নিজের সাথে ভাব
রুমাশ্রী সাহা চৌধুরী
শাড়ির দোকানটা বেশ ফাঁকা আজ,অনেকদিনই আসেননা এই দোকানে কুহু। কি হবে একগাদা শাড়ি কিনে আলমারি ভরিয়ে? তবুও আজ খুব ইচ্ছে করলো নিজের জন্য কিছু কিনতে। কয়েকদিন ধরেই ভেবেছিলেন কথাটা সত্যিই তো যাদেরকে কেউ কিছু কিনে দেবার নেই তারা যদি নিজেকে কিছু গিফ্ট করে ক্ষতি কি? আল্টিমেটলি তো সেই একলা চলো গানটাই গাইতে হবে। অসীম বেশ কয়েকবছর অসুস্থ,ও সুস্থ থাকার সময় এইদিনটা একটু রান্নাবান্না করতে বলতো। এখন তো নিজেরই মনে থাকেনা বারের হিসেব। প্রায়ই জিজ্ঞেস করে কত তারিখ আজ।
কুহুর আজ খুব মনে পড়ল বাবার কথা। ছেলেমেয়েদের জন্মদিনটা বোধহয় বাবা মায়েরাই বেশি মনে করে। যেমন রাতুলের জন্মদিন নিয়ে কত চিন্তাভাবনা করত একসময় ওর ছোটবেলায়।কি রান্না করবে কাকে আসতে বলবে কত প্ল্যানিং। একটা সময় ছেলের জন্মদিনে আর ওকে সেভাবে পেতোনা। বুঝতে পারত সেই পায়েস রান্না করে জন্মদিন পালন করাটা এখন একটা ফালতু সেন্টিমেন্ট ওর কাছে। তার থেকে কোন ভাল রেষ্টুরেন্টে গার্লফ্রেন্ডের সাথে জন্মদিন কাটিয়ে রাতে বেশ দেরি করে ফেরাটাই রীতি হয়ে গিয়েছিলো। এমনও হয়েছে রাত্রি বারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে কোন রকমে এক চামচ পায়েস খাইয়ে প্রদীপের তাপ দিয়েছে ছেলের কপালে। ততদিনে ইংরেজী ক্যালেন্ডারে তারিখের বদল হয়েছে। কিছু বললে বলত,' মা আমি বড় হয়ে গেছি,আর কতদিন এইসব করবে। এখন একটা দিন বন্ধুদের সাথে পার্টি করলাম ট্রিট দিলাম ব্যাস।'...ভাবে কুহু ও যেদিন জন্মেছিল সেদিন মা আর ছেলের মাঝে কেউ ছিলোনা। এখন ওর জন্মদিনে সবাই আছে অথচ মা নেই।
...এই যাহ্ শাড়ি দেখতে দেখতে কি ভাবছে। আচ্ছা ঐ শাড়িটা দেখাননা এই রঙটা বাবার খুব পছন্দ ছিল। তবে এই বয়সে কি মানাবে ঐ রঙটা,তবুও সত্যি ভাল লাগছে রঙটা। গায়ে ফেলে মন্দ লাগছেনা। শাড়ি কিনে ব্লাউজ পছন্দ করতে করতে অনেকটা সময় চলে গেল আজ যেন কুহু শুধু নিজের জন্যই ঘুরে বেড়াচ্ছে। কত দায় দায়িত্ব আর কেনাকাটা করেছে সবার জন্য। কারো পছন্দ হয়েছে কারো পছন্দ হয়নি। তবে ও কি চায় ওর কি পছন্দ কেউ কি জানতে চেয়েছে তেমন করে? বাহ্ খুব সুন্দর একটা কস্টিউম জুয়েলারী একদম শাড়ির সাথে ম্যাচিং। একবার অসীমের কথা মনে হল কি করছে এখন কে জানে? অবশ্য আজ মিনতিকে বলে এসেছে ওর ফিরতে দেরি হবে। অসীমের জগতটাই এখন পুরো আলাদা হয়ে গেছে অনেক কথাই মনে থাকেনা,একটু বাদেই ভুলে যায়। ছেলেও বিয়ের পর বাইরে ওর এই একা জীবনটা আজকাল যেন বড় বেশি ফাঁকা লাগে। মাঝে দেখা হয়েছিল পুরনো বন্ধু মিতালির সাথে ওর পরামর্শেই নিজের কাউন্সিলিং করিয়েছে কুহু।
আজ অনেকদিন বাদে তাই নিজের খুশির জন্য বেড়িয়েছে। সেটাই নাকি জরুরী নিজেকে খুশি রাখা।একা একাও ভালো থাকা যায়,কথাটা শুনে চমকে উঠেছিলো তবে উত্তর পেয়েছিলো কেন থাকা যাবেনা বলুন তো। আপনাকে ভালো রাখার দায়িত্ব তো আপনাকেই নিতে হবে। আপনার মন ভালো না থাকলে সবাইকে দেখবে কে?
একা একাই কফি আর গরম মোমো খেয়ে এসেছিলো সেদিন। খাবার নিয়ে এসেছিল বাড়ির জন্য,অসীম আজকাল রসগোল্লা ছাড়া আর কিছুই খেতে চায়না।
দেখতে দেখতে এলো জন্মদিনের দিনটা,সবচেয়ে আগে ঐ কাউন্সিলিং সেন্টার থেকেই ফোনটা এলো বেশ সুন্দর মনছোঁয়া কথাগুলো। তার আগেই ওর স্নান হয়ে গেছে,ভোরের শিউলির সুবাস মেখে নতুন শাড়িটা পরে আজ নিজের খেয়ালেই সাজলেন কুহু। অসীমের মাথায় হাত রেখে বলে যান একটু বেরোচ্ছেন বাইরে। দক্ষিণেশ্বরে একা একা আগে ভাবতেই পারতেননা। আজ বড় শান্তি লাগলো নাটমন্দিরে চুপ করে বসে থেকে। মনটা ভেতর থেকে এক ভালোলাগায় ভরে গেল। গঙ্গারঘাটের সুশীতল জলে স্নিগ্ধ হল মনপ্রাণ। আদ্যাপিঠে মাকে দর্শন করে ওখানকার বাচ্চাদের সাথে জন্মদিনটা কাটিয়ে আজ মনটা ভরে গেল এক অন্যরকম ভালোলাগায়।
বহুদিন পর কুহুকে পুরোনো চেহারায় দেখে মনটা বোধহয় ভাল হল অসীমেরও। ওর কপালে ফুলটা ছুঁইয়ে মুখে প্রসাদ দিয়ে পায়ে হাত দেয় কুহু,এখন গুরুজন বলতে তো স্বামীই। এই জন্মদিনে নতুন শপথ নিলো কুহু সবাইকে ভালো রাখার জন্য তো নিজেকে ভালো রাখতেই হবে।
সমাপ্ত:-
#সেরা_দুই_শিক্ষিকা#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
'মা ফেসবুক খুলেছিলে?'
'না রে খোলা হয়নি।'
'আরে একবার খুলেই দেখনা?'
'আমার কি তোর মত অখন্ড সময় নাকি,সকাল থেকে রাজ্যের কাজ। সব সারি আগে, তারপর খুলবো।'
'যাহ্ তাহলে তো মিস্ করে গেলে,আচ্ছা আমি দেখাচ্ছি।'
মেয়েকে এত উত্তেজিত দেখে চোখ রাখে ফেসবুকে অনুরাধা। ওহ্ বাবলির ছবি,বাবলি মানে ওর দিদির ছেলের বৌ। বছর তিনেক বিদেশে আছে। নিত্য নতুন ছবি আপলোড করে আজ সমুদ্রে তো কাল পাহাড়ে। ভালোই আছে, বিয়ের পর দুবছর শ্বশুরবাড়িতে কাটাতে না কাটাতেই একদম ছেলেটাকে ট্যাঁকে বেঁধে সোজা বিদেশে। আর তারপর থেকেই নিত্য নতুন প্রোফাইল স্ট্যাটাস আপডেট করছে,কখনো ফ্রকে আবার কখনো হটপ্যান্টে। বেচারা দিদিটা,খারাপ লাগে মানুষটার জন্য। আজ আবার কি নতুন ছবি দিয়েছে কে জানে,হয়ত বিকিনি পরা ছবি,তাই পলির এত উচ্ছ্বাস।
....' আরে ডালের সিটি বাজলো,দেখালে দেখা।"....'এই দেখো,বৌদিভাই কি বিরাট সম্মান দিয়েছে মাম্মানকে। পারেও বটে,একদম গ্ৰেট পলিটিশিয়ান।'..মোবাইলের স্ক্রীনে চোখ রাখে অনুরাধা আরে এটা তো সেই বৌভাতের দিন তোলা পুরোনো ছবিটা। দুই মাকে নিয়ে গলা জড়িয়ে বাবলি মানে ওদের বৌমার তোলা ছবি।
এই ছবি তো এর আগে দেখেছে,এখনকার দিনে তো শুধু ছবিরই ছড়াছড়ি। নতুন বৌ নেচে বেড়িয়ে একবার এর সাথে আরেকবার ওর সাথে ছবি তুলে বেড়াচ্ছে। বিরক্ত হয়ে চলে যাবার উদ্যোগ নিলো।
...." এই যে সুপারমম চশমাটা চোখে দিয়ে ক্যাপশনটা দেখো আগে...আমার জীবনের দুই সেরা শিক্ষিকা মানে নিজের মা আর শাশুড়িমাকে একেবারে অনার দিয়েছে,বাব্বা মাম্মান তো মেডেল পেল বৌদিভাইয়ের কাছে।"
এখনকার মেয়েরা সত্যি পারে,একসময় দিদি কিছু বললেই মুখ কালো করে উত্তর দিত সে আবার এই নেকু পুষু পোষ্ট করেছে এখানে। বেশ কয়েকশো লাইক আর কমেন্ট পেয়ে যাবে এই সুযোগে। আর দিদিটাও দেখে একেবারে গদগদ হয়ে উঠবে। কত যে আর দেখবে! শেষে টিচার্সডে তে ও মা আর শাশুড়িকে নিয়ে আদিখ্যেতা।
অনুরাধার মনে পড়ে যায় ওকে দেখতে যাবার দিনের কথা,দোষের মধ্যে জিজ্ঞেস করে ফেলেছিলো,' জামাইবাবু আর টুবলু খুব খেতে ভালোবাসে তা তুমি রান্নাটান্না টুকটাক জানো?
টুবলুও চোখ পাকিয়েছিলো,আর দিদিও অস্বস্তিতে পড়েছিলো কে জানে কি উত্তর দেবে।
উত্তর পেয়েছিলো,"টুবলু খেতে ভালোবাসে তা আর জানবোনা,সব টাকা তো খেয়েই খরচ করে। আর আঙ্কেল ভোজনরসিক বলেই তো এমন হয়েছে। তবে আমি বেশি রান্নাটান্না জানিনা। মানে সময় হয়না করার,মাও করতে দেয়না হাত পোড়াবো বলে। ভাব ভালোবাসার বিয়ে তাই দিদি একটু হাল্কা ঠ্যালা মেরেছিলো মানে কিছু না পারলেও ওখানেই ছেলের মন পড়েছে তাই কিছুই করার নেই। দিদি হেসে জিজ্ঞাসা করেছিলো," রান্না করার ইচ্ছে আছে তো,তাহলেই হবে।"..." না না আমার রান্না করতে ভালো লাগেনা,প্রতিদিনের মেনু ঠিক করা জাস্ট বোরিং। কেন ও বাড়িতে তো রান্নার লোক আছে তাহলে আবার কি?"
একটু হাসি পায় অনুরাধার সব খবরই তো জানো মা। তবুও যদি ও কখনো কামাই করে। যাক আর কথা বাড়ানো হয়নি। ফেরার সময় দিদি বলেছিলো,' তোর জামাইবাবুর জন্য তো আমাকে দেখতেই হবে রান্নাঘর। আমার আর ছুটি হবেনা কোনদিন।'..'জামাইবাবু আর ছেলে দুজনেই হেসে বলেছিলো যেদিন ভালো লাগবেনা বলবে আনিয়ে নেব হোমডেলিভারী।'...দিদির কাছে বকুনি খেয়েছিলো অনুরাধা,আজকাল মেয়েদের মুখে লাগতে হয়। আমাদের পলিটাই কম কি,মুখে খই ফুটছে। ফেসবুকে যা একখানা গল্প পড়ি, তারপর বলবে আমি এত পড়াশোনা করে কি রান্নার লোক হতে যাচ্ছি আপনাদের বাড়িতে? আপনার ছেলে কি রান্না পারে? যদিও আমাদের টুবলু টুকটাক কাজ চালাতে পারে।
বাবলি বিয়ের পর এসেছিলো শ্বশুরবাড়িতে,দিদি তেমন কিছু ওকে বলতোনা। নিজের খেয়ালে থাকতেই ভালবাসতো। এই সেল্ফি তুলছে,শপিংয়ে যাচ্ছে। উইকএন্ডে মুভি দেখা বা টুকটাক বন্ধুদের সাথে বেড়িয়ে যাওয়া এইসব নিয়েই বেশ যাচ্ছিলো। সবচেয়ে ঝামেলা হত ঠিকে লোক না এলে,হাতের নখ খারাপ হয়ে যাবে বলে বাসন মাজার ধার দিয়েও যেতনা কখনো। দিদি বেচারা অভিযোগ করত একটা কাপও ধোয়না কখনও,কি করে পারে বলত এমন চোখ বন্ধ করে থাকতে! মুখে অনেক কিছু হয়ত সবসময় বলা যায়না,তবুও টুবলু বুঝেছিলো হয়ত ওরা এখন বাড়তি চাপ হয়ে গেছে মায়ের কাছে। তাই বিদেশের হাতছানিটা লুফে নিয়েছিলো,ওদেশে থাকার মজাই আলাদা,স্বাধীন জীবন কেউ কিছু ভাবার নেই। খুশিতে মেতে উঠেছিলো বাবলিও,সত্যি ফেসবুকে বিদেশের স্ট্যাটাস আপডেট করার মজাই আলাদা। মা বাবা, শ্বশুর শাশুড়ির নজরের বাইরে এক স্বাধীন জীবন তার মজাই আলাদা।
এর মধ্যে ওদের একটা পুচকেও হয়েছে এখানে আসার পর,তাই সিটিজেন হওয়ার ব্যাপারটা মোটামুটি পাকা। উইকএন্ডে লঙ ড্রাইভ,খাওয়া দাওয়া পার্টি বেশ সাজানো জীবন। তবে বাবলির সাধের ম্যানিকিওর করা নখ একদম গেছে,ওদেশে গিয়ে মোটামুটি জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ সব নিজেকেই করতে হয়। টুবলু তো সারাদিনই অফিসে থাকে আর বাকিটা ছেলে সামলায়। এখন আর জানলায় কাপ রেখে বসে থাকা হয়না। খুব চটজলদি সিঙ্ক খালি করে ফেলতে হয় যাতে ওখানে কিছু না থাকে,শীতকালে হাত ফাটে জল ঘেঁটে তাতে বোরোলীন লাগিয়ে রেখেও কাজ সেরে ফেলতে হয়,আসলে এখানে ঠিকে লোক পাওয়া যায়না। বাথরুম সাফাই,ডাস্টিং,ওয়াশিং,ক্লিনিং, গাড়ি ধোয়া,বাজার করা সবটাই নিজেকে করতে হয়।
টুবলু বাজার থেকে কখনো কচুর শাক এনে কতদিন খাইনি বললে না করতে পারেনা যে করতে পারবোনা। রান্না অনেক শিখে ফেলেছে,কখনো ফোনে কখনো নেটে। ছেলে সামলানো,ন্যাপি পাল্টানো। ওর খাবার বানানো সবটা সামলাতে সামলাতে বাবলি এখন সত্যিই পাকা গিন্নী। আজকাল শাশুড়িমায়ের একটা কথা খুব মনে হয়,' তোমার শেখার ইচ্ছে আছে তো?'..যদিও তখন বিন্দাস বলে দিয়েছিলো শেখার কোন ইচ্ছেই নেই। আসলে কোন কাজ ঘাড়ে চাপলে সেটাই বোধহয় সব শিখিয়ে নেয় সুদে আসলে।
জীবনের প্রতি পদক্ষেপে জীবন আমাদের শিক্ষা দেয়,শেখায় কখনো বড়রা আবার কখনো ছোটরাও। শেখার হয়ত কোন শেষ নেই,জীবন কাউকেই ছাড় দেয়না। তাই বাপের বাড়ির সুখে আদরে মেয়েরা যেমন বাবা মায়ের কাছে অনেক কিছু শেখে তেমনি শ্বশুরবাড়িতে গিয়েও শেখে হয়ত জীবনের না শেখা অনেক পাঠ কখনো সুখে কখনো বা অসুখে। তাই বাবলি অনেক খুঁজে দুই মায়ের সাথে তোলা ছবিটা বের করে ক্যাপশনটা দিয়েই ফেললো। একটু কি বেশি তেল মারা হয়ে গেল? হোকনা,ক্ষতি কি?...সংসারে বোধহয় বুদ্ধি যস্য বলং তস্য। সকালে হাতে কফির মগটা নিয়ে ব্রেকফাস্টের ব্রেড টোষ্ট করতে করতে মোবাইলে চোখ রাখে,উরিব্বাস শাশুড়িমা,মা,মাসতুতো ননদরা এমন কি ওর মার্কামারা মাসিশাশুড়িও লাইক দিয়েছেন ছবিটাতে এমন কি টুবলুও!
মায়ের আর শাশুড়িমায়ের লাভ ইমোজিটা হ্যাপি টিচার্সডের সারাদিন লাভি ডাবি করে রাখলো নানান কাজের মাঝে বাবলিকে।
সমাপ্ত:-
দেখি একটু,হ্যাঁ বেশ। সব ঠিক হয়ে যাবে,শুধু যেমন ভাবে বলবো সেগুলো ফলো করুন,এক্সারসাইজ ,ডায়েট,মেডিসিন সবটা।"
"খুব কষ্ট পাচ্ছি ব্যাথায় ডাক্তারবাবু প্রায় শয্যাশায়ী হয়ে গেছি। অনেকটা নিশ্চিন্ত হলাম। আপনার ফি টা।
" চিনতে পারছেননা স্যার,আমি ইন্দ্র। সেই যে কবিতা মুখস্থ করতে পারিনি বলে...."
মনে পড়ে যায় একদিন একশোবার কানধরে উঠবোস করিয়েছিলেন ছেলেটিকে। হাঁটুব্যাথায় আর লজ্জায় কয়েকদিন আসেনি। তার কিছুদিন বাদে স্কুল ছেড়েছিলো।
ওটা রেখে দিন স্যার আর ফিজিওর জন্য আমি লোক পাঠিয়ে দেবো।" এই বলে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে। মাথায় হাত রাখেন মাস্টারমশাই বলেন," পুরোনো কথা মনে রাখিসনা।"
...." না স্যার,ওইদিনগুলো আমার আশীর্বাদ। হয়ত সেইজন্যই বড় হতে পেরেছি।"
#আমার_সেরা_শিক্ষক#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
ছোটবেলায় শিক্ষক দিবসের সকালে উঠেই প্রণাম করতাম বাবা মাকে। বিয়ের পর বাবা মায়ের ছবিতে প্রণাম করতাম আর ফোনে বাবাকে উইশ করা ছিল একটা অভ্যেস। ফাইভ থেকে টুয়েলভ পর্যন্ত বাবা মা যে স্কুলে পড়াতেন সেখানেই আমার পড়াশোনা। বাড়িতে বাবাকে পেয়েছি কড়া অভিভাবক হিসেবে আর স্কুলে দেখেছি ছাত্রছাত্রীদের প্রিয় শিক্ষক হিসেবে। মাকে দেখেছি বেশ রাগী দিদিমণি হিসেবে তবুও সেইসময় স্কুলের কিছু বড় দাদা দিদিরা মাকে ওদের মাতৃস্থানে বসিয়েছিলো। তখনকার ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে ছিল এক অদ্ভুত মূল্যবোধ,সাইকেলে যেতে যেতে মাস্টারমশাইকে দেখে নেমে পড়ত। মাস্টারমশাইকে ভারী বাজারের ব্যাগ বইতে দেখলে নিজেরা এনে পৌঁছে দিত বাড়িতে। বাবা যখন দেশের বাড়ি থেকে অনেক জিনিসপত্র নিয়ে আসতেন তখন দেখেছি ছাত্ররা বাস থেকে নামলেই সব গুছিয়ে এনে দিত বাড়িতে। আজকাল বোধহয় তেমন ছাত্র আর হয়না,নাকি তেমন মাস্টারমশাই আর দিদিমণি আমরা হতে পারিনি। সত্যি কথা বলতে পড়াশোনা,নিয়মশৃঙ্খলা,নিষ্ঠা সবই শিখেছিলাম বাবা মায়ের কাছে। ভাবলে আশ্চর্য লাগে ওদের কখনো দেরী করে ঘুম থেকে উঠতে দেখিনি,বাবার কাজই ছিলো সকালে উঠেই মশারির দড়ি খুলে দেওয়া। ঘুমোতে চাইলেও আর উপায় ছিলোনা। অনেক শাসন পেয়েছি কোন অন্যায় করলেই,কথা আর শেষ হতনা। এখন ভাবি তাই হয়ত এতটা ধৈর্য নিয়ে সবটুকু করতে পারি। বাবা মায়ের শিক্ষা কতটা কাজে লাগাতে পেরেছি জানিনা তবুও আজও পালন করার চেষ্টা করি সৎ এবং নির্লোভ জীবন। ঘৃণা করি মনেপ্রাণে মিথ্যেকে।
বাবা বাড়িতে না থাকলে ছাত্ররা এসে খবর নিত আমাদের কি লাগবে,মায়ের অনেক ছাত্র ছিল যারা মঙ্গলবারের হাটে যাওয়ার আগে খবর নিয়ে যেত কি আনতে হবে। বাড়ির সামনে মাঠে বাবার মুক্ত বিদ্যালয় ছিল। হ্যারিকেনের আলোতে পড়তে আসত সেখানে নানা বয়সের ছাত্র। বাবাকে দেখেছি স্নেহ আর শাসন দুটোই করতে।
অনেক দুঃস্থ ছাত্র স্কুলে আসার আগে না খেয়ে এলে মাকে দেখেছি যত্নে তাদের খাওয়াতে। দোলের দিন মাস্টারমশাই দিদিমণিদের পা ছোঁওয়ার জন্য কি যে ভীড় হত তাই মাকে দেখতাম সকাল থেকেই মালপোয়া আর পায়েশ করতে যাতে সবাই মিষ্টিমুখ করে যেতে পারে।
সরস্বতী পূজোর দায়িত্ব বাবার ওপর পড়লে আর দেখতে হতনা,রাতে আমাদের ঘুম হতনা। সারা রাত এটা চাই ওটা চাই করেই কাটতো তার ওপর ওদের বায়নার শেষ ছিলনা।
সারা দেশে হয়ত বা বিদেশেও কত ছাত্রছাত্রী ছড়িয়ে আছে বাবার তাইতো ট্রেনের স্টেশনে নামলে কেউ না কেউ ব্যাগ হাতে করে বলত চলুন স্যার আমাকে দিন ব্যাগটা। অথবা পথচলতি কোন ট্রেন স্টেশনেই পৌঁছে যেত গরম খাবারের কৌটো নিয়ে। স্যার ওদের বাড়ির ওপর দিয়ে যাচ্ছেন একটু দেখা করবেনা তা কি হয়। প্রণাম করাটাই হয়ত ছিল সৌভাগ্যের ব্যাপার। মুম্বইয়ে গেছি হোটেল বুক করা নেই,বাবার ফোন ছাত্রকে। আধঘন্টার মধ্যেই সে পৌঁছে গেল সব ব্যবস্থা করে হাসিমুখে প্রণাম করে বললো আগে জানাননি কেন স্যার। তার সাথে ছিল গ্ৰামের সরল সাধাসিধে মানুষগুলোর আন্তরিকতা। শিক্ষকতার এক স্বর্ণযুগ ছিল সেই সময়। আজ আমিও পড়াই তবে সেই অমলিন হাসি আর আন্তরিকতা কোথায়। শহরের মানুষ খুব তাড়াতাড়ি বদলাচ্ছে,বদলাচ্ছে গ্ৰামের মানুষও তবুও বাবা রিটায়ার করার প্রায় চোদ্দবছর পরে যখন গিয়েছিলাম আমার সেই ছোটবেলার গ্ৰামে অদ্ভুতভাবে দেখেছিলাম বদলায়নি কিছুই। হঠাৎই শুনেছিলাম কান্নার আওয়াজ,একছাত্র মায়ের পা জড়িয়ে কাঁদছে দিদিমণি আপনারা চলে গেলেন কেন এখান থেকে। আমাদের ঐ বাড়িতে এখন থাকে বাবাদের এক পুরোনো ছাত্র পরিবার নিয়ে, ওরা মুসলিম। আশ্চর্য হয়ে গেলাম দেখে যত্ন করে রেখেছে মায়ের তুলসীমঞ্চ একদম নিকোনো পরিস্কার। ওদের খুব ইচ্ছে মা ওখানে ধূপকাঠি জ্বালাক। মুগ্ধ হলাম ওদের চোখে আমার সেরা শিক্ষক আর শিক্ষিকার শ্রদ্ধা দেখে। মা তুলসীতলা থেকে ঘরে ঢোকার পথে পায়ের সামনে রাখলো দুই জোড়া চপ্পল,'স্যার ম্যাম একটু পা দিয়ে স্পর্শ করুন এগুলো আমরা রেখে দেবো যত্ন করে। এমন ছাত্রছাত্রী কজনের ভাগ্যে হয়! ভাবতেই পারিনা একদম এমন হয় আজও। ফেরার সময় আমাদের গাড়ি ভর্তি হল নারকেল,বাতাবিলেবু,মুসুরডাল,চালভাজা,
কাগজিলেবু আরো কত কি জিনিসে। ধুলো উড়িয়ে গাড়ি স্টার্ট করার আগে শেষ ধুলোটুকু মাথায় তুলে রাখলো সবাই। অনেকে চাইলো একটু আলিঙ্গনের ছোঁয়া। পাড়া প্রতিবেশি সবাইকে কাঁদিয়ে সেবার বিদায় নিয়েছিলাম এক সুন্দর গ্ৰামের স্কুলে পড়ানো সেরা শিক্ষক শিক্ষিকাকে দেখতে দেখতে। নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি যখন ভাবি আমি উনাদের সন্তান। দেখতে দেখতে আমিও জীবনে পার করেছি শিক্ষকতার অনেকগুলো বছর। আজও দুটো হাত তুলে প্রণাম করে বলি যে শিক্ষা পেয়ে বড় হয়েছি তার যেন অমর্যাদা না করি কখনো। শাসন ও স্নেহ মেশানো তোমাদের শিক্ষা উজ্জ্বল হয়ে থাকবে মনের মণিকোঠায়। আজ শিক্ষকদিবসে তাই শুধুই স্মৃতির অন্তরালে খোঁজা জীবনের সেরা সময়। অনেক অনেক শ্রদ্ধা শিক্ষক সমাজের প্রতি, প্রার্থনা করি প্রকৃত মানুষ হোক ভবিষ্যতের ছাত্রসমাজ।
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment