#কিছুই_কি_নেই#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
ট্রেনের জানলার সামনে বসে,মনটা বড় এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলো অরুণাংশুর। কি সুন্দর একের পর এক বাড়ী ঘর মাঠ ক্ষেত সব পার হয়ে চলে যাচ্ছে কু ঝিক্ ঝিক্ করে। একসময় ছোটবেলা এই জানলার ধারে বসা নিয়ে কি ঝামেলা হোত দিদির সাথে। মা সময় ভাগ করে দিতেন যাতে ঝামেলা না হয়। না না তখন স্লিপারে খোলা জানলার সামনে বসে হাওয়া খেতে খেতে যাওয়া এসি কোথায় তখন?। বাবার অত সামর্থ্য ছিলোনা।
কি অনাবিল আনন্দ ছিলো তাতেই,মন ছুঁয়ে যেতো জানালা দিয়ে দেখে আর এলোমেলো হাওয়ার ঝাপটা খেয়ে। সত্যি ভালো দিনগুলো যে কোথা দিয়ে চলে যায় বোঝাই যায়না।
মা বাবা তো সেই কবেই চলে গেছেন,দিদিও চলে গেলো বছর দুয়েক আগে হঠাৎই। আজ বড় একা লাগে তাই সুযোগ আর দুএকদিনের ছুটি পেলেই বেড়িয়ে পড়ে বাইরে,হয়ত এই একাকীত্বের জন্য অনেকটা নিজেকেই দায়ী মনে হয়। একসময় সবই ছিলো জীবনে,কিন্তু রাখতে হয়ত পারেনি কিছুই।
এলোমেলো ভাবনাতেই কখন যে স্টেশন চলে এসেছিলো বুঝতেই পারেনি। চায়ে গরম,চায়ে গরম। তাকাতেই দেখে,আরে এরপরের স্টেশনেই তো নামতে হবে। ঘাটশিলা আসছে। বেশি মালপত্র নেই সাথে শুধু একটা ছোট ব্যাগ নেমে পড়বেন সহজেই। ঘাটশিলা স্টেশন দেখে মুগ্ধ হলেন অরুণাংশু অনেকদিনই ভেবেছে এইদিকটায় একবার আসবে কিন্তু আসা হয়নি। মন ছুঁয়ে গেলো প্রকৃতির কোলে একটুকরো ছোট্ট ছবির মতো স্টেশনটা দেখে। এদিকেও বেশ গরম পড়েছে,তবুও সারিবদ্ধ গাছের ছায়া মনকে করেছে স্নিগ্ধ। খুব ভালো লাগছে,মনে বেশ একটা অন্য অনুভূতি। দীর্ঘদিন কাজের সূত্রে বাংলার বাইরে,কখনো বা বিদেশেও যেতে হয়েছে। অরুণাংশু বিপত্নীক,দিদিই দেখেশুনে বিয়ে দিয়েছিলেন। সংসার করেছে প্রায় বছর আটেক সন্তানের জন্ম দিতেই মারা গিয়েছিলো উমা। তারপর...তারপর আর ভাবা হয়নি।" বাবু কোন হোটেলে যাবেন? আমি লিয়ে যাবো।" আদিবাসী ছেলেটির ডাকে চমক ভাঙে হঠাৎ। " হ্যাঁ চলো,ওই যে সুবর্ণরেখার একদম পাশে যে হোটেলটা,সুবর্ণবেলায়,ওখানে যাবো।" সুন্দর করে যত্নে সারা রাস্তা গল্প করতে করতে এসে পৌঁছলো হোটেলে। বুকিং করাই ছিলো আগে থেকে,এইসময়টা এখানে গরমে লোকজন কম আসে। কিন্তু অরুণাংশু পঁচিশে বৈশাখের দিন কোথাও না কোথাও নির্জনে চলে যায়,হয়ত মন ডুব দিতে চায় ফেলে আসা কোন অতীতে। রোমন্থন করে অতীতের স্মৃতি একটু নির্জনে গিয়ে।
উমার আগেও জীবনে কেউ এসেছিলো তার এমনি এক পঁচিশে বৈশাখের সন্ধ্যায় গানে গানে। কলকাতায় পড়ছে তখন,ছুটিতে গ্ৰামের বাড়িতে আসা। দিদি জোর করেছিলো,' এই চল আমাদের স্কুলের ফাংশানে যাবি।' দিদি তখন সবেই চাকরি পেয়েছে ওদেরই গ্ৰামের স্কুলে। মুগ্ধ হয়েছিলো অরুণাংশু শ্যামাকে দেখে। কি অপূর্ব নাচলো চিত্রাঙ্গদাতে! আর তেমনি সুন্দর গান গায়! দিদির কাছে শুনেছিলো ওরা ধানবাদে থাকে,উচ্চমাধ্যমিক দিয়ে বেড়াতে এসেছে এখানে ওর মামাবাড়ীতে। মেয়েদের নাচগুলো ওই শিখিয়েছে। মন ছুঁয়ে গিয়েছিলো শ্যামার নাচ গান দেখে। আলাপ হয়ে গিয়েছিলো,দিদিই আলাপ করিয়ে দিয়েছিলো। আর সেবার অদ্ভুতভাবে এক ট্রেনেই ফিরেছিলো শ্যামারা আর অরুণ। অরুণের মনে হয়েছিলো রবিঠাকুরের কবিতা....
হঠাৎ দেখা
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
'রেলগাড়ির কামরায় হঠাৎ দেখা,
ভাবি নি সম্ভব হবে কোনোদিন।
আগে ওকে বারবার দেখেছি
লালরঙের শাড়িতে-
আমি ছিলেম অন্য বেঞ্চিতে ওর সাথিদের সঙ্গে।
এক সময়ে আঙুল নেড়ে জানালে কাছে আসতে।
মনে হল কম সাহস নয়-
বসলুম ওর এক-বেঞ্চিতে।
গাড়ির আওয়াজের আড়ালে
বললে মৃদুস্বরে,
‘কিছু মনে কোরো না,
সময় কোথা সময় নষ্ট করবার।
আমাকে নামতে হবে পরের স্টেশনেই;
দূরে যাবে তুমি,
দেখা হবে না আর কোনোদিনই।'
না না তা হয়নি,আবার দেখা হয়েছিলো। আসলে কিছুতেই ভুলতে পারেনি অরুণ শ্যামাকে। এ যেনো এক অনুভূতি মাখানো ভালোবাসা। যে ভালোবাসায় ছিলোনা কোন বাড়াবাড়ি,সুযোগ ছিলোনা রাত জেগে ফোনে কথা বলার। মনে মনে হাসেন অরুণ,বেশ লাগছে জানালা দিয়ে বাইরেটা তাকিয়ে দেখতে। এই রোদেও ছোট জাল নিয়ে বাচ্ছাগুলো লাফালাফি করে মাছ ধরছে।রোদে চিকচিক করছিলো বাইরে নদীর জল। কি মিষ্টি নাম সুবর্ণরেখা এই বালিতে হয়ত সোনা পাওয়া যেতো,মনটা উদাস হয়ে যায় অরুণাংশুর।
দেখা হয়েছিলো,হয়েছিলো মন দেওয়া নেওয়াও।আবার এসেছিলো শ্যামা পরের রবীন্দ্রজয়ন্তীতে। এবার দিদিরা করেছিলো শ্যামা। নাম আর চরিত্রের অপূর্ব মেলবন্ধন। মন ছোঁয়া হয়েছিলো আগেই, হাতে হাত রেখে গঙ্গার ধারে বসে সবার গোপনে হয়েছিলো টুকরো মনের কথা। বিনিময় হয়েছিলো শপথ একসাথে থাকার। সবাই মিলে বসেছিলো গানের আসর,আসলে ইন্টারনেট তো ছিলোনা,তাই বসতো এরকম মজার জলসা গানে আর আবৃত্তিতে। কখনো বা গানের লড়াই। একসাথে গেয়েছিলো চাঁদনীরাতে বসে..'সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে।' কখনো দিদি,শ্যামা আরো সবাই মিলে ছাদে বসে বসে হোত গাওয়া, '
আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে।'
ভালো দিনগুলো সত্যিই বোধহয় খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়। তাই লুকিয়ে চিঠি আর মনের আদান প্রদান হলেও বেকার অরুণাংশুর জীবনে আসেনি শ্যামা। যেদিন খবর পেয়েছিলো শ্যামার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে,কান্নাভেজা চিঠিটা পোষ্টঅফিসের ঝামেলায় পৌঁছনোর আগেই কোন এক পূর্ণিমায় শ্যামা অন্যের ঘরণী হয়ে গিয়েছিলো। মিথ্যে হয়ে গিয়েছিলো সব শপথ,আর হাতে হাত রাখা। হষ্টেলের বিছানায় শুয়ে মনে পড়েছিলো কবিগুরুর কিনু গোয়ালার গলির কয়েকটা লাইন,' ঘরে তে এলোনা সে তো,মনে তার নিত্য আসা যাওয়া,পরনে ঢাকাই শাড়ী কপালে সিঁদুর।
এরপর পার হয়ে গিয়েছিলো অনেকগুলো বছর,অরুণাংশুর চাকরি তারপর দিদির চেষ্টায় বিয়ে সবই হয়েছিলো একে একে। শ্যামার সাথে নাম মিলিয়ে উমা,ঘরোয়া মেয়ে। তবে গান গাইতে পারতোনা,ঘর গোছানো রান্না এসব নিয়েই থাকতো। পঁচিশে বৈশাখ খুব আলাদা করে প্রভাব ফেলতোনা ওর জীবনে। সত্যিই তো সবাই কি একরকম হয়? কবিগুরুও এক একজনের অনুভূতিতে এক এক রকম। তবুও কেনো যেন সে ঘরও টিকলোনা।
তারপর থেকেই ঘুরে বেড়ানো জীবন, চাকরির ফাঁকে ফাঁকে,শ্যামারও আর কোন খবর পাননি। শুনেছিলেন ভালো আছে শ্যামা,কোথায় আছে কি দরকার জেনে? কত কিছু মনে পড়ে যায় একাকীত্বে। চোখটা বুজে আসে,ঘুমিয়ে পড়েছিলেন হঠাৎই ঘুম ভেঙে যায়,ওহ্ চা দিতে এসেছে। চা খেয়ে পড়ন্ত বেলায় একটু হাঁটতে বেরোন, কি অপূর্ব সুন্দর চারধার। সবুজের সারি,চারদিকে কত নাম না জানা গাছ মাঝে মাঝে মহুয়া গাছ দেখেন মন ভরে যায়। একসময় বাঙালীরা হাওয়া বদল করতে আসতো এইসব জায়গায়। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের খুব প্রিয় ছিলো ঘাটশিলা,অমর সাহিত্যিকের লেখায় ছবির মতো উঠে এসেছে এখানকার টিলা,নদী,পাহাড় আর জঙ্গলের বর্ণনা। হাঁটতে হাঁটতে অরুণাংশু পৌঁছে যায় বিভূতিভূষণের স্মৃতিবিজড়িত গৌরীকুঞ্জে। মন ছুঁয়ে যায়,হাত দিয়ে স্পর্শ করতে ইচ্ছে করে মাটিকে।
প্রায় সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসছে,এবার সত্যি ফেরা দরকার। পরপর বাঙালীদের বাড়ী,অনেকগুলো ভগ্ন অবস্থায়। কিছু খুব সুন্দর!
হঠাৎই কানে আসে ....' যদি প্রেম না দিলে প্রাণে।'
কেউ হয়ত কবির স্মৃতিচারণা করছে, তাঁর জন্মদিনে। কিন্তু অসাধারণ গলা যিনি গাইছেন তার। কতদিন এমন গান শোনেনি। মন্ত্রমুগ্ধের মতো এগিয়ে যায়,সামনে বাগান দেওয়া সুন্দর একটা বাড়ী। কতক্ষণ যে দাঁড়িয়ে স্মৃতির অন্তরালে চলে গিয়েছিলো বুঝতে পারেনি। হঠাৎই চমক ভাঙে," আপনি কাউকে খুঁজছেন?"
একটা বছর বারোর ছেলে বাগান থেকে মুখ বার করে বলছে। একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায় অরুণাংশু মুখ দিয়ে সত্যিটাই বেরিয়ে আসে," না না, আসলে এতো ভালো গানটা আজকের দিনে তাই.."
ততক্ষণে গান থেমে গেছে তবে তানপুরার আওয়াজে মনে হচ্ছে হয়ত আরো গান হবে কথাটা শেষ না হতেই কানে আসে," কার সাথে কথা বলছিস বাবু?"
প্রশ্নটা করে যে বাইরে বেড়িয়ে আসে তাকে দেখে কেমন যেন অদ্ভুত আবেশে আবিষ্ট হয়ে যায় অরুণাংশু,শ্যামা এখানে!.....
শ্যামাও ততক্ষণে হয়ত থামে হাত দিয়ে নিজেকে সামলেছে। প্রথমে শ্যামাই কথা বলে," অরুনদা আপনি এখানে?বাবু গেটটা খুলে দে ওনাকে ভেতরে আসতে বল।"
ইতস্ততঃ হলেও ভেতরে যান অরুণাংশু। চোখে পরে শ্যামার ফাঁকা সিঁথি আর দেওয়ালে মালা দেওয়া ছবিটার দিকে। অনেক কথা হয় দুটি জীবনের পথে হারিয়ে যাওয়া মানুষের,কথা হয় শ্বেতশুভ্রর মানে বাবুর সাথেও। এবার যাবার পালা ততক্ষণে রাত্রি নেমেছে। "একটা অনুরোধ করবো,খুব ইচ্ছে করছে অনেকদিন বাদে আজ একটা গান শুনতে। আপত্তি করলোনা শ্যামা গাইলো," তবু মনে রেখো,যদি দূরে চলে যাই তবু মনে রেখো।"
পরেরদিন অরুণাংশুর অনুরোধে শ্যামা আর বাবু এলো ওর হোটেলে। সুবর্ণরেখার তীরে বসে শ্যামা গাইলো,ভরা থাক,ভরা থাক হৃদয়ের পাত্রখানি। নির্বাক অরুণাংশু, নীরবতা ভাঙালো শ্যামা," ও হঠাৎ ম্যালেরিয়ায় চলে যাওয়ার পর স্কুলের চাকরি,গান আর বাবুকে নিয়ে আছি। কবি ভুলিয়েছেন হয়ত সব,আবার কিছুটা মধুর স্মৃতি করে রেখেছি যত্নে মনের মণিকোঠায়।"
অরুণাংশুকে ফিরতে হবে কাজের জায়গায়,ঘাটশিলা হয়ত দিলো একরাশ সুখস্মৃতিকে আবার ফিরিয়ে। আজ স্টেশন পর্যন্ত তাকে এগিয়ে দিতে এসেছে শ্যামা। দুজনেই জানেনা আর দেখা হবে কিনা?
হঠাৎই কবির কথায় অরুণাংশু জিজ্ঞেস করলো শ্যামাকে...
'তাই, যে প্রশ্নটার জবাব এতকাল থেমে আছে,
শুনব তোমার মুখে।
সত্য করে বলবে তো?’
আমি বললেম, ‘বলব।’
বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়েই শুধোল,
‘আমাদের গেছে যে দিন
একেবারেই কি গেছে-
কিছুই কি নেই বাকি?’
উত্তর দিতে পারেনা শ্যামা,মাথা নিচু করে আঁচলটা জড়ায় আঙুলের ফাঁকে। ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে এসেছে, অরুণাংশু উঠে দরজায় দাঁড়ায়। সিগন্যাল হয়ে গেছে, ট্রেন গতি নিতে থাকে ধীরে ধীরে। মাথা তোলে শ্যামা,চোখের কোলে টলটল করে শিশিরবিন্দুর মতো দু ফোঁটা জল।
************************************
শ্যামার চোখের কোলের টলটলে জল হয়ত অনেক না বলা কথা বলে যায়। লাল কৃষ্ণচূড়ায় সাজানো স্টেশনে চলে যাওয়া ট্রেনের দিকে তাকিয়ে শ্যামার খুব মনে হোলো এতোদিন বাদে কেনো যে অতীত আবার সামনে এসে দাঁড়ালো? সবই তো ছিলো স্মৃতির অতলে এই গত বারো বছরে। আর অরুণাংশুর মনে হোলো জানালার দিকে তাকিয়ে,শ্যামাকে এভাবে না দেখলেই মনে হয় ভালো হত। সব রঙটাই মুছে গেছে মেয়েটার জীবন থেকে। আজ হয়ত তাই দুজনেই ওরা খুব খুব একা,সত্যি বোধহয় আজ দুজনের দুটি পথ দুটি দিকে গেছে বেঁকে। ভালো থাক শ্যামা,বড় মনটা এলোমেলো হয়ে গেছে এই দুদিনে। হয়ত মনে চলছে পাওয়া আর না পাওয়ার দ্বন্দ্ব। ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে একটু একটু করে মিলিয়ে যাওয়া শ্যামাকে দেখছিলেন। হঠাৎ একবার মনে হয়েছিলো নেমে যাবেন নাকি,পরক্ষণেই মনকে শাসন করেছিলেন।
শ্যামাও কিছুক্ষণ বসে থাকে স্টেশনের বেঞ্চটাতে,হঠাৎই মংলু আসে। মংলুকে অনেকদিন চেনে শ্যামা। এই কদিন ঘাটশিলায় অরুণকে ঐ ওর ছোট্ট বাহনে নিয়ে ঘুরেছে আজও ওরা এসেছে ওর সাথেই।," দিদিমণি ইটো ঐ বাবুটা দিয়ে গেলেন। যাবে তো এখন আমি আছি উখানে।"
মংলু হাতে তুলে দেয় একটা খাম,ওপরে গোটা গোটা অক্ষরে শ্যামা লেখা। কতদিন বাদে কেউ এভাবে চিঠি দিলো শ্যামাকে। বাবা বেঁচে থাকতে মাঝে মাঝে চিঠি দিতেন। একযুগ বাদে অরুণের চিঠি,খামটা খুলতে ইচ্ছে করছে না শ্যামার শুধুই নিতে ইচ্ছে করলো অনুরাগের সুবাস। সত্যিই বোধহয় মানুষের মন চিরপ্রেমিক,প্রেম মানেনা কোন পরিসর। আমরা শুধু তাকে নিয়ন্ত্রণ করি সামাজিকতা আর অনুশাসনের ভয়ে। কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়া গাছগুলো যেন কানাকানি করে বলতে লাগলো,"খোলনা ও মেয়ে,আমরাও দেখি তোর অনুরাগের রঙ আজো রাঙা কিনা?"
খামটা খোলে শ্যামা, " সুচরিতাষু"
লজ্জার হালকা রঙ লাগে শ্যামার সাদা শাড়িটাতে। এখনো চিঠিতে এমন সম্বোধন করে অরুণ! ফোন এসেছে,তবুও চিঠির মিষ্টতা বোধহয় মেসেজে নেই। যে কথা বলতে পারেনি অরুণাংশু তা হয়ত বলেছে খুব অল্প কথায়। যদি কখনো শ্যামা মনে করে সত্যি একলা জীবনে কাউকে দরকার তাহলে একবার যেন ডাক দেয়,আবার হয়ত সুবর্ণরেখার ধারে কোন এক চাঁদনীরাতে করবে শপথ সাথে থাকার,সাথে হাঁটার ক্লান্ত জীবনের বাকি পথ একজন আরেকজনের বন্ধু হয়ে। শেষে অরুণদা লিখেছে," থাকলাম অন্তহীন অপেক্ষায়,যদি কখনো মনে করো।"
মনটা অদ্ভুত এক অনুভূতিতে ছুঁয়ে যায় শ্যামার। মংলুর সাথে বাড়ি ফিরে আসে আনমনা শ্যামা। মনটা বলে,' তুই ফেলে এসেছিস কারে মন মনরে আমার। তাই জনম গেলো শান্তি পেলিনা রে ।'
শ্যামার আর সেদিন স্কুলে যাওয়া হয়নি,বাবুকে পাঠিয়েছিলো স্কুলে। ওর ঘরের কাজ করে অম্বা। " দিদিমণি কিছু খা এবার,সকাল থেকে কিছু খাস নাই।" সত্যিই কিছু খেতে ইচ্ছে করেনি আজ শ্যামার মনটা বড় খারাপ লাগছিলো। বিছানায় শুয়ে চিঠিটা আবার পড়ে। হয়ত কিছুক্ষণের জন্য মন চলে যায় রবীন্দ্রজয়ন্তীর কোন সন্ধ্যায়। হঠাৎ মনটা চমকে ওঠে বারণ করে আর শাসন করে না না ছি ছি,বাবু আছে তো। কি সব ভাবছে,এখন তো একমাত্র ওর পরিচয় যে ও বাবুর মা।
অরুণাংশু পৌঁছে ফোন করেছিলো,বাবুর সাথেও অনেক কথা বলেছে ও। বাবুর খুব ভালো লেগেছে আঙ্কেলকে,আসলে পাঁচবছর বয়েসে বাবাকে হারিয়েছে এমনভাবে কোন দিন কারো আদর পায়নি।" মা আঙ্কেল আবার কবে আসবে গো? আমার টিনটিনের সিরিজটা যে কবে আসবে।" ছেলেকে একটু বকুনি দেয় শ্যামা," ইশ্ তুই ওকে বইয়ের কথা বললি কখন?"
....." আমি বলিনি মা,আঙ্কেলই তো বললো আমার কি কি পছন্দ সেগুলো সব নিয়ে আসবে।"
অরুণাংশু মাঝে মাঝে ফোন করে কিন্তু আসেনি আর,শুধু মাঝে ক্যুরিয়ারে বাবুর বইগুলো পাঠিয়ে দিয়েছে। শ্যামা তো সেভাবে কখনো বলেনি আসতে তাই আসতে পারেনি। তাছাড়া বার বার আসাটাও শোভন নয় শ্যামা একা থাকে।
কাজ অফিস আর ট্যুরের মাঝেও অরুণের একলা জীবন একটু ছুঁয়ে যায় শ্যামা আর বাবুর টুকরো কথা। মনে হয় কাছে না থাকলেও খুব কাছের কেউ আছে ওর জীবনে। থাক যেখানেই থাক ওরা ভালো থাক।
হঠাৎই একদিন রাতে ফোন করে বাবু,অদ্ভুত অসহায় এক গলার আওয়াজ বুঝতে পারে পাশে কথা বলছে ওদের কাজের বৌটি। ঘড়ি দেখে অরুণাংশু এতো রাতে ঐ বৌটিও কেনো বাড়িতে যায়নি, কি হয়েছে? " আমার কিছু ভালো লাগছেনা আঙ্কেল,তুমি আসবে। কেঁদে ওঠে বাবু,মায়ের খুব জ্বর। মা কোন কথা বলছেনা। পাশের বাড়ির ওরা বলছে মাকে হসপিটালে নিয়ে যাবে।" সত্যি এই সপ্তাহে বেশ কয়েকদিন ফোন করা হয়নি,আর শ্যামাটাও তেমন নিজে থেকে কোনদিনই কথা বলেনা। কিন্তু কি করে যাবেন তিনি এতো রাতে? তবুও যেতেই তো হবে তাকে। অনেক কিছু ব্যাবস্থা করতে হবে,বাবুটা কান্নাকাটি করছে,সত্যিই তো খুব অসহায় মাকে ছাড়া ছেলেটা। শ্যামা ভালো নেই,মনটা ছুটে যায় অরুণের। রওনা দেন দেখে নেন,গাড়ীর খবরাখবর। অরুণাংশু এসে পৌঁছয়, জড়িয়ে ধরে বাবু এক পরম অবলম্বনে।শ্যামাকে ওরা হসপিটালে দিয়েছে, কয়েকদিন যমে মানুষে টানাটানি চললো। অরুণাংশুকে দেখে শুকিয়ে যাওয়া ফ্যাকাসে মুখটাতে হাসি ফুটলো একটু শ্যামার," এবার আমি নিশ্চিন্তে মরতে পারবো।"
.....' কে মরতে দিচ্ছে তোমায়,ছেলেটা কোথায় যাবে? এতো স্বার্থপর কবে থেকে হলে শ্যামা!" চোখ বোজে শ্যামা,জল গড়িয়ে পড়ে চোখ দিয়ে।
সুস্থ করে শ্যামাকে বাড়ি নিয়ে আসে অরুণ। পাশের লোকেরাও একটু নিশ্চিন্ত কেউ আছে ওদের পাশে দাঁড়ানোর মতো। আর শরীরের অযত্ন কোরোনা শ্যামা,তোমায় যে ভালো থাকতেই হবে। আমার কাজ শেষ এবার তো আমায় ফিরতে হবে।
অরুণাংশু জড়িয়ে ধরে বাবু," আরো দুদিন থাকোনা আঙ্কেল।" কথা দিতে হয় আসবেন খুব তাড়াতাড়ি। শ্যামাকে বলেন যেন শরীরের যত্ন নেয়।। মাঝে মাঝেই কথা হয়,আজকাল বাবুই বেশি কথা বলে,ওর সারাদিনের ভালোমন্দ সবটা,থাকে অনেক অভিযোগ আবদার সবটা।
মাসছয়েক বাদে একদিন শ্যামাই ফোন করে,বাবুর নাকি শরীর খারাপ। দুদিন ধরে স্কুলে যাচ্ছেনা,কিছু খাওয়ানো যাচ্ছেনা। ফোনে সবটা বলতে গলাটা আটকে যায় শ্যামার।
না এসে পারেননা অরুণাংশু,আসলে সন্তানহীন জীবনে বাবু এক স্নেহের বন্ধন। শুকনো মুখটায় একটু হাসি ফুটে উঠে বাবুর। অরুণাংশু পুরোনো হোটেলেই উঠেছেন। ভীষণ বায়না করলো বাবু সুবর্ণরেখার ধারে যাওয়ার জন্য,আজ ও বেড়াবে শুধু আঙ্কেলের সাথে। মা আজ বাড়ীতে থাক। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে মেনে নিলো শ্যামা," ওহ শেষে মাকেই ভুলে গেলি বাবু? আমায় নিলিনা সাথে?"
মজা করে মাছ ধরা দেখলো নদীর তীরে বসে তারপরেই বললো," আমাদের স্কুলের অনুষ্ঠানে সবার বাবা আসে,মায়েরা কি সুন্দর করে সাজে। এবার আমি আর যাবোনা ওখানে। আর কবিতা বলবোনা। ম্যাম আমাকে বকেছে,খুব রাগ করেছে। আমার কষ্ট কেউ বোঝেনা। ম্যাম বলেছে আমি খারাপ হয়ে গেছি।" আঙ্কেলের কোলে মাথা রাখে বাবু।
অরুণাংশু বুঝেছে কোথাও যেন এক শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে ছেলেটার মনে। কি চাইছে ছেলেটা? বাবু ওর ছোট্ট মন নিয়ে বুঝেছে ওদের জীবনে অরুণাংশুর মত কাউকে প্রয়োজন যার ওপর নির্ভর করা যায়। যাকে পেলে মা হয়ত একটু ভালো থাকবে,আবার হয়ত হাসিখুশি হবে ওদের বাড়ীটা,বাবাকে ওর অল্প মনে পড়ে।
শ্যামাকে রাজী করানো টা খুব একটা সহজ হয়নি। অরুণ কিছু বলতে পারেনি শ্যামাকে,বলেছিলো ওর আত্মজ,জোর করেছিলো। ওর প্রতিবেশীরা আর অম্বা,মংলু সবাই ছিলো বাবুর দলে। পাশের বাড়ীর মাসিমা বুঝিয়েছিলেন শ্যামাকে," ছেলেটাকে বোঝ শ্যামা,তোর রঙহীন জীবনটাতে একটু রঙের ছোঁয়া দিতে চায়।"
বিয়েটা হয়েছিলো রেজিষ্ট্রী করে,বাবুকে নিজের সন্তান করে নিয়েছিলেন অরুণ। তবে আবার নতুন করে শাঁখা সিঁদুর চট করে পরতে পারেনি,শ্যামা। অরুণাংশুকে ফিরে আসতে হয় কাজের জায়গায়,কয়েকদিন বাদেই আবার আসতেই হবে ছেলের ফাংশানের জন্য। খুশি আর ধরেনা ছেলের,মা বাবার সাথে যাবে এবার বন্ধুদের মতো।
ফাংশানের দিন বেঁকে বসলো বাবু শ্যামাকে দেখে। কিছুতেই যাবেনা যদি না মা অন্য মায়েদের মতো সেজেগুজে যায়। বেশ কয়েকটা শাড়ি এনেছিলেন অরুণাংশু রেজিষ্ট্রীর আগে কিন্তু যত্নে আলমারীতে রাখলেও পরতে পারেনি শ্যামা। একবিন্দু সিঁদুর ছোঁয়ায় সিঁথির এককোণে। আলমারি খোলে শ্যামা ছেলের বায়নায়। ছেলের পছন্দে কৃষ্ণচূড়ার রঙে রাঙানো ঢাকাই গায়ে তুলে নেয় শ্যামা লজ্জায় রাঙা লাগে, হয় কিছুটা অস্বস্তিও। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঠিক করে এলোচুল,আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে বাবুর মুখটা। এই তো সেই ছেলেবেলায় দেখা পুরনো মিষ্টি মা।
পায়ে পায়ে এসে দাঁড়ায় অরুণাংশু,নতুন রূপোর সিঁদুর কৌটো থেকে একচিলতে উজ্জ্বল লাল সিঁদুরে গাঢ় করে রাঙিয়ে দেয় শ্যামার সিঁথি
গভীর অনুরাগে। লজ্জায় মাথা নীচু করে শ্যামা। অরুণাংশুর কলেজের স্বপ্নটা সত্যি হলো,বিদায়ী বসন্তে। বসন্তের দিন গুলো বোধহয় কখনোই ফিকে হয়না জীবনে,বসন্তের অনুভূতি দোলা দেয় এক অন্য অনুভূতিতে জীবনের প্রতি পর্যায়ে। সুবর্ণরেখাকে সাক্ষী করে কনে দেখা রোদ্দুর মুখে মেখে শ্যামা গাইলো,' রাঙিয়ে দিয়ে যাও গো এবার যাবার বেলায়।'©ইচ্ছেখেয়ালে শ্রী
Comments
Post a Comment