#মেকআপ#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
'ঐ শাড়িটা একটু দেখাননা,ঐ যে লালের ওপর টিপটিপ দেওয়া।'
..'ওটা তো ডিজাইনার বেনারসি,আপনি বললেন যে আপনাদের বাজেট কম। ওটা দশ হাজারের ওপরে।'
চোখটা ফিরিয়ে নেয় শিল্পা,সত্যিই তো ওদের বাজেট কম। কোথায় পাবে এত দামি শাড়ি কেনার টাকা। বিয়েটা হচ্ছে এই অনেক। পার্লারে কাজ করে আর কত টাকা পাওয়া যায়। বাবার তেমন কিছু আয় নেই তারপর এখনো আরেকটা বোন আছে বিয়ে দিতে।
হঠাৎই রঞ্জনের সাথে আলাপ হয়ে গিয়েছিলো। রঞ্জন মোটামুটি একটা চাকরি করে তবে ওদের বাড়ির অবস্থা ভালোই। কিন্তু যা হয় শাশুড়ি পরিস্কার জানিয়ে দিয়েছিলেন,' ঐ মেয়েকে বিয়ে করলে এই বাড়িতে জায়গা হবেনা। ইশ্ বিউটি পার্লারে সারাদিন লোকের পা ঘষছে মুখ ঘষছে আরো কত কি করছে। চাকরি ছেড়ে যদি বাড়িতে ঘরের বৌয়ের মত থাকতে পারে তবুও দেখা যাবে একরকম ভেবে। তাছাড়া তোরই বা কয় টাকা ইনকাম যে বিয়ের জন্য লাফাচ্ছিস।'
অনেক কষ্টে গলায় জোর এনে রঞ্জন বলেছিলো,'ওদের বাড়ি থেকে চাপ দিচ্ছে বিয়ে করার জন্য। আমাদের অনেকদিনের সম্পর্ক।'...'তা তো দেবেই থাকে তো ঐ ভাঙা ঘরে আকাশের চাঁদ ধরার ইচ্ছে আরকি।'
শিল্পাকে ফেলতে চাইলেও ঘরে নিতে হয়েছিলো ওর শাশুড়িকে একটু চাপে পড়েছিলো রঞ্জনও ওদের পাড়ার ছেলেরা বলেছিলো এতদিন ধরে ঘুরলে আমাদের পাড়ার মেয়ের সাথে তারপর বিয়ের পর বাপের বাড়ি ফেলে রেখে যাবে তা হবেনা। হয় বাড়িতে নিয়ে যাবে নাহলে আলাদা বাড়ি ভাড়া করে থাকো কোথাও। তখন সে ক্ষমতা রঞ্জনের ছিলোনা।
সত্যি কি সমস্যায় পড়েছে,আসলে প্রেম করতে গিয়ে যে এভাবে ঝামেলা পোহাতে হবে বুঝতেই পারেনি। মেট্রোতে যাতায়াতের পথে আলাপ হয়েছিলো শিল্পার সাথে,এখনকার মেয়েদের মতই শিল্পা বেশ স্টাইলিশ। আসলে তখন ওদের বাড়ির সবটা জানতোনা রঞ্জন। শিল্পা ভালোবেসেছিলো ওকে মনপ্রাণ দিয়ে। স্বপ্ন দেখেছিলো ঘর বাঁধার। রঞ্জন একটু এড়িয়ে গিয়েছিলো প্রথমে কম রোজগারের কথা বলে। শিল্পা বলেছিলো,'আমিও তো কিছু করি,ঠিক চলে যাবে দেখো।'...'ঠিক আছে আমায় কিছুদিন সময় দাও,একটু গুছিয়ে নি তারপর।'
একটু একটু করে ওদের ঘনিষ্ঠতা বাড়ছিলো। শিল্পা প্রথমে বাধা দিয়েছিলো,'এখন না আগে বিয়েটা হোক তারপর। আমিও খুব চেষ্টা করছি ট্রেনিং নিচ্ছি যদি ভালো করে কাজ শিখতে পারি তাহলে একটা নিজের মত করে কিছু করার ইচ্ছে আছে।'...'টাকা কোথায় পাবে এতো?'...'দেখিনা,এখন তো অনেক লোন দিচ্ছে সরকার যদি একটা কিছু পাওয়া যায়।'...আনন্দের স্বপ্নে চোখদুটো চকচক করে শিল্পার। রঞ্জন কাছে আসে হাতে হাত রাখে,' তখন আমার বিউটিশিয়ান বৌ আমাকে ভুলে যাবেনা তো?'..'শুধু বাজে কথা যতসব।'
টুকরো টুকরো কথা আর ছোঁয়ায় কাছাকাছি এসেছিলো দুজনেই। রঞ্জন বলতো,'তুমি কিন্তু ভীষণ হট আর সেক্সি'..'তোমরা ছেলেরা বোধহয় শুধু ওটাই বোঝো তাইনা?'...মুখে বললেও ওতেই গলে যেত শিল্পা আর একটু একটু করে এগিয়েছিলো রঞ্জন তাই টুকরো ছোঁয়াটা যখন গভীর হয়েছিলো বাধা দিতে পারেনি শিল্পা। রঞ্জনের আদরে আদরে ভিজে যাওয়া শিল্পা স্বপ্ন দেখতো তার একটা সুন্দর সংসার হবে,স্বামী সন্তান নিয়ে সুখে থাকবে সেখানে।
এই করেই কেটে গিয়েছিলো বেশ কিছুদিন একদিন হঠাৎ শিল্পা বলেছিলো,'তুমি বলেছিলে অপেক্ষা করতে অনেকদিন তো হলো। আমার ট্রেনিংটাও শেষ। এবার বাড়িতে বলো আমাদের বিয়ের কথা।'...' আমার চাকরিটাও তো এখনও নড়বড়ে,চেষ্টা করছি একটা বিজনেস করার। ব্যবস্থা হচ্ছে,একটা লাইন করেছি। তাহলে আর ভাবতে হবেনা।'...'কত দেরি হবে তাহলে?'..'কত আর এই ধরো ছয়মাস মত।'...' না তাহলে দেরি হয়ে যাবে।'..'কেন দেখতে দেখতে কেটে যাবে।'
রঞ্জনের বুকে মাথা রাখে শিল্পা,'অতটা দেরি করা যাবেনা,আমি কনসিভ করেছি।'..'সে কি তুমি কোন ব্যবস্থা নাওনি,আমি তো বলেছিলাম। আচ্ছা ঠিক আছে একবেলার তো ব্যাপার।'
কিছুতেই রাজি করানো গেলনা শিল্পাকে। চাপ আসতে লাগলো ওদের বাড়ি থেকে। ওর দাদাও চাপ দিলো কয়েকজন বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে। তাই বাধ্য হলো রঞ্জন শিল্পাকে বিয়ে করতে।
শিল্পার বিয়ে হলো কিন্তু স্বপ্নের কণাটুকুও পূর্ণ হলোনা। ভালো বেনারসি পরে বিয়ে করাটা স্বপ্নই রয়ে গেলো। শ্বশুরবাড়ি থেকেও এলো এমন কিছু জামাকাপড় যা কাউকে বড় মুখ করে দেখানো যায়না। শাশুড়িমা মুখ ব্যাকালেন,'বস্তির মেয়ে কিরকম আমার ছেলেটাকে পটিয়ে বড় ঘরের বৌ হয়ে বসলো। জায়ের আর শাশুড়ির কথা অগ্ৰাহ্য করেও শিল্পা বন্ধ করলোনা ওর পার্লারের কাজ। দু মাস পরেই জানা গেলো ও মা হতে চলেছে। শাশুড়ি বললো,' এত তাড়াতাড়ি সব হয় কি করে? তোমার কয় মাস হলো এখন?'..সব সত্যি কি চেপে রাখা যায়,তাই বাড়িতে ছি ছি পড়ে গেলো। ওহ্ তাই এত বিয়ের জন্য তাড়াহুড়ো,একেবারে তৈরি মেয়ে। তবে শাশুড়িমা এটাও বলে ফেললেন,'আমার তো চিন্তা বাচ্চাটা আবার আমার ছেলের কিনা?'
মনে অনেক উত্তর এলেও শাশুড়ির মুখে মুখে কথা বলে বাড়িটা ছাড়তে সাহস হলোনা শিল্পার। রাতে রঞ্জনকে বললো,'বাড়িতে বোলো বাচ্চাটা তোমারই,মা যেভাবে বললো আমাকে। যেন আমি অন্য কারো বাচ্চা নিয়ে এসেছি পেটে করে।'..পাশ ফিরে শোয় রঞ্জন।'কি গো কি হলো?'..'এইজন্যই তো বলেছিলাম আ্যবরসন করে নাও।'চোখটা ছলছল করে ওঠে শিল্পার লোকে একটা বাচ্চা পায়না আর নিজেদের শখ মেটাতে গিয়ে প্রাণ নেবে ঐ নিরীহ ছোট প্রাণটার।
সংসারের কাজের দায়িত্ব বেশিরভাগই শিল্পার ওপর কারণ বেশিরভাগ সময় নাকি ও বাড়িতেই থাকেনা। তাই থাকলেই সারাক্ষণ কাজ আর কাজ। তার মাঝে অনেক সময়ই শাশুড়ি আর জায়ের পেডিকিউর আর ফেসিয়াল করে দিতে হয়। তবুও জা মুখ বেকিয়ে বলে,'মা ও নাকি পার্লার খুলবে?এখনো তো হাতই সেট হয়নি ওর। তাই তো মাঝে মাঝে ওর কাছে করি যাতে ওর হাত ঠিক হয়।'...'কি বলছো দিভাই,পার্লারে কাস্টমাররা তো আমাকেই খোঁজে মাসাজের জন্য।' সত্যি মানুষ বোধহয় এমনি হয় সুযোগ পেলে খাটিয়ে নেয় আবার বদনামও করতে ছাড়েনা। পূজোর সময় জা একটা বাতিল করা শাড়ি দিয়ে বলেছিলো,'কয়েকবার ফেসিয়াল করেছি তাই আলাদা করে দিলাম। একদম ডিজাইনার শাড়ি।'
মা হলো শিল্পা মেয়ের জন্ম দিলো। ' আর কিই বা হত,এখন সামলাও সব ঝামেলা। বিয়ের সাতমাস হতে না হতেই বাচ্চা। লোকেই বা কি বলে।'..ছি ছি করলো শাশুড়ি। বেশ কিছুদিন আর পার্লারে যাওয়া হলোনা শিল্পার। ওর বাচ্চার দায়িত্ব কেউ নেবেনা। ..'কি গো আমি কি আর বেরোবোনা,ঐটুকুই তো আমার হাত খরচ ছিলো।'...'কিছু করার নেই ঐ জন্যই বলেছিলাম এখনই ঝামেলা কোরোনা,শুনলেনা। একটু অপেক্ষা করো আমার ব্যাবসাটা হয়ে যাবে তবে তোমাকে সাহায্য করতে হবে একটু।'...অবাক হয় শিল্পা,'আমি কোথা থেকে সাহায্য করবো,আমার টাকা পয়সা কি আছে?'..'না না তেমন কিছুনা ঐ একটু কথা বার্তা বলবে পার্টির সাথে তাহলেই হবে। তুমি তো সুন্দর গুছিয়ে কথা বলতে পারো।'
রঞ্জনকে বোধহয় ঠিকমত চিনতে পারেনি শিল্পা নিজের ব্যাবসার উন্নতির জন্য ওকে ঠেলে দিতে চেয়েছিলো ক্লায়েন্টদের কাছে।কোনমতে নিজেকে বাঁচিয়ে ফিরে এসেছিলো শিল্পা। রুখে দাঁড়িয়েছিলো,'ছিঃ এই তুমি আমার স্বামী!নিজের বৌকে এভাবে ব্যবহার করতে লজ্জা হলোনা তোমার।'...'কি লজ্জা,তোমার উচিত ছিলোনা স্বামীর পাশে দাঁড়ানো। কতটা ক্ষতি করলে তুমি জানো? ঐ বিউটি পার্লারে কি কাজ করো তা আমি জানি। কয় টাকা মাইনে পাও ওখানে?'..'যা পাই তা অনেক সৎভাবে রোজগার করি। আমি মাকে বলবো সব কথা।'
লাভ হয়নি কিছু,শাশুড়িও পক্ষ নিয়েছিলেন ছেলের। শ্বশুরমশাই কিছু বলেননি।
রঞ্জনের অত্যাচার বেড়েছিলো,নেশা করে এসে মারধোর করা আর শিল্পাকে জোর করা হোটেলে যেতে। বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলো শিল্পা মেয়েকে নিয়ে। ওরা আটকায়নি,শুধু রঞ্জন বলেছিলো,'এখানে পোষালোনা এরপর তো ঐ কাজই করবে। দেখবো কত সুখে থাকো তুমি।'
রঞ্জন আর খোঁজ নেয়নি শিল্পার ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলো নিজের কাজ নিয়ে মেতেছিলো ওপরে ওঠার সিঁড়ি বাইতে। শিল্পা বাপের বাড়িতে উঠেছিলো,ওদের বাড়িটা ভেঙে ফেলায় ওরা অন্য জায়গায় উঠে গিয়েছিলো। অনেক কষ্টে দিনরাত পরিশ্রম করে রোজগার করত। সারাদিন কাজ করে হাতদুটো আর চলতে চাইতোনা। সৎ পথে থেকে শিল্পা এগিয়েছিলো একটু একটু করে। খুলেছিলো নিজের পার্লার। প্রথমে ছোট আর তারপরে বড় আর এখন তো ইউনিসেক্স। অনেকেই আসে সাজতে ওর পার্লারে,শিল্পা এখন আর পেডিকিওর করেনা। ফেসিয়ালও করেনা। ওগুলো ওর মেয়েরাই করে।
শুধু মেকআপের কাজটাই করে শিল্পা। বদলে গেছে অনেককিছু বদলেছে শিল্পাও। দশবছর আগের শিল্পাকে এখন অনেকেই চিনতে পারেনা,চেনা যায়না। হয়ত বা এক আত্মপ্রত্যয়ী নারীকে মেলানো যায়না পদতলে পিষ্ট এক নারীর সাথে। আজ পার্লারে খুব চাপ,একটা অনুষ্ঠান বাড়ির লোক সাজতে আসবে। এক সাথে তিন চারজনকে সাজাতে হবে। সাজানো শুরু হয়েছে,মেয়েরা সাজাচ্ছে। ভেতর থেকে এসে হাত লাগায় শিল্পাও,মুখটাকে মুখোশে ঢাকতে খুব ভালো লাগে ওর। ওর হাতের তুলির ছোঁয়ায় কত বোঁচা নাক হয় টিকোলো,ছোট চোখ হয় পটলচেরা। কালো রঙ হয় ফর্সা আসে ঝকঝকে জেল্লা। সাজাতে গিয়ে একটু চমকে যায় শিল্পা আয়নায় দুটো চেনামুখ দেখে,ওর শাশুড়িমা আর জা সাথে আরো দুজন নতুন মানুষ। বুঝতে পারে রঞ্জনের এখনকার বৌ একজন,আরেকজন কোন আত্মীয়া। যত্ন করে নিজের কাজ সারলো শিল্পা,সব মোটামুটি শেষ। বুঝতে পারলো অনেকদিন বাদে হয়েছে বাচ্চা,আর সেইজন্যই সাজগোজ। হঠাৎই পরিচিত গলার আওয়াজে চমকে ওঠে,'আপনাদের সুনাম শুনে গিন্নির বায়নায় এতদূরে আসা। বিলটা হয়ে গেছে তো?'
....বরের গলা শুনে এগিয়ে যায় রঞ্জনের বৌ আর বৌদি,'দেখনা কেমন লাগছে?'...'ওহ্ একদম পারফেক্ট আর প্রেটি।'এগিয়ে আসে ওর শাশুড়িমাও। বাঁকা হাসি খেলে যায় শিল্পার মুখে। মেকআপ বক্সে ব্রাশগুলো রাখতে রাখতে পেছন ফিরিয়ে বলে,' এখানকার সবার হাত ভালো আসলে মুখোশ খুলে নতুন মুখোশ আঁকার কাজটা আমরা ভালোই করি তাই এই পার্লারের এত সুনাম।' গলাটা বড় চেনা লাগে ওদের সবার ফিরে তাকায় ওরা। মেলাতে পারেনা কিছুতেই।ফিরে তাকায় শিল্পাও দাঁড়ায় ওদের মুখোমুখি চোখেমুখে আত্মবিশ্বাস আর এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব আজ যে ও এক নতুন যুগের স্বাধীন নারী যে নিজের ভাগ্য নিজের হাতেই গড়েছে।
সমাপ্ত:-
©ইচ্ছেখেয়ালে শ্রী
Comments
Post a Comment