Skip to main content

প্রেমের ফাঁদে

#প্রেমের_ফাঁদে#

#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#

কলেজে উঠলেই ছেলেগুলো কেন যে এত রোমিও হয়ে যায় কে জানে? ইশ্ এই দুই মাস কলেজে যেতে না যেতেই সারাক্ষণ প্রেমভাবে মশগুল হয়ে আছে। অসহ‍্য লাগে মহুলের। বাপরে প্রেমের হাত থেকে ও সাতক্রোশ দূরে থাকতে চায়। না না মাকে আর ও কষ্ট দেবেনা। মায়ের এত টেনশন আর দেখতে ভালো লাগেনা। ও খুশি রাখবে মাকে মানে ওর বেষ্ট ফ্রেন্ডকে। যদিও মা ওকে বেষ্টফ্রেন্ড বলে ভাবেনা,তাই তো সব কথা ওকে খুলে বলেনা। মুখ গোমড়া করে থাকে অথচ বলে ঠিক আছে সব। কেন যে বোঝেনা মায়ের হাসিখুশি মুখটা ওকে কত পজেটিভ এনার্জি দেয়।
       মায়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছিলো বেশ ছোট বয়সে। আর তারপর থেকে সবার মন জোগাতে জোগাতে কখন যে মা একটু একটু করে হারিয়েছিলো ছোট ছোট ইচ্ছেগুলো কে জানে? মহুল ছোট, ওর দাদা আছে। মেয়েদের নাকি ম‍্যান্দা বলে,এটা শুনে খুব হেসেছিলো ও ছোটবেলায় তবে এখন গা জ্বলে যায়। মায়ের পটলের মত ফোলা পেটটা দেখিয়ে ঠাকুরদা বলেছিলো,'দেইখ‍্যা কওতো বৌমার কি হইব? ওর ঠাকুরদার বৃদ্ধা মা বলেছিলো,' কি আর হইব ম‍্যান্দাই হইব।ওর মায়েরও তো প্রথমে তাই।' আচ্ছা মেয়েদের তুলনা করতে বাপের বাড়ি চলে আসে কেন যে কে জানে। তবে মা সবার মুখে হাসি ফুটিয়ে পোলা মানে ছেলেই জন্ম দিয়েছিলো। ওর দাদা সৌরভ মায়ের নয়নের মণি,প্রথম সন্তান বলে কথা তাই সবার আদর পেয়েছে ও। মহুল বেশ কিছুটা ছোট দাদার থেকে,ও বলে আমি তো তোমার জীবনে দাদার মত মূল‍্যবান কিছু না তাইনা। মা আদর করে বলে,' বোকার মত কথা বলতে নেই। তোরা দুজনেই এক আমার কাছে'। দাদু দিদা সবাই যেন দাদাকেই বেশি ভালোবাসছে মনে হত। তবে একটু একটু করে দাদা বড় হয়ে যখন মায়ের কাছ থেকে সরে গেছে ও এসে কখন যে ঢুকে পড়েছে মায়ের মনের কাছাকাছি বুঝতেই পারেনি।
         ওদের বাড়িতে মেয়েদের কিছু করতে নেই,এই যেমন দ্বিতীয় বাচ্চার বেলায় সাধ দিতে নেই,মেয়েদের অন্নপ্রাশন,জন্মদিন করতে নেই এই সব আর কি। তবে ওর দাদু যতদিন বেঁচে ছিলেন মায়ের জন্মদিন ছিলো। দাদু ঠিক মনে করিয়ে দিতেন জন্মদিনটা আগে থেকে। দাদু বছর দুয়েক আগে চলে যাবার পর থেকে আর ওসব কেউ মনে রাখেনা। দাদাও বোধহয় বিশ্বাস করে মায়েদের জন্মদিন থাকেনা তাই চাকরি করলেও মাকে একটু উইশও করেনা। নিজের টুকটাক টাকা বাঁচিয়ে কখনো একটু খাবার বা ছোট্ট কানের দুল গিফ্ট করে মাকে মহুল।
       চোখ দিয়ে মায়ের জল গড়িয়ে পড়ে,'তোর মনে আছে?'...' তোমার চোখে জল কেন মা?শুভদিনে কাঁদতে নেই।' বুঝতে পারে অনেক না পাওয়ার যন্ত্রণায় মায়ের চোখে জল ঝরছে। দাদার উপেক্ষাটা মা নিতে পারেনা। অথচ বাবাকে বলে কিছু অনুষ্ঠান করতে চাইলে করতেও দেবেনা। 'না রে থাক,বুড়োদের আবার কিসের জন্মদিন। যতদিন আমার বাবা ছিল হয়েছে।'

মহুলের ইচ্ছে মাকে কিছু দিতে,একটু খুশি রাখতে। দাদাটা বড় কাঁদায় মাকে,অথচ ছোটবেলায় ওর সাথেই বেশি বন্ডিং ছিল মায়ের। অথচ ওর গার্লফ্রেন্ডের জন্মদিনের গিফ্টটা মাকে এনে দেখায়,ওকে খুশি করতে মাকে উইশ করতে হয় ওর বান্ধবীকে কিন্তু অদ্ভুতভাবে মায়ের জন্মদিনটা ভুলে যায়,না কি ভোলার ভান করে কে জানে?
      তাই দরকার নেই বাবা প্রেম করে,ও মাকেই প্রায়োরিটি দেবে। মা বকা দেয়,আমি কি সারাজীবন থাকবো? তারপর কে দেখবে তোকে?
কে আবার দেখবে? নিজেই নিজেকে দেখবো,নিজেকে দেখার আশ্বাসে সারাজীবন অন‍্যদের দেখতে দেখতেই কেটে যায়। তবুও প্রেমিকরা ওর পেছন ছাড়েনা কেউ না কেউ আছেই পেছনে পড়ে। মাকে বললেই মা হাসে।
      কলেজ থেকে বেড়িয়েই ফুচকার দোকানে ফুচকা খেতে খেতে বিষম খেলো, পিয়ালদা চোখ ভরা দুষ্টুমি নিয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে ওকে। পিয়ালদা মায়ের ছোটবেলার বন্ধু মমতামাসির ছেলে, ছোটবেলায় ওদের বাড়িতে এলেই ওর চুলের ঝুটি ধরে টেনে দিত নাহলে হাতে ধরা ক‍্যাডবেরিটা নিয়ে দৌড়ে পালাতো। ভয়ে সিঁটিয়ে থাকত মহুল, ওরা বাড়িতে এলেই। একেবারে দুষ্টুর শিরোমণি। দাদার সাথেও মারামারি লাগতো। মাঝে অনেকদিন ছিলোনা কলকাতায়, মেসো বদলি হয়ে গিয়েছিলো শিলিগুড়িতে। গতবছর মমতামাসির আমন্ত্রণে ওরা গিয়েছিল ওখানে। পিয়ালদাও এখন চাকরি করে তবে তখন এসেছিল বাড়িতে। ওকে দেখেই বলেছিল,' ওমা টেপি না! বাবাঃ কত বড় হয়ে গেছে মা।'..মাথাটা গরম হয়ে গিয়েছিল চট করে কি হতচ্ছাড়া বদমায়েস ছেলে এখনো ঐ পচা নামটা মনে করে রেখেছে।...' এই যে ল‍্যাজকাটা দা আমি এখন কলেজে পড়ি।'...'তাতে কি হয়েছে,টেপি টেপিই থাকবে,যাক চুলটাও বেশ লম্বা হয়েছে তো!'
        ধমক দিয়েছিল মমতামাসি,' অসভ‍্য কোথাকার এখন এই নামটা কেউ বলে ও লজ্জা পাবেনা?'..নামটা সো সুইট মা,আগে যা মোটা ছিল! মমতামাসির বাড়িতে একটুও শান্তি দেয়নি ওকে ঐ চারদিন জ্বালিয়ে মেরেছে। সত‍্যিই বোধহয় মানুষের স্বভাব পাল্টায় না। পানিঘাটার ব্রীজে উঠে একটু দুলিয়ে দিয়েছিলো ব্রীজটা,ওর কানের কাছে আস্তে বলেছিলো তোকে দেখে এখন সত‍্যিই মনে দোলা লাগে। মুখ বেকিয়েছিলো মহুল,তোমরা ছেলেরা একটা বয়সের পর কেমন যেন প্রেমিক হয়ে যাও।তোমার একটা দজ্জাল বৌ এলে মাসিকে কে দেখবে শুনি?...' মুচকি হেসে বলেছিল,কেন তুই?'
...'আমি!'মাথায় ঢোকেনি কথাটা।..' মানে মাসি বলছিল তুই তো বিয়েই করবিনা। তাহলে আবার কি মায়ের সাথে মাসিদেরও নিয়ে নিস।'
     তবে আইডিয়াটা মন্দ দেয়নি পিয়ালদা ভালোই হবে মায়েদের ছেলেবেলা ফিরিয়ে দিতে পারবে। যদিও তখন মুখ ভেংচে বলেছিল এমনি হয় ছেলেগুলো নিজেদের দায়িত্ব অন‍্যের ঘাড়ে দিতে পারলেই বাঁচে। তবে আমার আপত্তি নেই মমমাসি যদি তার আদরের ছেলেকে ছেড়ে থাকতে পারে। আড্ডায় ঝগড়ায় দেখতে দেখতে চারটে দিন কেটে গিয়েছিল। তবে পিয়ালের মনে দোলা দেওয়ার কথাটা বলা হয়নি মহুলকে, যা ঝগড়ুটে মেয়ে শেষে কি বলতে কি বলবে কে জানে। মহুলের লাল সবুজ ওড়নার ঝাপটায় মনটা সত‍্যিই হারিয়ে গিয়েছিল। টেপিটা সত‍্যি খুব সুইট,যতই ঝগড়া করুক না কেন।
             ফুচকার জলটা গলায় লেগে চোখ দিয়ে জল গড়ালো,এই ল‍্যাজকাটা হনুমানটা এখানে কি করছে? নিজেকে কন্ট্রোল করার জন‍্য ফেসবুক করেনা মহুল। দাদাটা তো ফেসবুক করেই গেল। সারাদিন বাড়িতে থাকলেই ওটা খুলে বসে আছে। হোয়াটস আ্যপটা মায়ের মোবাইল থেকে চালায়। পিয়াল যখন জিজ্ঞেস করেছিলো,'ফেসবুক করিস না ?'...'আমার অত বেকার কাজের সময় নেই গো।'..'গুড গার্ল,আর হোয়াপ?'...'মায়ের ফোনে করি।' তাই আর কিছু বলার ছিলনা। সত‍্যি এখনো ছেলেমানুষ মেয়েটা।
            মোটেই পাত্তা দেয়নি পিয়ালদাকে,আর সে কিনা এতদিন বাদে কলকাতায়! পিয়ালদা শেফ,মুম্বাই তাজে ছিলো,প্রথম পোষ্টিং ওখানেই। তাহলে এখানে কেন? তবুও স্মার্ট সেজে আরো পাঁচটা ফুচকা খেলো।..'তুমি এখানে কি করছো?'..' কেন রে কলকাতাটা তোর কেনা নাকি?'..' এবার থেকে আমি এখানেই থাকবো,আয় উঠে আয়।'...'কোথায়?'...'চলনা,তোর খাওয়াটা মনে হয় ঠিক হলনা।'..'আমি সোজা বাড়ি যাবো এবার'...' তাই যাবি চল।' ওকে বোকা বানিয়ে একদম ওদের হোটেল ঘুরিয়ে খাইয়ে বাড়িতে ছেড়ে দেয় পিয়াল। ইশ্ এত বড় ফাইভ স্টার হোটেলে কি যে পচা লাগছিলো নিজেকে দেখতে ওখানে কলেজের ড্রেসে। তবুও তার মাঝেও একদম ভি আই পি ট্রিট পেলো। অনেকের সাথেই আলাপ করিয়ে দিলো পিয়ালদা। শুধু একজন আ্যংলো ভদ্রমহিলা বললেন,' ইয়োর ক্রাশ? সো কিউট!'...পাজি ছেলে একটা ওদের কি বলেছে কে জানে?
          বাড়িতে মা খুব খুশি হল পিয়ালদাকে দেখে। তবে এরপর আর খুব একটা বেশি আসতে পারেনি কাজের চাপে। কলেজের গেটে ফুচকা খাওয়া ছেড়েছে মহুল,কে জানে আবার কোনদিন এসে হাজির হবে। তবে মাঝে মাঝে ফোনে কথা হয় আর কথা হলেই ঝগড়া। মাঝে কেটে গেছে বেশ কয়েকটা মাস।
          সেদিন কলেজ থেকে ফিরেই দেখে বাবার মুখটা গোমড়া,মাও চুপচাপ। দাদা যথারীতি বাড়িতে নেই,ও যেন এক অন‍্য মেরুর বাসিন্দা ওদের ভালোমন্দ কিছুতেই ওর কিছু আসেনা।
রান্নাঘরে গিয়ে ফিসফিস করে বলে মাকে,'কি হয়েছো গো? আজ এমন মেঘলা আকাশ? আমার আকাশে রোদ্দুর নেই কেন?'....' তোর বাবাকে জিজ্ঞেস কর আমি জানিনা।' জানতে পারলো মায়ের বন্ধুরা সামনে মাসে শান্তিনিকেতনে বেড়াতে যাবে মাকেও নিয়ে যেতে চায় ব‍্যাস বাবার মাথা গরম বুড়ো বয়সে বন্ধুদের সাথে বেড়াতে যাওয়া আর হোয়াটস আ্যপে গল্প! এই সব নিয়ে অশান্তি,তবে মাও এবার বেঁকে বসেছে অনেকদিন শুধু সংসার সংসার করেছে এবার যখন সবাই যাচ্ছে তখন মাও যাবে। ব‍্যাস আর কি শুরু অশান্তি মানে ঠান্ডা লড়াই। যাক শেষে মাসিরাই সমস‍্যার সমাধান করলো,সবারই হাবিরা নাকি ঝামেলা পাকাচ্ছে তাই ওদেরকে নিয়েই যাওয়া হবে। যাক আপাতত শান্তি,বাবারও মাথা ঠান্ডা। বাড়ির দায়িত্ব কদিন মহুলের ওর একটা পরীক্ষা আছে,ঠিক হল দাদা আর ও থাকবে। মহুল এখন অনেক কাজই পারে তাই অসুবিধে নেই। শুধু মায়ের গলাটা জড়িয়ে বলে,' জন্মদিনের আগে ফিরে এসো মা।'..' ও সব পাট তো কবেই উঠে গেছে রে,শুধু তুইই মনে রাখিস। কি হবে আমি বাড়িতে আসি আর বাইরে থাকি তাতে?'..' কিছুই না গো এবার একটা প্ল‍্যান আছে আমার,আর ঐ দিনটায় তুমি আমায় ছাড়া থাকতে পারবে?'...মা এবার চুপ করে যায় সত‍্যি মেয়েটাই তো একমাত্র জন্মদিনটা মনে রাখে,ওকে একা বাড়িতে রেখে!..' না রে আমি চলে আসবো আগের দিন ঠিক,বা সেদিন সকালে।'
          মাকে বেশ খুশি খুশি লাগছে,সত‍্যিই তো অনেকদিন বাদে বেড়াতে যাওয়া তাও আবার বন্ধুদের সাথে,কি শাড়ি নেবে সব গুছিয়ে দেয় মহুল,সুন্দর দেখতে বাটিক আর নক্সিকাঁথার শাড়িগুলো। 'মা তোমরা খোয়াইয়ের কাছে থাকবে? এই তো মমমাসি ছবি পাঠিয়েছে। ইশ্ কি সুন্দর বাড়িগুলো এখানে তো অনেক শুটিং হয়। এই দেখো।"...' মম বলছিলো আমাকে, সব ব‍্যবস্থা নাকি পিয়ালই করে দিয়েছে।' ঢোক গেলে মহুল সেই পাজিটা! বাহ্ বেশ করিৎকর্মা তো,যাক্ ভালো।
          মা চলে যাবার পর বাড়িটা বেশ ফাঁকা ফাঁকা,ওর ফোনে হোয়াপ খুলেছে মহুল। মা কি সুন্দর সুন্দর ছবি পাঠাচ্ছে। মা আর মাসিদের পুরো কলেজগার্ল লাগছে। ওরে বাবা মা কি সুন্দর একটা স্কার্ট পরেছে,দারুণ তো,ও মাসিরাও সব। নিশ্চয় খোয়াইয়ের হাটে কিনেছে।..' মা আমাকে বাদ দিয়ে এত কিছু?'..' আর বলিসনা,বান্ধবীদের পাল্লায় পড়ে। তোর আর বাবুর জন‍্যও কিনেছি রে।'..' খুব ভাল করেছো মা,কতদিন তোমার মুখের এই হাসিটা দেখিনি,বাবা কোথায় গো?'..'মেসোদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে বারান্দায় বসে,আর চায়ের কাপ খালি করছে।'..' মেজাজ কেমন?'...'এই নে কথা বল'। বাবা যে খুব এনজয় করছে সেটা ভালোই বুঝতে পারলো মহুল। গলার স্বরই পাল্টে গেছে। যাক খুব ভালো থাক মা।
...সাওতালি নাচের ভিডিওটা জাস্ট ফাটাফাটি হয়েছে,সবার কত ট‍্যালেন্ট! ওরে ওরে এই তো বাবা খুব লাজুক লাজুক মুখে ভিডিও করছে। রোমান্টিক বাবাকে বেশ লাগলো দেখতে।
         পরের দিন ওর হোয়াপে একটা কবিতা পেল ওমা এই পাজিটা ঠিক খুঁজে বার করেছে ওকে। আসবি নাকি ফুচকা খেতে,কাল একটু ফা‌ঁকা আছি বিকেলে। মহুল উত্তর দেয় ওর পেট খারাপ।...' বেরসিক একটা,কাঁচকলার ঝোল খা।'
                 দেখতে দেখতে কয়েকটা দিন কেটে গেল,কালই তো মায়ের জন্মদিন। কাল দুপুরের মধ‍্যে মা ফিরে যাবে। উফ্ এই মা ছাড়া বাড়িতে আর ভাল লাগছেনা।
                রাত্রি বারোটায় মাকে উইশ করতে হবে,বলে দিয়েছে যেন জেগে থাকে। এই কদিন দাদাটাও ভুগিয়েছে কত রাত করে যে ফিরছে! ভাগ‍্যিস ওদের পুরোনো লোক প্রমীলামাসি আছে। মাকে উইশ করতেই মা বললো,'মলু,কাল ফেরা হবেনা রে,সবার বায়না জন্মদিনটা ওদের সাথে কাটাই এবার।'..খুব রাগ হল,চোখে জল এল মহুলের বন্ধুদের পেয়ে মা ওকে ভুলে গেল! খট্ করে ফোনটা কেটে দিল। মা দুবার তিনবার ফোন করার পর ধরলো। 'তুই কাল চলে আয় মলু এখানে,খুব মজা হবে। বাবুকেও বলি আসতে।'..' দাদা যাবে,তাহলেই হয়েছে। কালই ওর সবচেয়ে জরুরী কাজ থাকবে। আমি কি করে যাবো অতটা,একা!'...' পুরোটা তো শুনলিই না,কাল পিয়াল গিয়ে তোদের নিয়ে একদম ড্রাইভ করে সোজা এখানে নিয়ে আসবে।'...হায় ভগবান,ঐ পাজিটার সাথে তিনঘন্টা একা একা যাওয়া। কি করে যাবে,মাকে না করে দেবে ভাবলো। কিন্তু পারলোনা। সারারাত ভালো করে ঘুম হলোনা,যথারীতি দাদা যাবেনা। এদিকে উৎপাত করে মারছে হনুমানটা সকাল ছটায় নাকি ওকে নিতে আসবে। রাত জেগে একটু গুছিয়ে নিল।
            পরদিন সকালে যথারীতি প‍্যাঁ প‍্যাঁ হর্নের আওয়াজ। তাড়াতাড়ি নেমে এল মহুল,এরপর হয়ত টেপি হয়েছে বলে চ‍্যাঁচাবে। হলুদ চুড়িদার আর সবুজ ওড়নায় খুব মিষ্টি লাগছে মহুলকে। তবুও পিয়াল পেছনে লাগলো,' চোখে সর্ষেফুল দেখিয়ে ছাড়লি সক্কাল সক্কাল।' ও ভেবেছিল পেছনে বসবে,দেখে সামনের দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে হনুমানটা। অগত‍্যা বসতেই হল সামনে। শরৎকাল,আর তিনসপ্তাহ বাদেই পূজো। অনেক জায়গায় প‍্যান্ডেল হচ্ছে,হাল্কা ঠান্ডা বাতাস বইছে। জানলা দিয়ে তাকিয়ে মনটা উদাস হয়ে যায় মহুলের ভোরের শিউলির গন্ধে। ' কি রে টেপি ঘুমিয়ে গেলি নাকি? সামনে সিটে বসে ঘুমোতে নেই। তোর তো পেট খারাপ,স‍্যান্ডউইচ আর কফি নিয়ে এসেছি। কিছুক্ষণ বাদেই গাড়ি থামাবো। আজ কফি আর স‍্যান্ডউইচটা সত‍্যি দুর্দান্ত লাগলো মহুলের। ছেলেরা এত গোছানো হয়! না আজ খুব একটা পচা লাগেনি পিয়ালদাকে,শুধু টেপি নামটাই অসহ‍্য লাগছিলো মনে হচ্ছিলো গলাটা টিপে দেয়।
           অনেকটা পথ গান শুনতে শুনতে পার হয়ে গেল,লালমাটির পথের রঙে মনটা রাঙা হয়ে গেল মহুলের। কি সুন্দর খোয়াইয়ের বন, সেখান দিয়েই গাড়ি নিয়ে একদম সোজা মায়েদের রিসর্টের সামনে। ওদেরকে দেখেই হৈ হৈ করে ওঠে সবাই। ওরে বাবা ডিকি খুলে কত কি বের করছে পিয়ালদা। পার্টির সব জিনিস,কত বড় একটা কেক। মহুলও নিয়ে এসেছে ওর বানানো একটা কেক।...' এটা আমার বানানো কেক,তোমাদের সবার জন‍্য। আর টেপির আনা পচা কেকটা মাসি আর আমি খাব। সবাই বকুনি দেয় পিয়ালদাকে,হাসিতে মুখর হয়ে ওঠে চারদিক। মহুল জড়িয়ে ধরে মাকে,কতদিন মায়ের গায়ের মিষ্টি গন্ধ পায়না।
                পিয়ালদা সত‍্যিই কাজের,সেই নষ্টালজিক লুচি আলুরদম,ছোলার ডাল,পায়েশ আর মিষ্টি দিয়ে হৈ হৈ করে জন্মদিনের ভোজ। মায়ের মুখের হাসিটাই বোধহয় মহুলের সবচেয়ে সেরা গিফ্ট। আর অনেকটাই হয়েছে পিয়ালদার জন‍্য। তবে আরো যে সারপ্রাইজ ছিল সেটা ভাবেনি মহুল।
     বারান্দার জমজমাট গানের লড়াইয়ে সবাই যখন মগ্ন। মমমাসি কানে কানে মহুলকে বলে, 'আমার ঐ পাজি ছেলেটাকে নিবি আপন করে? কতদিন আর ঘুর ঘুর করবে তোর পেছনে?'
       লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে মহুল। মমমাসিই সবাইকে থামায়,' শোন সবাই নীরবতাই সম্মতির লক্ষণ। মহুল একটু একটু রাজি মনে হচ্ছে,ওদিক থেকে মুচকি হাসে মা। ও তার মানে এটা একটা ষড়যন্ত্র!....' ওয়ান মিনিট মা,শেষে এমন একটা ঝগড়ুটে মেয়ে তোমার পছন্দ হল? তোমার ছেলেকে যদি বিগড়ে দেয়।'...' মহা পাজি ছেলে,সবসময় শুধু! এই আমি কি তেমন শিক্ষা দিয়েছি ছেলেকে? আর মহুল তো জানে ছেলেরা মায়েদের কষ্ট দিলে মায়েরা কত কষ্ট পায়।'... লাফ দিয়ে মায়ের গলাটা জড়িয়ে পিয়াল বলে,' 'নমস্তে মা জননী দ‍্য গ্ৰেট পলিটিশিয়ান।'
             ...' কিন্তু মমমাসি,ওকে বলো মায়ের জন্মদিনের লুচি ছোলারডালের দায়িত্বটা কিন্তু ওর শুধু তোমার জন্মদিনের রান্না করলেই হবেনা।'....মমমাসি কিছু বলার আগেই ,'ওকে ডান্' বলে মহুলের হাতে হাত রাখে পিয়াল।
          ....' কি নির্লজ্জ দেখেছিস,একবার আমার পারমিশনটাও নিলোনা! এক্বেবারে কথা দিয়ে দিলো!'
         জিভ কাটে পিয়ালদা। মহুলের দিকে তাকিয়ে দুষ্টুমি ভরা চোখে যেন বলতে চাইলো,' কি রে শেষে পড়লি তো প্রেমের ফাঁদে?'
         কিছু আনন্দ আর ছুঁয়ে যাওয়া অনুভূতির সাক্ষী হয়ে রইলো খোয়াই আর সোনাঝুরির জঙ্গল।

সমাপ্ত:-
          
        

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...