#মণিহার_তোমার#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
"মিষ্টিটা নিন দিদি,এগুলো আমি ঘরে বানিয়েছি। আর এই মালাই চমচম আর মনোহরাটা হরি ময়রার দোকান থেকে আনা। আমাদের এই তল্লাটের একদম নামকরা দোকান।'
....." না না ঠিক আছে,আসলে আমার সুগার লেভেলটা একটু হাই। ওর আবার কোলেস্টরল বেশি। তাই এই যে একটা নিলাম।"
.....গিন্নীর দিকে তাকিয়ে একটু ইতস্ততঃ করলেও মনটা বড্ড আনচান করলো সুবিমলবাবুর ইশ্ গরম গরম ফুলকো লুচি,আর তার সাথে কি সুন্দর ফুলকপির ছেচকি। তবে বাড়ি থেকে যা ধমকে এনেছে লীলা তাই ভয়ে ভয়ে একটা লুচিই তুললেন কিন্তু লুচি আর মিষ্টির স্বাদে চোখটা বুজে এলো। আঃ ....ওনার অবস্থা দেখে কিছুটা বোধহয় বুঝেছিলেন ওনার হবু বিয়াই মশাই তাই গিন্নীকে ইশারা করলেন। পাত্রীর মানে মধুরার মা মাধবী একটা দুটো নয় চারটে লুচি তুলে দিলো সুবিমলবাবুর প্লেটে। " খান দাদা একদিন খেলে কিছু হবেনা।"
বাড়ি গিয়ে কি হবে জানেন তবুও খেয়েই ফেললেন,সাধা লুচি বলে কথা। শুধু একবার আড়চোখে দেখে নিলেন গিন্নীর মুখটা যেখানে একটা কথাই লেখা, আজ হবে তোমার। এরপর সাতদিন হয়ত ব্রাউন ব্রেড আর শশা খেয়ে কাটাতে হবে।
মধুরার হবু শাশুড়িমা লীলা বললেন," আমার খুব একটা ইচ্ছে ছিলোনা গ্ৰামে সম্বন্ধ করার। দূরে শ্বশুরবাড়ি মানেই হাজার ঝামেলা। বাপের বাড়ি যাওয়া আসা,আত্মীয় স্বজন। তবুও ছেলের মন পড়ে গেছে এখানে কিছু করার নেই। এই গ্ৰামে এসেই শেষে আটকে পড়লো,কলকাতায় কত মেয়ের সম্বন্ধ এলো। আসলে আমাদের শহরে থেকে অভ্যেস তো। আজই তো আপনাদের এই রাস্তায় গাড়ি ঢোকাতে আমাদের ড্রাইভারের একটু চাপ হয়ে গিয়েছিলো,নেহাত ওর হাত খুব পাকা। ছেলে এখন জেদ করে বসেছে এখানেই বিয়ে করবে তাই আসতেই হলো"।
বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলো শখ করে সুগত,আসলে উদ্দেশ্য ছিলো বসন্ত উৎসব উপভোগ করা। গাড়ি ড্রাইভ করে যাওয়াও হবে মানে একদম নিশ্চিন্ত লঙ ড্রাইভ,আর কলকাতার ব্যস্ততার ক্লান্তি থেকে কিছুটা মুক্তি নিয়ে লালমাটির মেঠো পথে রঙে রঙে মেতে ওঠার আনন্দ। খুব মজা করতে করতে,সারা রাস্তা লাল কৃষ্ণচূড়ার শোভা আর সবুজে চোখ ভেজাতে ভেজাতে এসেছিলো ওরা চারবন্ধু। মনের আনন্দে গান ধরেছিলো,'এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়।'
তবে মুক্তির আস্বাদ পাওয়ার সাথে সাথে এক নিবিড় ভালোলাগার বন্ধনে জড়িয়ে গিয়েছিলো মন। সুগতর বন্ধু প্রশান্তর মাসতুতো বোন মধুরা,ওদের বাড়ি বীরভূমের তাঁতিপাড়ায়, পড়াশোনার জন্য বিশ্বভারতীর হস্টেলে থাকে। সোনাঝুরির পাশেই যে আদিবাসী গ্ৰাম তারই মেঠোপথ ধরে গেলেই প্রশান্তদের বাড়ি। প্রথমে ওখানে পৌঁছেই মনটা গেয়ে উঠেছিলো,' গ্ৰামছাড়া ঐ রাঙা মাটির পথ।" চাঁদনীরাতে মেঠোপথ ধরে ওরা পৌঁছে গিয়েছিলো খোয়াইয়ের ধারে,যেখানে বাউল বসে গাইছিলো,' মিলন হবে কতদিনে আমার মনের মানুষের সনে। যোগ দিয়েছিলো ওরাও গানের আড্ডায় বাউলের সাথে সাথে। তারপর একসময় প্রশান্তই তাড়া দিয়েছিলো," চল এবার কাল খুব ভোরে উঠতে হবে কিন্তু,না হলে প্রভাতসঙ্গীতটা দেখতে পারবিনা।" ওদের আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়েছিলো সুগত। পরেরদিন রঙের আনন্দে যখন সবাই মাতোয়ারা, বিশ্বভারতীর অনুষ্ঠান শেষে তখনই একগুচ্ছ পলাশের লাল রঙের মাদকতা রাঙিয়ে দিয়েছিলো সুগতকে। অনেক জায়গায় তখন গানবাজনা করছে ছেলেমেয়েরা। মনে তখন শুধুই রঙের খেলা। সেই সময় প্রশান্ত আলাপ করিয়ে দিয়েছিলো," আমার বোন মধুরা,এখানে পড়ে। মা বাবা মাঝে মাঝেই এসে ওর খবর নিয়ে যায়। ও সময় পেলেই চলে যায়।"
লাল,সবুজ গোলাপী আবিরে রাঙানো মাথায় পলাশফুলের মালা জড়ানো মধুরার চোখে চোখ রেখে সুগতর মনে হয়েছিলো এই বুঝি কবিগুরুর কৃষ্ণকলি। গেয়ে উঠতে ইচ্ছে হয়েছিলো,' কালো তা সে যতই কালো হোক,দেখেছি তার কালো হরিণ চোখ।'
রঙের আনন্দে রাঙানো মনটা একটুকরো মন পাগলকরা প্রেমের রঙে রঙিন হয়ে ফিরে এসেছিলো সেবার শান্তিনিকেতন থেকে। সুগতর আর যাওয়া হয়নি ওখানে, শুধুই রয়ে গিয়েছিলো প্রথম দেখার রেশ,ফোনে ফোনেই কথা হত সময় পেলেই। মধুরার এম.এ পরীক্ষার পরেই বাবা মাকে পাঠিয়েছিলো আর সেইজন্যই ওনাদের আসা।
...." মেয়ে তো ছেলেই পছন্দ করেছে,আমাদের একবার দেখতে আসা এই আরকি। সবই ঠিক ঠাক তবে আপনাদের এই মাটির দোতলা বাড়িতে আমার ছেলে কি করে থাকবে এসে তাই ভাবছি। মেয়ের রঙটা চাপা বলেও আমি একটু আপত্তি করছিলাম।"
মধুরার বাবা আর মায়ের শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে ওর হবু শাশুড়িমা বললেন," না না ওসব নিয়ে ভাববেন না,আসলে বিশ্বভারতীর ওপর আমাদের একটু অন্যরকম নষ্টালজিয়া আছে। আপনাকে কোন পণও দিতে হবেনা,আর চিন্তাও নেই। আমার এই একমাত্র ছেলে তাই কেউ যেন না বলতে পারে আমি আপনাদের কাছ থেকে কিছু নিয়েছি। শুধু গয়নাগুলো যেন ঐ... মানে কলকাতার নামী সোনার দোকান থেকে করাবেন খুব ঠুনকো দেবেননা। আত্মীয়স্বজন নিন্দা করবে। বরযাত্রী আপ্যায়ন আর প্রণামীর শাড়িগুলো যেন ভালো হয়। এইটুকুই বলার ছিলো।"
মধুরার রঙিন কল্পনার মাঝে শাশুড়িমায়ের কথাগুলো কেমন যেন মনে হোলো। ওদের অবস্থা খারাপ নয় তবে ওরা খুব সাধারণ সরল গ্ৰাম্য পরিবার।
মেঠোপথে লাল ধুলো উড়িয়ে ওনাদের গাড়িটা চলে গেলো। রাস্তায় বেশ বকুনি দিলেন কর্তাকে লীলা," সত্যি তোমার কোন বুদ্ধি নেই, ইশ্ লুচিগুলো কিভাবে খেলে! এতো রেষ্ট্রিকশনের পর ঐ অত অয়েলি খাবার দাবার।.." আরে আমি তো নিইনি জোর করলে কি করবো!চাপ নিয়োনা,বাড়িতে বানানো খাবার সব কিছুই হবেনা।"
..." যেমন ছেলে তেমন বাবা ইশ্ এই ধ্যারধেরে গোবিন্দপুরে শ্বশুরবাড়ি করলো। বিশ্বভারতীতে না পড়লে আমি রাজিই হতাম না কিছুতেই,বলার মত তো ঐ একটা জিনিসই আছে আর তো কিছুই নেই।"
.......বিয়ের যোগাড়যন্ত্র চলছে দুইবাড়িতেই। গয়নার ব্যাপারে ওর বাবা মা কোন ত্রুটি রাখবেন না ঠিক করলেন। ওদের অবস্থা স্বচ্ছল হলেও সব গয়না কিনে দেওয়া সম্ভব হলোনা। মা বসলো মায়ের গয়না নিয়ে," শোনোনা এই গয়নাগুলো তো আমার খুব একটা কাজে লাগেনা। এগুলো যদি পাল্টে ঐ কলকাতার দোকানটা থেকে গয়নাগুলো করিয়ে নেওয়া যায়? তোমার তো এখন চাষের সময়। তারপর তত্ত্বর জন্য আর প্রণামীর জন্যও খরচ আছে। বরযাত্রী আপ্যায়ন,খাওয়া দাওয়া একটা বিয়েতে কত খরচ!"
বুকের ভেতরটা একটু হু হু করে ওঠে মধুরার,মায়ের গয়নাগুলো ওর জন্য ভাঙা যাবে! একটুও ভালো লাগেনা।...." মা ওগুলো ভেঙোনা, আমি এ বিয়ে করবোনা। আমার জন্য তোমার গয়নাগুলো নষ্ট হয়ে যাবে।"
....." বোকা বোকা কথা বলিসনা মনা,আমি গয়না নিয়ে কি করবো আর বলতো? তবুও ভালো এরা পণের টাকা দাবি করেননি। আমাদের এখানে তো এখনো চালু আছে টাকা দেওয়া।"
......" এতো পড়াশুনা করে পণের বিনিময়ে বিয়ে ভাবতেই পারেনা,তবুও গয়নাগুলো ভাঙতে হবে শুনে খুব কষ্ট হলো।"
মা নিজের জন্য সামান্য কিছু রেখে বাকি গয়নাগুলো ভেঙে ফেলবে ঠিক করলো। ওকে নিয়েই একদিন সেই নামী গয়নার দোকানে গেলো মা বাবা। সব ভাঙলেও একটা গয়না কিছুতেই ভাঙতে দিলোনা মধুরা। মায়ের গলার সীতাহারটা। মায়ের কাছেই শুনেছিলো ওটা বাবার দেওয়া প্রথম উপহার ছিলো। " কি কান্ড দেখো এই হারটা ভাঙতে দেবেনা বলে বায়না ধরেছে আর এটাতেই পাঁচভরি সোনা। ভাবলাম বাদ দিয়ে যা পাবো তাতে ওর নেকলেশটা হয়ে যাবে। কি করি বলতো,এতোটা টাকাও তো এখন জোগাড় করা মুশকিল তাইনা।" বলে মাধবী অসহায় ভাবে ওর কর্তার দিকে তাকিয়ে।
মুশকিল আসান করে দিয়েছিলো মধুরাই," মা আমি ওই নেকলেশটা পরেই বিয়ে করবো। তাহলেই তো হবে। ওটা ভেঙোনা মা।".....মুখে মা বাবা যাই বলুক,বাবার মুখে যেন অদ্ভুত এক ভালোবাসার আলো দেখতে পেয়েছিলো মধুরা।
শেষ পর্যন্ত কিছুতেই হারটা ভাঙা যায়নি ওর জেদে। পালিশ করে আনা হয়েছিলো। মাধবীর বুকটা একটু টিপটিপ করছিলো কি শুনতে হবে মেয়েটাকে কে জানে এই পুরোনো হারটার জন্য।
বিয়েরদিন ওর শাশুড়ির খুব আসার ইচ্ছে থাকলেও এতোটা রাস্তা এসে আবার বাড়ির কাজকর্ম সব ফিরে করতে হবে এই জন্যই আসেননি। ভালো ভাবেই বিয়েটা হয়ে গিয়েছিলো, বরযাত্রীদের আপ্যায়নে কোন ত্রুটি রাখেননি মধুরার বাবা। বরযাত্রীরাও খুব খুশি ওদের পুকুরের টাটকা মাছ আর কচি পাঁঠার মাংস,বড় বড় পোস্ত বড়ার ভাজা এইসব খেয়ে। আপ্রাণ চেষ্টা করেছে গ্ৰামের অন্যরাও,এছাড়া প্রশান্ত আর ওর বাড়ির লোকেরা তো ছিলোই। শুধু মধুরার মনটা বড় ফাঁকা হয়ে গেলো মাকে দেখে,ওর মায়ের একটু গোলগাল মোটাসোটা চেহারা। মাকে ঢাকাই শাড়ী আর গয়নায় কি চমৎকার যে লাগে!পূজোর সময় মায়ের এলোচুলে লালপাড় শাড়ি আর গয়নায় অষ্টমীর অঞ্জলির দিন যে কি সুন্দর লাগতো! ওর অনেক আশা ছিলো ওর বিয়েতে মা ওইরকম গা ভর্তি গয়নায় আর শাড়িতে সাজবে,আসলে মায়ের এ্যলার্জীর জন্য মা কস্টিউম জুয়েলারীও পরতে পারেনা। মধুরার কেনো যেন মনে হয় মাকে সোনার গয়নায় সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে, একদম মা দুর্গার মতো।
শুধু মনে হলো ওর জন্য মা নিরাভরণ হয়ে গেলো। সত্যিই তো কতটুকু বয়েস ওর মায়ের! অনেক কম বয়েসে বিয়ে হয়েছে মায়ের। " মা এদিকে এসোনা,আমি সত্যি তোমাকে খালি করে দিয়ে চলে গেলাম মা।"...." মায়েরা তো মেয়েকে ভরিয়ে দেয় এমন করেই মনা,আজ গয়নার কথা মনে হচ্ছেনা রে,শুধু মনে হচ্ছে এতোদিন যাকে বুকে করে মানুষ করলাম সে আমার বুকটা খালি করে চলে যাচ্ছে। ভালো থাকিস মা,ভরিয়ে রাখিস নতুন বাড়িটা,মানিয়ে নিস সবার সাথে।"
......মনে একটা কথাই ঘুরপাক খেলো শুধু মানিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব কি মেয়েদেরই? আসলে মাও হয়ত এভাবেই মানিয়ে নিয়ে এতো বছর সংসার আলো করে শক্ত হাতে সব সামলাচ্ছে।
মা বাবাকে ছেড়ে সুগতর কৃষ্ণকলি,তার কাজলমাখা চোখদুটো জলে ভাসিয়ে রওনা দিলো লালমাটির পথে ধুলো উড়িয়ে এক নতুন জীবনে পা দিতে। সারাটা রাস্তা সুগত ওর শক্ত কাঁধটা বাড়িয়ে দিয়েছিলো এক পরম নির্ভরতার অবলম্বন হতে মধুরার দিকে।
বরণ করতে গিয়েই লীলার চোখ পড়লো মধুরার গলার হারের দিকে,সত্যিই এরা পারে! এতো বার বলা সত্ত্বেও সেই কবেকার একটা হার দিলো! আজকাল এমন হার চলে নাকি,একদম ব্যাকডেটেড ডিজাইন। তবুও হাতের গয়নাগুলো মনে হচ্ছে নতুন,আসলে পরবে তো ওদেরই মেয়ে ওনার আর কি,তবুও যদি একটা লেটেষ্ট ডিজাইনের কিছু দিতো এতো ভালো ভালো শাড়ি কেনা হয়েছে। এদিক থেকে গয়নার তেমন ত্রুটি রাখেননি লীলা,সবকিছুর মাঝে বড্ড বেমানান ওই হারখানা কেমন যেন পেতল পেতল রঙ,আদৌ সোনার কিনা কে জানে? অসন্তোষ মনে জমলেও বাড়ি ভরতি লোকজনের সামনে আর কিছু বললেননা। বরং বোন আর ননদই এসে বলে গেলো,ইশ্ আসল গয়নাটাই তো একদম ম্যাচ করেনা অন্য গয়নাগুলোর সাথে।
মধুরা বোঝে ওর মায়ের পুরোনো হারটা নিয়ে বাড়িতে কথা হচ্ছে। বৌভাতের দিন গয়না পরানোর সময়,ওর শাশুড়িমা এসে বললেন," শোন এই পুরোনো হারটা আমাদের এক্সক্লুসিভ বেনারসীর সাথে একদম যাবেনা। ওটা বাদ দিয়ে,এ বাড়ী থেকে যে হার দিয়েছি আমরা, আর যেগুলো পেয়েছে তা দিয়ে ওকে সাজিয়ে দাও।
.....কথাটা সুগতর কানেও আসে," মা থাকনা ঐ হারটা ওর গলায়,কি এতো সমস্যা তোমাদের! সেটাই বুঝতে পারিনা।"....." তুই যা তো, মেয়েদের মধ্যে কথা বলিসনা। যাতে ওকে দেখতে ভালো লাগে সেই ব্যবস্থাই করছি।"মায়ের ভালোবাসা মাখা হারটা থেকে নিজেকে আলাদা করতে বড় কষ্ট হলো মধুরার তবুও মায়ের কথাটাই মনে রাখলো,মানিয়ে নিতে হয়। কখনো বা মেনে নিতেও হয়।
মাধবীর বড় ভালোলাগলো মেয়েকে দেখে, মনটা জুড়িয়ে গেলো। কি সুন্দর লাগছে মেয়েকে, সত্যি ওরা খুব ভালো করে সাজিয়েছে। কিন্তু মাকে দেখে মধুরার মনে হোলো মায়ের ভালোবাসার মর্যাদা ও দিতে পারলোনা। এ হার শুধু মাকেই মানায়,বড় সুন্দর লাগে।
মধুরা মেনে নিয়ে মানিয়ে নিয়েছে নতুন সংসারে। সুগতর ভালোবাসায় ভালো আছে হয়ত বা ভুলে আছে ওর ছেলেবেলার শিউলিতলা,দোতলায় ওর পড়ার ঘর আর বিশ্বভারতীর ছাতিমতলাটা। সুগতও খুশি হয়েছে শ্বশুরবাড়ির মাটির দোতলায় শুয়ে কৃষ্ণকলিকে কাছে নিয়ে নিজের অনুরাগের রঙে রাঙাতে।মন ভরে উপভোগ করেছে চাঁদনীরাতে মধুরার গান।দেখতে দেখতে ওর বিয়ের একবছর হয়ে আসছে। অনেক পরিকল্পনা সুগতর,বেশ বড় করেই হবে সেলিব্রেশনটা বাড়িতে আর তারপর খোয়াইয়ের ধারে নিরিবিলিতে চাঁদনীরাতে শুধু দুজনে দুজনের কাছাকাছি। প্রশান্তই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
একসাথে কেক কাটার পর মধুরার গলায় সুগত পরিয়ে দিলো নামী দোকানের একদম এক্সক্লুসিভ ডিজাইনের একটা দারুণ নেকলেশ। একটু সঙ্কুচিত হয়ে মধুরা তাকায় শাশুড়িমায়ের দিকে। শাশুড়িমায়ের মুখে একটা অদ্ভুত মিষ্টি হাসি ঠিক গোয়েন্দাদের মতো। খুব ভালো লাগলো মাধবীরও ওদের মিষ্টি সম্পর্কটা দেখে। " মা পছন্দ করেছে এই হারটা তোমার জন্য,এই গিফ্টের আইডিয়াটা মায়েরই।"
সত্যি বোধহয় মানুষকে চিনতে হলে বেশ কিছুটা সময় লেগে যায়। মানতে আর মানিয়ে নিতে পারলে অনেক সমস্যাই মিটে যায়। কেউ খুব তাড়াতাড়ি মানতে আর মানিয়ে নিতে পারে। আবার কারো মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়ার ভুলে জীবনটাই হয়ে যায় একটা নষ্ট জীবন।
মধুরা অনেকদিনবাদে বাপের বাড়ি যাচ্ছে। ওর মায়ের বিবাহবার্ষিকী,ওদের উদ্যোগেই একটু বড় করে এবার আয়োজন হয়েছে। ওর শাশুড়িমাও যাচ্ছেন ওদের সাথে। আজ লালমাটি মাখা ধুলোর পথটা বেশ ভালো লাগলো লীলার,সবুজ লালের সমারোহ দেখতে দেখতে কখন যে পথ শেষ হয়ে গেলো বুঝতেই পারলেননা। সুবিমল এবার নিশ্চিন্তে জলখাবারের ফুলকো লুচি আর মনোহরা খেলেন। কলকাতা থেকে রজনীগন্ধা গোলাপের মালা,কেক, মায়ের জন্য লাল পাড় দেওয়া পাটলিপাল্লু কোরিয়াল বেনারসী আর বাবার তসরের পাঞ্জাবী ধুতি ওরাই সাথে করে নিয়ে এসেছিলো। এই গ্ৰামে তো এসব পাওয়া যায়না। বাবা মায়ের মালাবদলের সময় কোরিয়াল বেনারসী পরে মাকে যে কি ভালো লাগছে,চোখ ফেরাতে পারেনা মধুরা। বাবাকেও তসরের পাঞ্জাবীতে অপূর্ব লাগছে। সুগত হাতে এসএলআর টা নিয়ে মুহূর্তগুলো বন্দী করছে। শাশুড়ীমা ভিডিও রেকর্ডিং করতে করতে একটু ইশারা করে মধুরাকে। হাতের বাক্সটা এগিয়ে দেয় বাবার দিকে মধুরা," এটা মাকে পরিয়ে দাও বাবা।"...বাক্সটা খুলে অবাক হয়ে যান ওর বাবা।..." এটা তো তোর মনা,তোর মা তোকে দিয়েছে।"
...." টাকা আর সোনা ব্যক্তিগত হয়না বাবা,এটা হাতবদল হয়ে যার কাছে যায় তারই হয়ে যায়। মামণি শিখিয়েছেন আমাকে। তাই এটা হাতবদল হয়ে এখন তোমার। এই মণিহার আমায় নাহি সাজে। এটা যাকে সাজে তাকে পরিয়ে দাও। মা তোমার চোখে জল কেনো গো?"
.....পরম যত্নে বাবাকে সাহায্য করে মায়ের গলায় হারটা পরিয়ে দেয়। আজ মায়ের সাথে একফোঁটা মুক্তো গড়িয়ে পরে মধুরার গাল বেয়েও। ভালোবাসায় জড়ানো মণিহারের মূল্য যে কত অমূল্য তা সুগতর প্রেমে বন্দী মধুরা বুঝতে পেরেছে। আজ মাকে বাবার ভালোবাসা জড়ানো হারটা আবার ফিরিয়ে দিতে পেরে বড় ভালো লাগলো মধুরার। ইচ্ছেটা বহুদিন ওর হয়েছিলো তবে ওর মামণি মানে শাশুড়িমাই আইডিয়াটা দিয়েছিলেন ওর মুখে সীতাহারের গল্প শুনে।
মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়ার টানাপোড়েনে জয়ী দুটো মানুষের ভালোবাসার বন্ধনের কাছে কলকাতার নামী দোকানের সব হারই বোধ হয় তুচ্ছ। মাকে হারটা পরিয়ে পরম নির্ভরতায় মামণির কাঁধে মাথা রাখে মধুরা। আলতো হাতের ছোঁয়া বুলিয়ে দেয় লীলা ওর মাথায়। মিষ্টি হাসির ঝলক খেলে যায় সুগতর মুখে। আসলে সব ছেলেই বোধহয় মা আর বৌ দুজনকে নিয়েই ভালো থাকতে চায়। আর সেই সহাবস্থানটাই সুখে ভরিয়ে তোলে জীবনের ছোটছোট মুহূর্তগুলোকে।
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment