#মায়ের_নতুন_হাবি#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
'মা কোথায় গো দিদান?'
'এই একটু বাইরে গেলো তো,বলেছে একটু বাদেই আসবে। আমি তোর জন্য লুচি আর সাদা আলুর তরকারি করে রেখেছি তুই খেয়ে নে।'
মা জানে এই সময়টা আমি স্কুল থেকে ফিরি এখনো মা থাকতে পারেনা বাড়িতে। যাও আমি খাবোনা। আমার খিদে নেই।'....' এমন করেনা দিদিভাই,স্কুল থেকে এসে কি কেউ না খেয়ে থাকে? মধু এসেও খুব রাগ করবে তুই খাসনি শুনে।'
দিদানের কথাগুলো শুনতে ইচ্ছে করেনা রুমকির দিদা কি করে বুঝবে ওর কষ্টটা। বেশ তো ছিলো মা একদম ওর একার হয়ে। মাকে জড়িয়ে ধরে ভুলে যেত সব কষ্ট। মা আর বাবির কেন যে ঝগড়া হত ক্লাশ ফোরে পড়ার সময় অতটা বুঝতে পারেনি। শুধু মনে হত বাবা যেন শুধু শুধুই বকছে মাকে। অথচ একটা সময় বাবার ঘাড়ে পিঠে উঠে আর মায়ের কোলে চড়ে কি মজা করে কেটে যেত সময়গুলো। হাওয়ার বেলুন উড়িয়ে নিয়ে যেত রূপকথার দেশে এক নিমেষে। যখন যা চাইত বাবা কিনে দিত হাসিমুখে,মাকেও কি সুন্দর লাগত লাল শাড়ি আর গয়নায়। মায়ের কাছে এসে বলত,'মা এত মিষ্টি গন্ধ কোথা থেকে আসে গো?'..মিঠে হাসিতে রাঙানো মুখে মা বলত,'ওটা তো চন্দনের গন্ধ,তোর বাবা এনে দিয়েছে। একটু লাগিয়ে দিই তোর হাতে?'..'ওটা তোমাকে মাখলেই খুব ভালো লাগে,এই তো আমার গায়ে গন্ধ হয়ে গেছে। তুমি আমাকে জড়িয়ে আদর করো তাহলেই আমার গায়ে গন্ধ হয়ে যাবে।'...' একদম বাবার মত দুষ্টু হয়েছিস তাইনা?'..বলেই মায়ের মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে যেত।..'বাবাও দুষ্টু করছে মা?'..একটু হেসে মা বলত,'খুউব'।
ভালো দিন গুলো বোধহয় বেশিদিন থাকেনা। মাকে দেখতে খুব সুন্দর ছিল আর একদম কিউট কিউট। আঙ্কেলরা বাবাকে বলত,' সত্যি তুই লাকি,একদম ঘর আলো করে আছে বৌদি।'..বাবা তখন কিছু না বললেও বাড়ি এসে কেন যেন খুব রাগ করত বাবা। মাকে বলত,'অত হেসে হেসে সবার সাথে কথা বলার কি আছে শুনি। আমার বন্ধুগুলোও তেমন আদেখলা, মেয়ে দেখলেই হয়েছে। যত নজর আমার বৌয়ের দিকে।'...রুমকি একটু একটু করে বড় হতে হতেই সম্পর্কটা কেমন যেন বদলে গেছিল। বাবা ভালো কোন শাড়ি পরতে দিতে চাইতনা মাকে। বলত,' যা পরবে আমার জন্য সাজো,বাইরের সবাইকে দেখাতে হবেনা।'
মা বলত,'এত সন্দেহ বাতিক যখন তোমার তখন সুন্দরী বৌ বিয়ে করেছিলে কেন?তোমাদের বাড়ি থেকে বিয়ের তাড়ায় আমার গ্ৰাজুয়েশনটাও হয়নি। ভালো ছেলে বলে দিলো মা বাবা ঝুলিয়ে।'
....' তাই নাকি আমি ভালো ছেলে নই,আর কত ভালো ছেলে জুটতো তোমার শুনি?'...ফোঁস করে উঠতো মাও,' তোমার বয়েসটা দেখেছো একবার,বিয়ের এই দশবছরে আরো...। মায়ের কথা শেষ না হতেই বাবা ঝাপিয়ে পড়ে,' ও ঐ জন্যই কচি খোকাদের মন ভোলাও সেজেগুজে তাইনা।'...মা চেঁচিয়ে ওঠে,' একদম চোপ বাজে কথা আর বোলোনা,মেয়েটা উঠে যাবে। এই স্কুল থেকে এসে ঘুমিয়েছে।'..মায়ের কাতরে ওঠা কান্নায়,দুচোখে জল নিয়ে বালিশে মুখ ঢেকে ঘুমিয়ে পড়ত রুমকি। তখন না বুঝলেও এখন বোঝে শুধু একটা সন্দেহের বশে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিলো ওর হাতে আঁকা প্যাস্টেলে রঙ করা ছবিটা,মাঝখানে রুমকি সোনা আর দুপাশে বাবা আর মা।
সবটা না বুঝলেও বুঝেছিলো বাবার সাথে আর থাকতে পারেনি মা তাই ওর মনটা কান্না কান্না কথা বললেও কেউ শোনেনি ওর কথা। বাবাও বোঝেনি রাতে বাবার গায়ে পা তুলে না শুলে যে ওর ঘুম আসতো না। মা রুমকিকে নিয়ে চলে এসেছিলো ওর দিদানের বাড়ি। তারপর কত ঝামেলা হলো কিন্তু মা আর ফিরে যেতে চায়নি। বলেছিল যেখানে বিশ্বাস নেই সেখানে সংসার হয়না। রুমকির ভীষণ মন কেমন করত ওর নিজের ঘরটার জন্য,কে জানে টেডিগুলো কি করছে এখন। মা তো ওদেরকে আনতেই দিলোনা। এই বাড়িতে দাদু কিনে দিয়েছে অনেক বড় বড় টেডি,তবুও পুরোনো গোলু আর গুবলুর জন্য খুব মন কেমন করে।
দেখতে দেখতে তিনটে বছর কেটে গেছে, সবাই বলে ওর মা নাকি ডিভোর্সি। রুমকি প্রথমে বুঝতে পারতনা ডিভোর্সটা আবার কি,ওটা কি একটা ঢিসুম গুলি যেটা বাবা মাকে আলাদা করে দেয়? তবে এখন ক্লাস সেভেনে উঠে রুমকি অনেক কিছুই বোঝে। এখানে দিদানের বাড়িতে এসে মা আবার পড়াশোনা শুরু করেছে,দেখতে দেখতে মা কেমন যেন পাল্টে গেলো। মা এখন আর আগের মত লাল শাড়ি পরে চন্দনের গন্ধ মাখেনা। মায়ের লম্বা চুলগুলো এখন স্টেপস কাটে কাটা। কখনো শালোয়ার কুর্তি,জিন্স,স্কার্ট আর হিল পরে মা কলেজে যায়। গাঢ় লিপস্টিক আর আইলাইনারে মায়ের মায়া মাখানো চোখদুটো বড় মিস্ করে রুমকি,গায়ে খুঁজে পায়না সেই গন্ধটা। নাকে আসে বিদেশি পারফিউমের গন্ধ। ওকে আদর করে মা কলেজে বেড়িয়ে যায়। সেদিন পাড়ার বৃন্দামাসিকে বলতে শুনেছিল একটাকে ছেড়ে এসেছে আবার কোন ছেলের মাথা খাবে কে জানে।
ভীষণ রাগ হয়েছিলো রুমকির,ওর মাকে বাবাও এমন বলতো। মাকে সুন্দর দেখতে এটাই কি মায়ের অপরাধ?তাই বোধহয় সবাই এমন বলে। তবুও রুমকির মনে হলো মা এতটা না বদলালেই হয়ত পারত। এখন কেমন যেন অচেনা লাগে মাকে,সবসময় সাজগোজ আর ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকে। মধুজা কিছুটা বুঝতে পারে যে রুমকির রাগ জেদ কেন যেন একটু বাড়ছে। প্রায়ই শোনে ওর কলেজ থেকে ফিরতে দেরি হয় বলে বায়না করে খায়না।...সেদিন একটু বেশিই মাথা গরম হয়ে গিয়েছিলো ওর,' বাবার মতই হয়েছে,হবেনা বাপ কা বেটি বলে কথা। একজন আমার জীবনটা তছনছ করে দিলো আর এই মেয়েকে এত করেও মন পাইনা। আচ্ছা আমার কি নিজের কোন জীবন নেই?আমাকে এইভাবেই গলা টিপে রাখবে সবাই।'..মায়ের সেদিনের চেহারাটা কেমন যেন অন্য মায়ের মত লেগেছিল রুমকির। মা খুব কাঁদছিলো জোরে জোরে, ভয় পেয়েছিল রুমকি। দিদা এসে ওকে কাছে টেনে নিয়ে এসে বুঝিয়েছিলো মাকে। লাল হয়ে গিয়েছিলো মায়ের মুখটা মাথা ঝাঁকিয়ে বলেছিল মা,' অনেক হয়েছে,এবার আমি নিজের মত করে বাঁচবো।'
সত্যি বোধহয় মা বেশি নিজের কথাই ভাবতে শুরু করেছিলো। মাকে দেখতে ভালো লাগত রুমকির। কিন্তু যখন নতুন স্কুলের বন্ধুরা বলত,' তোর মা! ইশ আমরা তো ভেবেছি তোর দিদি।"খুব রাগ হত রুমকির কে জানে রাগ না হিংসে। ওর দিদানদের পাড়ায় থাকতো মিতুদি, ওকে পড়াতো। রুমকি একদিন মিতুদির জন্মদিনে গিয়ে ওর দাদাকে আঙ্কেল বলেছিলো। মিতুদি তো হেসেই কুটোপাটি,' ওরে রুমকি এটা আমার দাদা একটু বেশি তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গেছে এই যা কত বড় চাকরি করে!' হেসে ফেলে কুন্তলদা,' এই মিতু মার খাবি,এই যে রুমকিসোনা আমাকে তুই দাদাই বলিস। কাকা হতে এত তাড়াতাড়ি ইচ্ছে নেই রে।'...একটু রাত্রি হয়েছিলো খাওয়াদাওয়া সারতে তাই কুন্তলদা আর মিতুদি এসে পৌঁছে দিয়েছিল ওকে বাড়িতে। তারপর মাঝে মাঝেই কুন্তলদার সাথে রাস্তায় দেখা হত,স্কুল যাওয়ার পথে।
তারপরে কেটে গেছে বেশ কিছুদিন হঠাৎই শুনলো মিতুদির বিয়ে। মিতুদির বিয়েতে রুমকি ওর মায়ের সাথে গিয়েছিলো। ও জানতোই না কুন্তলদার সাথে মায়ের আলাপ আছে। পরে শুনলো কুন্তলদার কাছে মা মাঝে মাঝে কলেজের নোটসও নেয়। মিতুদি অবশ্য প্রায়ই বলত দাদা কলেজের ছাত্র পড়ায় অফিসের পর।
মাকে খুব সুন্দর লাগছিলো লাল জরির পাড়ের নীল শাড়িতে আর কি সুন্দর হার পরেছিলো গলায় মা। কেন যেন রুমকির মনে হলো মাকে সবাই দেখছে,ওকে কেউ দেখছেনা। মিতুদির বিয়ে দেখে ফেরার পথে বেশ রাত হলো,কুন্তলদা ওদের পৌঁছে দিলো। গাড়ি স্টার্ট দিয়েই গানটা চালিয়ে দেয়..'ও কেন এত সুন্দরী হলো?দেখে যে আমি মুগ্ধ হলাম।' কুন্তলদা একঝলক মায়ের দিকে তাকালো,মা রাঙামুখে মাথা নিচু করলো।
রুমকি ক্লাশ এইটে এখন,বন্ধুদের কাছে শোনে অনেক পাকা পাকা কথা। হঠাৎই একদিন ক্লাশ টেনের পিউদি এসে বলে গেলো,'তোর মা তো...কি আর বলবো। শেষে কুন্তলদা! ইশ্ তোর যে কি হবে!'..ছোট ছোট টুকরো কথাগুলো অনেক কথা বলে গেলো রুমকিকে। ওর বুকটা যন্ত্রণায় টনটন করে উঠলো। মা একটুও ভাবলোনা ওর কথা,বাবা দূরে চলে গেছে। মা ওর সবটুকু ছিলো, এখন কোথায় যাবে ও? অদ্ভুত এক নিরাপত্তাহীনতায় একদলা কান্না বুকে চেপে আজ রুমকি দাদুর কিনে দেওয়া নতুন টেডিটাকে জড়িয়ে কান্নায় ভেজালো। অথচ কাউকে বলতে পারলোনা ওর ছোট্ট মনের জানলা দিয়ে আজ বাদলা হাওয়ার ঝাপটা ঢুকে সব এলোমেলো করে দিয়েছে।
এর মাঝে অনেক ঝড় বয়ে গেলো।পিউদি ঠিকই বলেছিলো,ও শুনলো মা কুন্তলদাকে বিয়ে করতে চায়। মিতুদিদের বাড়ি থেকে অনেক বাধা এলো। রুমকির এলোমেলো মনে ঝোড়ো বাতাস বয়ে গেলো তবুও মধুজা,রুমকির মা চাইলো আরেকবার নিজের মত ভালো করে বাঁচতে,কুন্তল যদিও ওর থেকে বয়েসে একটু ছোট কিন্তু কুন্তলের হাতে হাত দিয়ে মধুজা সাহস পায়,নির্ভর করে, সবকিছু ছেড়ে আবার মনে হয় ডুব দিতে ইচ্ছে করে ভালোবাসার গহীন গাঙে,ভেসে যেতে ইচ্ছে করে কুন্তলের প্রেমে।
বাড়ির লোকের আপত্তির জন্য কুন্তল মধুজাকে নিয়ে গেলো ওর ইনোভাতে করে সোজা জয়ন্তীতে। ভারী চাকার শব্দে কিছুটা রক্ত ঝলকে উঠলো রুমকির বুকে। মধুজা রুমকিকে অনেক বোঝাতে চেয়েছিলো,ওর অনুমতি চেয়েছিলো। না না রুমকি অত ভালো মেয়ে হতে পারেনি শুধু চিৎকার করে বলেছিলো,' তোমরা সবাই শুধু নিজের কথা ভাবো,আনন্দ খোঁজো। লিভ মি আ্যলোন,যাও যেখানে খুশি।'...কান্না চেপে মধুজা মা বাবাকে প্রণাম করে বেড়িয়ে গিয়েছিলো। কুন্তলের ঘাড়ে মাথা রেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলো মধুজা।' মধু এটা তো নরমাল,একটা এই বয়সের মেয়ে মায়ের বিয়ে দেখবে ভাবতে পারো কতটা মানসিক চাপ হতে পারে ওর! আমরা সবসময় আমাদের দিকটা ভাবছি,ওর কথাটাও একটু ভাবো। ওর বন্ধুবান্ধব ওকে কি বলবে,তাছাড়া তোমাকে দেখবে আবার অন্যরূপে এমন একজনের সাথে যে ওর বাবা নয়। একটু সময় দাও ওর এলোমেলো পৃথিবীটাকে সাজিয়ে নিতে। একটু ধৈর্য রাখতেই হবে আমাদের।
ওদের বিয়েটা হলো কয়েকজন বন্ধুদের সামনে ওখানেই মধুজা আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখলো কুন্তলের সাথে হাতধরে একমুঠো ভালোবাসা মেখে পথের ক্লান্তি ভুলে যেতে। জয়ন্তীর জঙ্গলের ময়ূরের আর পাখির ডাক শুনতে শুনতে মধুজা নির্ভরতার স্বপ্নের জাল বুনলো কুন্তলের বাহুবন্ধনে। কোথা দিয়ে কেটে গেল তিনটে দিন,স্বপ্ন দেখতে বড় ভালো লাগে মধুর। কে জানে আবার যেন টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে যাবেনা তো স্বপ্নের রঙিন কাঁচটা। মনে হচ্ছে ভালোই হত যদি অনন্তকাল এখানে কাটিয়ে দেওয়া যেত। কুন্তলকে সেকথা বলতেই ও বললো,'তোমার নেশা হয়েছে মধু। নাকি ভয় পাচ্ছো আমাদের মেয়ের সামনে দাঁড়াতে?'...কুন্তলের পরের কথাটাই তো ঠিক,সত্যিই মধু ভয় পাচ্ছে রুমকির সামনে দাঁড়াতে,ওর চোখে চোখ রাখতে। তবে কুন্তলের আমাদের মেয়ে কথাটা শুনে অদ্ভুত একটা শান্তি হল মধুর। দেখতে দেখতে ওদের ফেরার দিন এলো।
....' দিদিভাই কি অবস্থা করেছিস বলতো ঘরটার,আমাকে তো ঢুকতেই দিতে চাসনা। কাল তো তোর মা আসবে দে একটু পরিস্কার করে দিই।'..চিৎকার করে ওঠে রুমকি,'এটা আমার ঘর এখানে কেউ ঢুকবেনা।'..'তাই নাকি,তোর মাকেও ঢুকতে দিবিনা,কাল এসেই তো ঢুকবে।'..'এখানে কেন আসবে,বিয়ে করেছে হাবির বাড়িতে থাকুক গিয়ে।'..'এসব আবার কি কথা,হাবিটা আবার কি?'...'আমার ভালো লাগছেনা দিদান তুমি যাও।'
রুমকি না জানলেও ওর দিদান জানে কুন্তলদের বাড়িতে মধুকে মেনে নেয়নি। ওর মা পরিস্কার বলে দিয়েছে ,'আর মেয়ে জুটলোনা তোর,শেষে অতবড় মেয়ের মা একটা বুড়ি মেয়ে। হায় হায় শেষে আমারই ঘর ভাঙলো!'...কুন্তল শুধু বলেছিলো,'ওকে আমি ভালোবেসেছি মা, মধু ভালো মেয়ে একবার দেখো কাছ থেকে। ঠিক আছে আমি জোর করবোনা।'..কথাই হয়েছিলো ওদের কুন্তলও মা বাবাকে কষ্ট দেবেনা। আর মধু রুমকিকে তাই মধু এইবাড়িতে আর কুন্তল ঐ বাড়িতে। কেঁদেছিল মধু,'তাহলে আমায় বিয়ে করছো কেন?'..'করছি এই জন্য যাতে তোমাকে আর কোন খারাপ কথা শুনতে না হয়। কতটুকু দূরেই বা আমাদের বাড়ি,আমি আসবো প্রতিদিন তোমার কাছে। রুমকির কথাও তো ভাবতে হবে আমাদের ও বড় হচ্ছে।'
বাইরে গাড়ির আওয়াজ পায় রুমকি,অভিমানে দরজাটা ভিজিয়ে দেয়। কিছুদিন আগেই শুনেছে বাবাও বিয়ে করেছে,আবার মাও বিয়ে করলো। ওর কথা কেউ ভাবলোনা!..মায়ের বিয়ে,আর পারছেনা ও। বাড়িতে ঢুকেই দৌড়ে রুমকির ঘরের দিকে যায় মধু,মেয়েটা দরজা বন্ধ করে রেখেছে কেন!উল্টো হয়ে শুয়ে আছে টেডিটার গায়ে রুমকি।'একটু কথা বল সোনা,আমাকে ভুল বুঝিসনা,একটু কাছে আয় আমার।"মায়ের হাতটা সরিয়ে দেয় রুমকি। তবুও জোর করে টেনে নেয় মধু ওকে,মায়ের দিকে তাকাতে ইচ্ছে করেনা হয়ত একমাথা সিঁদুর পরে বৌ সেজে এসেছে। তবুও হঠাৎই নজর পরে যায় ওর,মাকে তো একদম আগের মতই লাগছে। ' আমি শুধু তোর মা রুমু,তোকে ছেড়ে কোথাও যাবোনা। শুধু আমাদের মধ্যে একটা নতুন বন্ধু এলো,আমার তো কোন বন্ধু ছিলনা তুই ছাড়া।' মধুজা কথা বলে যায়,রুমকি কিছু বলেনা দুজনেই কাঁদছে অভিমানে। কুন্তল আসেনি মা মেয়ের মাঝে,ও চলে গেছে ওদের বাড়িতে। মেয়েকে বুকের কাছে টেনে ঘুমিয়ে পড়ে মধু।
কুন্তলকে বাড়ি আর মধুকে ব্যালেন্স করে চলতে হয়,সত্যি বোধহয় এমন ছেলে হয়না। মধু একটা ছোট চাকরি পেয়েছে,কুন্তলই পৌঁছে দিয়ে অফিসে চলে যায়। রুমকি স্কুল থেকে এসে পড়তে গেলে কুন্তল কিছুটা সময় কাটিয়ে যায় মধুজার সাথে এইভাবেই চলে ওদের লুকোচুরি প্রেম। রুমকি বোঝে কুন্তল আসে প্রতিদিনই তবে রাতে থাকেনা এই বাড়িতে। দিদানকে একদিন রাগ করে বলেই ফেললো,'ঐ লোকটার আনা খাবার আমার জন্য রাখবেনা,ফেলে দাও ঐ চকলেটগুলো।'...' লোকটা আবার কি কথা রে দিদিভাই!'..'তো কি বলবো কুন্তলদা,ঐ তো আমাকে বলেছিলো কুন্তলদা বলতে। নাকি মায়ের হাবি বলবো?'...হঠাৎই শুনতে পায়,'কুন্তলদাই বলিস তোর ইচ্ছে হলে, তবুও মাঝে মাঝে কথা বলিস। তোর মুখের আগের হাসিটা খুব মিস্ করি। আগে মিতুর সাথে আমাদের বাড়ি গিয়ে কত হাসতিস।'..কিছু উত্তর দিতে ইচ্ছে করেনা রুমকির ঘরে ঢুকে যায়। কুন্তল আর মধু অনেক চেষ্টা করেও কিছুতেই ওর সাথে ভাব করাতে পারেনা রুমকির।
দেখতে দেখতে কেটে গেছে প্রায় একটা বছর। সেদিন স্কুল থেকে ফিরে দেখে মা তাড়াতাড়ি ফিরেছে,দিদার কথা শুনতে পায়,'তোর শরীরটা খারাপ কদিন দেখছি,ছেলেপুলে হবে নাকি রে? একটা হলেই ভালো তাহলে কুন্তলের মা হয়ত তোকে মেনে নেবে।'...মাথাটা কেমন টলে ওঠে রুমকির এখন ওর ভাইবোন হবে!এমনিতেই তো কত কি ঝড় বয়ে যাচ্ছে মনের ওপর দিয়ে।হঠাৎই শুনতে পায়,'কি বলছো মা, তোমার কি হল বলতো?আমার কি ছেলে মেয়ে নেই?তাহলে রুমকি কি?ও এখন বড় হয়েছে মা একটু ভেবো। কুন্তল চায়না আর কেউ আসুক।'..নড়তে পারেনা ওখান থেকে রুমকি। এমনও হয়!' ওর জন্য ভেবে কুন্তলদা বাবা হতে চাইছেনা! তাতে কি হয়েছে তবুও ওর ভালো লাগেনা কাউকে। নিজের জীবনে নিজের মত থাকবে ও।
রুমকির এখন টেন,অনেক জায়গায় পড়তে যেতে হয়,মা আনতে চাইলেও ও কিছুতেই রাজি হয়না। অন্য বন্ধুর মায়েরা হাসাহাসি করবে, বাঁকা চোখে তাকাবে। আজকাল মাকে মা বলতেও ইচ্ছা করেনা ওর। ওখানেই আলাপ হয়ে যায় ঋকের সাথে, ঋক টুয়েলভে পড়ে। দারুণ স্মার্ট,ওরা খুব বড়লোক। প্রতিদিন গাড়ি করে আসে। ঋক ড্রাইভ করে, বাইক চালায় আর তেমন স্মার্ট। রুমকির কিশোরী মনে নাড়া দিয়ে যায়,ওর ইচ্ছে করে ঋকের বাইকের পেছনে করে দিক হারাতে। আজকাল পড়াতেও মন বসেনা রুমকির,সবসময় চোখ ফোনের দিকে। মায়ের সাথে কিছুতেই শুতে চায়না। মধুরও খুব অভিমান হয় কুন্তলকে বলে,' ওর জন্য তুমি থাকোনা,ও আমার কাছে শুতে চায়না। আমাকে সবাই একা করে দাও।'....'মেয়ে আমাদের বড় হচ্ছে মধু একটু বোঝো ওকে নজর রেখো,ওর সাথে থেকো।'...'থাকতে দিলে তো থাকবো?যা খুশি করুক,ও তো আমাকে সহ্যই করতে পারেনা।'
...'আচ্ছা আমি দেখছি। রুমকি কাছাকাছিতেই পড়তে যায়। তবুও আজকাল কুন্তল মাঝে মাঝে অফিসের পর একটু দূর থেকে নজর রাখে। ওর টিউশনগুলো সকালে রেখেছে।
কয়েকদিনেই কিছুটা বুঝতে পারে। ঋক ছেলেটাকে একটু চোখে চোখে রাখে,হঠাৎই একদিন কানে আসে ও বন্ধুদের বলছে,'ধ্যাৎ ওই রকম বেবিটাইপের মেয়ে আমার চলে নাকি?দেখলাম বাচ্চা মেয়ে,কিন্তু খুব হট আর সেক্সি ঐ একটু মজা করে নেবো।'...কুন্তলের মনে হচ্ছিলো তখনই একটা চড় লাগায় ছেলেটার গালে। মধুজাকে বলে ব্যাপারটা,' একটু বোঝাও মেয়েকে বন্ধুর মত।'..অস্থির লাগে মধুর কিভাবে যে মেয়েটা এমন পাল্টে গেলো মায়ের কথা শুনে চিৎকার করে ওঠে রুমকি,'সবাই নিজের ইচ্ছেমত বাঁচবে প্রেম করে বেড়াবে,আর আমি করলেই দোষ। আমি বড় হয়েছি,আর কতদিন ছোট করে রাখবে আমায়!'বড় অচেনা লাগে রুমকিকে মধুর। এমন ভাবেই চলতে থাকে। একদিন রুমকি চিৎকার করতে থাকে,' নতুন হাবিকে লাগিয়েছো আমার পেছনে তাইনা?'...কয়েকদিন বাদে মধুজা কান্নায় ভেঙে পড়ে,'রুমকি এখনো ফেরেনি আমি কিছু বুঝতে পারছিনা কি করবো,খোঁজ নিচ্ছি।'..' আমি দেখছি এদিকে একটু সময় দাও।'..নজর রাখতে গিয়ে দুএকজনকে চিনে ফেলেছিলো কুন্তল তাদের একজনকে পুলিশের ভয় দেখিয়ে জানতে পারে কোথায় গেছে ওরা কয়েকজন বন্ধুর সাথে আর দেরি না করে গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পরে ও।
কথা ছিল ঋকের সাথে একা যাবে ও,কিন্তু এরা কারা আরো দুজন ছেলেকে দেখে ওর সাথে। একটু ভয় করে রুমকির গাড়ীর পেছনের সিটে বসে আঁকড়ে থাকে ঋককে, ঋক হাত বোলাতে থাকে ওর গায়ে। চাপ দেয় বুকে,সামনের ছেলেদুটো হাসে তাকায় লোলুপ দৃষ্টিতে। রুমকি নিজেকে একটু দূরে সরাতে চায় কিন্তু পারেনা,ঋক ততক্ষণে ওকে আষ্টেপৃষ্টে চেপে ধরেছে। কিছুক্ষণ বাদে ওরা গাড়িটা সাইড করতে যায়। রুমকি জানতে চায় এখানে কেন ওরা?ওরা বলে,' তুইই তো আসতে চেয়েছিলি লঙ ড্রাইভে।' ভয় হয় ওর,বেশিই সাহস দেখিয়ে ফেলেছে। কি করবে ভেবে পায়না,হয়ত আরও একটু দেরি হলে অনেক কিছুই হতে পারত তবে ততক্ষণে কুন্তল পুলিশের সাহায্য নিয়ে পোঁছে গেছে ওদের কাছে। রুমকির গালে কষে একটা চড় মারে কুন্তল,'এতটা বেয়ারা হয়েছিস তুই!যা খুশি তাই করবি। আমরা কি মরে গেছি?'...গালটা টনটন করলেও কিছু বলতে পারেনা রুমকি। সত্যি আজ কি যে হত!এরপর কোথায় যেত ও?'ততক্ষণে পুলিশ ছেলেগুলোকে ধরেছে। ওর জন্য কুন্তলকে অনেক কথা শুনতে হলো।'
.....সারা রাস্তা আর কোন কথা বলেনি রুমকি। বাড়িতে এসে আজ মায়ের কান্নাভেজা মুখটা দেখে খুব মায়া হয় ওর। সত্যিই তো ওকে সবাই কত ভালোবাসে। হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে মা ওকে জড়িয়ে। কুন্তল বলে,'ওকে জিজ্ঞেস করো,যদি আমাকে নিয়ে ওর সমস্যা থাকে আমি আর আসবোনা এখানে। তোমরা ভালো থেকো।'..
কুন্তল বেড়িয়ে যায়,মধু ডাকলেও পেছন ফেরেনা। রুমকির গলাটা আটকে যায় বলতে ইচ্ছে করে,'কুন্তলদা যেয়োনা,আমি আর মা একা হয়ে যাবো।'সারারাত ভালো করে ঘুম হয়না রুমকির শুধু মনে হয় আজ ওর বাবা থাকলে হয়ত এমন করেই একটা চড় মারত গালে। দিদান বলে যে শাসন করে সেই সোহাগ করে। তাহলে কি মা আর কুন্তলদা ওকে সত্যিই ভালোবাসে?
পরেরদিন জানতে পারে মধুজা কুন্তলের খুব জ্বর বড্ড মনটা ছটফট করে,কিন্তু ঐ বাড়িতে ঢোকা মধুর বারণ। অথচ কি করবে ভেবে পায়না,তবুও চিন্তা করে একবার চোখের দেখা দেখতে যাবে যদি ওরা অপমান করে করবে। মাকে বড় এলোমেলো লাগে রুমকির,এত রকম চিন্তায় কয়েকদিনে মা যেন কেমন হয়ে গেছে।
....'মা একটু এসোনা,চটিটা পরে নাও।'আজ যত্নে মায়ের হাতটা ধরে রুমকি মধুজার কোন কথা না শুনে সোজা চলে যায় কুন্তলদের বাড়ি।....দরজা আটকায় কুন্তলের মা,'তোরা এখানে কি করছিস?বেরিয়ে যা। আজ কোনদিকে তাকায়না রুমকি,' মা চলে এসো ভয় কি আমরা তো বাবার কাছে যাচ্ছি,দেখি কে আমায় আটকায়?'।অবাক হয়ে মেয়ের মুখের দিকে তাকায় মধুজা বুঝতে পারে ও আর একা নয়। জ্বরের তাপে উষ্ণ কুন্তলের কপাল ছুঁয়ে যায় রুমকির শীতল হাতটা,'এই তো আমরা,তুমি তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে ওঠো,রাগ কোরনা কুন্তলদা।'...বাবা বলতে পারেনা রুমকি,খুব ইচ্ছে করলেও গলার কাছটায় বাবা ডাকটা এসেও আটকে যায়। মলিন হাল্কা হাসি ছুঁয়ে যায় কুন্তলকে,'যাক তবুও তো মেয়েটা আমার সাথে কথা বললো মধু।'
কুন্তলকে দাদা থেকে বাবা করতে একটু সময় লেগেছিলো রুমকির তবুও সবসময় মনে হত বোধহয় এই মানুষটাকেই বাবা বলা যায়,যে অপরের সন্তানকে নিজের মেয়ে বলে মেনেছে হয়ত বা সেইজন্যই কোনদিনই বাবা হতে চায়নি।
সামনে রুমকির জন্মদিন,শপিং মলের ট্রায়ালরুমে রুমকি তিনটে ড্রেস নিয়ে ঢুকেছে। মধুজা বাইরে দাঁড়িয়ে,'রুমু হলো তোর? দেখি একবার।'....দরজাটা একটু খোলে রুমকি,'বাবা কোথায়? বাবাকে ডাকো,আগে বাবা বলবে চলবে কিনা।'....মধুজা কিছু বলার আগেই কুন্তল এগিয়ে এসে বলে,'চলবে মানে,দৌড়াবে বিটিয়া রানী।'
মধুজা,কুন্তল আর রুমকি তিনজন আবার আবদ্ধ হলো এক নতুন বৃত্তে যার নাম হাসিখুশি এক সুখী পরিবার। চন্দনের গন্ধ আর ঢাকাই শাড়িতে মধুজা আবার সাজলো বৌদের মত,অনেকদিন বাদে হারিয়ে যাওয়া মা মা গন্ধটা আবার ফিরে পেলো রুমকি। সুখের ঘরের চাবিটা আজ পকেট থেকে বের করে মধুজার আঁচলে যত্নে বেঁধে দিয়েছে কুন্তল।
সমাপ্ত:-
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment