#হীরের_দুল#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
"এই নে আজ একটু মিষ্টিমুখ কর,দেখতো মিষ্টিগুলো ভালো কিনা তোদের দাদাকে দিয়ে রিষড়া থেকে আনালাম। এখানকার মিষ্টি তো রোজই খাস।"
...."মিষ্টি তো খাবোই তার আগে বলো আজ কি স্পেশাল ডে...না আজ তো তোমার বার্থডে নয়। তাহলে কি আজ তোমার আ্যনিভার্সারী?"..জিজ্ঞেস করে শুক্লা।
...." দাঁড়াও দাঁড়াও আগে তো তোমাকে দেখি তারপর মিষ্টি খাবো। কি সুন্দর গো তোমার শাড়িটা,এটা কি রিভার্স কাঁথা? উরিব্বাস কানের দুলটা তো হেব্বি। শুক্লা দেখেছিস?"..নমিতা বলে ওঠে।
....ওদের হৈ হৈ শুনে বেশ ভালো লাগে ইন্দিরার,সত্যি এই চাকরিটাই যেন অক্সিজেন এখন। একটা সময় যখন ছেলে ছোট ছিলো,মাঝে মাঝে সংসারের চাপে নাজেহাল হয়ে ভাবতো চাকরিটা ছেড়ে দেবে ছেলেটাকেই ভালো করে মানুষ করবে এত টেনশন আর ভালো লাগেনা। চাকরি করা মায়েদের বাচ্চারা বড় কষ্ট পায়। আজ পুলকার আসেনা তো কাল শরীর খারাপ,মাঝে মাঝেই সমরেশের বুকে মাথা রেখে মন খারাপ করতো,কখনো বা কাঁদতও।"ইন্দু একটা কথা বলবো,চাকরিটা ছেড়োনা। ছেলে তোমার ঠিক বড় হয়ে যাবে একদিন তখন ওর আলাদা জগৎ হবে কিন্তু তুমি কি নিয়ে থাকবে বলো?”
সমরেশের কথায় চাকরি ছাড়বে বললেও চাকরি ছাড়া হয়নি ওর। ছেলেকে নিয়ে অনেক কষ্ট করেছে ঠিকই কিন্তু আজ সবই মনে হয়,আরে এই তো সেদিনের কথা। এর মধ্যেই কত বড় হয়ে গেলো। সত্যি দিনগুলো যে কোনদিক দিয়ে কেটে যায় বোঝাই যায়না। সেদিনের সেই পুঁচকে ঋক্ মানে ঋত্বিক আজ ইঞ্জিনিয়ার,রীতিমত চাকরি করছে। ইন্দিরা তো ভাবছে আর দুয়েক বছর বাদে ছেলের বিয়ে দেবে,সবাইকে তাই বলে রেখেছে এর মধ্যেই।
ওদের শাড়ি গয়না দেখাদেখির মধ্যেই কোণের টেবিলে বসে কেয়াকে গুঁতো মারে শিখা,"নে সাজুনি দিদি এসে পড়েছে,ব্যাস শুরু হয়ে গেল ছেলের প্রশংসা। আর যেন কারো ছেলে ভালো চাকরি করেনা।"..."আরে শোননা,অন্য কিছুও তো হতে পারে।"..."না রে বাবা দেখিস মিলিয়ে,একটু মজা দেখ বুঝতে পারবি তাহলে।"
....ততক্ষণে ইন্দিরা মেতে উঠেছে হাসি গল্পে। "আরে আর বলিসনা,ঋক তো একটা নতুন কোম্পানীতে জয়েন করলো অনেক উঁচু পোষ্টে,ভাবতেই পারবিনা। তবে ইশ্ বাচ্চাটা আমার অনেকটা দূরে চলে যাচ্ছে,একদম ব্যাঙ্গালুরু,তারপর হয়ত বাইরে চলে যাবে বছর দুয়েক পরে।"
...."কি কেয়া বলেছিলাম না,শুরু হবে ছেলের গুণগান। ওরেবাবা এইসব গল্প আমার জানা।"
অফিসে অনেকেই ইন্দিরাকে ভালোবাসে,আবার কেয়া আর শিখার মত লোকও আছে। ইন্দিরার শাড়ি আর গয়না দেখে সবাই প্রশংসা করে মিষ্টিগুলোও সত্যি ভালো ছিলো,কেয়া আর শিখাও খেলো শুধু প্রশংসাটা ঠিক মুখ দিয়ে বেরোলোনা।
আসলে এও ইন্দিরার একরকম সুখের জগত,যে জগত শুধুই ছেলেময়। কিছুক্ষণের জন্য এক অলীক সুখে হারিয়ে যায়। মনটা হারিয়ে যায়,সবার সাথে মিলেমিশে কত বড় বড় গল্প করে ছেলের সম্বন্ধে। সত্যিই তো কত বড় চাকরি করছে ঋক,কদিন বাদেই তো ব্যাঙ্গালুরু যাবে,তারপর হয়ত কিছুদিন বাদেই স্টেটসে। " আর বলিসনা,এত বড় ছেলে আমাকে সবটা দেখতে হয়,এখনো অফিসে যাওয়ার সময় ভাত মেখে খাইয়ে দিলেই ভালো। আর এই প্রমোশনের পর আমাকে সাথে নিয়ে এই শাড়িটা কিনে দিলো একগাদা খরচ করে,সাথে দুলটাও। কিছুতেই শুনলোনা,তাতেও হলোনা ওর বাবার জন্যও আমার শাড়ির সঙ্গে ম্যাচ করে ড্রেস কিনলো। আমাকে কোন কথাই বলতে দিলোনা। এই দেখ ছবিটা,ভালো না!"
সবাই ঝুঁকে পড়ে মোবাইলে,"সত্যি দারুণ লাগছে তোমাদের গো। আর তুমি তো এখনও যা দেখতে,আমি তো আমার কর্তাকে বলি। ইন্দুদির সোনার সংসার। আর ইন্দুদিও তেমন সোনার মা,তাইতো সংসারের সবটা সামলাও এমন সুন্দর করে। সত্যি গো আমি সবসময় তোমার গল্প করি বাড়িতে।" বলে শুক্লা,আর সবাই সেটা সাপোর্ট করে।
ওদের হৈ হৈ এর মাঝে মুখটা আরো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ইন্দুর। " তোদের মাঝে প্রাণ পাই,একসময় ভাবি রিটায়ার করে গেলে এই অক্সিজেনটা পাবো কি করে। এখানে তো শাড়ি গয়না পরেও সুখ। এখন তো সবাই আমরা ফ্ল্যাটবন্দী।"..."ঠিক বলেছো গো,আমাদের ছোটবেলায় জিনিস দেখানোর লোক ছিলো,এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে সবাই দেখতো। তার মজাই আলাদা ছিলো।"...বলে নমিতা।
...."এখনো মজা আছে,আমি তো সেজেগুজে সেল্ফি তুলে পোষ্ট করে দিই। ব্যাস আর কত কমেন্টস আর লাইকে ভরে যায়।"...এতক্ষণ শুনতে শুনতে না বলে পারেনা শিখা।
সবার কথার মাঝে একটুকরো অন্ধকারে আলো খুঁজে ভালো থাকা ইন্দুর মুখটা ভরে ওঠে আনন্দে। অনেক খারাপ লাগা এইভাবেই মুছে দেয় মন থেকে। সবার চোখে সেরা মা ইন্দিরা। কিন্তু ঋক,ওর চোখে কি সত্যি ওর মা বেস্ট মম? ফাইলগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে সবার হাসিমুখের আনন্দটা নিজের মুখে মাখতে মাখতে বারবারই আনমনা হয়ে যাচ্ছিলো ও। আজকাল তো সারাদিন ছেলের সাথে একটা দুটো কথাও হয় কিনা তাও সন্দেহ। খুব প্রয়োজন ছাড়া ঋক ওর মূল্যবান কথা বাড়িতে শেয়ার করেনা। কতদিন ছেলের কাছে প্রাণভরা মা আর বাবা ডাকও শোনেনি। আর শপিং মল বা বুটিকে নিয়ে গিয়ে মায়ের জন্য শাড়ি কেনা সেতো রূপকথার গল্প ইন্দুর কাছে। এই শাড়িটা আর সাথে কর্তার জন্য ড্রেসটা তো ওই কিনেছে নিজে ঘুরে ঘুরে পছন্দ করে। আর দুলটা এবার জন্মদিনে নিজেই নিজেকে গিফ্ট করেছে। গত দুবছর হ্যাপি বার্থডে মাম্মা কথাটা ছেলের কাছ থেকে শোনেনি ইন্দু। ওরা চেয়েছিলো ছেলে অনেক বড় হোক,ভালো রেজাল্ট করুক যাতে সবার কাছে বড় মুখ করে বলতে পারে আমার ছেলে অমুক বা তমুক তোমার ছেলের মত হরিপদ কেরানী নয়। আর তার ফলে কখনো হয়ত একটু বেশিই কঠোর হয়েছে প্রয়োজনের তুলনায়।
না ঋক কোন খামতি রাখেনি ওর চেষ্টার,খেলার ব্যাটবল আর শখগুলো ভুলে করেছে বাবা মায়ের স্বপ্নপূরণ মাইনেটা মোটামুটি ভালোই পায়। তবে একটু একটু করে নিজের ভালোটা বড় বেশিই বুঝতে শিখেছে। ওর স্বপ্ন অনেক,কোটি টাকার ফ্ল্যাট হবে বড় শহরে,দামি গাড়ি আর সুন্দরী বান্ধবী সব সব পেতে হবে। আরো চাই আরো বেশি চাই। আর এই চাওয়ার মাঝে কখন যে হারিয়ে গেছে ওর সবচেয়ে কাছের মানুষ মা তা বুঝতেই পারেনি। না না এমন ভালো ছেলে চায়নি ইন্দু,আজকাল বড় সাধ হয় ছেলেটার সাথে একটু বসে কথা বলতে ওর গায়ে মাথায় হাত রাখতে বা একটু হাসির কথা বলতে। কতদিন ও হাসিমুখে কোন কথা বলেনা।
নিজেকে বোঝায় ইন্দু... স্রষ্টাকে সৃষ্টির কাছে কিছু চাইতে নেই। ওর আবার কিসের প্রত্যাশা? তবুও কেন মন বার বার ছুটে যায় একটু মাতৃত্বের নরম ছোঁয়া পেতে। এই তো প্রমোশন ট্রান্সফারের কথা কিছুই বলেনি বাড়িতে,দুদিন আগে বলছে। আজ তাই মনের কান্না ঢাকতে সেজেগুজে মিষ্টির বাক্স নিয়ে এসেছে ওর স্বাদবদলের জায়গা অফিসে। আজকাল নিজের কেনা অনেক কিছুই ছেলে দিয়েছে বলে চালিয়ে দেয়। অনেক বড় মুখ করে গল্প করে ছেলের,দীর্ঘশ্বাসগুলো হাসির জলতরঙ্গে ঢেকে।
সবাই যখন বলে সত্যি ইন্দুদি তোমার একটা ছেলে হয়েছে বটে,এতো ভাবে মায়ের কথা। মনটা আনন্দে ভরে ওঠে সাময়িক মিথ্যেকে সত্যি করার আনন্দ।
ঋককে এয়ারপোর্টে তুলে দিতে যায় ওরা স্বামী স্ত্রী, যদিও ছেলের খুব অমত ছিলো,"তোমাদের যাবার কোন দরকার নেই,এইটুকু গিয়ে আর কি হবে? এখনো কি আমি বাচ্চা?"...ইন্দু বোঝে এয়ারপোর্টে ওর বান্ধবী আসবে,সেখানে বড় অপ্রয়োজনীয় মা বাবা।
..এয়ারপোর্টের বাইরে একটু মুখটা কাঁচুমাচু করে ইন্দিরা বলে," আয় না একটা ছবি তুলি একসাথে"..বিরক্তিতে ভরে যায় ঋকের মুখটা। " মা ঐসব বোগাস ফেসবুক স্টেটাস দেওয়া বন্ধ করো প্লিজ।"..ফেসবুকের ব্যাবহার খুব বেশি না বুঝলেও এটুকু বোঝে ইন্দিরা ছেলের কোন পোস্ট ও দেখতে পায়না,আর ছেলে হয়ত ওর পোস্টগুলো দেখতে চায়না। মনটা ভারী হয়ে যায় ইন্দিরার,হঠাৎই কি যেন মনে হয় ঋকের। " ব্যাস হলো তো,আরে আমার টেনশনটা বোঝো। কতটা চাপে থাকি সবসময়। আচ্ছা এসো, বাবাও এসো একটা ছবি তুলি।"...মা বাবারা বোধহয় খুব অল্পেই খুশি হয়। মুখটা উজ্জ্বল হয়ে যায় ইন্দিরার, ছেলের ঘাড়ে হাত দিয়ে একদম কাছে দাঁড়িয়ে পড়ে। ব্যাস কমপ্লিট একটা সুখী পরিবারের পারফেক্ট সেলফি।
ইন্দুর ফ্ল্যাটের ওয়াশিং মেশিন,ষাট ইঞ্চি এল ই ডি টিভি। ইন্দুর নতুন ট্যাব বা দামি শাড়ি সবটাই চলে যায় ছেলের নামে। কি অদ্ভুত এক জগত ইন্দুর,অনেকদিন আগে একটা ইংরেজী গল্প পড়েছিলো The Silver Tea Pot সেখানে মিসেস হ্যালেট নামে এক বৃদ্ধা ভদ্রমহিলা যার ছেলে বহুদিন নিরুদ্দেশ,মায়ের কোন খবর নেয়না। তার প্রশংসা করতেন পথচলতি লোকের কাছে এবং ছেলে উপহার দিয়েছে এই বলে একটা রূপোর টি সেটে চা খেতেন..পরের অংশটুকু আরো বেদনাদায়ক। আজকাল ওর মনে হয় ও কি মিসেস হ্যালেট হয়ে গেলো নাকি?
ছেলের হাজার অবজ্ঞার মধ্যেও একটু ছোট ফোন কল নিয়ে ভালো আছে ইন্দু। সারাদিন বাদে রাতে..." ঐ দুটো কথা,ভালো আছিস তো বেটা? খেয়েছিস ঠিকমত দুপুরে? রাতের ডিনার সকাল সকাল করে নিস। না খেয়ে যেন ঘুমোস না।"..."আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে।"..এমনি জবাব পায়,আবার কোনদিন বা শোনে,"এক কথা প্রতিদিন জিজ্ঞেস করো কেন?আমি খেয়ে নেবো ঠিক।"...সত্যিই তো কথাটা কখন যে কমে গেছে ওদের মাঝে বুঝতেই পারেনি। অথচ এই ঋকই একটা সময় স্কুল থেকে সারাটা রাস্তা বকতে বকতে আর ললিপপ চাটতে চাটতে আসতো। সব কথা মাকে বলা চাই। আসলে একটা সময় কথাগুলোও বোধহয় প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে যায়,অথবা হয়ত ফুরিয়ে যায়। তাই ঋক কোনদিন জিজ্ঞেস করেনা,"মা তোমরা কেমন আছো? তোমার পায়ে ব্যাথাটা কমেছে তো? আর বাবার চেক আপ করাচ্ছো তো ঠিকমত?"....আসলে সংসারের দায় দায়িত্ব আজকাল পুরোটাই মা বাবা নিয়ে একটা দুটো ছেলেমেয়েকে এত আদরে মানুষ করে যে ওরা কোন দায়িত্ব নিতেই শেখেনা। এই করতে করতে একটা সময় ভাবে ওগুলো মা বাবার কাজ,আমার নয়।
তবুও ইন্দু ভালো থাকতে চায়,ঐ একফালি চাঁদের আলো আর আকাশ নিয়ে বাঁচতে চায়। হোকনা কল্পনার উপহার,তবুও ছেলের কথা মনে করেই কেনে কখনো লঙ ড্রেস,কখনো বা ছোট্ট পেনডেন্ট আবার কখনো শৌখিন ব্যাগ। অফিসে সবাইকে তাই বলে,"আর বলিসনা,এখন হয়েছে এক অনলাইন। সবসময় বাড়িতে পার্সেল আসছেই। এত বারণ করি শুনলে তো ছেলে। ব্যাগ থেকে শাড়ি,জুয়েলারি ওর বাবার ওষুধ আর মাসের বাজার সব ঐ ছেলে করে দেয় নেটে।" আসলে এখন অনলাইন শপিং ওলা উবার বুক করা সবটাই ইন্দিরা শিখে নিয়েছে বাঁচার তাগিদে। ঘরে বসে পে টি এমে বিলও দিতে পারে,অসহায় আর নির্ভরশীলতার জীবন আজকালকার মা বাবারা চায়না। কখনো দাবীও জানায়না সন্তানদের কাছে,ওরা যে বড় ব্যস্ত। আমরাই যে ঠেলে দিয়েছি ওদের ইঁদুর দৌড়ে। আর ওরাও শুধু শিখেছে নিজেদের জীবন সাজাতে, ঘুরতে বেড়াতে আর এনজয় করতে। আরে জীবন তো একটাই। কিন্তু একবারও কি মনে পড়েনা যে মানুষগুলো তাদের সোনালী সময়গুলো ওদের দিয়েছে এখন তাদের রুগ্ন হাতগুলো ধরে বলা,পাশে আছি। ভালো থেকো।
থেমে থাকতে শেখেনি ইন্দিরা,ভালো থাকে নিজে আর ভালো রাখে স্বামীকে। তাই বেড়ানো,খাওয়া সবটাই করে ওরা দুজনেই। সাজুগুজু করে ফেসবুকে ছবিও দেয় এখনকার ডিজিটাল পৃথিবীর মা ইন্দিরা। ভালো থাকতে চায় পৃথিবীর রূপ রস আর গন্ধ মেখে ইন্দিরা। দিন তো কমছে একটা একটা করে।
দেখতে দেখতে ইন্দিরার রিটায়ারমেন্টের দিন চলে আসছে। নিজেকে আ্যক্টিভ রাখতে খুব চেষ্টা করে ও। এর মধ্যেই দু একজন বন্ধুর সাথে কথা বলে রেখেছে যদি কিছু সমাজসেবা মূলক কাজ করা যায়।
ঋকও হয়ত কিছুদিন বাদে চলে যাবে বিদেশে,এখনকার ছেলেরা একবার ওদেশে গেলে আর তো ফিরবেনা এদেশে এমনটা জানে ইন্দু তাই ওর বিয়েটাও দিয়ে দিতে চায় অবশ্য ছেলে বলেছে যাবার আগে বিয়েটা করেই যাবে। ইন্দিরার খুব ইচ্ছে ওর রিটায়ারমেন্টের দিন যদি ছেলেটা কাছে থাকে তবে এর মধ্যে কোনদিনই সে কথা সাহস করে বলে উঠতে পারেননি। যদিও রাতে শুয়ে শুয়ে কর্তাকে বলাতে ধমক খেয়েছিলো,"তুমিই বলো প্রত্যাশা রাখতে নেই আবার নিজেই প্রত্যাশা করো। আমি তো আছি,যাবো সেদিন তোমায় আনতে।"
এরই মাঝে হঠাৎই ঋকের সাথে দেখা যায় ওর মায়ের বান্ধবীর ছেলে অর্পণের সাথে। অর্পণ একসময় ওর সাথে স্কুলে পড়তো। বন্ধুকে নিজের এগিয়ে যাওয়া দেখাতে ভালোই লাগে তাই ঋক ওকে জোর করেই ওর ফ্ল্যাটে নিয়ে গেলো। " ওহ্ সত্যি রে তোকে দেখে হিংসে হয়,এমন ভালো কপাল তোর! এই বয়সে কত ওপরে উঠে গেছিস। আর আমার ঐ নড়বড়ে চাকরি ভালো লাগেনা। কোনদিকই ম্যানেজ করতে পারলামনা ঠিকমত।"...ঋক বলে" নারে তেমন কিছুনা,সবটাই অফিসের দেওয়া। আমি তেমন কিছু করিনি তবে..ওর মুখের কথাটা কেড়ে নেয় অর্পণ,"মা তো সবসময় তোর কথা বলে,যে তোর মত ছেলে হয়না। মা বাবার কত খেয়াল রাখিস,ইন্দুমাসিকে কত কি কিনে দিচ্ছিস সবসময়। তারপর মাসের বাজার থেকে ওলা উবার বুক করা এমনকি বাইরে বেড়াতে যাবার খরচ,ফ্লাইটের টিকিট সবই তো তুই দেখিস। একদম হীরের না না প্ল্যাটিনামের টুকরো ছেলে।"
অর্পণ বলে যায়,ওর কথাগুলো যেন বুকে রক্তক্ষরণ করে একটু একটু করে ঋকের। ওলা,উবার বুক,মাসের বাজার,ফ্লাইটের টিকিট এসব কি বলছে অর্পণ! সারাদিনে হয়ত একটা দুটো বা খুব জোর দশটা কথা হয় মা বাবার সাথে। কই কোনদিনই তো জিজ্ঞেস করেনা ওরা কেমন আছে,ওদের কিছু লাগবে কিনা? মা এগুলো কি বলেছে ওদের! অর্পণের সাথে কথা বলে জানতে পারে ও এসেছে বাবাকে ডাক্তার দেখাতে এখানে,সাথে কাকাও এসেছে।
সেদিন রাতে কেন যেন মা বাবার সাথে একটু বেশিই কথা বলতে ইচ্ছে করলো ঋকের। ইন্দু অভ্যেস মত দুটো কথা জিজ্ঞেস করেই ফোন রাখতে যাচ্ছিলো হঠাৎই ছেলে বলে,"মা বাবাকে নিয়ে এসে একবার এখানে ডাক্তার দেখিয়ে নেবো,আর তার সাথে তোমাকেও।"...গলার কাছে একদলা কান্না কেন যেন ধাক্কা দেয় ওর," এখন তো অফিস আছে অত ছুটি পাবোনা,একসময় অনেক ছুটি নিয়েছি। তুই ভাবিসনা আমরা চেকআপ করাই তো।"
সেদিন রাতে কেন যেন ইন্দিরার ঘুম এলোনা,হয়ত আনন্দে। খুব ছোট একটা জিনিস তার নাম সহানুভূতি,সেটা পাওয়ার আনন্দে। কি হলো ছেলেটার? আজ ঋকেরও ঘুম এলোনা অনেক রাত পর্যন্ত,সত্যি তো মায়ের ছুটি থাকবে কোথা থেকে। ওর সব পরীক্ষার সময়ই তো মা ছুটি নিতো,অনেক সময় বেশ আগে থেকেই। আর ওর অসুখ হলে তো কথাই নেই,কত যে এমন হয়েছে তার কোন ঠিক নেই। এত প্রশংসা মা কি করে করলো ওর!
সামনে সপ্তাহে ইন্দিরার রিটায়ারমেন্ট,ছেলেকে তেমন করে কিছু বলেনি ও। ঋক ওর বাবার কাছে শুনেছে তারিখটা ভালো করে। ভোরবেলায় ঘুমটা ভেঙে যায় ইন্দিরার,গতকাল ঘুম আসতে অনেক দেরি হয়েছে। আজ ওর অবসর হয়ত বা একটুকরো মুক্তির জানালার পাল্লা বন্ধ হবে আজ থেকে। শাড়ি,গয়না,রান্না,পি এন পিসি সবই হত ওখানে।
বড় ফাঁকা লাগে মনটা একটা শূন্যতা বুকের মধ্যে দোলা দেয়। স্বামীর গায়ে হাতটা রাখেন,ওর পরম নির্ভরতার সঙ্গী তো একজনই। " মন খারাপ কোরনা ইন্দু,অবসরটাও জরুরী। করলে তো অনেক আর কত? এবার দুজনে মিলে সেকেন্ড ইনিংস এনজয় করবো,তাই চিয়ার আপ।"
অনুষ্ঠান ওরা করবেই তাই আগে থেকেই খুব সুন্দর একটা শাড়ি কিনেছে পছন্দ করে,সাথে আ্যকসেসরিজও। চোখে হাল্কা কাজল টানতে গিয়ে চোখটা একটু ভিজে গেলো।
অফিসের শেষে অনুষ্ঠান, সবারই মনটা আজ খারাপ। ইন্দিরার এত পজেটিভ যে ওটাই ছিলো সবার কাছে উদাহরণ। কারো কোন সমস্যা সমাধান করতেন পাশে থেকে। তাই আজ অনেকেই কেঁদে ফেলছে কথা বলতে,চোখে জল ইন্দিরারও। হাতে মানপত্র আর ফুলেররাশি নিয়ে ইন্দিরার চোখটা ঝাপসা হয়ে যায়। হঠাৎই শুনতে পায়..."আজ আমাদের মাঝে আছে বিশেষ একজন,যে একসময় অফিসে বছরে দুএকদিন এসে কাগজপত্র ছিঁড়ে যেতো।"..মুখ তোলে ইন্দিরা কাকে দেখছে ও ..ঋক!কই কিছু বলেনি তো আগে। চোখটা ছলছল করে ওঠে ইন্দিরার। মাকে জড়িয়ে ধরে ঋক,আজ বড় নির্ভর করে কাঁধে মাথা রাখতে ইচ্ছে করে ওর। পেছনে অনেক স্মৃতি ফেলে ছেলের হাতটা ধরে বেড়িয়ে আসে ইন্দু অফিস থেকে,ওর কর্তার মুখে তখন একচিলতে মিষ্টি হাসি।
"চোখটা বন্ধ করোনা মা।".." কেন রে?".."আরে করোই না"। মায়ের গায়ে পশমিনা শালটা জড়িয়ে দেয় যত্নে, আর হাতের মুঠোয় একটা ছোট বাক্স। আর তার সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমগ্ৰ। " বাক্সটা খোলোনা মা.."। ইন্দিরার দুচোখ দিয়ে ঝরছে আজ কুচো কুচো হীরের টুকরো তবুও ভেজা গলায় বললেন," আমার কাছেই তো দামি হীরে,হীরের দুলে কি হবে?"...." আজ খুব মনে পড়ে মা তোমার না পাওয়া দিনগুলোর কথা। একসময় কত কষ্ট করেছো তুমি,মনে পড়ে আ্যন্টেনা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তোমার টিভি দেখার কথা? অথবা বাস ভাড়া বাঁচানোর জন্য হেঁটে যাওয়ার কথা?নিজের জন্য ঝোল আলু রেখে আমাকে মাংস দেওয়ার কথা?"
...."সে তো অনেক আগের কথা,তোর মনে আছে?"..." তুমি মজা করে বলতে,আমি চাকরি পেলে তুমি হীরের দুল পরবে।"
আজ মায়ের কোলে মাথা দিয়ে শুতে বড় ইচ্ছে করে ঋকের ছোটবেলার মত। অর্পণের সাথে দেখা হয়ে সবটাই কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেছে। মায়ের গায়ের গন্ধটা কিন্তু এখনো তেমনি আছে একদম মিঠে মিঠে। কি আনন্দের দিন আজ!নাহ্ কাউকে আজ দেখাতে ইচ্ছে করলোনা ইন্দুর হীরের দুলটা। সন্তানের ভালোবাসার কাছে আজ সবই তুচ্ছ মনে হলো ইন্দুর।©ইচ্ছেখেয়ালে শ্রী..রুমাশ্রী সাহা চৌধুরী
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment