#দিয়া#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
প্রদীপের থালা হাতে নিয়ে অসাধারণ ছবিগুলো চোখটা কতক্ষণ ছুঁয়ে ছিলো মোবাইল স্ক্রীনটা বুঝতেই পারেনি অনিরুদ্ধ। মনটা হারিয়ে গিয়েছিলো কিছুক্ষণের জন্য অতীতে। সত্যি বোধহয় উৎসবে রাঙা দিন গুলোতে বঙ্গসুন্দরীরা একদম জাস্ট রূপের ডালি। এতো সুন্দর লাগে মেয়েদের তা সে সরস্বতীপুজোর দিনই হোক বা অষ্টমীর অঞ্জলিই হোক। আর সিঁদুরখেলা,ওহ্ জাস্ট মনছুঁয়ে যায় ছবিগুলো মনে করলেই।
অনিরুদ্ধ প্রায় পাঁচবছর আছে প্যারিসে,দেশের টান আছে কিন্তু ঠাঁই নেই হয়ত সেখানে। আসলে কার কাছে যাবে,যাকে ঘিরে ছিলো ওর ভালো থাকা সেই মা যখন চলে গেলো তখন স্বদেশ আর বিদেশ কিছুই ফারাক রইলোনা। ফটোগ্ৰাফি আর ভিডিওগ্ৰাফির জন্যই একটা ওয়ার্কশপে এসে চাকরিটা পেয়ে আর ছাড়েনি চলে এসেছিলো।
তাই ভালো কোন ছবি দেখলেই আর চোখ ফেরাতে পারেনা। যদিও কাজটা ঠিক নয় তবুও প্রোফাইলে উঁকি মারে একবার। বাহ্ নামটা দারুণ তো দীপাবলি দিয়া। দুটোই প্রদীপের সাথে সম্পর্কিত। সত্যিই মিষ্টি ছবিগুলো,স্ট্যাটাসটা দেখে অনিরুদ্ধ.."বেনারসের দিয়া বাতি জ্বালায় কলকাতার কোন তুলসীতলায়।" খুব সুন্দর তো,আর ছবিগুলোও দুর্দান্ত মনে হয় একদম নতুন বিয়ে হয়েছে তাই এত সিঁদুরের ছড়াছড়ি।
ছবিগুলো দেখে বড় মায়ের কথা মনে হলো অনির। ওর মাও ছিলো এমন সিঁদুরে মাখা প্রদীপের আলোতে উদ্ভাসিত একটা শান্ত স্নিগ্ধ মুখ। মায়ের কিছু সুন্দর ছবি আজও আছে যত্নে রাখা ওর কাছে,মাঝে মাঝেই দেখে। আর মনে হয় এই তো মা আছে। কালীপুজো এলেই প্রদীপ প্রদীপ করে মাথা খারাপ করত মা। বাবা সেই সময় খুব অসুস্থ হঠাৎ স্ট্রোকে। তাই দায়িত্ব পড়তো ওর কাঁধেই। সেই দিনগুলো আজও বড় আপন ওর স্মৃতিতে।
"মা এই নাও এনেছি।"
"এনেছিস,কই দেখি দেখি,বাহ্ কি সুন্দর ডিজাইনগুলোরে। দারুণ দেখতে কিন্তু।"
..."তোমাকে বলি তো যাবেনা কিছুতেই বাজারে গেলে দেখতে কত রকম আলো বেড়িয়েছে।"
..."আসুক আমার প্রদীপই ভালো। ছোটবেলায় মাটি মেখে মায়ের সাথে কত প্রদীপ বানিয়েছি। প্রদীপের আলোতে কি স্নিগ্ধ লাগে চারিদিক মন ভরে যায়।"
...." বানাবে নাকি আবার?"..." মাটি কোথায় পাবো শুনি?"..."সত্যি মা তোমাদের ছোটবেলাই ভালো ছিলো। ভালো দিনগুলো কেমন তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায় তাইনা?" সত্যি চলে গেছে দিনগুলো বড় তাড়াতাড়ি। বাবা চলে যাওয়ার পর মা আর আলো জ্বালায়নি দুটো বছর। শুধু বলতো,"আর ওসব ভালো লাগেনা। তোর বৌ আসুক তারপর করবে।"...নাহ্ আলো আর জ্বলেনি ওদের বাড়িতে, এখনো অন্ধকারে ডুবে আছে বাড়িটা।
আজও অফিস থেকে এসে দিয়ার প্রোফাইলটাতে চোখ রাখে অনি। ফ্রেন্ড রিক্যুয়েস্ট পাঠিয়েই দিলো বেশ কিছুক্ষণ ভেবে। অন্য কিছু নয়,প্রদীপের আলোর মিঠে তাপে দিয়ার লালচে মুখটা মাকেই মনে করিয়ে দিত যে। বেশ কিছুদিন বাদে দেখে ওকে বন্ধু করে নিয়েছে দিয়া। হঠাৎ অনিই একদিন দিয়াকে অন দেখে ওর সাথে কথা বলে,"আমি কিন্তু আপনার ছবিগুলো দেখেই রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছি। আসলে অনেকদিন দেশের বাইরে তো তাই এই উৎসবগুলো খুব মিস্ করি।"...প্রথম দিকে একটু কম কথা বলত দিয়া বুঝত অনি রক্ষণশীল মধ্যবিত্ত বাড়ির বৌ। কিন্তু পরে একটু একটু করে বন্ধু হয়ে যায় ওরা।
দিয়া প্রদীপের মতই ঝলমলে আর স্নিগ্ধ,ঠিক ওর মায়ের মতই প্রদীপ কেনার পাগল। অনি চুপ করে শোনে দিয়া বলে যায় বেনারসের কথা,"জানেন তো গঙ্গামাইয়ার ঘাটে আমরা রোজ সন্ধ্যাবেলায় দিয়া জ্বালাতাম আর ভাসিয়ে দিতাম। ভেসে ভেসে কোথায় কতদূরে চলে যেত সেই দিয়া। আর আমি বসে বসে দেখতাম মায়ের সাথে।" দিয়ার আধভাঙা বাঙলা শুনতে বেশ লাগতো অনির। সব সময় আলোর গল্পে ঝলমল করতো দিয়া। মজার কথা বলতে বলতেই বলেছিলো ওর দিয়া নাকি ভাসতে ভাসতে বেনারসের ঘাট থেকে সোজা চলে এসেছিলো কলকাতায়। তাইতো এখানেও শোভাবাজারে ওদের বাড়িতে বসে গঙ্গা দেখে দিয়া। মজা করে বলেছিলো অনি," আর তোমার হাবিও কি ভালোবাসে গঙ্গা দেখতে?"..একটা ইমোজি পাঠায় দিয়া,লজ্জা রাঙানো,"ও তো গঙ্গামাইয়ার ভক্ত কিন্তু এখন পাহাড়ে। সামনে দেওয়ালিতে এলে আমায় নিয়ে যাবে পাহাড়ে।"
শুনেছে ওর বরের নতুন চাকরি,কোয়ার্টার পেলেই ওকে নিয়ে যাবে পাহাড়ে। তবে বেশিদিন ওখানে থাকতে পারবেনা দিয়া,গঙ্গামাইয়াকে ছেড়ে। হয়ত সেইজন্যই দিয়া মাঝে মাঝে কথা বলতে পারে খুব অল্প সময়ের জন্য অনেক নিয়মের বেড়ায় বাঁধা দিয়া। বেনারসের দিয়ার কথা আর ছবিগুলো মাঝে মাঝেই মনে পড়ে যায় অনির প্যারিসে সিন নদীর ধারে বসে আবার কখনো বা লাভলক ব্রীজের ওপর দাঁড়িয়ে। এখনো কত সহজ সরল দিয়া। মাঝে মাঝে নিজেকেই জিজ্ঞেস করে অনি, দিয়াকে এত মিস্ করে কেন? ওকি অন্যের বউকে ভালোবেসে ফেলছে? নাকি শুধুই ভালোলাগা? আচ্ছা এটাকে পরকীয়া বলেনা তো? না না ওর ভালো লাগে কথা বলতে দিয়ার সাথে, দিয়া একমুঠো সতেজ মেঠো হাওয়া।
বেনারসের অলিগলির গল্পও হয় ওদের একটু সময় পেলেই। মিষ্টি পানমশালা,কাঁচের চুড়ি,কাঠের পুতুল,বিশ্বনাথ মন্দিরের চমকদার গলির কথা সবকিছু ছবির মত ভাসে অনির চোখের সামনে। বন্ধু হিসেবে অনিকে ভালো লাগে দিয়ার, যাকে দিলকি বাত বলা যায়। ফেসবুকে তো কত মানুষই দেখলো। অনি সময় পেলেই বলে ওর মায়ের কথা,আর দিয়া বলে ওর মাও নাকি এমনি। "সব মায়েরাই মনে হয় জীবনে শুধু উজালা দেয় নিজেদের পুড়িয়ে।"..."তুমি খুব সুন্দর কথা বলতো।"..হাসির ইমোজি পাঠায় ও, "শেখর আমার হাবিজিও তাই বলে আমাকে। কথা বলতে বলতে নাকি সারাদিন পার হয়ে যায় আমার সাথে।"...হঠাৎই অফ হয়ে যায় দিয়া মাঝে মাঝেই বোঝে অনি রক্ষণশীল পরিবারের বৌ তাই হয়ত বাড়ির চাপও থাকে। দিয়াও একটু ভয় পায় শাশুড়ি আর জাকে কড়া নজরে রাখে ওরা ওকে। বাড়ির ছেলে বাড়িতে থাকেনা। তার ওপর কমবয়েসের বৌ,বাপ মাও কাছে থাকেনা। তাই দায়িত্ব তো ওদেরই।
অনেকদিন দিয়াকে অন দেখেনা অনি। লাভলক ব্রীজের ওপর দাঁড়িয়ে বেশ কয়েকটা ছবি তুললো আজ। চোখের অন্তরালে ভাসলো গঙ্গার ছবি আর সূর্যাস্ত। আজকাল একটু একা লাগে। যদিও এখানেও অনেক বন্ধু হয়েছে, উইকএন্ডে প্রায়ই থাকে ডিনারের নেমতন্ন তবুও মন যেন নিজের কাউকে খোঁজে। ফেসবুকের অসম বয়েসের বন্ধুত্ব পঁয়ত্রিশের অনিরুদ্ধর সাথে তেইশের দিয়ার। একজন উচ্ছ্বল গঙ্গোত্রী থেকে নেমে আসা গঙ্গার মত আর আরেকজন এই বয়েসেই জীবনের অনেক অভিজ্ঞতায় ক্ষত বিক্ষত। একটু প্রলেপ খোঁজে,খোঁজে দেশের মাটির আর মায়ের গন্ধ।
পুজো এসে গেছে,এখানেও হয় পুজো। ও যায় একটু স্বাদবদল করতে আর ছবি তুলতে প্রবাসী বঙ্গললনাদের। কিন্তু কই দিয়ার ছবি এখনো নেই কেন ফেসবুকে? ওর হাবি তো আসে এইসময়,দিয়াই বলেছিলো। পুজো কাটিয়ে ও যাবে বাবার বাড়ি ওহ্ খুব মজা। ওখানে ওকে রেখে শেখর চলে যাবে কাজের জায়গায়। তারপর কালীপুজোতে এসে দুদিন থেকে ওকে নিয়ে যাবে কোয়ার্টারে। একদম পাক্বা প্রোগ্ৰাম।
পুজোর বেশ চারদিন বাদে দিয়ার ছবি দেখলো ফেসবুকে। বাহ্ কি সুন্দর লাগছে, একদম মানানসই সাজে কর্তাগিন্নী। বেশ হ্যান্ডসাম দেখতে ওর হাবিকে,প্রোফাইল খুললেই ওদের দুজনের ছবি দেখে। বাহ্ সিঁদুর খেলার ছবিতে কি ভালো লাগছে দিয়াকে। মায়ের কথা বড় মনে হলো অনিরুদ্ধর,একগাল হাসিতে কপালে আর গালে সিঁদুর লাগিয়ে মাকে যে কি ভালো লাগত! ছবি দেখতে দেখতে একটু আনমনা হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু নাহ্ আজও অন নেই দিয়া,লাস্ট সিন অনেক আগে। তাহলে একটু কথা বলতো, আসলে ফেস্টিভ সিজন হাবি এসেছে তাই হয়ত খুব ব্যস্ত।
এতদিনে হয়ত বেনারসেও চলে গেছে ওরা। মা বাবার সাথে বেনারস গেছে অনেক আগে অনি। তবে বেনারসের ছবি আবার নতুন করে এঁকে দিয়েছে দিয়া। চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পায় গঙ্গা নদী,বিশ্বনাথ মন্দির,অন্নপূর্ণা মন্দির সবটা। এমনকি দিয়াদের বাড়ির বারান্দাটাও হয়ত কল্পনায়।
শেখর আসাতে দিয়ার সময় কোথা দিয়ে যে কেটে গেছে। সত্যি আর ফেসবুক করা হয়নি তেমনভাবে। কতদিন বাদে আবার দুজনের একসাথে হওয়া,কত কথা,আদর আর বায়না শেখরের। দিয়াকে চোখে হারায় যেন। " এত যদি তোমার ভালোবাসা তাহলে চারমাস আমাকে একলা রাখলে কেন?".."আর একলা করবোনা আমার বৌটাকে। একদম গঙ্গামাইয়াকে প্রণাম করে গঙ্গাতে স্নান করবো।"..."এই ,ছেলেরা খুব বেসরম হয় তো।"বৌয়ের আধা হিন্দি বাংলা মেশানো কথা দারুণ লাগে ওর। হেসে বলে,"তাই কটা বেসরম ছেলেকে চেনো শুনি তুমি?".."চোখের তারায় বিদ্যুৎ খেলিয়ে বলে দিয়া বহত জানি।"..বুকের কাছে টেনে ওকে বলে,"তাইতো এবার আমি নিয়ে যাবো আমার এই মিষ্টি বৌটাকে একদম কাছে রেখে দেবো। পাহাড়ের কোলে আমার কোয়ার্টারে।".."ওখানে নদী আছে?".."আছেতো,একদম গাঢ় সবুজ নদী। তবে স্নান করলে ঠান্ডা লাগবে। আমার কাছে তো গঙ্গাই আছে চিন্তা কি?"..আবার হাসে দিয়া। .."এই দেওয়ালিতে আমার এত পটাকা লাগবে আর অনেক বাতি। আমাদের বেনারসের বাড়িতে খুব মজা হবে এবার।"
আসলে চ্যাট করাটাও একটা নেশা,অনিরুদ্ধর বেশ ফাঁকা লাগছে কয়েকটা দিন। দিয়াকে বেশ মিস্ করলো। অফিস থেকে ফিরেই দেখতো দিয়া অনলাইনে আছে কিনা। তবে কয়েকদিন বাদে অভ্যেস হয়ে গেলো। তবে দেওয়ালির ছবি দেখার জন্য মনটা বেশ উৎসুক হলো। হাজার প্রদীপে আর আলোতে সাজানো বেনারস গঙ্গার ধারে ঝুল বারান্দাওয়ালা বাড়িতে হাতে একথালা প্রদীপ নিয়ে দিয়া। যেমন ওর মা সারা বাড়িতে প্রদীপ দিতো নতুন শাড়ি পরে।
ওদেরও একটা গেটটুগেদার ছিলো ফেস্টিভ সেলিব্রেশনের জন্য। ভালো লাগলো,বেশ মজা হলো। তারপর উইকএন্ডে একটু ঘোরাঘুরি আর খাওয়াদাওয়া। এর মাঝেই খুঁজেছে দিয়ার ছবি,যা দেখে গতবছর ও ফ্রেন্ড রিক্যুয়েষ্ট পাঠিয়েছিলো।
ফেসবুক থেকে হঠাৎই কত বন্ধুই হারিয়ে যায় ঠিক তেমনি দিয়াকে আর খুঁজে পাওয়া গেলোনা। হারিয়ে গেলো দিয়া হঠাৎই একদম না বলে। অনিরুদ্ধর অবসর সময়গুলো আজকাল আর মনে মনে বেনারস বা কলকাতার ছবি দেখে কাটেনা। তার বদলে কখনো ওয়াইন,পার্টি,ছবিতোলা বা ওগুলো এডিটিং করেই কেটে যায়। দেখতে দেখতে পার হয়ে গেলো তিনবছর। দিয়া এখন নিভে যাওয়া বাতি অনিরুদ্ধর কাছে। বেশ কয়েকমাস আগে অনিরুদ্ধর আলাপ হয়েছে এলিজার সাথে,বেশ মিষ্টি মেয়ে। মডেলিং করে,ওর বেশিরভাগ ছবিগুলো তুলে দেয় অনিরুদ্ধ। এভাবেই প্রথমে আলাপ হয়েছিলো। বিদেশিনী হলেও এলিজার সাথে কথা বলে ভালো লাগে অনির। ওকে বলে ওর খুব ইচ্ছে একদম ভারতীয় নারীর সাজে ওর ছবি তোলার। এরপর যদি কখনো দেশে যায় তাহলে ওর জন্য আনবে লালপাড় শাড়ি আর মাটির প্রদীপ। আ্যলবাম খুলে মায়ের একটা ছবি দেখায় ওকে। মিষ্টি হাসি হাসে এলিজা। হয়ত আগামীবছর ওকে দেশে যেতে হবে। কাকা ফোন করেছিলেন বাড়িটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে,এবার ওটার কিছু ব্যাবস্থা করা দরকার আর অনি না এলে সেটা হবেনা।
অনেক বছর বাদে কলকাতায় এসেছে অনি,কয়েকদিন বাদেই দুর্গাপুজো। এবার পুজোটা কলকাতায় কাটিয়েই যাবে ভেবেছে। ওদের বাড়িটা খুলেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো, সব গাছগুলোই মরে গেছে প্রায়। ঝুল জমেছে আনাচে কানাচে। যদিও কাকা বলেছিলেন পরিস্কার করিয়ে রেখেছেন মোটামুটি। টেবিলে বাবা মায়ের ছবি পাশাপাশি। বাড়ি পাহারা দিচ্ছে যেন। মনে হলো মা যেন বলবে,"অনি এলি আয়। মুখহাত ধুয়ে নে আমি জলখাবার দিচ্ছি।"..সব ঘরগুলো ঘুরে দেখলো একটু করে। একদিন যেখানে ছিলো সোরগোল আনন্দ,আজ সেখানে শুধুই নীরবতা।
কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে অনিরুদ্ধ,মনটা ভারী হয়ে যায়। মনে পড়ে যায় কত পুরোনো স্মৃতি। আজ বড় মায়ের কথা মনে পড়ছে ওর। লাল সাদা ঢাকাই শাড়ি পরে হাতে প্রদীপ নিয়ে মা যেন একদম সাক্ষাৎ লক্ষ্মী,কে জানে এতদিন বিদেশে থেকেও ভুলতে পারেনি দেশের সংস্কৃতি আর উৎসব। খাবার দাবারের ব্যবস্থা হয়ে যায়,কাকাই সব করেছেন। এই দেশে ওরাই একমাত্র আপনজন। অনেকগুলো কাজ আছে অনিরুদ্ধর এর মধ্যে,হাতে দিন পনেরো সময় তারমধ্যে সবটা সারতে হবে।
বাড়িটার ব্যাপারে কথা চলছে কিছু একটা হয়ে যাবে হয়ত। গড়িয়াহাটে আসে অনি,দোকান বেড়েছে প্রচুর। পুজো বলে সব জমজমাট একদম। তবে ওর খুব একটা চিনতে অসুবিধে হয়না,একসময় মাকে নিয়ে তো কত শপিংয়ে আসতো। এবারও কিছু কেনাকাটা আছে কাকিমা কাকুদের জন্য আর এলিজার জন্য একটা লালপাড় গরদের শাড়ি। ওকে বলেছে,হাতে প্রদীপ নিয়ে একদম ট্র্যাডিশনাল সাজে ওর ছবি তুলে দেবে। বঙ্গনারীর সাজে বিদেশিনী এলিজা,হঠাৎই দিয়ার কথা মনে পড়ে যায় অনিরুদ্ধর বেশ কিছুদিন বাদে। কিছু মুখ কেন যেন ভোলা যায়না,কিছু কথা আর হাসি লেগে থাকে চোখে অনেকদিন।
পুজো প্যান্ডেলে অনেক ছবি তুললো অনি,বাড়ির সবারও ছবি তুললো,অনেক পুরোনো বন্ধুর সাথে দেখা আর আড্ডা হলো কদিন বেশ জমিয়ে। সেদিন দুপুরে খুব জমাটি খাওয়া দাওয়া হলো কাকার বাড়িতে,ওর দুই খুড়তুতো বোনও এসেছে পুজো উপলক্ষ্যে। ওদের নাম দুষ্টু আর মিষ্টি ওরা যমজ। কলকাতার বাইরে থাকে দুজনেই,একজন দিল্লীতে আরেকজন উদয়পুরে। বেশ আছে ওরা,খুব পেছনে লেগেছে দাদাভাইয়ের। "শোন দাদাভাই এবার তো একটা বিয়ে কর,আর কতদিন! অনেকদিন তো বাবা এনজয় করলি ব্যাচেলার লাইফ। দেখবো নাকি এখানে?"..."না না বাবা বেশ আছি,আমার মায়ের মত কি হবে এখনকার মেয়েরা? তার থেকে আমার বিদেশিনী বান্ধবীই ভালো।"..হাসিতে ফেটে পরে ওরা দুজন।..."এই বোন কিছু তো বল,কি দেখছিস তখন থেকে। সারাক্ষণ ম্যাগাজিন ওল্টাচ্ছে জানিস দাভাই,তোর মতই হয়েছে,ওর ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে আছে। আমার বাবা অফিসের চাকরিই ভালো।"
...."দেখি রে দুষ্টু ম্যাগাজিন দুটো,আজকাল খুব একটা সময় হয়না। আগে রেগুলার দেখতাম ইন্ডিয়ান কিছু ম্যাগাজিন,অনলাইনে অর্ডার দিয়ে আনিয়ে নিতাম।"..."এই নে দাভাই,দেখ ভালো লাগবে। আমারও একটা ড্রেসের ছবি আছে একটাতে।"...."তাই নাকি,আগে বলবি তো?"
সোফায় পা ছড়িয়ে বসে ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাতে থাকে অনি, নাহ্ বেশ ভালো করেছে। কভারপেজটাও দারুণ।"দাভাই এই দেখ আমার ড্রেস।"..." আমার বোন এত গুণী,সত্যি কি ভালো হয়েছে!"..পরের ম্যাগাজিনটার কভার পেজে চোখটা আটকে যায় অনিরুদ্ধর, কি সুন্দর ছবিটা। চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করেনা, এক দিকের ঘাড়টা দেখা যাচ্ছে,তাতে ঝরেছে খোলা চুল থেকে বিন্দু বিন্দু জল। ঢালা লালপাড়ের শাড়ি পরনে,একহাতে একগোছা পদ্মের কুড়ি। অন্য হাত মাটির পাত্রে ধরে রেখেছে প্রজ্জ্বলিত প্রদীপ।
মুখটা বড় চেনা লাগে,একজনের সঙ্গে খুব মিলে যায়,কিন্তু তা কি করে হয়? এই রকম একটা ইংরেজী ম্যাগাজিনে হঠাৎ না না হয়ত একই চেহারার অন্য কেউ তাছাড়া মেলেনা পুরোটা। দুষ্টুকে ডাকে অনি,"তোদের ওদিকেও এমন ছবি কেন কভার পেজে?এত বঙ্গসংস্কৃতির ছবি।"..." দাদাভাই এমন সুন্দর সংস্কৃতি আর রঙিন ছবি কোথায় আছে? আর দুর্গাপুজো তো সব জায়গাই হয়। দারুণ না ছবিটা?"..."মডেল কে রে চিনিস? না রে দাদা,তবে খুব মিষ্টি। নতুন কাজ করছে মনে হয়।"...রাতে ভালো করে ঘুমোতে পারেনা অনি,মডেলের নামটা দেখেছে….গঙ্গা। তবুও কেন যেন মনে হচ্ছে বারবার ওটা দিয়া। দিয়া....ওর স্বপ্নসুন্দরী,কিন্তু কি করে হয়! ও হয়ত পাহাড়ের দেশে বরের সাথে সুখে সংসার করছে,হয়ত বা মাও হয়েছে এতদিনে। দুটো দিন কেটে যায়,ল্যাপটপ খুলে একটু চেষ্টা করে খোঁজ নিতে ঐ ম্যাগাজিনটার ওয়েবসাইটে গিয়ে। কেটে যায় আরো দুদিন,বড় অস্থির লাগে অনিরুদ্ধর,ও আজকের ফ্লাইটে দিল্লী চলে যাচ্ছে সেখান থেকে যেতেই হবে এক জায়গায়,এতটা কৌতূহল নিয়ে কিছুতেই ফিরতে পারবেনা প্যারিসে।
.....অনেকগুলো সোর্স ধরে আর খোঁজ খবর নিয়ে সুযোগ পেয়েছে গঙ্গার সঙ্গে দেখা করার,এখন বেশ ব্যস্ত মডেল। আপাতত হরিদ্বারে যাচ্ছে অনি। নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছে যায় অনি,এখান থেকে গঙ্গাকে দেখা যায় প্রাণভরে। মনটা ভালো হয়ে যায়,আগে থেকে আ্যপয়েন্টমেন্ট করা ছিলো,ওর ডাক আসে।
....হাল্কা দিনের আলো ঢুকেছে রঙিন কাঁচের ফাঁক দিয়ে। খোলা জানলার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে গঙ্গা,চুলটা খোলা। পরনে চন্দন রঙের তসরের শাড়ি। চন্দনের গন্ধে ভাসছে ঘর..." আইয়ে বৈঠিয়ে.."পেছন না ফিরেই বলে গঙ্গা। বসে পড়ে অনিরুদ্ধ বড় মুখটা দেখতে ইচ্ছে করে।
অনেকটা নীরবতা,মুখ ফেরায় গঙ্গা। প্রথমে কথা বলতে পারেনা অনিরুদ্ধ। তারপর হিন্দীতে শুরু করতে যায়।..."আপনি বাঙলায় বলতে পারেন,আমি বাঙলা বুঝি।"..কি বলবে ভেবে পায়না অনি,ওকে কি বলবে,"তুমি কি দিয়া?দীপাবলি?"না না কেমন করে বলবে?..
.."আপনি কি জানতে চান বলুন,আমার একটু তাড়া আছে খুব বেশি সময় দিতে পারবোনা। থোড়া জল্দি কিজিয়ে।"..হিন্দী বাঙলা মেশানো কথা,একজন বলতো।...ও কয়েকটা ছবি তুলতে চায়,তারজন্য পারিশ্রমিক যা নেবে তাই ও দেবে। লালপাড় শাড়ি পরে প্রদীপ জ্বালানোর ছবি।..ওখানে একটা একজিবিশনে দেবে...হা হা করে হেসে ওঠে গঙ্গা," বাঙ্গালি লেড়কির ছবি দেখিয়ে মোটা পয়সা কামাবেন বাবুজী,তাই গঙ্গাকে মু মাঙ্গি রূপেয়া দিচ্ছেন।"...চমকে ওঠে অনিরুদ্ধ না না এ দিয়া নয়,এ তো পুরো প্রফেশনাল।.." চমকে উঠলেন নাকি? সওদা আমি এখন ভালোই করি বাবুজী..রূপিয়া তো নেবোই। বাইরে কথা বলে নিন,টাইম দিয়ে দেবে। জুয়েলারী আর ড্রেস সব বলে দিবেন উখানে।"..উঠে দাঁড়ায় গঙ্গা,গলায় মোটা চন্দন কাঠের মালা। অনি বুঝতে পারে ওকে এখন চলে যেতে হবে। হাত তুলে নমস্কার করে গঙ্গা।
অস্থিরতাটা কাটেনা অনির,এলিজার সাথে ফোনে কথা হয়,ও এখন সুইজারল্যান্ডে শ্যুটিংয়ের কাজে। তবুও ঘুম আসেনা,আর একদিন বাদেই তো ওর ফোটোশ্যুট। ভোরবেলায় হোটেল থেকে বেড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে গঙ্গার ধারে বসে সবে ভোরের আলো ফুটছে প্রায় অন্ধকার। চারিদিকে অপূর্ব শোভা,তবুও ছবি তুলতে ইচ্ছে করেনা।
হঠাৎই আশ্চর্য লাগে স্নান করে কে উঠছে! কাকে দেখছে!গঙ্গা এসেছে গঙ্গাস্নান করতে,খোলাচুলের জল ঝরছে গায়ে জড়ানো নামাবলি। হাতের কমন্ডুল থেকে জল দিচ্ছে শিবলিঙ্গে। সঙ্গে দুজন সঙ্গী,কোনদিকে না তাকিয়ে চলে যায় ওরা। কিন্তু আজ যেন দিয়াকে দেখলো অনি।
অনির নির্দেশমত বাধ্যমেয়ের মতই পোজ দিলো গঙ্গা,ওকে সত্যিই কিছু বলতে হয়না। যেন সবটাই সহজাত,তবে নিজেকে একটা আবরণের মধ্যে রাখে। কিছুতেই ওর কাছে যাওয়া যায়না। বলা যায়না অপ্রয়োজনীয় কথাও,কিছু বলতে গেলেই বলে,"কামের বাত বলুন বাবুজী। সময় কোথায় বেকার কথা বলবার। তাহলে তো সারাদিনই বাতো বাতো মে কেটে যাবে।"..না না এ দিয়া নয়,কত কথা বলতে ভালোবাসত মেয়েটা,সুযোগ পেলেই কত কথা!
কাল ফিরে যাবে অনি,গঙ্গার নির্দেশে ওর আ্যড্রেস আর ইমেইল আইডি রেখে যায় ওখানে। খুব ভোরে উঠে গঙ্গার ধারে যায়,সূর্য উঠে গেলো কিন্তু কই গঙ্গা তো এলোনা স্নান করতে। বেশ কিছুক্ষণ বসে ফিরে আসে হোটেলে। ছবিগুলো দেখতে ইচ্ছে করছে বারবার। মনটা বড় এলোমেলো,আর সেই মন নিয়েই এবার ফিরলো প্যারিসে।
ফেসবুকে গঙ্গার প্রোফাইল দেখে অনি,তবে ও এখন শুধুই ফলোয়ার্স হাজার হাজার গুণগ্ৰাহীর মাঝে। প্রায় ছমাস বাদে একটা মোট খাম আসে অনিরুদ্ধর কাছে,হয়ত কোন ম্যাগাজিন হবে,ঠিকানাটা তো একটা আ্যড এজেন্সির। খুলে ফেলে ও..সুন্দর করে মোড়ানো বেশ কয়েক পাতার কাগজ বেশ বড় একটা চিঠি। বড় অবাক লাগে ওর পড়তে শুরু করে...
বাবুজী,
কিছু বাত হয়ত না বলা থাকলেই বহুত আচ্ছা হয় তবুও পারলাম না তাই এই চিঠ্ঠি লিখছি। আপনার চোখদুটো দেখে সেদিন আমি বেশিক্ষণ তাকাতে পারিনি। আপনি খুঁজছেন কাউকে আমার মধ্যে কিন্তু বলতে পারছেন না। গঙ্গা কি করে দিয়া হবে? আমি বেনারসের দিয়া,আজ বলবো আমার কাহানি,যা সামনে বলা যায়না। ফেসবুকের দিয়া আজ গঙ্গা,আমিও কাজের মাঝে আপনার সাথে বাতের কথা ভাবি,মনে পড়ে। মগর আজ আমার চ্যাটের টাইম নাই। সেবার দুর্গাপূজার পর আমি যাই বেনারস,কত মজা হলো সবাই মিলে। গঙ্গামাইয়াতে স্নান,মিঠাই খাওয়া। বিশ্বনাথ দর্শন সব কুছ,শেখরও খুব খুশ ছিলো। দেওয়ালিতে আমি সাজলাম খুব,গয়না পরলাম অনেক। লাল শাড়ি পরলাম,আর কত ফটো তুললো সবাই। আমার দুই বোন পিয়া আর সুহানা সবাই মিলে বাজি পটাকা,আতসবাজি সব জ্বালালাম ছাদে।
রাতে শেখর বললো,আরেকবার সুহাগরাতের মত সারারাত জেগে শুধু তোমাকে সোহাগ করবো আজ। শরমে মুখ ঢাকলাম ওর বুকে,ও কথা বলতে দিলোনা আর আমাকে। কিন্তু সেই রাতের পর সব বদলে গেলো। দুদিন বাদে আমাদের পাহাড়ে যাবার বাত ছিলো। সেদিন রাতে বাড়িতে ডাকাতের হামলা হলো,ওরা খবর পেয়েছিলো অনেক গয়না আছে বাড়িতে। আমরা তখন ঘুমাচ্ছিলাম,সেদিন সুহানা আর পিয়া গিয়েছিলো মাসির বাড়ি। ডাকুরা সব নেওয়ার সাথে সাথে,আমার জীবন শেষ করে দেয়। ওরা চারজন মিলে আমার ইজ্জত নেয়। শেখর বাধা দিতে গেলে ওকে খুব মারে,বাবাও মার খায় খুব। শেখরকে দুদিন হাসপাতালে রেখে বাঁচানো যায়না। আমাকে শ্বশুরবাড়িতে নেয়না,আমাদের জ্ঞাতিরা বাবাকে বলে আমাকে রাখলে ওরা বাবাকে সমাজে থাকতে দেবেনা। বোনেদের বিয়ে হতে দেবেনা। আমি সব শুনতে পাই তাই ভোরবেলায় গঙ্গামাইয়াতে ডুবে মরতে যাই। কিন্তু পারিনা,আমাকে বাঁচায় একজন। আজ উনিই আমার মাইজী,ওনার হাত ধরে বেনারস ছাড়ি। চলে যাই উদয়পুর রাজস্থানে। ওখান থেকেই একটু একটু করে আজ এই জায়গায়। দিয়া মরে গেছে,মরে গেছে দীপাবলিও,শুধু বেঁচে আছে গঙ্গা। গঙ্গামাইয়ার থেকে দূরে থাকতে পারিনা তাই হরদ্বোয়ারে ঐ বাড়িটা নিয়েছি। এখন তো সারা দেশেই ঘুরতে হয়। গঙ্গা দয়া করে পুরুষদের,তাদের কামনা বাসনার পাপ ধুইয়ে দেয়। গঙ্গা পবিত্র,শুদ্ধ তাতে তো কত পাপ নোংরা রোজ পরে আমিও তাই আজ একটা কেন হাজারটা পুরুষের কামনা। ওদের আমি ভিক্ষা দিই,ওদের খুশ চেহারা দেখে সুখ পাই মনে।"
.....বাবুজি আপনাকে আমি ভুলিনি,মনে ছিলো ফোটো বাবুকে। আপনিই তো বলতেন আমি বহুত খুবসুরত একদম আপনার মাইজীর মত। কথাটা ভুলতে পারিনি আজও,তাই বাঙ্গালী ফোটোশুট আমি মিস্ করিনা।
(আপনার দেওয়া চেকটা আমি ফেরৎ পাঠালাম,ওতে কোন আ্যমাউন্ট বসাইনি আমি, তাই ক্যানসেল করে পাঠালাম। আপনাকে খুশ দেখে বহুত ভালো লাগছিলো। গঙ্গা পুরুষের খুশ চেহারা বহুত পসন্দ করে। ভালো থাকবেন,খুশ থাকবেন।)
'গঙ্গা'
চিঠিটা পড়তে পড়তে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিলো অনিরুদ্ধ,কি শুনলো ও! এ যেন গায়ে কাঁটা দেওয়া এক জীবনযুদ্ধের কাহিনী। সারারাত ঘুমোতে পারেনা ছটফট করে এক যন্ত্রণায়। ভোরবেলা চিঠিটা পকেটে নিয়ে সিন নদীর ধারে বসে আবার পড়ে চিঠিটা। তারপর ধীর পায়ে লাভলক ব্রীজে উঠে একটা তালা লাগিয়ে দেয় চোখবন্ধ করে একটু প্রার্থনা করে। আজ যে দিয়ার থেকেও গঙ্গাকে বেশি ভালোবেসে ফেলেছে অনি। তাই গঙ্গার শুদ্ধতাতে নিজের মনপ্রাণকে শুদ্ধ করতে বড় ইচ্ছে হলো ওর।
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment