"সামারে আসছো তো?মানে আসতেই হবে এছাড়া কোন অপসন নেই, নাহলে এলিজা একা থাকবে পুরো হলিডেজটা।"
সত্যব্রত এখন সম্পূর্ণএকা জয়া চলে যাবার পর কলকাতার বড় দোতলা বাড়ীর ফাঁকা ঘরগুলোতে একা একা দিন কাটে,আর সাথী পুরোনো আ্যলবামের ছবিগুলো
#পরম্পরা#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
"চলো ঐদিকটায় গিয়ে বসি,একটু ফাঁকা আছে মনে হচ্ছে। তুমি কি চা খাবে এখন?"..."না ইচ্ছে করছেনা গো ,তুমি খেয়ে এসো।"
একই সাথে হাওড়া স্টেশনে এসেছেন জয়া আর শান্তনু। দুজনেরই আজকেই ট্রেন,জয়াকে ট্রেনে তুলে দেবেন আগে,তারপর শান্তনুর ট্রেন। জয়া যাবেন দিল্লী মেয়ের কাছে আর শান্তনু ছেলের কাছে মুম্বইয়ে। প্রতিবছর সামার ভ্যাকেশনে কর্তাগিন্নীর বিচ্ছেদ হয়,নাতি নাতনির দেখভাল করার জন্য দুজনকে যেতে হয় দুই জায়গায়,কারণ ছেলে বৌমা আর মেয়ে জামাই দুজনেই চাকরি করে।
প্রতিবারই মনখারাপ করেন জয়া শান্তনুকে ছেড়ে থাকার জন্য,কষ্ট হয় খুব শান্তনুরও পঁয়ত্রিশ বছরের অভ্যেস তো। তবুও মুখে হাসি এনে জয়াকে বলেন," আসলের চেয়ে সুদ যে মিঠে গো,তাই তো যেতেই হবে।কয়েকটা সপ্তাহ তো দেখতে দেখতে কেটে যাবে। তারপর আমি দিল্লী চলে আসবো ফেরাটা দুর্দান্ত হয় আমাদের কি বলো?"
" তুমি কিন্তু শরীরের খেয়াল রেখো। নাতিকে পেয়ে ওর সাথে ক্রিকেট আর ব্যাডমিন্টন খেলতে বোসোনা।"...." সে তো আমি খেলবোই,দাদুভাই কি আমাকে ছাড়বে নাকি না খেললে।"..."তবে তুমিও যে দিদিভাইয়ের সাথে পুতুল খেলো সে খবর আমি পেয়েছি। পুতুলের নাকি বিয়েও হয়েছে আগের বার। তা এবার কি হবে শুনি,ওদের বেবির মুখেভাতের অনুষ্ঠান?"
একটু লজ্জা পেয়ে মুখটা লাল হয়ে যায় জয়ার। "কি যে বলোনা তুমি,মুখে কোন কিছুই আটকায় না।" ..."সত্যি লজ্জা পেলে এখনো তোমায় ভারি মিষ্টি লাগে। এই তো গতবার মুনিয়া ছবি পাঠিয়েছিলো হোয়াটসআ্যপে যে তুমি পুতুলের বিয়ের রান্না করছো। ইশ্ আমার বউ রান্না করে সবাইকে খাওয়ালো আর আমিই বাদ! এবার মুখেভাতের অনুষ্ঠানটা কিন্তু আমি দিল্লী যাবার পরেই কোরো।"...." তা কি করে হয় দিদিভাইয়ের স্কুল খুলে যাবে তো! আর এই যে তোমাকেও আমি ওখানে,লাফালাফি করতে দেখেছি,এমন কি নাচতেও দেখেছি। বাবু আমাকে ছবি পাঠিয়েছিলো। বুড়ো হাড়ে অত হিরো হতে হবেনা,হাত পা ভাঙলে কি হবে শুনি?"...." ইশ্ তুমি আমাকে বুড়ো বলছো? আমার সবুজ মনটা দেখলেনা। এখনো সাদা প্যান্ট আর টি শার্টটা পরলে না..."..."জানি, বাবুদের নেবার মিস্ আয়ার ব্যালকনি থেকে নড়েননা। এরপর আমি মুম্বই যাবো আর তুমি দিল্লী,দেখাচ্ছি মজা ঐ মিস্ আয়ারের।"
মনখারাপের মধ্যেও মজা করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন দুজনেই বুঝতেই পারেননি। সকালে একদম বুকের কাছে মাথা রেখে ঘুমনো জয়ার মুখটা সত্যিই যেন খুব ভালো করে দেখতে ইচ্ছে করলো শান্তনুর। মুখে কিছু না বললেও খুব মিস্ করবেন জয়াকে। সকালে তাড়াতাড়ি সব শেষ মুহূর্তে গুছিয়ে একদম নির্দিষ্ট সময়ে স্টেশনে চলে এসেছেন। ছেলেমেয়েদের জন্য একগাদা খাবার নেবার জন্য ট্রেনেই সফর করতে হয়। এই এক জয়ার বাতিক,এ এটা ভালোবাসে ও ওটা ভালোবাসে এই করে পনেরোদিন আগে থেকে শুরু করে প্রায় প্রস্তুতি। " আরে ওরা এখন সব হেল্থ কনসাস এগুলো খাবেনা,শুধু শুধু নিজেও খাটছো আর আমাকেও খাটিয়ে মারছো। "...."তুমি কিছুই জানোনা,জামাই তো ভীষণ ভালোবাসে আমার হাতের নাড়ু, মালপোয়া আর প্যাড়া। "..." তা ঠিক তবে বৌমার ফ্রিজে ওগুলো পড়ে থাকবে,শেষে আমিই খাই,কি করবো তোমার হাতের ছোঁয়ায় বানানো বলে কথা।"...."এই বৌমাও ভালোবাসে আমি জানি। হয়ত সময় পায়না।"...বেশি কিছু বলেননা শান্তনু থাক কি দরকার বেচারা কষ্ট পাবে।
এবার ওদের ব্যাগগুলো আরো একটু বেশিই ভারী। জয়াকে ট্রেনে তুলে দিয়ে হাত নাড়েন শান্তনু,বার বার করে দরকারি কথাগুলো বলে দেন। অবশ্য চিন্তা নেই জামাই চলে আসবে স্টেশনে। জয়ার চোখের কোনটা একটু চিকচিক করে ওঠে। মুখে হাসি ফুটিয়ে একদম জয়ার কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বললেন "ইশ্ আমার একটা হাগ করতে খুব ইচ্ছে করছে। এখনকার ছেলে মেয়ে হলে ঠিক....।" বাকিটা আর বলা হলোনা জয়া ইশারায় কেউ দেখছে এই বলে মুখটা লাল করে একটা চিমটি কাটলো। দুজনেরই মুখে তখন হাসি। " সাবধানে তুমিও যেয়ো,তোমার তো আরো দূরে যেতে হবে। রাস্তার খাবার কিনে খেয়োনা। সব গুছিয়ে দেওয়া আছে ব্যাগে। আর ফোন কোরো কিন্তু,আমি চিন্তায় থাকবো।"
দুজনেই পৌঁছলেন যথাসময়ে যে যার গন্তব্যে। জয়াকে নিতে এলো জামাই আর শান্তনু কে ছেলে। " ভালো আছেন তো মা,এতো কি লাগেজ করেছেন। এতো বলি মিনিমাম কিছু নিয়ে চলে আসবেন। এখানে তো সবই আছে।"..জামাইয়ের কথা শুনে হাসেন জয়া,সত্যিই ওরা বলে সবসময় কিন্তু না আনলে হয় নাকি? তেমনি বকুনি খেলেন শান্তনুও ছেলের কাছে। " ইশ্ এবার আবার একটা এক্সট্রা ট্রলি,তুমি পারোও বাবা। কিছুতেই তোমরা শুনবেনা।" মুম্বইতে নাতি মহা খুশি দাদুকে পেয়ে আর নাতনি খুশি দিদানকে পেয়ে। ম্যাচ খেলা আর পুতুলখেলার সব প্ল্যান হয়ে যায়। " ও দিদান তুমি যে বলেছিলে আরো দুটো পুতুল বানিয়ে আনবে কই গো?"..."দিদিভাই এই কাপড়ের পুতুল তোর ভালো লাগে? তোর কত সুন্দর সব পুতুল।".." ওগুলো তো সবার বাড়িতে আছে। এই পুতুলগুলো কারো নেই।"
এদিকে শান্তনুর সকাল বিকেল ব্যাটবল পিটিয়ে বেশ চলে যাচ্ছে নাতির সাথে। কে শুনছে জয়ার বারণ,নিজে সারাদিন পুতুল খেলছে সেই বেলা! দেখতে দেখতে অনেকগুলো দিন কেটে গেলো,সময় এগিয়ে আসছে ফেরার..." কি গো কালকের কথা মনে আছে তো? তোমার ট্রলিতে সব গোছানো আছে,ওটা খোলনি তো?" "না না একদম যেমন থাকে আছে।
....." কি মজা কি মজা,দাদু তুমি সারপ্রাইজ দিলে ঐ যে বলেছিলে এটা তো চ্যারিয়ট,জগন্নাথজী থাকেন এখানে। হ্যাঁ দাদুভাই এসো আমরা রথটা সাজিয়ে নিই এবার। বিকেলে বাবা আর মা এসে একদম চমকে যাবে।"....একগাদা পুচকে বিচ্ছুদের নিয়ে শান্তনু সাজিয়ে ফেললেন রথ। মাঝে মাঝেই মনে পড়ে যাচ্ছিলো ছেলেবেলার কথা। টুকরো অনুভূতি আর ছোট ছোট খুশি তার সঙ্গে থাকতো মেলার জিলিপি,পাপড় আর ভেঁপু বাঁশি। তারপর একসময় রথ সাজিয়েছেন ছেলেমেয়েদের জন্য। প্রথমে একতলা তারপর দোতলা আর শেষে তিনতলা রথ। কি বায়না ছিলো ওদের, প্রতিবছর নতুন কাগজ চাই,ফুল চাই,পাতা চাই আরো কত কি। জয়া বলতো," তোমার জন্যই তো এতো বেড়েছে। আসলে নিজের শখ এইসব করার।"
হাসতেন শান্তনু আসলে উৎসবগুলো বড় নষ্টালজিক এই সময় কখন যে মনে পড়ে যায় ছেলেবেলা আর একরাশ খুশি ঝুপ করে ঢুকে পড়ে একদম মনের মাঝে।
...." ও দাদান মাম্মা আর পাপা কি বলবে আজ,রাগ করবেনা তো?"..." কে বলেছে রাগ করবে আমি দেবোনা বকে। এতো কষ্ট করে কলকাতা থেকে অর্ডার দিয়ে রথ বানিয়ে আনলাম, তাও আবার দুটো,একটা তোর আর একটা তিন্নিদিদির।"
....." তিন্নিদিদিরও আছে রথ,আমার মতই?"
..." হ্যাঁ রে একদম তোর মতই।"
সত্যিই সেদিন অফিস থেকে এসে শান্তনুর ছেলে বৌমা অবাক হয়ে যায় বাবার কান্ড আর ছেলের আনন্দ দেখে,এছাড়াও এতো বিরাট বাহিনী। হৈ হৈ করে রথ টানা হলো ওদের সামনের মাঠে আর মিস্ আয়ার বোধহয় আজ একটু বেশিই মুগ্ধ হয়ে পড়েছেন। তাই ব্যালকনি থেকে সোজা নেমে এসে দাঁড়িয়েছেন ঠিক শান্তনুর পাশে। "বাবা মাকে একটা ভিডিও কল করে দেখিনা ওদের রথ টানা কতদূর হলো?"...হাসেন শান্তনু এই সেরেছে আবার ভিডিও কল। সারাদিনে ফোনে অনেকবারই কথা হয়েছে।
জয়াদের রথটানা প্রায় শেষের দিকে তবুও সবাই মেতেছে রথের আনন্দে। জয়া তখন পাপড় আর পকোড়া ভাজছিলেন ওপেন কিচেনে। " মা এই দেখো বাবার কান্ড, সত্যি তোমরা পারো। ওমা তিন্নিবেটির রথও তো খুব সুন্দর হয়েছে। বাবার জন্য আবার যেন ছেলেবেলা ফিরে পেলাম,কাজের চাপে ভুলতেই বসেছিলাম এই রথ টানার কথা। "
...." তোর বাবা কোথায় রে?"..."ঐ তো রথের সামনে,দাঁড়াও দিচ্ছি।"... ..ভিডিও কলে শান্তনুর পাশে মিস্ আয়ারকে দেখে গরম খুন্তি দেখান জয়া। উৎসব যাই হোক না কেনো মনে এনে দেয় একরাশ আনন্দ আর অতীতে ডুব দেবার হাতছানি তাই খুশিতে আর লজ্জায় জিভ কেটে শান্তনু বলেন," হ্যাপি রথযাত্রা,কয়েকটা পকোড়া পাঠিয়ে দাও প্লিজ।" ওদিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখান জয়া।
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment