Skip to main content

কৃতজ্ঞতা

#কৃতজ্ঞতা#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#

অমরনাথ যাওয়ার স্বপ্ন ছিল অনেকদিনেরই,মনে মনে সব সময় এক অদম‍্য ইচ্ছে ছিলো তুষারাবৃত বরফের শিবলিঙ্গ দর্শন করার। 2015 সালে আমি আর আমার স্বামী ছেলে মেয়েকে মা বাবার কাছে রেখে পাড়ি দিই অমরনাথের উদ্দেশ‍্যে। ট্র‍্যাভেল এন্ড ট‍্যুরিজম ফেয়ারে আলাপ হওয়া এক কাশ্মিরী ট্র‍্যাভেল এজেন্টের সঙ্গে। ওদের দায়িত্ব ছিলো আমাদের শ্রীনগর এয়ারপোর্ট থেকে নেওয়া আর তারপরের সব ব‍্যবস্থাই থাকবে ওদের। কাশ্মীর যেহেতু আমাদের দেখা তাই অল্প কিছুটা সময় ঘোরাঘুরি করি ওখানে,আসল উদ্দেশ‍্য ছিলো অমরনাথ। কেন জানিনা,আমাদের ট‍্যুর অপারেটর কাশ্মীরী ভদ্রলোককে আমার খুব একটা ভালো লাগেনি। আমাদের রেখেছিলেন বেশ ভেতরে একটা হোটেলে। ওনার ছিলো শালের দোকান,ঐ দিকটার পরিবেশ কেমন যেন থমথমে। চারদিকে তখন মিলিটারি পাহারা। খুব যেন একটা কড়া নজরে কাশ্মীর এমনটাই মনে হয়েছিলো। আর কয়েকদিন বাদেই ছিলো ঈদ।
  আমরা কাশ্মীরে পৌঁছনোর পরেই এক আশঙ্কায় রয়েছি,আবহাওয়া ভালোনা। আর আবহাওয়া খারাপ থাকলে হেলিকপ্টার উড়বেনা। আমাদের যাওয়ার ব‍্যবস্থা ঐভাবেই ছিলো। মনে মনে শুধু ঠাকুরকে ডাকছি,ছেলেমেয়েদুটোকে রেখে এসেছি বাড়িতে,শেষে কি দর্শন হবেনা?
    শেষ পর্যন্ত আবহাওয়া ভালো হলো,এক উজ্জ্বল দিনে আমাদের হেলিকপ্টার উড়লো নির্দিষ্ট সময়ে। অপরূপ সেই অভিজ্ঞতা,মন ছুঁয়ে যাওয়া সুন্দর প্রকৃতি। সব বাধা পার করে প্রথমে কপ্টার আর তারপরে ঘোড়ায় করে পৌঁছলাম অমরনাথ। দর্শন করলাম সেই অপরূপ বরফের লিঙ্গকে যার স্বপ্ন দেখে এসেছি অনেকদিন ধরে।ধন‍্য হলো ক্লান্ত ভীত মনপ্রাণ। অনেক উৎকন্ঠা ছিলো এই দর্শনকে ঘিরে। আমার স্বামীর খুব ইচ্ছে ছিলো দর্ণন ভালো করে হয়ে গেলে ওখান থেকে গাড়ি করে একদম লে চলে যাওয়া হবে। সেইমতই ব‍্যবস্থা হয়েছিলো,যদিও এর জন‍্য অনেক দক্ষিণা চেয়ে বসলেন আমাদের ট্রাভেল এজেন্ট। কারন আমাদের দলে আর কেউ ছিলেননা তাই পুরো গাড়িভাড়াটাই আমাদের দিতে হবে। যাইহোক খরচের তোয়াক্বা না করে আমাদের হাতের বাড়তি দিনগুলো কাজে লাগিয়ে ফেললাম। লে লাডাকের সৌন্দর্য হয়ত মনের মণিকোঠায় রয়ে যাবে আজীবন। অপূর্ব সেই সৌন্দর্য! প‍্যাংগঙ লেক আর নুবরা ভ‍্যালি উফফফ সত‍্যি মনে হয় আবার চলে যাই। মন গিয়ে ডুব দিক সেই নীল লেকে। নুবরার দুই কুঁজ বিশিষ্ট উটের পিঠে চড়া মনে থাকবে অনেকদিন।
অপরূপ সুন্দর অথচ ভয়ঙ্কর রাস্তা। পদে পদে বিপদ অথচ মনলোভা।
              যেদিন আমাদের ফেরার কথা শ্রীনগরের পথে তার আগেরদিন খবর পেয়েছিলাম ক্লাউড বার্ষটে রাস্তা বন্ধ। চেষ্টা চলছে পথ পরিষ্কারের। আমাদের ফ্লাইটের টিকেট কাটা পরের পরদিন। ভোরবেলা আমরা রওনা দিই লে থেকে। কার্গিলের পরে আর যেতে দেয়না। গাড়ির লাইনে আমরাও আটকা পরি,তখন প্রায় বিকেল। আমরা কার্গিলে থেকে যাই রাতটা,সারা কার্গিল জুড়ে তখন চলছে ঈদের হৈ চৈ। সবার আনন্দের মাঝে বোধহয় বিষণ্ণ আমাদের মত কিছু লোক। অনেক অনুরোধ করেও মিলিটারিদের টলানো গেলোনা। বাধ‍্য হয়ে আমাদের রাত্রে কার্গিলের এক হোটেলে থেকে যেতে হলো,যাওয়ার সময় দেখলাম জিপে চাঁদ তারা পতাকা হাতে পরিক্রমা করছে আনন্দে মাতোয়ারা ছেলেরা। সত‍্যি কথা বলতে ভয়ে,উৎকন্ঠায় মনটা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। পরদিন বিকেলে ছিলো আমাদের ফ্লাইট। পৌঁছনো ছিলো বড়ই অনিশ্চিত,বার বারই মনে হচ্ছিলো ছেলেমেয়েদের কথা। ভয় হচ্ছিলো অন‍্য বিপদেরও,কারণ আমরা শুধুই দুজন। সাথে আর কেউ নেই। রাতের খাবার গলা দিয়ে নামলোনা। মাঝরাতে খবর পেলাম রাস্তা খুলবে। যথারীতি ড্রাইভারকে নিয়ে,শুনশান পথ পেরিয়ে আবার অপেক্ষায়। ওখানে তখন অনেক গাড়ি,অবশেষে ভোরে পথ খুললো। রওনা দিলাম,কিন্তু পাঁচ ঘন্টা চলার পর আবার মিলিটারিরা পথ আটকালো। অমরনাথযাত্রীদের প্রচুর গাড়ির সাথে আমরাও আটকে তখন কয়েক ঘন্টা লাগবে যেতে। প্রায় দশটা বাজে,আমরা কি করবো বুঝতে পারছিলামনা। হঠাৎই একজন কাশ্মীরী ভদ্রলোক বললেন আমাদের গাড়িটা ছেড়ে দিয়ে একটা লোকাল গাড়িতে যেতে,ওটা ভেতর দিয়ে নিয়ে হয়ত পৌঁছে দেবে আমাদের। উনিই যোগাযোগ করিয়ে দিলেন একটা গাড়ির সাথে,গাড়িতে কম বয়সি তিনটে কাশ্মীরী ছেলে,আর পেছনে আমরা তিনজন। কিছুটা পথ ওদের সাথে হেঁটে আমরা গাড়িতে উঠি। বিপদ সবসময় ওত পেতে আছে। পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে ওদের সাথে যেতে গিয়ে মনে হয়েছিলো এরা জঙ্গী নয় তো? বুকটা কেঁপে উঠেছিলো,যে কোন বিপদ ঘটতেই পারতো যে কোন সময়। কিছুই করার ছিলোনা শুধু নির্ভর করা ছাড়া। আমাদের মালপত্রগুলোও ওদের কাছে ছিলো। আমার গলায় শুধু ঝুলছিলো একটা স্লিং ব‍্যাগ। এইপথ দিয়ে গাড়ি নিয়ে গেলে মিলিটারীরা ধরবে এই বলে আমাদের হাঁটিয়ে দূরে নিয়ে গিয়ে জিপে ওঠায়।
               জিপে মালপত্র দেখে আস্বস্ত হই,তবুও ভয় যায়না মন থেকে। ফোনের চার্জও শেষ হয়ে এসেছে ইতিমধ‍্যে,বাড়িতে ফোন করার চেষ্টা করি, টাওয়ার পাইনা। এরমধ‍্যে অনেকটা পথ এসে গেছি,চুপচাপ বসে আছি গুটিয়ে পেছনে। তার মাঝেই স্তূপাকৃত কাদামাটি মাখানো রাস্তা। গাড়ি আটকালো আবার ওরা বললো মিলিটারি অফিসারকে একটু বলতে। আমি কথা বললাম,উনি পারমিশন দিলেন,কথা দিলেন গাড়ি ছাড়লেই আমাদের আগে যেতে দেবেন। অশেষ কৃতজ্ঞতা মনে মনে জানাই ওনাকে উনি যতটা পেরেছেন ওনার জিপের সাথে আমাদের জিপ নিয়ে এসেছেন। সামনে বসা ড্রাইভার আর তার সঙ্গী ছেলেগুলো মাঝে মাঝে সিগারেট খাচ্ছিলো,আমার গলা শুকিয়ে আসছিলো। সকাল থেকে উৎকন্ঠায় জল আর খাবার কিছুই খাওয়া হয়নি। একটা দোকান দেখে আমার স্বামীকে বললাম জল এনে দিতে। ওরা ওকে নামতে দিলোনা,নিজেরাই নেমে জল আর কোল্ডড্রিংকস কিনে বললো বহেন পি লো। আশ্চর্য হয়ে গেলাম ওদের আন্তরিকতায়। যাদের ভয়ে শিঁটিয়ে গিয়েছিলাম কেন যেন ওদেরকে বড় আপনজন বলে মনে হলো। ঐ বিদেশে নিজের ভাই ছাড়া আর কিছু মনে হলোনা।
       অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলো ছেলেগুলো আমাদের ফ্লাইটটা পাইয়ে দেওয়ার জন‍্য। এয়ারপোর্টে পৌঁছনোর জন‍্য গ্ৰামের মধ‍্যে দিয়ে অনেক শর্টকাট রাস্তা দিয়ে গাড়ী ছুটিয়েছিলো। তার মাঝেই আমাদের ট্র‍্যাভেলিং এজেন্টের সাথে যোগাযোগ করেছিলাম ওদের ফোন থেকে বলেছিলাম বাড়িতে খবর দিতে। বুঝেছিলাম আর আমরা ফ্লাইট পাবোনা। চরম টেনশনের মধ‍্যে একটু একটু করে পার হচ্ছিলো ফ্লাইটের সময়।
            হঠাৎই ওদের সাথে যোগাযোগ করে ট্রাভেলিং এজেন্ট মাঝরাস্তায় গাড়ি নিয়ে হাজির হয়ে ওদের বলেছিলো আমাদের শ্রীনগরের হোটেলে নিয়ে যেতে কারণ সামনে দু তিনদিন কোন ফ্লাইটের টিকিট নেই। অসহ‍্য মানসিক অশান্তিতে যখন রয়েছি,কি করবো বুঝতে পারছিনা তখন ড্রাইভার ছেলেটা আর তার বন্ধুরা বলেছিলো," বহেন এই আদমীটা ভালোনা,তোমাদেরকে আমরা এয়ারপোর্টে নিয়ে যাচ্ছি ওখানে কোন ফ্লাইট পেলে বাড়ি চলে যাও। নাহলে দিল্লী চলে যাও। ও আমাদের কিছু বললে বুঝে নেবো। "
      ওদের সহযোগিতায় আমরা এয়ারপোর্টে এসে অদ্ভুতভাবে দিল্লীর ফ্লাইট পেয়ে যাই। আরেকটু দেরি হলে ওটা পেতামনা। আসলে অনেকেই এসে পৌঁছয়নি তাই সিট খালি ছিলো। আমরা বাড়ি ফিরে যেতে পারবো,ফ্লাইট পেলাম এটা শুনে অদ্ভুত আনন্দ দেখেছিলাম ওদের চোখে মুখে বলেছিলো," যাও বহেন,ঘরমে যাও। উস আদমিকো হম দেখ লেঙ্গে।"
          হাতে বেশি টাকা ছিলোনা আমাদের,ওদের গাড়ি ভাড়া দিয়ে দুশোটাকা বেশি দিয়ে ট্রলিতে লাগেজগুলো তুলে তখন ছুটছি বাড়ি আসবো সেই আশায়। কার্ডে পেমেন্ট করে টিকিট কেটে,ফ্লাইটে এন্ট্রি করার আগে কোনক্রমে বাড়িতে ফোন করে বললাম আসছি আমরা আর ভাবিসনা। ভালো আছি আমরা।" চিন্তামুক্ত হলো ওরা অনেক দুশ্চিন্তার পরে।
          আজো মনে পরে ওদের আর কার্গিলে কাটানো সেই ভয়ঙ্কর ঈদের রাতটার কথা। আসলে সবাই একরকম হয়না। ভালো মানুষ এখনো বেশি। পৃথিবীটা ভরে উঠুক আমার ঐ কাশ্মীরী ভাইদের মত ভালো মানুষে এই প্রার্থনা করি।

            

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...