#খাট্টি_মিঠ্ঠি_মেয়েরা#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
"মা একটা কথা বলার ছিলো...আজ আমার এক বান্ধবী আর ওর বর আর ছেলে আসবে,ফোন করেছিলো। আমি বলেছি রাতে এখান থেকে খেয়ে যেতে। এই প্রথম আমার বিয়ের পর ওর সাথে দেখা হচ্ছে তাই ভাবলাম...আসলে ও আমার বিয়ের সময়ও আসেনি,ওর বিয়ে অনেক আগেই হয়ে গেছে এখন ওরা দিল্লীতে থাকে।" একটু ইতস্ততঃ করে কথাগুলো বলে রুমি। " আর কি বলেছো যখন ওদের, তখন তো ব্যবস্থা করতেই হবে। আমাদের রান্না বান্না তো শেষ। আবার কিছু ভাবতে হবে,সৈকতও তো অফিসে বেড়িয়ে গেছে।"
...." মা বাবাকে বলবো একটু বাজার থেকে চিকেন আনতে,আমি টাকা দিয়ে দিচ্ছি।"
...." এসব কি কথা বৌমা,সেই তো আমার ছেলেরটাই দেবে। তুমি তো আর রোজগার করোনা। এই তোমাদের এক দোষ বিয়ে হতে না হতেই আমার তোমারটা বেশ বুঝে যাও। যা খরচ হবে সংসার থেকেই হবে। এ আবার কি এসব ভালো নয়।"
আসলে রুমি জানে ওর শাশুড়িমা একটু কৃপণ, কিছু করার নেই অনেক কষ্টে ছেলেমেয়েকে বড় করেছেন শ্বশুরমশায়ের একা চাকরির ওপর আর তখন মাইনেই বা কত ছিলো। তাই ঐরকমই অভ্যেস হয়ে গেছে এখনো প্রাণ খুলে খেতেও পারেননা আর দিতেও পারেননা। তাই ভাবছিলো ও টাকাটা যদি দেয় কিন্তু সেটা হলোনা। আবার নতুন বৌ পাড়ার বাজারে মুরগী কিনছে সেটাও প্রেস্টিজের ব্যাপার তাই হাত গুটিয়েই থাকতে হোলো শাশুড়ির ওপর ভরসা করে। " হ্যাঁ শোনো,দুপুরের যা রান্না হয়েছে তা তো থাকবেই তার সাথে চিকেন হলেই চলবে তো,কি বলো?"..." ঠিক আছে মা,দরকার হলে একটু ভাজা ভেজে দেবো।"
শ্বশুরমশাই বাজার থেকে চিকেন আনলেন বিকেলে,প্যাকেটটা বড় ছোট মনে হলো রুমির মনে মনে ভাবলো এতটুকু মাংস কি হবে! সব মিলিয়ে ওরা ছয়জন। মাংস হলে বাড়ির সবাই তো একটু খাবেই। রুমিকে আর রান্নাঘরে তেমন ঢুকতে দিলেননা উনি।" তুমি যাওনা,কাপড় পাল্টে রেডি হয়ে নাও। আমি রান্না করে নেবো। ওরা এসে তোমায় রান্নাঘরে দেখলে কি ভাববে?"
বাধ্য হয়ে নিজে তৈরি হয়ে নেয়। বন্ধু এলে অনেক গল্প হয়, কতদিন বাদে দেখা দুজনেরই মনটা আনন্দে ভরে যায়। বাড়িতে এদিকে মাংস রান্নার গন্ধ ম ম করছে। রান্নাটা শাশুড়িমা সত্যি দারুণ করেন। ওর ছেলেটা এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করছে। এর মাঝে সৈকতও এসে পড়েছে ভালোই হয়েছে।
খাওয়ার শাশুড়িমা বেড়ে দিয়েছেন ও এনে টেবিলে দিচ্ছে,মাংসের বাটিতে উঁকি মেরে দেখে দু টুকরো করে আলু আর দু টুকরো মাংস। লজ্জা লাগে রুমির,ইশ্ চারটুকরোর কমে দেওয়া যায়!
আস্তে আস্তে বলে," মা আরো দু টুকরো করে দিলে হোত না? আর কি ওরা কোনদিন আসবে,হয়ত এটাই শেষ।"...." রাতে কত খাবে বৌমা? দাও তো চাইলে দেখা যাবে।" সত্যি মাংসটা খুব ভালো হয়েছে,ওরাও বারবার বলছে। "আরেকটু দেবো? না জিজ্ঞেস করে পারেনা রুমি।" থালাটা নিয়ে এসে ওদেরকে দেয় ওর বর আরেক টুকরো বেশিই নেয়। তখন তাকিয়ে দেখে আর তিনটুকরো মাংস আছে,সত্যিই মনটা খচখচ করে এবার,ওর বর আর শ্বশুরের কথা মনে হয়। শাশুড়ি এতো খেটে রাঁধলেন উনিও তো খাবেন। তখন শুকনো মুখে ঠাকুরের নাম জপ করছে রুমি আর যেন কেউ কিছু না চায়। হঠাৎই বাচ্ছাটা বলে,আমি একটু মাংস নেবো। ওর বান্ধবী হয়তো বুঝতে পেরেছিলো ওর অবস্থা তাই বললো, "তুমি আর খেতে পারবে না সোনা"।..." আমি পারবো খেতে।" আসলে ততক্ষণে ওর মায়ের খাওয়া প্রায় শেষ ওর মা যে নিজের থেকে তুলে দেবে তার উপায় নেই, তাই রুমি একটা ছোট বাটি করে এক পিস মাংস ওর বাটিতে এনে দিলো।
সেদিন রাতে বর আর শ্বশুরমশাই এক পিস করে ভাগে পেলেও ওর আর শাশুড়িমায়ের পাতে শুধু আলু আর ঝোল তাও প্রায় ছিলোনা তেমন, এই জুটলো। শাশুড়িমা বললেন," ওরা যে বেশি খায় বুঝতে পারিনি। যাক হয়ে গেছে ব্যাস্। মেয়েমানুষের আবার খাওয়া কি,বাড়ীর সবাই পেয়েছে এতেই খুশি।"
উনি হয়ত খুশি হলেন কিন্তু রুমির টেনশনে প্রাণ যাবার জোগাড় হয়েছিলো। মেয়েমানুষের আবার খাওয়া কি? মেয়েমানুষের অত নোলা ভালোনা সংসারের অকল্যাণ হয় এই কথাগুলো প্রায়ই শুনেছে শাশুড়ির কাছে। বেশিরভাগ দিনই হয় ওদের তরকারী কম, নাহলে ভাত কম এইসব লেগেই থাকতো। কখনো একটা রুটি বা একমুঠো ভাতও বেশি হোতনা ওনার রান্নার মাপে। বলতেন বাসি খাবার খেলে শরীর খারাপ হয়। মাঝে কেটে গেছে প্রায় চারবছর এর মধ্যে রুমি মা হয়েছে। সংসার আরো বেড়েছে। ননদরা বাড়িতে এলে অনেক সময় অতিথি আপ্যায়ন করতে গিয়ে ওদের এই ভেবেই সান্তনা পেতে হয়,মেয়েমানুষের আবার খাওয়া কি। ওর বর সাপোর্ট করে মাকেই, বলে," শোন মা হিসেব করে না চললে আমাদের মানুষ করার পর এতো বড় দোতলা বাড়ি বাবা করতে পারতেননা। তুমিও একটু শেখো। আচ্ছা তোমার এতো অভিযোগ কেন,আমি তো বাজার থেকে হিসেব করেই মাছ আনি,কম হওয়ার তো কথা নয়।"
রুমির গলার কাছে এসে আটকে যায় পেটির মাছ থাকলেও শাশুড়িমা নিজেও খাননা আর ওকেও দেননা রাতের জন্য তুলে রাখেন।
একদিন সৈকতই রাতে বললো," মা একবেলা সবাই ডিমভরা ইলিশমাছের পেটি খাবো ,আর রাতে সবাই গাদা। তা এবেলাও পেটি দিয়েছো কেনো আমাকে?"
শাশুড়িমা সেই পুরোনো ডায়ালগটা দেন মেয়েমানুষের আবার খাওয়া তোরা খেলেই...। "সারা জীবন তো এটাই শুনলাম" রাগে একটু গজগজ করতে করতে সৈকত পেটিটা একটু ভেঙে খেয়ে উঠে গেলো। শ্বশুরমশাইও অগত্যা তাই করলেন।
বিয়ের পাঁচবছর পর অনেকটা পরিণত রুমি,শাশুড়িমায়ের ওপর এখন আর ওর রাগ হয়না হয়ত কষ্ট হয়। আসলে ওনার সাথে থেকে থেকে কখন যে ওর মনটাও একটু একটু করে ওনার মতো হয়ে গিয়েছিলো বুঝতেই পারেনি। আজকাল ও নিজেও ভালোমন্দটা না খেয়ে তুলে রাখে ছেলের জন্য। " মা এই সন্দেশটা থাক বাবানের জন্য।"
এর মাঝেই একটুকরো খুশির ঝলক এলো রুমির জীবনে,অনেকের সাথে ওরও প্রাইমারী স্কুলের চাকরিটা হয়ে গেছে। একটু মনকেমন করে,ছেলেটাকে ছেড়ে যেতে অবশ্য খুব একটা অসুবিধে হলোনা দুজনেরই মর্ণিংস্কুল।
বাধাধরা গন্ডীর বাইরে একটুকরো খোলা আকাশ,ওর নিজের জীবন। নিজে রোজগার করবে,ইচ্ছেমত কিছু খরচ করতে পারবে ভেবেই খুব খুশির দোলায় নেচে উঠলো মনটা। ভালোই লাগছে নতুন চাকরির দিনগুলো।
সবচেয়ে আনন্দ হলো যেদিন প্রথম মাইনেটা পেলো,সত্যি নিজের স্বাধীন উপার্জনের স্বাদই আলাদা। সেদিন বাড়ি ফিরতে বেশ দেরি হয়ে যায় রুমির। শাশুড়িমা একটু রাগ করেন," আচ্ছা বৌমা,স্কুলে এতো কি করো বলতো? ছেলেটা কখন থেকে মা মা করছে।"
....." আসছি মা আগে এই প্যাকেটটা রান্নাঘরে রেখে আসি। আজ কিন্তু আমি সব করবো। আজ আপনার ছুটি।"
...." কি আবার করবে?দুপুরের রান্নাটা তো করেই রেখেছি আমি।"
ছেলের হাতে ওর খেলনাটা দিয়ে শ্বশুরমশাইয়ের হাতে মিষ্টির বাক্সটা দেয় রুমি।
একগাল হেসে উনি বলেন," কি করেছো বৌমা,এর তো অনেক দাম!"
"তাতে কি বাবা,আজ আপনার প্রিয় দোকানের সন্দেশ কিনতে খুব ইচ্ছে করলো। খেয়ে দেখুন তো কোয়ালিটিটা এক আছে কিনা?"
....."এখন থাক বৌমা যত্ন করে রাখো, আগে ঠাকুরকে দাও আর আমার দাদুভাইকে দাও। রাতে সৈকত এলে একসাথে খাবো।"
শ্বশুরমশাইয়ের কথাটা শুনে চোখের কোলে এক বিন্দু জল টল টল করে ওঠে রুমির। এটাই হয়ত বন্ডিং আর অপত্যস্নেহ,সত্যিই এখনো কত স্নেহপ্রবণ মানুষগুলো। কিছু অভিযোগ অনেক সময় মনে জমা হলেও ভালো স্মৃতিগুলোকে আজ আগলে ধরতে ইচ্ছে করলো রুমির।
সেদিন বড় সাইজের ডিমভরা পেটিগুলোকে খুব যত্ন করে রান্না করে সবচেয়ে বড় পেটিটা শাশুড়িমায়ের থালায় দিতেই উনি হা হা করে উঠেছিলেন," তোমার বায়নায় আজ ওদের সাথে খেতে বসলাম,চিরকাল তো পরেই খেয়েছি। তাই বলে এতো বড় মাছটা আমায় কেনো ওটা আমার ছেলেকে দাও। আমার ল্যাজটাই ভালো লাগে।"
" চিরকাল ল্যাজটা খেয়ে কখন যে ল্যাজটাকেই ভালোবাসতে শিখেছিলেন মা তা হয়ত নিজেই বুঝতে পারেননি। আসলে পাওয়া না পাওয়ার মাঝে না পাওয়ার সাথে সমঝোতা করেই সুখী হয়েছেন সবসময়। আর সুখী সংসারের সেটাই মূলমন্ত্র। কথায় আছেনা সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে। আজ এই বড় পেটিটাই খান মা,এই দেখুন আমারও আছে। সত্যিই তো মেয়েমানুষের আবার খাওয়া কি এই চরম সত্য আপনার সাথে আমিও বুঝে গেছি এতোদিনে। আগে রাগ হোত এখন আর হয়না,ভালোলাগে। তবুও তো আমরাও মানুষ মা একটু নোলা আমাদেরও আছে। আর আমাদের ভালো থাকার ওপর নির্ভর করছে আমার আর আপনার সন্তানের ভালোমন্দ।"
শাশুড়িমা আজ আর রাগ করলেন না একগাল হেসে বললেন," মাছটার খুব স্বাদ গো,পদ্মার ইলিশ নাকি। কোন ছোটবেলায় খেয়েছিলাম,বাড়ির বড়মেয়ে তো তাই বাবা আদর করে খাওয়াতেন।"
বাবার কথা বলতেই ছোট্ট মুক্তোর দানা গাল বেয়ে নেমে আসে মায়ের।
হঠাৎই সৈকত বলে ওঠে," সত্যি কইর্যা কও তো তোমার ল্যাজার থনে পেটির স্বাদ বেশি না কম?"
সৈকতের কথা শুনে সবাই একসাথে হেসে ওঠে,এমন একটা মিঠে দিন বহুদিন হয়ত মন ছুঁয়ে থাকবে রুমির। ভালো থাক সবাই,তবুও মেয়েরা ভালো না থাকলে কে ভালোবাসবে ছেলেদের মাতা,পত্নী,ভগিনী আর কন্যারূপে? অবশ্য তার সাথে ঝগড়াটাও আছে,ওটা কিন্তু উপরি পাওনা,মিষ্টির সাথে একটু খাট্টি।
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment