Skip to main content

সৌরভী

#সৌরভী#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#

আমি সৌরভী, এক সাধারণ মেয়ে, কোন রকমে গ্ৰ‍্যাজুয়েট হয়েছি দেখতেও কালো শুধু মাথায় একঢাল লম্বা চুল। কে জানে কেন মা আমার এত সুন্দর নামটা দিয়েছিল। পরে মাকে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি ,'মা আমার তো রূপ গুণ কোন সৌরভই নেই তাহলে এমন নাম দিলে কেন গো?'
       'তোর সৌরভ তো তোর মনে,এমন সুন্দর মন কজনের হয় বলতো?'
...আমার যে বিয়ে হবে কোনদিনই ভাবিনি। স্বপ্ন আমিও দেখতাম সুন্দর একটা সংসারের কিন্তু একসময় সেটা ভুলতে বসেছিলাম ভেবেছিলাম দিদির সংসার আগলাতে আগলাতেই হয়ত দিন কেটে যাবে। ওর মেয়েকে বড় করতে করতেই হয়ত বুড়ি হয়ে যাব। আমার বিয়ে হচ্ছে মা পঁয়ত্রিশ বছরে, শুধু তোমারই দেখা হলনা তোমার সৌরভী লাল বেনারসী পরে হাতে গাছকৌটো নিয়ে শ্বশুরবাড়ি এলো। বাবা খুব একা হয়ে গেল আমি চলে আসাতে তবুও বাবা চাইছিলো কন‍্যাদান করে দায়মুক্ত হতে। বাবা ভেবেছিল সারাজীবন হয়ত দিদির সংসারে পার্টটাইমার হয়ে আমার দিন কেটে যাবে।
            ফ্ল্যাটবাড়ির উঁচুতলায় বসে আকাশে তারাদের মাঝে কত যে খুঁজেছি মা তোমায়। নিজে নিজেই বকবক করে গেছি তোমার সাথে। সবাই বলত আমার নাকি ডিপ্রেশন হয়েছে। তাই দিদি নিয়ে গেল ডাক্তারের কাছে ওরা অনেকগুলো ওষুধ দিলো তাই বড় ঘুম পেত। প্রতিদিন সকালে দেরিতে ঘুম ভাঙ্গতো। কাকে বোঝাই বলত আমার অসুখটা একা থাকার আর মনখারাপের। আমি সত‍্যি পাগল হইনি,যদিও দিদির শাশুড়ি বলছিল তোমার পাগল ছাগল বোনের আর বিয়ে হবেনা। আসলে এখনো ঘুমের মাঝে তোমার আঁচলের গন্ধটা খুব মিস্ করি,একসময় ওটা মুখের ওপর না দিয়ে রাখলে ঘুমই আসতনা। আসলে আমি বোধহয় একটু বেশিই মা ন‍্যাওটা ছিলাম।
            আমার শ্বশুরবাড়ি উত্তর কলকাতায়। ওদের ছেলেরও বয়স হয়েছিলো, বিয়ে হচ্ছিলোনা কেন কে জানে? দিদির খুব একটা ইচ্ছে ছিলোনা আমার বিয়ে দেবার তবুও বিয়েটা হয়েই গেল আমার। অনেক আলো আর হৈ চৈ এই বাড়িতে,বাড়ি ভর্তি লোকজন আসলে পুরোনো পাড়া তো। আমার যেমন কপাল,এই বাড়িতেও শাশুড়ি নেই তাই মায়ের অভাবটা আর মিটলোনা। তবে ল‍্যাটা মাছ ধরতে আমার হিমসিম অবস্থা দেখে পাশের থেকে মন্তব‍্য আর চাপা গলায় হাসি শুনলাম,' বয়স তো কম হয়নি,তবুও কোন কাজের ছিরি নেই একেবারে অকম্মা। একটা মাছও ধরতে পারেনা!'
     ওড়নার আড়াল থেকে মুখটা নজর পড়ে যায়,' সন্ধ‍্যামাসি'। নামটা অনেকবার শুনেছি এর আগে,একবার দেখেছিও।শ্বশুরমশাই,কাকিশাশুড়ি আর ননদের সাথে আমাকে দেখতে এসেছিল। শুনেছিলাম ওদের পুরোনো রান্নার লোক,শাশুড়িমায়ের আমল থেকেই আছে। আমি অন‍্যদের সাথে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছিলাম হঠাৎই চোখে পড়েছিল ওর মুখের আত্মতৃপ্তির হাসি। শ্বশুরমশাই বলেছিলেন সন্ধ‍্যা মোটামুটি আমার সংসারের অল ইন অল। অসিতের মা থাকতেই পুরোটাই ও সামলাত।
        দিদি আর বাবা বলেছিল ভালোই হয়েছে,তুই তো বেশি কাজ করতে পারিসনা। সবসময়ের লোক আছে তাই তোর তেমন ঝামেলা নিতে হবেনা। তবে বিয়ের আচার অনুষ্ঠান পালন করতে গিয়ে দেখেছিলাম সন্ধ‍্যামাসির চোখে স্নেহের বদলে ছিল অদ্ভুত এক দৃষ্টি। যা মনে ভয় ধরায়। মা তুমি তো জানতে আমি খুব ভীতু ছিলাম আর দিদি সাহসী ও মুখের ওপর কথা বলতে পারে,চাকরি করে। সন্ধ‍্যামাসিকে আমি ভয় পেলাম।
           বৌভাতের দিন আমার রূপ দেখে মুখ কুচকালো সন্ধ‍্যামাসি, বললো দাদা টাকা আর সোনা দেখেই মজে গেল। আমাদের অসিতের কত ফরসা রঙ। ওকে সাপোর্ট করলো অনেকেই,বিকেলে খুব সেজেগুজে ঘুরে বেড়ালো মাসি। এই বাড়িতেও খুব একা লাগলো আমার জানো তো? অসিত ভাল ছেলে তবে বাবার কাছে কেমন যেন চুপ হয়ে যায়। শ্বশুরমশাইয়ের খুব দাপট। অসিত পিতৃভক্ত না পিতৃভীত তখনও ঠিক বুঝতে পারিনি। তোমার তো অনেক গয়না ছিল মা তবে সবটাই দিদির দখলে ওর লকারে,বিয়ের সময় কিছু দিয়েছিল আর বাকিটা বাবা একটু একটু করে বানিয়ে রেখেছিল। বিয়ের দিন সেগুলো দেখে খুব রাগ হয়েছিল দিদির। বাবা বলেছিল তুই তো চাকরি করিসনা,এগুলো যত্নে রাখিস ভবিষ‍্যতে যদি কাজে লাগে।
                আমার গা ভর্তি গয়না দেখে শ্বশুরমশাই খুব খুশি হয়েছিলেন। তবে ফটোতে আমাকে দেখতে খারাপ লাগছিলোনা দেখলাম। ফুলশয‍্যার দিন সবাই মজা করলেও সন্ধ‍্যামাসিকে দেখে মনে হল অসিত যেন আজ থেকে হাতছাড়া হয়ে গেল। তবে বিয়ের আগে দিদি অসিতের সাথে দেখা করতে না দিলেও  কেন যেন বুঝলাম ও আমাকে ভালবাসবে। আমায় কাছে টেনে নিয়ে বলল,' মন খারাপ কোরনা আমি থাকব সবসময় তোমার সাথে। তবে বাবার মুখের ওপর কথা বলতে পারিনা।' কেন যেন জিজ্ঞেস করে ফেললাম আর সন্ধ‍্যামাসি?একটু যেন চিন্তার ছায়া খেলে গেল ওর মুখে,'আসলে অনেকদিন আছে তো একটু বেশিই আগলে রাখতে চায় সংসারটাকে। তবে তুমি তো বাড়ির বৌ ঠিক একটু একটু করে সব তোমার হাতে চলে আসবে দেখো।'...কিন্তু কে দেবে আমার হাতে? সন্ধ‍্যামাসির হাত থেকে কিছু ছিনিয়ে নেওয়ার সাহস আমার ছিলোনা মা। তাই ঐ বাড়িতে আমি হেল্পার হিসেবে রয়ে গেলাম। রান্নাঘরের বাইরে অপেক্ষা করে থাকতাম যদি কোন কাজে লাগি,আসলে এখনকার মেয়েদের মত আমি অতটা সাহসী নই যদিও বয়স হয়েছে আমার। তবে আমার কোন কাজই পছন্দ হতনা সন্ধ‍্যামাসির। সব্জি কাটতে গেলে বলত,' এমা এত মোটা মোটা করে লাউ কুচিয়েছো!'..রান্না করলে বলত,' একি এত তেল তরকারির ওপর ভাসছে,আমি কিছুতেই দাদাকে এটা খেতে দিতে পারবোনা।'..ঐ তরকারি শ্বশুরমশাইকেও খেতে দিতনা আর নিজেও খেতনা। যদিও অসিত আমার দিকে ইশারা করে বলত দারুণ হয়েছে।
                   বাবার কাছেও অভিযোগ গেল আমি একটা নিষ্কর্মা মেয়ে কোন গুণই নেই আমার। শ্বশুরমশাই চাপ দিতে লাগলেন গয়নাগুলো এনে ওনার লকারে রাখার জন‍্য। আসলে বাবা আমায় একটা আলাদা লকার করে দিয়েছিল ওটা কেউ জানতোনা। দিদিকে ফোন করে আমার সমস‍্যা বলতে গেলেই দিদি বলত,' আমার নিজের সংসারে ঝামেলার শেষ নেই। এত ঝামেলা নিতে পারবনা। বিয়ে করেছিস আ্যডজাস্ট কর। তোর মনে হয় আবার সমস‍্যা হচ্ছে,সাইক্রিয়াটিস্ট দেখিয়ে নে।'...আমি আরো একা হয়ে গেলাম,সারাদিন বন্ধ ঘরেই দিন কেটে যেত অসিত বেড়িয়ে যাবার পর।কোন কাজেই হাত দিতে দিতনা সন্ধ‍্যামাসি। একটু একটু করে অকেজো প্রমাণিত হলাম আমি। হানিমুনেও যাওয়া হলনা আমার,টিকিট কেটেও ক‍্যানসেল করতে হল শ্বশুরমশাইয়ের শরীর খারাপ হল।
                    শ্বশুরমশাইয়ের কড়া হুকুম ছিল দরজা বন্ধ করে শোওয়া চলবেনা। পর্দার আড়ালে সঙ্কুচিত থাকত অসিত যদি কখনো সন্ধ‍্যামাসি বা বাবা এদিকে এসে পড়ে। এর মাঝেই সন্ধ‍্যামাসি বলে ফেললো,' তুমি ভেতরের জামা গায়ে দাওনা,এইভাবে ঘুরে বেড়াও!'..আশ্চর্য হয়েছিলাম বলেছিলাম,' কই না তো,কে বললো?'..' দাদা বলছিলো'..চমকে উঠেছিলাম,নিজের বাবার সাথে ওনাকে মেলাতে পারিনি গা গুলিয়ে উঠেছিল।
         আমার জন‍্য হয়ত আরো কিছু অপেক্ষা করছিল। আমার শাশুড়িমায়ের ঘরে ওনার খাটে সন্ধ‍্যামাসি ঘুমোত,প্রথমে আশ্চর্য হয়েছিলাম। অসিত বলেছিল,' মা অসুস্থ থাকার সময় ঐ ঘরেই থাকত মাসি তাই তারপরেও ওখানেই থেকে গেছে।'...একদিন মাঝরাতে জল আনতে উঠে শ্বশুরমশাইয়ের ঘর থেকে সন্ধ‍্যামাসির চাপা গলার আওয়াজ পেলাম। অন্ধকারে কিছু না বুঝতে পারলেও হয়ত বুঝে গেলাম অনেক কিছু। অসিতকে কিছু বলতে পারলামনা গলাটা কেমন যেন বুজে এলো। তারপরে ঐ বাড়িতে এমন দৃশ‍্য দেখলাম আরো কয়েকবার। একদিন সাহস করে বলে ফেলেছিলাম মাসিকে,' কাল রাতে তুমি বাবার ঘরে কি করছিলে? গলার আওয়াজ পাচ্ছিলাম।'
          বিষাক্ত সাপের মত ফণা তুলেছিল মাসি,' ঘরে দরজা দিয়ে স্বামী সোহাগে মত্ত থাকো। বুড়ো শ্বশুর মরলো কি বাঁচলো তার খবর রাখো? দাদার খুব শ্বাসকষ্ট হচ্ছিলো তাই জল দিতে গিয়েছিলাম। আজ আসুক অসিত আর দাদা সব বলবো আমি কোন নোংরা মেয়েমানুষ ঢুকিয়েছে বাড়িতে।'...ভয়ে কুকড়ে গিয়েছিলাম আমি যদি অসিত আমার পাশ থেকে সরে যায়,কোথায় যাব আমি! অসিত আমার পাশ থেকে সরে যায়নি তবে আমার লাঞ্ছনা মুখ বুজে দেখেছিল প্রতিবাদ করতে পারেনি। শ্বশুরমশাই হুমকি দিয়েছিলেন,' এই বাড়ি আমার,এখান থেকে বেড়িয়ে যাও তোমরা। দুষ্টু গরুর চেয়ে শূন‍্য গোয়াল ভালো।'...ঐ মুহূর্তে অন‍্য বাড়িতে উঠে যাওয়ার মত সামর্থ‍্য আর সাহস অসিতের ছিলনা। তাই আমাদের ঠাঁই হল একতলার স‍্যাঁতসেতে ঘরে,ইলেকট্রিকের বিল বেশি উঠবে বলে ফ্রিজ,টিভি কিছুই চালাতে দেওয়া হলনা। ওপরে যখন ভালোমন্দ রান্না হয় তখন ডিমসেদ্ধ আলুসেদ্ধ ভাত অথবা ডিমের ঝোলভাত খেয়ে আমাদের চলে যায়। কোন কোনদিন অসিত চুপ করে কিনে আনে গোলবাড়ির মাংস। বাড়িতে ভালোমন্দ খেলে শুনতে হত বাবাকে লুকিয়ে  দিব‍্যি ভালোমন্দ খাচ্ছে। সন্ধ‍্যামাসি প্রায়ই এসে ঢুঁ মারত দেখে যেত হালচাল। পরে সবটাই যেত শ্বশুরমশাইয়ের কানে। ওপর তলায় শ্বশুরমশাই সন্ধ‍্যামাসির মেয়ে ভাইপো সবাইকে ঠাঁই দিয়েছেন শুধু ওনার একমাত্র ছেলের স্থান হলোনা। এমন বাবাও হয়! ছেলেকে বাদ দিয়ে কি করে ভালোমন্দ খান কে জানে?
     আমার বাবার ওপর চাপ দিতে লাগলেন শ্বশুরমশাই পাগলমেয়েকে ওনার ছেলের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে,তাই সমস্ত গয়না দিয়ে দেবার জন‍্য। কিছুদিনের জন‍্য বাধ‍্য হলাম ওদের অত‍্যাচারে বাবার কাছে চলে আসতে,মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লাম আরো। আশা হারিয়ে ফেললাম আর হয়ত সংসার করা হবেনা,ওষুধের ডোজ আরো বাড়লো সারাদিন ঘুমের ঘোরেই কেটে যেত। অসিত মাঝে মাঝে ফোন করত। বাবা গেল ঐ বাড়িতে কথা বলতে। অসিত এলো,ভেবেছিলাম বাবার ভয়ে আর আসবেনা,তবুও এলো আমি ততদিনে ডিপ্রেশনে অনেকটা তলিয়ে গেছি। আমায় নিয়ে গেল আবার ঐ নীচতলার স‍্যাঁতসেতে ঘরটায়। দেখলাম একটা ছোট টিভি কিনেছে। পোষ্ট অফিসে একটা ছোট চাকরি ছিল অসিতের,চলে যেত কোনরকমে আমাদের,আকাশ দেখার জন‍্য মনটা বড় ছটফট করত মা। অনেকদিনই সকালে ওঠা হতনা আমার ঘুমই ভাঙতোনা ওষুধ খেয়ে। সারাক্ষণ শুধু ভয় পেতাম। রাতেও অসিতের হাতদুটো চেপে বুকের কাছে এনে ঘুমোতাম। ও অফিসে চলে গেলে ভয়ে দরজা দিয়ে বসে থাকতাম। দরজার বাইরে থেকে শুনতাম শ্বশুরমশাই আর সন্ধ‍্যামাসির তর্জনগর্জন কি কপালে যে এই বুড়ি মেয়েটাকে সংসারে ঢোকালাম। আমার সংসারটা শেষ করে দিলো তারপর বাচ্চাকাচ্চাও তো হবেনা একেবারে আমার বংশ শেষ।
        প্রতিবাদ করা তো দূরের কথা,ঘরের কোণে বসে ভয়ে কাঁপতাম। অনেকদিনই খাওয়া হতনা,ভয়ে হাত থেকে বাসন পড়ে যেত ঝনঝন করে। মাগো সত‍্যিই এরা আমায় আর থাকতে দেবেনা। অসিত বাবাকে ফোন করলো তখন আমি নিজেই আর ওখানে থাকতে চাইছিনা। বুঝলাম অসিত হয়ত আর আমার সাথে থাকতে চাইছেনা। বাবার আর দিদির সাথে ও অনেক কথা বললো,আমি তখন আধেক ঘুমের দেশে। মা আমি তলিয়ে গিয়েছিলাম অন্ধকারে কিছুই ভালো লাগতনা। অন‍্য কোন কাজে মন দিতে পারতামনা। আমাকে দেখে বাবা খুব কাঁদলো,আচ্ছা মা মেয়েদের কি সারাজীবন সবাইকে খুশি করতেই চলে যায়?
             আমাকে একদিন ওরা নিয়ে এলো,'মনের খোঁজে'। 'মনের খোঁজ' এটা আবার কি? এদিক ওদিক তাকালাম। আমাকে খুব যত্ন করে ওরা নিয়ে গেলো তবে কি এটা পাগলা গারদ?কিছুদিন আমি ভালোমন্দ বোঝার অবস্থায় ছিলামনা। তবে এখানকার নীল আকাশটা খুব সুন্দর। শিউলিগাছটার তলায় কতদিন বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়তাম। ওরা তুলে নিয়ে যেত।
              আমার অবসাদ থেকে একটু একটু করে জেগে উঠছি আমি,ওরা আমাকে গান শোনায়। মন ভালো রাখার চেষ্টা করে। এই সুন্দর পৃথিবীটাকে দেখার জন‍্য আবার আমার বাঁচতে ইচ্ছে করে। তবে আমাকে দেখতে বেশি কেউ আসেনা,দিদি মাসে একদিন করে আসে। ওর কাছে শুনলাম বাবার শরীরটা ভালো নেই। দিদিকে জিজ্ঞেস করলাম আমায় বাড়ি নিয়ে যাবি? দিদি একটু মুখ কুচকে জিজ্ঞেস করলো কোন বাড়ি যাবি? বাবা তো অসুস্থ।আমিও চুপ করে গেলাম সত‍্যিই তো কোথায় যাব?
            জানিনা অসিত কবে এসেছিল শেষ, অনেকদিন আসেনা এখানে। মনের খোঁজ আমার মনে খুঁজে পেয়েছে যে আমি নাকি কবিতা লিখতে পারি। ওদের দেওয়া কাগজ আর পেন্সিলে কত এলোমেলো শব্দকে সাজিয়ে আমি লিখি আমার মত করে স্বপ্ন দেখার কবিতা। এখনো আমি স্বপ্ন দেখি মা একটা সুন্দর জীবনের যেখানে আমি নিজের খুশিতে বাঁচবো। কারো জন‍্য নয়,কাউকে খুশি করতে হবেনা ভালো বৌ বা মেয়ে হয়ে। নিজেকে প্রমাণ করতে গিয়ে খুব ক্লান্ত গো আমি,আবার বাঁচতে ইচ্ছে করে নিজের মত করে।
                   একদিন মনের খোঁজের বন্ধুরা বললো আমার নাকি ছুটি হয়ে যাবে। আমি কেঁদে শিউলিগাছটাকে জড়িয়ে বললাম আমার তো কেউ নেই। কোথায় যাবো আমি? হঠাৎই সামনের গেটটা খোলার আওয়াজ পেলাম। কে এলো এই দুপুরে? তাকিয়ে দেখলাম বড় চেনা দুটো হাত আমার হাতের মুঠোটা ধরে বললো,' চলো সৌরভী আমি এসেছি তোমায় নিতে।'...অসিত! এতদিন কোথায় ছিলে?...' একটা ছোট বাসা বেঁধেছি আমার সৌরভীর জন‍্য একদম লাল পলাশগাছের পাশে। তোমায় আর শোভাবাজারের বাড়িতে ফিরতে হবেনা। হঠাৎই ট্রান্সফারটা নিয়ে নিলাম পুরুলিয়াতে, তাইতো এত দেরি হল।'...' তোমার হাতে লাল কাগজে মোড়ানো ওটা কি গো?'...' দেখোতো চিনতে পারো কিনা?'..ওমা আমার লেখা কবিতার বই!অনেকগুলোই মাকে শোনাতাম বারান্দায় বসে। মা বলত কত স্বপ্ন আঁকিস তুই!
         .....' আবার আমরা স্বপ্ন দেখবো সৌরভী,আর কেউ তোমায় ভয় দেখাবেনা। চাঁদনীরাতে মহুয়া আর পলাশের গন্ধ মেখে তুমি কবিতা বলবে আর আমি শুনব।'...' তুমি এত ভালোবাসো আমায়! কিন্তু আমার যে তোমায় দেবার কিছু নেই। সন্ধ‍্যামাসি বলে আমি পাগল।"...' ওরা ভুল বলে সৌরভী,ওরা তোমার সুন্দর মনটা নষ্ট করে দিতে চেয়েছিল। আমি যে ওটাকে ছুঁতে চাই যত্নে রাখতে চাই।'
                 আজ অসিত অফিস থেকে আসার সময় একগোছা পলাশ এনে আমার খোঁপায় গুজে দিয়ে বললো,' আজ কানে কানে বলবো অনেক ভালবাসার কথা,সারারাত তোমার কোলে মাথা দিয়ে চাঁদ দেখবো।'..লজ্জা পেলাম আমি মুখ লুকালাম ওর বুকে, হয়ত তুমিও খুশি হলে মা। তোমার সৌরভী এতদিনে একটু সুখের মুখ দেখলো।

সমাপ্ত:-

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...