিলাম একটু কমেছে গো তাতে?"
সকাল সকাল ছেলেটার দিকে ঘুম চোখে তাকিয়ে মনটা যেন কেমন এক অদ্ভুত ভালোলাগার আনন্দে ভরে যায় নন্দার। আজকালকার ছেলে হয়েও যেন অনেকটা আলাদা। দেখে তো চারদিকে অনেকসময় এতো রুডলি ছেলেমেয়েরা মা বাবার সাথে কথা বলে ভাবাই যায়না। ওর ননদের ছেলেই তো এমন ভাবে কথা বলে যেনো মা বাবা কিছুই জানেনা একদম মূর্খ। সেদিনই তো ওর এক বান্ধবী বলছিলো ছেলের সাথে সারাদিনে দশটা কথা হয় কিনা সন্দেহ,কথা বললেই এমন উত্তর দেয় যে কথা বলার ইচ্ছেই চলে যায়। আজকাল নাকি ওর মনটাও তেমন হয়ে গেছে,যখনই ছেলে ভালো করে কথা বলে মনেহয় নিশ্চয় কোন দরকার আছে। অথচ সারাদিন ফোনে বান্ধবীর সাথে চ্যাট বা ফোন চলছে।
শুধু ছেলে কেন এই তো সেদিন ওর মাসতুতো বোন বলছিলো মেয়ের কথা,ঘরের কোন কাজ করেনা। বিছানাপত্র জামাকাপড় সব দলা মোচড়া করে ফেলে রাখা,তেমনি হাল বইয়ের তাকের। মাকে সাহায্য করা তো দূরের কথা,কিছু বললেই চিৎকার করে বাড়ি মাথায় করে। লজ্জায় নিজেদেরই চুপ করে যেতে হয়।
আসলে যত দিন যাচ্ছে মানুষ বোধহয় আত্মসুখী আর অমানবিক হয়ে যাচ্ছে,নিজের বাবা মাকেও ছাড়েনা। অথচ বাইরে থেকে যেন ঋজু আরো বেশি ইনডিপেন্ডেন্ট আর ভালো হয়ে গেছে।
....." দেখি দেখি আমার ছেলেটাকে, সত্যি কত বড় হয়ে গেছে,এই তো সেদিন যেন স্কুল থেকে নিয়ে আসতাম,একটা ললিপপ প্রত্যেকদিন বরাদ্দ ছিলো। ব্যাস্ ওটা পেলেই খুশি। কি অবস্থা করতিস জামাকাপড় আর জুতো মোজার।"
মায়ের কাছে যে কতবার এই কথাটা শুনেছে ঋজু তবুও আবার শুনলো। ভালো লাগে ছোটবেলার গল্পগুলো শুনতে। অনেক সময় নিজেও জিজ্ঞেস করে," আচ্ছা মা তোমার মনে আছে আমি যে ছোটবেলায় বন্ধুদের সাথে মারামারি করে এলে আগে তুমি দু ঘা বসাতে তারপর কোন কথা বলতে । ওদিকেও মার খেতাম আবার এদিকেও কানমলা।"
..." হুঁ মার খেতিস, না মেরে আসতিস?যা দুষ্টুর শিরোমণি ছিলি তুই,ওহ্ তখন ভাবতাম কবে যে বড় হবি। নিত্য একটা করে অপকর্ম মাথা খারাপ হবার জোগাড়। আর এখন ভাবি ছোটবেলাটাই ভালো ছিলো। কত মজা করতাম ছোট্ট ঋজুকে নিয়ে। ছোট ছোট বায়না আর ছোট ছোট খুশি। কি যে গাড়ির নেশা ছিলো তোর,উঃ তোর বাবা তো মাঝে মাঝে খেলনার দোকানের রাস্তা ছেড়ে দিয়ে অন্য জায়গা দিয়ে যেতো তোকে নিয়ে।"
....." সত্যি মা আমার খুব রাগ হয়েছিলো যখন পুরোনো বাড়িতে আমার তিন ব্যাগ ভাঙা খেলনা ফেলে এসেছিলে।"
......হেসে ফেলে নন্দা," ওহ্ বাবা ঐ জঞ্জালগুলো নতুন ফ্ল্যাটে আনবো। বন্ধুরা এলেই তো ওগুলো ছড়িয়ে বসতিস আর তারপর শুরু হত দক্ষযজ্ঞ আর মারামারি।"
ছেলের সাথে কথা হতে হতেই হঠাৎ বিছানা থেকে লাফ দিয়ে ওঠে নন্দা। "ইস কথা বলতে বলতে খেয়ালই করিনি কত বেলা হয়ে গেছে! তোর বাবা কতক্ষণ বসে আছে, চা খেয়েছিস তোরা? সত্যি আজ খুব ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।"
....." ওহ্ চাপ নিয়োনা মা,বাবার মর্ণিং ওয়াক হয়ে গেছে,আচ্ছা তুমিও তো একটু যেতে পারো ,দেখবে খুব ভালো লাগবে। আমার এক্সারসাইজ হয়ে গেছে। আমরা গ্ৰীন টি খেয়ে নিয়েছি। তোমারটা রেডি আছে।"
সত্যি ছেলেটা বাইরে থেকে অনেক কাজ শিখে গেছে। অথচ একসময় সব করে দিতে হোত। এবার একটা মেয়ে দেখতে হবে,ওর একটা বিয়ে দেওয়া খুব দরকার। বেশ কয়েক বছর চাকরি করছে একা একা থাকে ব্যাঙ্গালোরে। ছুটি পেলেই চলে আসে,তবে সেতো মাত্র কয়েকদিন, তখন কোথা দিয়ে যে কেটে যায় দিনগুলো বোঝাই যায়না। মাঝে মাঝে ওরাও চলে যায় ওখানে।
...." রান্নাঘরে কি খুটখুট করছিস রে? আরে আমি আসছি তো,ওখানে তো সেই একাই সব করিস।"
......" চলে এসো টেবিলে তাড়াতাড়ি,বাবাও চলে এসো। সারপ্রাইজ....
মুখটা খুশিতে ভরে উঠলো নন্দার স্যান্ডউইচ,চা সব কি সুন্দর সাজিয়ে ফেলেছে টেবিলে। নন্দার রান্নার লোক নেই নিজেই সব কাজ করে। আর কিই বা কাজ,তবুও আজকাল মাঝে মাঝে হ়াঁপ ধরে যায়। হয়ত বা একঘেঁয়েমিও লাগে কিছুটা। শাশুড়িমা আর ওর মা চলে যাবার পর এমন করে খাবার গুছিয়ে হয়ত অনেকদিন কেউ দেয়নি।
মায়ের হাসিমুখটা দেখে একঝলক খুশিতে ভরে ওঠে ঋজুর মনটাও,কাজগুলো সত্যিই ছোট অথচ একসাথে যে সবকাজটা করে তার কাছে সত্যিই অনেকটা কাজ। মায়ের সাথে আজ একটু কাজ ভাগ করে নিতে কেন যেন খুব ভালো লাগলো। হয়ত অনেক সময় ছেলে মেয়ে ভেদাভেদে এই ইগোগুলোই মানে সব কাজ মেয়েরাই করবে,এগুলো ছেলেরা করে নাকি এই মানসিকতাই অনেকটা চাপ বাড়িয়ে দেয় ওর মায়ের মতো অন্য মায়েদের জীবনেও।
এমন স্যান্ডউইচ যেন জীবনেও খায়নি নন্দা,সন্তানের হাতে বানানো জিনিস কি সত্যিই এতো ভালো লাগে! তাই হয়ত ওর বাবা মারা যাবার আগে ওর হাতে বানানো হরলিক্সকে অমৃত বলেছিলেন। নন্দার পরে খুব মন খারাপ হয়েছিলো,হয়ত বাবা চলে যাবেন বলেই এমন কথা বলে গিয়েছিলেন। ওর বানানো সব পদই বাবার অসাধারণ লাগতো। সন্তানের বানানো খাবারে যে কি অমৃতসুধা মেশানো থাকে তা আজ বুঝলো নন্দা। ভাবনার অতলে তলিয়ে গিয়েছিলো।
........"কেমন হয়েছে মা বললেনা তো,নিশ্চয় ভালো হয়নি,কি গো বাবা?"
নন্দা আর ঋজুর বাবার মুখ দিয়ে একসাথে বেড়িয়ে এলো এক্সসেলেন্ট।
নন্দা হঠাৎই বলে উঠলো," অমৃত।" হয়ত বাবার কথাটাই বেড়িয়ে এলো মুখ দিয়ে। একসাথে বেশ জমজমাট হলো ব্রেকফাষ্ট।
...." আচ্ছা তুই কবে বিয়ে করবি বলতো,এইরকম স্যান্ডউইচ আর ম্যাগি পাস্তা খেয়ে কদিন চলবে শুনি?"
....." মা আমি এখন সব পারি,কি খাবে তুমি বলো? ডাল ,আলুপোস্ত আর মাছভাঝা? ঝোলটা তোমার মত হয়না যদিও।"
...." তবুও তো দেখতে হবে মেয়ে বিয়ে করবিনা নাকি বেশ কয়েক বছর তো হলো চাকরির,এবার দেখি কি বল?"
ছেলের চুপচাপ মুখটা দেখে নন্দা বুঝে নেয় নীরবতাই সম্মতির লক্ষণ।
ঋজু ব্যাঙ্গালোরে চলে যাবার পর কোমর বেঁধে লেগে পড়ে নন্দা,এর মাঝেই অনেকগুলো মেয়ের খবর পেয়েছে। তাছাড়া ওর ননদ বলেছে ওর ভাসুরঝির কথা ওরা দিল্লীতে থাকে খুব বড়লোক। মেয়েটা খারাপ না তবে একটু বেশিই আধুনিকা। দুএকটা মেয়ে দেখেছে নন্দা। সত্যিই ভালো লাগেনা,এইভাবে মেয়ে দেখে বেড়াতে। দিন পাল্টেছে কিন্তু মেয়েরা বোধহয় তুল্যমূল্য বিচারে সেই এক জায়গায় থেকে গেছে। সত্যি খুব খারাপ লাগে,চা মিষ্টি খেয়ে মেয়ে দেখে বেড়াতে। ইস্ ছেলেটা এতোদিন বাইরে থাকলো কিন্তু শেষে এই কঠিন কাজটা নন্দার ঘাড়ে ফেললো।
এর মাঝে হঠাৎই একদিন দেখা হয়ে গেলো মলির সাথে ব্লাড টেষ্ট করাতে গিয়ে। সত্যি প্রথমে চিনতে পারেনি নন্দা। ঋজুর একদম ছোটবেলার বন্ধু শ্রীতমার মা,একদম নার্সারী থেকে এইট পর্যন্ত পড়েছে ওর সাথে। তারপর হঠাৎই ওর বাবা বদলী হয়ে গেলো গৌহাটি তাও যোগাযোগ ছিলো কিছুদিন তারপর যা হয়,আর ফোননম্বর পায়নি। নন্দার মাঝে মাঝে মনে হত মলির কথা,অথচ একসময় কত গল্প আর চা খাওয়া হত ওদের সাথে ছেলেকে স্কুলে ছাড়তে গিয়ে। সত্যি সব কেমন স্মৃতি হয়ে হারিয়ে যায় কোথায়। দেখতে দেখতে কোথা দিয়ে এতোগুলো বছর পেরিয়ে গেছে।
এতো বছর বাদে মলিকে দেখে সত্যিই খুব ভালো লাগে নন্দার,"কিন্তু একি চেহারা হয়েছে তোমার! সত্যি আমি প্রথমে চিনতেই পারিনি। তুমি না বললে হয়ত চিনতেও পারতামনা।"
দুজনের অনেক কথা হলো ওখান থেকে বাইরে বেড়িয়ে। জানতে পারলো ওর হাজবেন্ড খুব অসুস্থ লিভার সিরোসিসের সমস্যায় ভুগছে,প্রায়ই ভর্তি করতে হয় হসপিটালে। এই করে খুব মানসিক সমস্যায় আছে ওরা। নন্দা বুঝতে পারে আর্থিক সমস্যাটা ওকে বলেনা মলি, তবে ওর শুকিয়ে যাওয়া চেহারাটা অনেক না বলা কথা বলে যায়। একসময় ওদের বাড়িতে ঋজুর স্কুলের টাস্ক নিতে দুএকবার গেছেও নন্দা। যদিও এখন আর ওরা ওই বাড়িতে থাকেনা বললো। বাড়িটা প্রোমোটিং হওয়াতে ফ্ল্যাটে থাকে গড়িয়ার দিকে।
....' আচ্ছা শ্রীতমা এখন কি করছে গো? একসময় আমার ছেলেটা শান্ত বলে ওকে যা জ্বালাতো। ভাগ্যিস আমাদের বন্ধুত্বটা একদম মজবুত ছিলো তাই ওদের ঝগড়াতে কান দিতাম না। ছোটবেলায় ঋজুটা সত্যি মারকুটে ছিলো,কত নালিশ যে আসতো। আর তোমার মেয়েটা একদম তার উল্টো।"
.....মলি বলে," এখনো তেমনি আছে গো চুপচাপ,খুব বোঝে আমাকে। তেমন কিছুনা গো,ইংরেজীতে এম.এ করেছে এখনো পাকাপাকি কিছু হয়নি চেষ্টা করছে। এখন প্রচুর টিউশন করে,চাকরির পরীক্ষাও দিয়েছে হয়ত হয়ে যাবে। কাছেই একটা মিশনারী স্কুলে পড়ায়। ছেলেটাও একটা কোম্পানীতে আছে সবাই মিলে চেষ্টা করি সংসারটা চালিয়ে নিতে।"
ঋজুর বাবাকে বলে নন্দা "একদিন ভদ্রলোককে দেখতে যাওয়া উচিত তাইনা কি বলো?"...নন্দা একদিন মলিদের বাড়ি গেলো। ইশ্ সত্যি কি চেহারা হয়েছে ভদ্রলোকের অথচ কি সুন্দর দেখতে ছিলেন একসময়ে। তবে মলির ছেলে মেয়ে দুটো সত্যিই ভালো হয়েছে এমনটা দেখা যায়না। কি সুন্দর পরিপাটি করে যেটুকু ওদের সম্বল তারমধ্যেই ঘর সাজিয়ে রেখেছে। শ্রীতমা ডিমের ডেভিল বানিয়ে খাওয়ালো।
" এতো কাজ শিখে গেছিস,খুব ভালো হয়েছে রে খেতে,ঋজুটাও খুব ভালোবাসে খেতে।" ঋজুর কথা শুনে এক টুকরো হাসি খেলে গেলো শ্রীতমার মুখে,বাপরে যা দুষ্টুর শিরোমণি ছিলো প্রায় দিনই ওর পিঠে দুমদাম কিল বসাতো আর নাহলে টান দিয়ে ঝুটিটা খুলে ফেলতো। ঋজুকে দেখলেই ভয় লাগতো।
মলি বললো," ওই বললো মা বাড়িতে একটু খাবার বানাই আন্টিদের জন্য। আসলে ওর বাবার জন্য প্রায়ই হসপিটাল বাড়ি ছোটাছুটি করি তো তাই মেয়ে আমার অনেকটাই সামলায়।"
বাড়ি ফিরে আসে নন্দা,মাঝে মাঝে কথা হয় মলির সাথে। খুব দুঃখজনক ভাবে মাস দুয়েক বাদে ওর হাজব্যান্ড মারা যায়। নন্দা সেই সময় পাশে দাঁড়িয়েছিলো ওদের। শ্রীতমার কান্নাভেজা মুখটা বড্ড ছুঁয়ে যায় নন্দাকে। ঋজুর জন্য অনেকগুলো মেয়েই দেখা হয়েছে এর মধ্যে। তবুও অত আধুনিকা সাজগোজ করা মেয়ের মধ্যে কেন যেন হঠাৎই নন্দার মনে হলো শ্রীতমাকে ছেলের বৌ করলে কেমন হয়? হয়ত ঋজুরই বয়সী হবে,তা হোক এখন তো হচ্ছে সমবয়েসে বিয়ে। কিন্তু ঋজু কি রাজি হবে? বড় হবার সাথে সাথে তো মানসিকতাও পাল্টায়। যদিও ওকে বলেছে এর মধ্যে মলির সাথে দেখা হওয়ার ব্যাপারটা। শুনে ও খুশিই হয়েছে।....' না থাক্ ফোনে এতো কথা হয়না,তাছাড়া সদ্যই তো ওর বাবা মারা গেছে এখন ওদের কাল অশৌচ চলছে।"
মাস তিনেক বাদে ঋজু আসে। ওকে সঙ্গে নিয়ে যান মলিদের বাড়িতে। ও বাবা দুটিতে তো বেশ কথা বলছে! এখন আর ঝগড়া হচ্ছেনা।ঋজুর পাশে শ্রীতমাকে ভালোই লাগছে দেখলো নন্দা। ভাব তো হবেই পুরোনো বন্ধু বলে কথা। যদিও শ্রীতমা একটু শান্ত বরাবর বেশি কথা বলেনা,কম বয়সে অনেকটা দায়িত্ব চেপেছে ওর ঘাড়ে। ডিমের ডেভিলটা সত্যিই অসাধারণ বানায় মেয়েটা।"
......" এই কয়েকটা প্যাক করে দে তো পরে খাবো,বাড়িতে নিয়ে।"
....ছেলেকে ধমক দেয় নন্দা," কি বলছিস কি? পেটুক কোথাকার। ওর কাছে আরো চপ বানানো আছে কিনা কে জানে?"
একটু হাসে শ্রীতমা," আমি বানিয়েছি গো বেশি করেই,না দিলে হয়ত আবার সেই ছোটবেলার মত চুল ধরে টানবে অথবা পিঠে একটা কিল বসাবে।"
সবাই হাসে এবার। ছেলেকে নিয়ে কয়েকটা মেয়ে দেখেছে এর মধ্যে ,ঋজু খুব একটা কিছু বলেনি। ওর ননদের ভাসুরের মেয়েকে দেখতে যেতে খুব বলছে। এর মধ্যেই ছেলেকে একটু ইতস্তত করে শ্রীতমার কথাটা বলে নন্দা।
...." এই তো তোমার শুরু হয়ে গেলো ঘটকালি,বন্ধুত্বটাই তো ভালো ছিলো মা সব কিছুতেই পাত্রী দেখা শুরু করলে কি হবে....। তুমি ওদের কিছু বলেছো নাকি?"
....." না রে ওদের বলে কি লাভ তোরই যদি মত না থাকে।"
......"আচ্ছা আমাকে দুএকটা দিন সময় দাও একটু ভেবেনি মা তারপর তোমাকে বলবো।"
......আজকাল ছেলেকে একটু বেশিই ফোনে ব্যস্ত দেখে নন্দা। অনেক রাত পর্যন্ত ফোনে গল্প। কার সাথে এতো কথা বলে কে জানে। কিছু বলছেও না। এবার সত্যি জিজ্ঞেস করতে হবে। না হলে ননদের ভাসুরের মেয়ের ব্যাপারটা দেখবে।
"কি রে কিছু বললি না তো? তাহলে কি তোর পিসিমণিকে বলবো?"
......" মা তোমাকে যে কি করে বলি মা ব্যাপারটা,আমার সাথে না রিসেন্টলি একজনের আলাপ হয়েছে। আসলে ও পরিস্কার করে বলছে না কিছু। যদিও আমি অলরেডি প্রপোজ করে ফেলেছি।"
....মুখটা একটু কাচুমাচু হয় নন্দার ভাগ্যিস মলিদের কিছু বলেনি। এইজন্যই এতো ফোনে গল্প ছেলের। " কে রে? কোথায় থাকে? একটা ছবি তো অন্তত দেখা দেখি কেমন মেয়েটা।"
....." এই তো শুরু হলো প্রশ্নের ঝুড়ি,আরে আমাকে তো এখনো হ্যাঁ বললো না। জানিনা বলবে কি না। আমিই চাপে আছি,আর তুমি শুধু ব্যস্ত করছো।"
.....কাল তো তুই চলে যাবি আবার আসতে আসতে সেই দেওয়ালী। আমি ততক্ষণ কি হাত পা গুটিয়ে থাকবো। কি যে করিস না,ভালো লাগেনা। তোর যখন কাউকে পছন্দ তো আগে বললেই হত। আমি অযথা এতো চেষ্টা করলাম। চা মিষ্টি খেয়ে খেয়ে সুগার বাড়ালাম। আর তোর পিশি তো আমার মাথা খেয়ে ফেলবে এবার।"
....." ওহ্ মা একটু না হয় খেলোই পিসিমণি ,তোমার প্রিয় রায়বাঘিনী বলে কথা। দেখি কাল যদি আমায় সি অফ করতে এয়ারপোর্টে আসে তাহলে বুঝবো রাজী আছে।"
পরেরদিন ছেলেকে ছাড়তে ওরা কর্তা গিন্নী এয়ারপোর্টে যায়। ঋজু ঘনঘন এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।" কি রে এবার যাবি তো ভেতরে? বোর্ডিং পাস নিতে দেরি হয়ে যাবে তো।" "একটু ওয়েট মা দেখি যদি সে আসে তাহলে বুঝবো রাজী। ইশ্ আমারই খারাপ লাগছে কি মরতে যে প্রপোজ করতে গিয়েছিলাম।"
....." আমাকে তো কিছুই বললিনা তাহলে আমরা একবার চেষ্টা করে দেখতাম। এটা তো মনে হয় হবেনা তাহলে শ্রীতমাদের কি বলবো কথাটা?"
....." না না দরকার নেই ওটা একটা ভীতু, হাঁদা একদম ভোদাই মার্কা মেয়ে। আমার একটুও পছন্দ না এমন মেয়ে। ওকে শুধু পিট্টি দেওয়া যায় যেমন স্কুলে দিতাম।"
....." অনেক হয়েছে,এবার যা তো ভেতরে,দেরি হয়ে যাচ্ছে।"
মাসদুয়েক বাদে নন্দার আবার বাজার দোকান তুঙ্গে চলছে, কি যে করবে ভেবে পাচ্ছেনা । হঠাৎই ছুটি পেয়েছে ছেলে তাই চলে আসছে। কাল আসবে,আর আজ জানালো কি মুশকিল কান্ড। আরেকটু আগে বললে ওর পছন্দের রান্নাগুলো আগে থেকে করে রাখতে পারতো।
পরেরদিন এয়ারপোর্টে গেছে ছেলেকে আনতে ওরা,কেন যে ফ্লাইটটা দেরি করছে কে জানে। কিছুক্ষণ বাদে ফোন পায়,ল্যান্ড করেছে একটু বাদেই আসছে।
পেছন থেকে গলাটা জড়িয়ে ধরে ঋজু। ওহ্ এসে পড়েছিস,অনেকটা দেরি করলো ফ্লাইটটা,শরীর ঠিক তো বাবা? চল এবার বাড়ি যাই,যত তাড়াতাড়ি পৌঁছনো যায় ততই ভালো।"
....." কি রান্না করেছো মা আজ?"
..." ওরে পেটুক,শুধু খাওয়ার চিন্তা আগে চলতো।"
"মা,বাবা অনেকক্ষণ এসেছো তো তোমরা,তোমাদের একটু কফি খাওয়াই,বাড়ি থেকে তো অনেকক্ষণ বেড়িয়েছো।"
ওরা দুজনেই বলে ওঠে," না না বাড়িতে চল তো এখন কফি খাবোনা।"
......." একটু ওয়েট করো না মা, যদি ও আসে।"
..." এখনো ওর ভুত মাথা থেকে নামেনি। কি ছেলে রে তুই!"
হঠাৎই চোখ পড়ে যায় একটু দূরে শ্রীতমা আর ওর ভাইয়ের দিকে,অবাক লাগে নন্দার। শ্রীতমার ভাই কি বাইরে কোথাও যাচ্ছে? মলি তো কিছু বলেনি। ওদেরকে ডাকতে যাবে ভাবতেই দেখে ওরাই এগিয়ে আসছে এদিকে।
...." তোরা এখানে কি করছিস রে? কোথাও যাবি নাকি?"
.... আরে না না এই তো সেই ভীতু ভোদাইটা মা,যাকে তোমার পছন্দ। ও রাজী হলো বলেই তো চলে এলাম আবার। কিছুতেই রাজী হচ্ছিলোনা জানো। দেখতেই অমন চুপচাপ আসলে খুব জেদী ও ভাবছিলো আমরা বুঝি দয়া করছি ওর ওপর। কি সব ভাবে বলতো? আমার মাকে কেউ রিফিউজ করবে তা কেমন করে সহ্য করবো বলতো। তাই আমিই প্রপোজ করেছিলাম। প্রথমে বোধহয় পিট্টি খাওয়ার ভয়ে হ্যাঁ বলেনি,সময় নিচ্ছিলো। তারপর আবার ডেভিল বানানোরও চাপ আছে।"
শ্রীতমা এসে প্রণাম করে ওদের। " এই এখানে কি,আমাদের বাড়ি কবে আসবি বল?"
....." তোমরা যেদিন বলবে।" বলে একটু হাসে ঋজুর দিকে তাকিয়ে।
ওর বাবার বাৎসরিকটা হয়ে যাওয়ার পর আর বেশি দেরি করেনি নন্দা। শ্রীতমাকে নিয়ে এসেছিলো ওদের বাড়িতে বৌ করে মনের মত সাজিয়ে। মলি খুব ইতস্তত করে কিছু জিনিস আর গয়না দিতে চেয়েছিলো।মেয়েকে শুধু পাঠাতে ইচ্ছে করেনি তাই চেষ্টা করেছিলো যদি কিছু দিতে পারে। তবে কিছুই নেয়নি ওরা,নিজেরা সাজিয়ে এনেছিলো শ্রীতমাকে। নন্দার বিয়ের সময় ওর শ্বশুরমশাই ওর বাবার কাছ থেকে কুড়িহাজার টাকা আর দশভরি সোনা চেয়েছিলেন। ওর বাবা দিয়েছিলেন,খুব খারাপ লেগেছিলো নন্দার,যদিও বাবা বুঝিয়েছিলেন ওরা না চাইলেও দিতেন উনি,এতো ভালো ছেলে।
ওই কষ্টটা আজো মনে দাগ কেটে আছে নন্দার,এ কেমন নিয়ম! মেয়েকে বড় করে মানুষ করে আবার পণ দিয়ে তুলে দিতে হয় অন্যের হাতে। আর সেখানে গিয়েও তো একটা মেয়েকে সবই সামলাতে হয়।
ফুলশয্যার দিন ফুলশয্যার জন্য সাজানো হয়েছিলো ওর শ্বশুরের আমলের সেগুন কাঠের কারুকার্য করা খাটটাকে যত্ন করে। নন্দার ননদ এসে মুখ বাঁকিয়ে বলেছিলো,"সত্যি বৌদি তোমাদের যে কি ভীমরতি হলো এমন ঘরে সম্পর্ক করলে যারা একটা খাটও দিতে পারেনা। আমার ভাসুর হলে পুরো ইন্টেরিয়ার ডেকোরেশন করে তোমার ফ্ল্যাটটাই সাজিয়ে দিতো। এমন হীরের টুকরো ছেলে আমাদের।"
....." সেই জন্যই তো কিছু নিলাম না গো। হীরের ঝলকানির পাশে যে সব কিছুই নিষ্প্রভ আর ফেলনা। হীরের জৌলুস সবসময় ছাপিয়ে যায় যে কোন যৌতুককে। ভালো থাক ওরা দুটিতে সেই আশীর্বাদ কোরো, জিনিস দিয়ে কি হবে?"
ফুলের সাজে সাজছিলো শ্রীতমা,নন্দার কথাটা যেন অদ্ভুত এক ভালোলাগার আবেশ ছড়িয়ে দিলো হয়ত অনেকটাই নিশ্চিন্তও হলো। রজনীগন্ধার ফুলের গন্ধে শ্রীতমা ভেসে গেলো এক নতুন জীবনের খোঁজে ঋজুর সাথে। সত্যিই বড় নিশ্চিন্তে ঋজুর চওড়া বুকে মাথা রাখলো শ্রীতমা। পিট্টি দেওয়া মারকুটে ছেলেটা পরম যত্নে টেনে নিলো তার হারিয়ে যাওয়া বন্ধুকে সারাজীবনের বন্ধু করে।
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment