Skip to main content

শত পুত্র সম কন‍্যা

#শত_পুত্র_সম_কন‍্যা#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#

ওদের বাড়িতে পর পর দুটো মেয়ে হওয়ার পর যখন অন্নপূর্ণার জন্ম হয়েছিলো তখন ওর ঠাকুমা রাগ করে আর দেখতেই যাননি। গুষ্ঠীর ষষ্ঠীপূজো হয়েছিলো মায়ের,একেই ওর জেঠিমার দুই মেয়ে পর পর তারপর আবার সেই মেয়ে। " ভগবান আর এই জীবনে বোধহয় নাতির মুখ দেখা হবেনা। ঐ মেয়ের আর কি নাম হবে ও আন্নাই থাক।"..খারাপ লেগেছিল মায়ের কথাটা শুনে তবে তখনকার দিনে অত সাহস ছিলোনা প্রতিবাদ করার, তাই ভালো নাম রেখেছিলেন অন্নপূর্ণা। যদিও বাড়িতে আর পাড়াতে সবাই ওকে অন্ন আর আন্না বলে ডাকতো। মাঝে মাঝে তো পাড়ার পাজি ছেলেরা আন্নাকালীও বলতো। মায়ের কাছে এসে অভিযোগ করত," কি এমন করেছিলাম আমি যে আমার একটা ভালো নামও তোমরা খুঁজে পেলেনা।"...মা বলতে পারেননা কিছু,শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবেন তোর আর দোষ কি সবই আমাদের মানসিকতার দোষ।
      তবে ঠাকুমার নাতির মুখ দর্শন হয়েছিলো খুব তাড়াতাড়ি। জেঠিমা আবার মা হলো বাড়িতে ছেলে এলো তিন মেয়ের পর। ওরা তিন বোন আন্না, কান্না,পারিনা যাই হোক না কেন প্রত‍্যেকের ভালো নামটা বেশ বড় ছিল। তবে ঠাকুমার নয়নের মণি হলো ভাই। সবার আদর আব্দারে একটা ল‍্যাজকাটা বাঁদর হলো,যা খুশি করুক না কেন সাত খুন মাপ। ছেলে বলে কথা তাও আবার এতদিন বাদে এলো বংশে বাতি দিতে। ঠাকুমাকে মোটামুটি নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাতো। তবে অন্নপূর্ণার মায়ের আর দ্বিতীয় সন্তানের জন‍্য পা বাড়ানো হলোনা,বাবার আয় কম তাই অধিক সন্তানের জন্ম দেবার সাহস হলোনা। তারপর যদি আবার মেয়ে হয় তাহলে তো কথাই নেই শ্বশুরবাড়িতে টেকাই মুশকিল হবে। তাই অন্নপূর্ণা আন্না মানে আরনা নামটা স্বার্থক করে বড় হয়ে উঠলো একটু একটু করে। তবে গ্ৰামের বাড়িতে ঠাকুমা,জেঠিমার কাছে সবসময় শুনেছিলো মেয়েদের আগে ভালো জিনিস খেতে নেই। অত নোলা ভালোনা মেয়েদের। তবুও তো লোভ হয় খেতে ইচ্ছে হয় ওদেরও।
জন্মাষ্টমীর দিন তালের বড়া বানাচ্ছিলো ঠাকুমা। " আমাকে দুটো দাওনা গো খাই".."মেয়ের নোলা দেখো,ঠাকুরকে দেবার আগেই ও খাবে।" ঠাকুমার কথা শুনে ভয়ে সরে গিয়েছিলো ও। পরে দেখেছিলো ভাই বায়না করলে ঠাকুমা বলতো,"ওকে দাও বৌমা,ঠাকুরের জন‍্য কটা সরিয়ে রেখে। ওই তো আমার গোপাল।" মাথায় ঠিক ঢোকেনি,ছেলেরা গোপাল হলে মেয়েরা তো লক্ষ্মী বা রাধা হতেই পারতো।
      তখন ছোট মাথায় ঢোকেনি,ভাই গোপাল ও সব খেতে পারে তাহলে ওরা কেন নয়? ছোটবেলায় নিজেকে এই কেমন যেন একটা ফালতু মনে হলেও নিজেকে একটু একটু করে বদলাতে লাগলো অন্নপূর্ণা বুঝতে পেরেছিল নিজেকে পড়াশোনা শিখে স্বাবলম্বী হতে হবে। স্কুলের বন্ধুরা আন্না বললেও কলেজের বন্ধুরা অবশ‍্য অনু বলেই ডাকতো আদর করে। ঠাকুমা বিয়ে দেওয়ার জন‍্য তৎপর হয়ে উঠলে বাবাও প্রায় মেনে নিয়েছিলেন শুধু মা কোথা থেকে একটু সাহস সঞ্চয় করে প্রতিবাদ করেই বলেছিলো,"আমার তো মা ঐ একটাই,ছেলে মেয়ে সবই তো ও। মেয়েটা পড়াশোনায় ভালো,যতটা পড়তে চায় পড়ুক। দরকার হলে আমার গয়নাগুলো..."। তার আর দরকার হয়নি নিজেই কয়েকটা টিউশন করে টাকা জোগাড় করে পড়ার খরচ চালাতো। ওর দিদিরা তখন শ্বশুরবাড়িতে সুখে সংসার করছে। ভাই সবার আদরে মাধ‍্যমিক পেরোতেই নাজেহাল। যাক তবুও গ্ৰ‍্যাজুয়েট হয়ে মুখ রাখলো অন্নপূর্ণা। এম.এ পাশ করে চাকরি হয়ে গেল স্কুলে,ঠাকুমার কথা একটু পাল্টালো, এত শিক্ষে হলে যে মেয়েকে বিয়ে দেওয়াই মুশকিল হবে,উপযুক্ত ছেলে কোথায় পাওয়া যাবে। সত‍্যি মেয়ে হয়ে জন্মানো মানে সমস‍্যার পর সমস‍্যা। তবে ধনেখালি তাঁতের শাড়িটা ঠাকুমার খুব পছন্দ হলো। আসলে উপহার পেতে কার না ভালো লাগে?
      আন্নার মা গোপাল দিতে পারেননি তবে খুব মন দিয়ে গোপালের পূজো করতেন। ছোট থেকেই গোপালকেই ভাই বলেই জেনে এসেছে ও। নিজেও সবসময় গোপালের জন‍্য জামা,গয়না কিনতেই থাকে। যদি গোপালকে খুশি রাখা যায়,ভাই বলে কথা।
            যাক গোপাল ভাইয়ের কৃপায় চাকরি পাওয়ার কিছুদিন পরেই বিয়ে হয়ে গেলো ওর।শাশুড়ি শ্বশুর সবাই এসে পছন্দ করেছেন। ঠাকুমার সাথে আলাপ করলেন ওরা,তবে ঠাকুমার মুখে আন্না নামটা শুনে কেমন যেন মুখটা শুকিয়ে গেলো ওনার। আসলে শহরের মানুষ তো। " আন্না নামটা ভালো নয় মাসিমা,আপনি ডাকছেন ডাকুন তবে আমি কিন্তু অন্নপূর্ণা বা পূর্ণা বলেই ডাকবো।"..পরে জানতে পারে ওনারাও অনেকগুলো বোন,তাই এই যন্ত্রণাটা কিছুটা জানেন তিনি,তবে একমাত্র মেয়ের নাম আন্না এটা শুনেই আশ্চর্য হয়েছিলেন। পরে ব‍্যাপারটা বুঝেছিলেন।
নিজেরা অনেক বোন হলেও তাদের বোনেদের ঘরে গোপালের অশেষ কৃপা। যদিও একটা মেয়ের আশায় ওনার তিন ছেলে,কর্তার ইচ্ছে না থাকলেও তৃতীয়বার মা হয়েছেন কিন্তু সেবারও নিরাশা। শাশুড়ির পান খেতে খেতে বলা গল্প শুনে মনে মনে আশ্চর্য হয় অন্নপূর্ণা এত মেয়ের শখ! যদিও ওর মনে হয় ইশ্ মেয়েদের সারা জীবন শুধু খুশি করতে আর মানিয়ে নিতেই যায়। তাই ছেলেরাই ভালো ওদের ওসব কোন ঝামেলা নেই।এই তো অন্নপূর্ণাই কখনো আন্না,কখনো অন্ন আবার এখন পূর্ণা। নিজের নামটা ছদ্মনামের আড়ালে কখন যে হারিয়ে যায় মেয়েদের।
          আবার এখন তো কারো কাম্মা,কারো বা বৌমা আবার বর ডাকে এই শুনছো। হাসিই পায় মাঝে মাঝে।
          শাশুড়িমায়ের দুই ছেলের মানে ওর দুই ভাসুরের বিয়ে হয়েছে তারা আলাদা থাকে,তাদের দিয়েও মেয়ের আশা পূর্ণ হয়নি,সেখানেও দুই নাতি। এমনটা দেখা যায়না,লোকে ছেলে ছেলেই করে। মাঝে মাঝে ওনার নাতিরা এসে ঠাম্মুর আর কাকির মাথা খেয়ে যায়।
        মা হতে চলেছে ও,বরের ইচ্ছে ছেলেই হোক,দাদারা কলার উঁচু করে চলে। কে জানে ছেলে হলে নাকি জামার কলারটা উঁচু করে হাঁটা যায়। অন্নপূর্ণা গোপালকে বলে যে আসুক সুস্থ হোক। শাশুড়িমা চান একটা মেয়ে আসুক বংশে,মেয়ে বাড়িতে না থাকলে লক্ষ্মীশ্রী থাকেনা। মহা মুশকিল তো কাকে যে খুশি করতে পারবে কে জানে? উনি বলেন ঐ হনুমানদুটোকে কে ফোটা দেবে শুনি? নাকি ওনার ছেলেদের মত ওদের কপালও শুকনো থাকবে।কার ইচ্ছে শেষ পর্যন্ত পূরণ করতে পারবে কে জানে?
         অবশেষে লক্ষ্মী এলো ঘরে,ওর বরের কলারটা একটু মুচড়ে গেলো বোধহয় তবে খুব বেশি সময় নয়, মেয়ের মুখ দেখে ভুলে গেল সবটা। এমন বাড়িও আছে যেখানে শাশুড়িমা খুশি হয়ে নাতনির নাম রাখলেন খুশি ভালো নাম প্রাপ্তি। তবে ও দেখলো এখন অনেকেই মেয়ে নিয়ে ভীষণ খুশি। এই পঁচিশ বছরে একটু একটু করে মানসিকতা পাল্টেছে। কেন যেন মায়েদের বিছানার পাশে অসুস্থতার সময়ে মেয়েদেরই দেখলো হসপিটালে।
           খুশির কলতানে মাতলো বাড়ি,শাশুড়িও শান্তি পেলেন যাক তবুও এবার নাতিগুলোকে দাদা বলার কেউ এলো। কয়েক মাস বাদে হঠাৎই ওর বাবা খুব অসুস্থ হলেন,তবে অন্নপূর্ণা আপ্রাণ চেষ্টা করে বাবাকে সারিয়ে তুললো একসময় মেয়েকে নিয়ে হীনমন‍্যতায় ভোগা বাবা বললেন,শতপুত্র সম কন‍্যা। অর্থাৎ মেয়েকে যদি সুশিক্ষা দিয়ে প্রকৃত মানুষ করা যায় একশো ছেলের সমান হয়।
           বরের পাশে শুয়ে একান্ত নিভৃতে আদরে ডুবে যেতে যেতে বলে," এই ছাড়ো,খুশি জেগে যাবে।"..."এই যে খুশি একটু করে বড় হচ্ছে এবার তো ওর একটা ভাই আনার কথা ভাবতে হয়।" আদরে ভেজা অন্নপূর্ণা বলে ,"আবার! বলেছি না শতপুত্র সম কন‍্যা। ওকেই আমরা ভালো করে মানুষ করবো। আর কি দরকার?"..."তাহলে আমার দাদাদের কি হবে ওদের তো একটাই পুত্র,শতপুত্রের কাজ কে করবে শুনি।" দুষ্টুমির হাসি খেলে যায় ওর বরের মুখে। ..." এই যে পুত্র হোক বা কন‍্যা যদি তাদের মানসিকতা যদি ভালো হয় মানে সহানুভূতি আর মনুষ‍্যত্ব থাকে তাহলে একাই একশো,বুঝেছো।"..."ইশ্ খুশির একটা খেলার সঙ্গী তো চাই"...ওর খোলা এলোচুলে মুখ ঢাকতে ঢাকতে বলে।..." আবার যদি মেয়ে হয় তাহলে তো তোমায় কলার ছাড়া ফতুয়া পরতে হবে এবার।"...দুজনেই হেসে ফেলে এবার।
            জন্মাষ্টমীর দিন অনেক কিছু হয়েছে বাড়িতে শাশুড়ি বৌ দুজনেই খুব ব‍্যস্ত। গুটি গুটি এসে দাঁড়ায় খুশি," মা ঐটা খাবো"..."এখন না সোনা আগে পূজো হোক।" শাশুড়িমা বলেন,"ঠাকুরের জন‍্য সরিয়ে রেখে আমার দিদিভাইকে আগে দাও তালের বড়া। ওই তো সব। শিশুদের মাঝেই ভগবানের বাস।"..মন ছুঁয়ে যায় অন্নপূর্ণার সত‍্যিই বোধহয় সময় বদলাচ্ছে,আন্নার জীবনের অপূর্ণতা পরিপূর্ণ করে পূর্ণতা পাক প্রাপ্তি। শিক্ষায়,দীক্ষায় আর মনুষ‍্যত্বে হোক শুধুই মানুষ,মেয়েছেলে বা মেয়েমানুষ হয়ে নয়, এগিয়ে যাক পুরুষের পাশাপাশি সহযোদ্ধা হয়ে।

সমাপ্ত:-

   

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...