#তুমি_কি_সবজান্তা#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
শুধুই পড়াশোনা করছস্ না রান্নাবান্না কিছু জানস্? ওহ্ তোরা তো আবার ঘটি,আমাগো রান্নায় কিন্তু একদম মিষ্টি দেইনা। তোরা তো মাছের ঝোলেও মিষ্টি খাস।' বিয়ের পর শ্বেতার দিদিশাশুড়ি বললো।
একটা কথা মনে করে খুব হাসি পেলো ওর দাদা প্রায় মাকে বলতো কবিগুরুর কবিতা থেকে কয়েকটা লাইন,খুকি তোমার কিচ্ছু বোঝেনা মা, খুকি তোমার ভারী ছেলেমানুষ।" সত্যি কত কম বুঝত তখন মানে এই সেদিনও।
বিয়ের পর আর কেউ মেয়েদের ছোট ভাবেনা তাই কম বয়সে বিয়ে হলেও শ্বেতাকেও সব বোঝার চেষ্টা করতে হল। বাড়ির বৌ বলে কথা কত দায়িত্ব কর্তব্য তারপর আবার শাশুড়ি মৃত। দিদিশাশুড়ি কাজ করতে না পারলেও নির্দেশনায় খুব পটু। মানে চচ্চড়ির আনাজ কত সরু হইব,ঝোলের আনাজ কেমন কাটতে হয়। শুক্তোর বেগুনের শেপ এন্ড সাইজ কেমন হবে মাছের ঝোলের বেগুন কেমন কাটা হবে এইসব নিয়ে তার মাথাব্যাথার অন্ত ছিলনা। মাঝে মাঝে এই নিয়ে রান্নার লোকের সাথে লাগত ঝামেলা। শ্বেতা তখন সবে কলেজ পেরিয়েছে ওর দিদিশাশুড়ির কাছে ও মোটামুটি বুড়ি মাইয়্যা,' এই বয়সে আমি তিন ছাওয়ালের মা হইয়্যা গেছিলাম।' বিয়ের দিন সাতেক বাদে ওর প্রথম দায়িত্ব মাছের ঝোল বানানো। রুইমাছ দেখেই মনে হল মা বেশ পেঁয়াজ টম্যাটো দিয়ে ঝোল করত। তার জোগাড় করতে গিয়ে হাসির খোরাক হল,আমরা মাছে পেঁয়াজ খাইনা। টম্যাটো দিয়া আবার কি হইব । ওর নাজেহাল অবস্থা তখন উপভোগ করত অনেকেই মানে পাড়া প্রতিবেশীও। আসলে তখন তো স্মার্টফোন ছিলনা যে টুক করে ইউটিউব থেকে দেখে নেবে। মনে মনে মাকে বলেছিল,'মাগো শুধু শিক্ষাই দিলে দীক্ষা দিলেনা'। বাড়িতে ছিল মায়ের হেল্পার আর এখানে পুরো দায়িত্ব।
একদিন তো কড়াইশুটির কচুরী করতে গিয়ে কাকিশাশুড়িকে জিজ্ঞেস করতে গিয়ে বুদ্ধু হল। আরেকদিন পাটিসাপটা ভাজতে গিয়ে সে কি কান্ড! একদম ল্যাজে গোবরে অবস্থা।
রূপে কালা মাইয়্যা,গুণও তেমন কিছু নাই তবুও পোলাটাকে ভ্যাড়া বানাইসে বৌয়ের কথায় ওঠে বসে। এমন কথা প্রায়ই শুনতো আর মনে মনে ভাবতো সত্যি ওর কত ক্ষমতা।কলকাতা শহরটা তখন ভাল করে চেনা হয়নি অনেকদিনই ভুল বাসে উঠে হয়ত ভুল জায়গায় গিয়ে নামতো,তবুও পড়াশোনাটা থামালোনা শ্বেতা যদিও শুনেছিলো বিয়ার পর আবার পড়া হয় নাকি? অসহযোগিতা করেছিল সবসময়ের কাজের বৌটিও তাই সকালে উঠে রান্না করেও এম.এ আর বি.এডটা করেই ফেলেছিলো। হার মানেনি।
তবে ততদিনে ওর মায়ের খুকি একটু একটু করে সবকিছু বুঝে নেওয়ার দায়িত্ব নিজেই নিয়েছে। মাছের চচ্চড়ির আনাজ কাটতে শিখেছে,পূজো পার্বণ,পিঠে পায়েশ পাটিসাপটা,কচুরী,ফ্রাই সবই একটু একটু করে শিখে নিয়েছে। যদিও সমালোচনা থাকে সবসময়ই। আসলে কাজ করলে সমালোচনা তো থাকবেই। পাত্তা দিতনা খুব একটা তবে বেশ ভাল লাগত যখন দিদিশাশুড়ি বলতেন কচুর শাক বা মোচাঘন্টটা তুইই রাধিস রান্নার মানুষকে দিসনা। বা আজ ভাপাটা খুব ভালো হইসে তো। শ্বশুর মশাই খুশি হতেন রবিবারের রান্না খেয়ে। আত্মতৃপ্তির হাসি হেসে শ্বেতার মনে হত হয়ত পেরেছে কিছুটা শিখতে। আসলে সবসময় একটা জেদ কাজ করত পারবোনা কেন ঠিক হবে। মনে মনে বলত হাল ছেড়োনা বন্ধু....
অনেকসময় বেশ এনজয় করত যখন শুনত.." হ্যালো বৌদি একটু ডাবচিংড়ীর রেসিপিটা বলবে। আচ্ছা তার সাথে বাটার ফ্রাইটাও বলো। আজ এই দুটোই থাক এরপর চিকেন তন্দুরটা শুনবো,দারুণ হয়েছিল খেতে।" অথচ একসময় শুনতে হয়েছে বাড়ির ছেলেগুলোর ভাগ্যই খারাপ একটা বৌ ও ভাল হলনা। শ্বেতা কলিগদের টিপস দেয় মানুষের মন জয় করতে দুটো জিনিস লাগে একটা হচ্ছে হাসি আর আরেকটা ভাল রান্না জানা। তবে ভালবেসে যা একদিন শিখেছিল বর্তমানের চতুষ্পর্ণী,সানন্দা,টিভি দেখে আজকাল মাঝে মাঝে সেটাই চাপের কারণ হয়ে যায়। দেখে জানার কোন শেষ নেই জানার ইচ্ছা বৃথা তাই,হা হা হা সত্যিই হাসি পায়।
সংসার হচ্ছে এক অদ্ভুত জায়গা যেখানে শেখার কোন শেষ নেই। তোমাকে হতে হবে সবজান্তা মানে সব ব্যাপারে তোমাকে জ্ঞান রাখতেই হবে নাহলেই তুমি হেরো। মাঝে মাঝে ওর বর মজা করে বলে ,'তুমি কত জানো অথচ একটুও অহংকার নেই।' হা হা করে হেসে ফেলে দুইহাত জড়ো করে শ্বেতা বলে,' অল দ্য ক্রেডিট গোজ টু ইউ ডিয়ার'। আহা প্রশান্তির হাসি দেখা যায় বরের মুখে সত্যিই বোকা মাইয়াটাকে কত কি যে শিখিয়েছে।তেল জিনিসটা বোধহয় সবার প্রিয়। শ্বেতা বোঝে কাউকে ভাল বললে সে খুব খুশি হয়,তুমি খুব সুন্দর!এটা দারুণ করেছো তুলনা হয়না অথবা গুড এই কথাগুলো অনেকটাই আনন্দ দেয়। যদিও ওর নিজের কপালে তেমন করে এটা শোনার ভাগ্য হয়নি। হয়ত বা ওর মত অনেকেরই এমন কপাল। আবার অনেক সময় বেশি প্রশংসায় বুদ্ধু হয়ে হয়ত ষাট সত্তর পিস্ ভেটকি পাতুরি বানিয়ে ফেললো,ওকে দিয়ে বেশ একটা পার্টির রান্না করিয়ে নিল কোন আত্মীয় প্রশংসা করে। আসলে ভাল এই তকমাটা পেলে অনেক কঠিন কাজ মেয়েরা করে ফেলতে পারে।
মেয়েরা কখনো কন্যা কখনো ভগ্নী কখনো পত্নী কখনো বা মা। ওহ্ যা কখনো বৌমা এটা তো বলাই হলনা। এখন শ্বেতা মনে করে বৌমা হওয়ার পরীক্ষাটা বোধহয় বেশি কঠিন কখনো বা সারাজীবন চলে যায় নিজেকে ভাল প্রমাণ করতে। তবে এই ধাপটাই বোধহয় একটা গ্ৰেট কোয়ালিফিকেশন দিয়ে দেয় পরবর্তীকালে,' মানে আমার মা সব জানে।' শ্বেতার গাইডলাইন অফ লাইফ জানতে চাই,শিখতে চাই,ভালবাসতে চাই নিজেকে আর সবাইকে। তবে সবজান্তা না হওয়াই ভাল যত জানবে জীবন বলবে গিভ মি মোর,যেমন ওর হয়েছে।
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment