#বিকেলের_রোদ্দুর#
রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
"বাহ্ দারুণ তো!
এগুলো কি?"
"চন্দ্রপুলি...দেবো একটা?"
হাতটা বাড়াতে গিয়েও একটু পিছিয়ে আসেন পরিতোষ। যদিও এ মাসে সুগার লেভেল মোটামুটি ঠিকঠাক তবুও ...নাহ্ লোভটা সামলানোই উচিত।
এদিকে সুশোভন কি মজা করে পাটিসাপটা খাচ্ছে। ঐ ব্যাটাই ধরে নিয়ে এলো এই মেলাটায়,সাথে আরো কয়েকজন এসেছে ওদের মর্ণিং ওয়াকের গ্ৰুপের।
ওকে ইতস্ততঃ করতে দেখে ভদ্রমহিলা হেসে ফেলেন। "সুগার আছে নিশ্চয়? আচ্ছা এইগুলো খান। এটা চন্দ্রপুলিই কিন্তু সুগার ফ্রী দিয়ে একটু মিষ্টি কম করে বানানো।
একটা কামড় বসিয়ে সত্যি চোখটা বুজে আসে কতদিন বাদে খেলেন,মা বানাতেন পিঠেপুলি একদম থালা ভরে। তখন সে এক দিন ছিলো যত খুশি খাও,ওদের খেতে দেখে মা পরিতৃপ্তির হাসি হাসতেন। পৌষ পার্বণের আগে বাবার কাছে লম্বা ফর্দ ফেলতেন কি কি আনতে হবে। ছোটবেলাটা আসলে বোধহয় শুধুই জমানোর সময়,কত স্মৃতি কত আনন্দ সব তখন ঝুলিতে এসে জমা হচ্ছে একটু একটু করে। বড় হওয়া,একের পর এক পরীক্ষায় পাশ,চাকরি, বিয়ে তখন শুধুই সেভিংস।
একের পর এক আনন্দে ঝুলি ভরা, হৈ হৈ করা বন্ধুবান্ধব নিয়ে। তার সাথে বাড়তি পাওনা দেশ বিদেশ বেড়ানো। কত ছবি আর কত স্মৃতি একদম মন জুড়ানো। অতসী অবশ্য চিরকালই একটু রুগ্ন ছিলো। ওদের জীবনে সন্তান আসেনি তবুও ভালোবাসার ঘাটতি হয়নি কখনো সবসময় অতসীকেই আগলে রাখতেন একদম ছোট্টটি করে যত্নে। বন্ধুরা ওদের প্রেমে নজর দিয়ে বলতো,"বৌদি সত্যিই তুমি লাকি পরিতোষের পুরো ভালোবাসায় আর কাউকে ভাগ বসাতে দিলেনা।"...একটু গর্বের আদুরে হাসি হাসতেন অতসী সত্যি মানুষটার তুলনা হয়না শুধু ওর মুখের হাসি দেখবে বলে কি না করে। শাশুড়িমাও এক কথাই বলতেন," আমার ছেলেগুলো একদম ওদের বাবার মত।"..হাসতো অতসী,শুধু মনে মনে ভাবতো যদি একটা সন্তান হত। অবশ্য এক ঝটকায় কথাগুলো উড়িয়ে দিতো পরিতোষ,"ছাড়তো,এই বেশ ভালো আছি। দুজনে একদম দুজনের কাছাকাছি।"
চন্দ্রপুলিতে কামড় দিতে গিয়ে মনটা ডুবে গিয়েছিলো কখন সেই পুরনো কথায়। সুশোভন ততক্ষণে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। "এই যে মিষ্টি বেশি খেয়োনা বন্ধু।"..."বাহ্ কি আব্দার মিষ্টি মেলায় এনে বলে মিষ্টি খেয়োনা। এদিকে নিজে বেশ মজা করে খাচ্ছে।"
.." ওহ্ দুর্দান্ত বানিয়েছেন,অনেকদিন মুখে লেগে থাকবে। না খেলে সত্যিই মিস্ করতাম। এবার বলুন কত হলো। প্রথমে তো টাকাই নিলেন না।"
...."না না টাকার এতো তাড়া কিসের,আপনারা তো পালিয়ে যাচ্ছেন না। এই তো বেশ,আপনাদের মুখের পরিতৃপ্তিটাই টাকার সাথে আরো বাড়তি পাওনা আমার।"
বেশ কয়েক বছর ধরে এই মেলায় পিঠেপুলির স্টলটা দেন সুধা,সাথে মালপোয়াও থাকে। মানে একসময় মায়ের কাছে যা যা শিখেছেন সবটাই বানিয়ে নিয়ে আসেন। এ বছর তো একজনের বায়নায় তিলের নাড়ুও আনতে হয়েছে।
ওর স্টলে বেশিরভাগই বয়স্কদের ভীড়,আসলে এখনকার কমবয়সী ছেলেমেয়েরা অনেকেই চটজলদি স্ন্যাক্স ভালোবাসে।এই বয়স্ক মানুষগুলোর নষ্টালজিক মুখগুলো দেখতে যে কি ভালো লাগে সুধার! অনেকেই হয়ত স্বামী স্ত্রী একলা থাকেন সেভাবে আর বানানো হয়না বাড়িতে। কেউ আবার একলা হয়ে গেছেন কয়েকবছর আগে কিন্তু এখনো ভুলতে পারেননা ছোটবেলার পিঠেপুলির স্বাদ বা মা ঠাকুমার হাতে বানানো নাড়ু মোয়া। কেউ আবার প্যাক করে নিয়ে যান অসুস্থ স্ত্রী বা স্বামীর জন্য। সত্যি সময় অনেক এগিয়ে গেছে তাই একসময় বাড়ির অন্দরে বানানো পিঠেপুলিও সমাদরে জায়গা করে নিয়েছে মেলায় আর দোকানে।
পরিতোষের এই প্রথম আসা মেলাতে, তবে অন্যেরা এর আগেও এসেছে তাই সুধার পাওনা হলো একরাশ ধন্যবাদ আর তার সাথে আয় তো হলোই। শুভকামনাটাই বোধহয় উপরি পাওনা। কম বয়সে বিয়ে হয়ে এসেছিলেন সংসারে মা আর শাশুড়িমায়ের কাছে রান্নার হাতেখড়ি। বকাও খেয়েছেন কত ভুলভাল কাজ করলে। আজ সেই শেখাটাই হাসি ফোটাচ্ছে অনেক মুখে। অনেকেই বলেন গতবারের পিঠেটা আনেননি,বা ইশ্ এতো তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেলো! অনেক সময় ব্যস্ত ছেলে বৌমারাও কিনে নিয়ে যায় মা বাবা বা শ্বশুর শাশুড়িমায়ের জন্য।
সুধার এক মেয়ে, বাইরে থাকে, ষাটে একা হয়ে গিয়েছিলেন হঠাৎই। জীবন তো তাই বলে কখন যে কাকে একা হয়ে যেতে হয় কেউ জানেনা। সুধারও তেমনটাই মনে হত প্রথমে,আরো কিছুদিন তো একসাথে থাকা যেতো। হঠাৎই তাকে একদম নিষ্কর্মা করে চলে গেলো মানুষটা। মেয়ে জোর করে কিছুদিন নিয়ে গিয়েছিলো কাছে তবে ওদেশে খুব একটা পোষায় না, ওরা তো সারাদিনই থাকেনা বাড়িতে। সেই ওখানে গিয়েও একা একা থাকা,আর ছাই ইংরেজীও আসেনা তেমন। তাই নিজেকে কেজো রাখার জন্য গিয়ে ঢুকতেন রান্নাঘরে,প্রতিদিনই বানাতেন নিত্যনতুন পদ,তবে সবই একটু ফেলে আসা পুরোনো রান্না। মেয়ে এসে যদিও বকুনি লাগাতো,"তুমি কি চুপচাপ কখনো বসতে পারোনা মা,কি দরকার এইসব করার?"... তবে জামাইয়ের আনন্দের সীমা ছিলোনা, সুধার রান্নার উপকরণ জোগাড় করে আনতো প্রতিদিনই। অবাক লাগতো সুধার এই সাহেবদের দেশে এতো কিছুও পাওয়া যায়!
কৃষ্ণেন্দু মানে জামাই দিয়েছিলো আইডিয়াটা," মাম্মীজি তুমি একটা রান্নাঘর খুলে ফেলো,দারুণ চলবে,আমার ফাদার ইন ল তো শুধু একাই চেখে দেখলেন তোমার রান্না এবার একটু অন্যদেরও সুযোগ দাও।"...মা মেয়ে দুজনেই তখন কৃষ্ণেন্দুকে বকা দিয়েছিলো যদিও কিন্তু সত্যিই ছেলেটা অনেক বোঝে তাকে।
কলকাতায় ফিরে মনটা বড় একলা হয়ে গিয়েছিলো,কমতে শুরু করেছিলো খাওয়া আর বেরোনো। শুধুই মনে হত এখন শুধু দিন গোণার অপেক্ষা,কি হবে এতো কিছু সবই ফেলে চলে যেতে হবে। পূজোর আগে এলো মেয়ে আর জামাই,খুব বকুনি খেলেন। কৃষ্ণেন্দু আর দেরি করলোনা,একদম অনলাইনে ব্যবস্থা করে খুব তাড়াতাড়ি গুছিয়ে দিলো একতলাটা।লিফলেট ছাপানো, কাজের ছেলে জোগাড় করা সবটাই মোটামুটি করলো। সত্যি হয়ত কপাল করে জামাই পেয়েছেন,ওকে যে কি বলবেন ভাবতে পারলেননা। " শোন মাম্মীজি,স্বার্থ তো একটা আমার আছেই,মা চলে যাওয়ার পর বাবার খুব খাওয়ার অসুবিধে হয়েছে। প্রতিদিনই ফোন করলেই হাজারটা অভিযোগ। আচ্ছা রান্নার লোক কি মায়ের মত রাঁধতে পারে? তোমার প্রথম মানে একেবারে পার্মানেন্ট কাস্টমার বাবা। আর বাবার হেংলু বন্ধুরা,সবাই ভীষণ খাদ্যরসিক।"
....জিভ কাটেন সুধা শেষে বেয়াইয়ের সাথে ব্যাবসা,মরণ! কৃষ্ণেন্দু বলে," অনেকদিনই ভেবেছি,কিন্তু এই তিনটে স্টপেজ কে যাবে? ব্যাস মুশকিল আসান,ডেলিভারী বয় আছে তো।".."কি সাঙ্ঘাতিক বিজনেসম্যান দেখেছো মা?"...মেয়ে ইরার কথায় প্রশ্রয়ের হাসি হাসেন সুধা।
"আসলে মাম্মীজি আমাদের ভালোলাগা গুলোই আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। তাই জীবনের বসন্ত হোক বা গোধূলি, রঙ মাখতে ক্ষতি কি? তোমার আনন্দ ছড়িয়ে দাও সবার মাঝে।"
একটু দুশ্চিন্তা হয়েছিলো সুধার,পারবেন তো শেষ পর্যন্ত। তবে ছাড়া পাননি, 'পেটে ও পিঠে'র উদ্বোধন করিয়ে কব্জি ডুবিয়ে খেয়ে তবেই ছেড়েছিলো মেয়ে জামাই।
তারপর থেকেই শুরু হয়েছে একটু একটু করে পথ চলা। নিজের একা অবসন্ন মনটাকে একটু একটু করে কেজো করে তুলেছিলেন আগের মত। আগে রাঁধতেন শুধু কর্তার জন্য এখন বড় রান্নাঘরে রান্না হয় অনেকের জন্য। সুখ্যাতি করেন সবাই,আবদারও জানান নতুন নতুন পদের জন্য।
কত মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছে কাজের সুবাদে তা বলার নয়। বেয়াইমশাইয়ের জন্যও বেড়েছে অনেক পরিচিতি। সুগারের পেশেন্ট অনেকেই,তাদের জন্য অনেক ভাবনা চিন্তা করে মুখরোচক অথচ ডায়াবেটিক পদ বানান সুধা। মেয়ে মজা করে বলে,"আগে বাবাকে সামলাতে হিমসিম খেতে,আর এখন একসাথে কতজনকে সামলাও মা। সবারই কত রকম খাইখাই আব্দার।"
সুধার এখন আর মনে হয়না আর বেঁচে থাকবো কার জন্য বা এইবয়সে আবার কি করার আছে? স্বামী মারা যাবার পর একরকম টিভি দেখে আর বিছানাতে শুয়েই দিন কেটে যেতো। আজ তার মনে হয় চব্বিশঘন্টার দিন না হয়ে যদি আরো পাঁচঘন্টা বাড়তো তাহলে বেশ হত।
খাওয়ার মেলাগুলোতেও যান,ঐ কদিন আবার আলমারি থেকে বেরোয় পছন্দের শাড়িগুলো,কিছু গয়নাও বের করেন। মাঝে তো সাজতেই ভুলে গিয়েছিলেন সবসময় মনে হত কার জন্য আর সাজবেন?একেক দিন একেক সাজে যেতে ভালোই লাগে। সবাই এসে প্রশংসা করে।'সত্যি তোমাকে দেখে অনেক কিছু শেখার আছে। এতো সুন্দর করে যে দ্বিতীয় ইনিংসটা খেলা যায়!'
সেদিন মেলা থেকে গিয়ে পরিতোষবাবুর সত্যিই ভালো লাগলো,যদিও প্রথমে আসতেই ইচ্ছে করছিলোনা। মুখে লেগে রইলো চন্দ্রপুলির মিঠে স্বাদ। বেশ আলোচনা হলো খাওয়া নিয়ে সবাই বললো এই বয়সে কেনাকাটা আর কি আমাদের খেতেই তো মেলায় আসা।হঠাৎই একজন বলে উঠলো ভদ্রমহিলাকে আমার খুব ভালো লাগে এই বয়সেও কি হাসিখুশি আর পজিটিভ। পরিতোষ হঠাৎ বলে ওঠেন চন্দ্রপুলি, মজা হলো সেটা নিয়েও," না ভাই
চন্দ্রপুলি নয় চন্দ্রমুখী।যাক্ রঙের ছোঁয়া তাহলে আছে এই বয়সেও। ব্যাপারটা কি শুনি?খেতে আসা না দেখতে আসা।" সবাই একমত হলো এ ব্যাপারে কারণ গিন্নী চলে যাবার পর এমন যত্ন করে কজন বলে এটা সুগারফ্রী এটা খান। আর যারা বিয়ে করেননি তাদের তো এটা উপরি পাওনা। আবার অনেকের গিন্নী পেরে ওঠেন না তাই প্যাক করা পিঠে হয়ত মিঠে হাসির ছোঁয়া দেবে দাম্পত্যে।
এরপর বেশ কয়েকমাস কেটে গেছে। সুধার মেয়ে জামাই ফোনে মেনু শুনেই খুশি হয়। শুধু কৃষ্ণেন্দুটা বলে মাম্মীজি তুমি বাবার ওজনটা বেশ বাড়িয়ে দিয়েছো কিন্তু মনটা দেখি বেশ ফুরফুরে আছে। হাসেন সুধা ঐটুকুই আনন্দ।
সকালে উঠেই পরিতোষের মাথাটা খারাপ হবার জোগাড়। ওনার রান্নার মেয়ে শেফালি নাকি কাজে আসবেনা পনেরো দিন। ছেলের অপারেশন। " যা করে হোক একটু করে দিস মা,তোর মাসিমা চলে যাবার পর আর অভ্যেস নেই অনেকদিন মা।"...হেসে একটা কার্ড ধরিয়ে দিলো,"কদিন হোমডেলিভারী খেয়ো মেসো,ঐ পাড়ার চক্কবত্তি কাকা খায় আমার বোন বলছিলো ও তো ঠিকে করে ওখানে।একদম ঘরোয়া,খুব ভালো। আর আমি তিনদিনের রান্না করে গেলুম গো। এরমধ্যে কথা করে নিয়ো।"...তিনদিনের রান্না চারদিন ধরে খেয়ে তারপর একদিন মুড়ি খেয়ে অবশেষে ফোন করলেন ঐ কার্ড দেখে। ধরলেন একজন মহিলা শুনলেন পরদিন দুপুরে কোন স্পেশাল পদ খেতে চাইলে আগের দিন রাতে বলে দিলে ভালো হয় আর না হলে যা থাকে তাই পাবেন। প্রথমদিনের খাবার খেয়ে খুব ভালো লাগলো দারুণ তো,প্রত্যেকদিন শেফালির ঐ ট্যালটেলে পাঁচফোড়ন টম্যাটোর মাছের ঝাল খেয়ে অরুচি ধরে গেছে। কি সুন্দর ঝিঙের ঝোল একদম সবুজ সবুজ হাল্কা,ওনার সুগার আছে জেনে একদম আলু ছাড়া সব তরকারি,ওমা চিচিঙ্গে দিয়ে মাছের ডিম ঝুরো করে ভাজা,কতদিন খাননি এমন সব পদ। আর এতো অনেকটা!দুবেলাই চলে যাবে।
নিত্যনতুন পদ খেতে খেতে মনে হলো শেফালি পনেরো দিন কেন দরকার হলে ছয়মাস ছুটিতে থাক। অর্ডার দিতে দিতেই কথা হয় ভদ্রমহিলার সাথে,খুব সুন্দর কথা বলেন। তবে দেখেননি কোনদিন,ঠিক সময়ে ডেলিভারি বয় এসে সুন্দর করে গোছানো খাবার দিয়ে যায়। এই কাজটা নিজেই করেন সুধা যাতে গন্ধলেবু থেকে কাসুন্দির পাউচ কিছুই যেন বাদ না পড়ে। মাঝে একদিন ওনার জন্মদিনও গেলো একটু কিন্তু কিন্তু করেই অর্ডার দিলেন,সবাই বয়স্ক অথচ বন্ধুদের আব্দার কিছু খাওয়াতে হবে। সুধা শুধু জেনে নিলেন কি কি খাবেন ওরা। যথাসময়ে সব হাজির তার সাথে সুধা ইচ্ছে করেই একটু পায়েশ করে পাঠালেন আগেই বলে দিয়েছিলেন ওটার জন্য কিছু দিতে হবেনা। সবাই তো মুগ্ধ ভেটকি পাতুরি আর পার্শে ফ্রাই খেয়ে।
শেফালি ফোন করে জানিয়েছে ওর আরো কদিন দেরি হবে আসতে। রাগ হওয়ার বদলে বরং ভালোই লাগলো একদিক দিয়ে এই ভালো আছেন বাজারে যাওয়া নেই,গ্যাসের খরচা নেই,চাল ডাল কিনতে হচ্ছেনা। সেদিন রাতে সুধাকে ফোনে খাবারের অর্ডার দিতে গিয়ে কেমন যেন খুব অস্থির করছিলো শরীরটা,কথা বলতে বলতেই হঠাৎই ফোনটা হাত থেকে পড়ে যায়। আর কথা বলতে পারেননা। ভীষণ চিন্তা হয় সুধার ফোনটা অন অথচ কোন সাড়া নেই। কেটে দিয়ে আবার রিং করেন বেজে যায়। থাকতে পারেননা সুধা,বিপদের সম্ভাবনায় রতন আর মালতিকে নিয়ে পৌঁছে যান। রতন থাকাতে কোন অসুবিধে হলোনা বাড়ি চিনতে। এ বাড়ি,ও বাড়ির লোককে বলে ওরাই উদ্ধার করেন পরিতোষবাবুকে। বন্ধুরাও চলে আসেন,কললিস্ট দেখে সুধাই ফোন করেছিলেন।
টানা সাতদিন লড়াই করার পর একটু একটু করে স্বাভাবিক হলেন পরিতোষ। সুধাকে প্রথমে দেখে বড় চেনা লাগে পরিতোষের কিন্তু মনে করতে পারেননা ফোনে কথা তো বলেছেন,তবুও মনে হয় খুব চেনা। শুধু অনেক ধন্যবাদ জানান এই যাত্রায় বোধহয় ওর জন্যই রক্ষা পেলেন। পরে হঠাৎ মনে হয়,ওহ্ সেই চন্দ্রপুলি। সুধারও মনে ছিলোনা,পরিতোষই বলে ওঠেন," আপনি চন্দ্রপুলি না?"..একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যান সুধা। পরে অবশ্য পরিতোষই বলেন ব্যাপারটা। লজ্জা পেয়ে সুধা বলেন," আসলে এমন কতজনই তো আসেন মেলায়। সময় পেলে দুএকবার চলে এসেছেন সুধা,একলা থেকে সুধাও অনুভব করেন বার্ধক্যের নিঃসঙ্গতা কতটা খারাপ।..."তৎকালে স্বর্গে যাবার টিকিটটা কেটেই ফেলেছিলাম আপনার জন্য সবটা ক্যান্সেল হয়ে গেলো।"..." এখনো সময় হয়নি,আরো কয়েকটা জন্মদিন এখানে কাটিয়ে যাবেন। অনেকগুলো নতুন রান্না ভেবেছি।"
সব বাধা বিপদ কাটিয়ে সুস্থ হয়ে এলেন পরিতোষ। মাঝে মাঝেই ফোন করতেন সুধা কোনদিন বা চলে আসতেন টুক করে, অন্য বন্ধুরাও থাকতো বেশ জমজমাট হত তখন পরিতোষের অন্দরমহল। সাথে থাকতো পরিতোষের জন্য যত্নে বানানো স্যুপ বা স্টু। কখন যে সুধার পরিবারটা এইভাবে একটু একটু করে বড় হয়েছিলো বুঝতেই পারেননি। ভালোই লাগে সুধার ওর মত কিছু একা মানুষকে যখন একটু ভালো থাকার ম্যাজিক টাচ্ দিতে পারেন। আসলে রান্না দিয়ে বোধহয় সবচেয়ে আগে মানুষের মন জয় করা যায়।
দেখতে দেখতে আবার পূজো আসছে কয়েকটা দিন বাদেই মেয়ে জামাই আসবে। সুধারও প্রস্তুতি চলছে,ঘর গোছানো একটু কেনাকাটা সবই। সেদিন ঐ জন্যই দক্ষিণাপণে আসা,মেয়ের ভীষণ সিল্ক আর ঢাকাই পছন্দ। ওনার আবদার উনি এসে যেন একদম শাড়িগুলো রেডি পান,এই এক মেয়ে হয়েছে এখনো নাচুনি বুড়ি। শাড়ি দেখতে দেখতে হঠাৎই শুনতে পায়,"আপনি এখানে?" ..."আপনি শাড়ির দোকানে! শরীর ঠিকতো?ফোনে যদিও কথা হয় মাঝে মাঝেই।"....নিজের শাড়ির সাথে সাথে পরিতোষবাবুকেও দু তিনটে শাড়ি পছন্দ করে দিতে হলো,উনি মা দুর্গাকে দেবেন আরো দেওয়ার আছে দুএকটা। " একটা অনুরোধ ছিলো যদি একসাথে একটু কফি খাওয়া যেতো।"
অনেকদিন বাদে একান্তে কিছুটা সময় পথ চলতে চলতে পাওয়া এক বন্ধুর সাথে কাটিয়ে সুধা ফিরলেন। ফেলে আসা কফির কাপগুলো স্মৃতি করে ধরে রাখলো জীবনের শেষবেলার আর মিঠেবেলার কত ছোটছোট কথা।
.....মেয়েজামাই এসে পড়েছে,কাল থেকেই তো পূজো শুরু,সুধার ব্যস্ততা চরমে। আরো কয়েকজনকে রাখতে হয়েছে। ষষ্ঠীর দিন রতন এসে হঠাৎই হাতে একটা প্যাকেট দিয়ে চলে যায় সাথে টাকা।..."এটা কি রে?"...."সাত নম্বরের মেসো দিয়েছে।" মেয়ের সামনেই প্যাকেটটা খোলেন সুধা সুন্দর স্নিগ্ধ একটা ঢাকাই শাড়ি,নিজের গায়ে একবার ফেলে দেখেছিলেন শাড়িটা সেদিন দোকানে,কিন্তু এটা কিভাবে এলো.....সাথে একটা ছোট চিঠি,"কিছু সম্পর্কের কোন নাম হয়না,তবে ভালো লাগা থেকে যায়। তাই বন্ধু নামটাই খুব মিষ্টি। দুই অক্ষরের শব্দটা কত মনের কথাই বলে যায়। ভালো থাকবেন,হঠাৎই এই শাড়িটা কিনে ফেলেছিলাম সেদিন খুব মানিয়েছিলো আপনাকে এটা। আপনি নিলে আমার ভালো লাগবে।"...সাথে একটা সুন্দর মিষ্টি চন্দনের সুগন্ধি আর রাইটিং প্যাড আর পেন। সুধার মেনু লেখার জন্য।
মুখে একটু সোনালী রক্তিম আভা ছড়িয়ে পরে সুধার,লজ্জা পায়।...পাশে বসে ইরা সবটাই দেখছিলো মায়ের ঘাড়ে মাথা রেখে। " কি অবস্থা দেখ! কি কান্ড,আর বলিসনা এই ভদ্রলোকই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন তোকে বলেছিলাম না।"
...."মা ভদ্রলোক বোধহয় তোমার প্রেমে পড়েছেন,আরেকবার ভাববে নাকি? এমন তো অনেকই হচ্ছে।"...হেসে গড়িয়ে পরে মেয়ে,' মনে হচ্ছে লাভ হয়েছে।'....হাসেন সুধাও," লাভ ক্ষতি,প্রেম অপ্রেম সবটাই হয়েছিলো তোর বাবার সাথে। বাবা এই বুড়ো বয়সে আবার এক বুড়োর সাথে গাঁটছড়া বাঁধা!মরণ আর কি?"....."ওহ্ তোমার যা আ্যডমায়ারের গ্ৰুপ,আমার শ্বশুরমশায়ও আছে সেই লিষ্টে,হি হি হি কৃষ্ণেন্দু বলছিলো। "....." লাভে নয় রে এই বয়সে ভাবে থাকলেই আমি খুশি। আনন্দ,সহানুভূতি আর বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিতে চাইরে। এখন শুধুই মুক্তির অনাবিল আনন্দ পেতে চাই। "....কৃষ্ণেন্দু যে কখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতেই পারেননি। হা হা হা করে হেসে বলে," এনজয় পারফেক্ট ব্যাচেলর লাইফ মাম্মিজী।"...ঢাকের বোল আর রান্নাঘরের হট্টগোলে হাসি খেলে যায় সুধার মুখে।
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment