Skip to main content

রূপের বিচার

#রূপের_বিচার#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#

"পাত্রী ঘরোয়া সুশ্রী,উচ্চতা পাঁচ ফিট সাত...এই শুনছো,বড় বেশি লম্বা না?ঐরকম একটা ঢ‍্যাঙা বৌমা ঘরে ঘুরে বেড়াবে বাড়িময়। আমাদের বড় বৌমা তো পাঁচ তিন। সেইরকমই ভালো তাইনা?"..ব‍্যাজার মুখে কর্তাকে বলেন ইন্দু।
''তাহলে আর কি এটা বাতিল করো,অন‍্যগুলো দেখো। আমাকে আর এর মধ‍্যে জড়িয়োনা তো বাপু। নিজেরা দেখো,দরকার হলে মেয়েকেও ডেকে নাও।''...''এই হয়েছে একটা লোক সারাদিন বইয়ে মুখ গুজে আছে। কোন ব‍্যাপারে তাপ উত্তাপ নেই। ছেলের বিয়ে দেবে মাথাব‍্যাথাই নেই।''
...''যার বিয়ে তাকে একটু মাথাব‍্যাথা করতে দাওনা।''...''তাহলেই হয়েছে মা আর বৌদির ওপর সব ছেড়ে বসে আছে। আর বৌমার তো সময়ই নেই। অফিস নিয়ে রয়েছে সারাদিন,আর আমার হয়েছে জ্বালা সংসার সামলাও নাতি সামলাও।
তাই সুমনকে বলে দিয়েছি আর চাকরিওয়ালা বৌয়ের দরকার নেই। সাধারণ মেয়েই ভালো।''
....''তাহলে আর এত খোঁজা কেন বাপু একটা মেয়ে আনলেই তো হয় মোটামুটি দেখে।''
...''কি যে বলোনা,বড়বৌমার পাশে তো রাখার মত কাউকে লাগবে। যা খুশি একটা আনলেই হলো?''
             সুমন অফিস থেকে ফিরতেই পাকড়াও করেন ইন্দু ,''বাবু এই পাঁচটা মেয়ে বেছেছি,ফোনও করেছিলাম। তুই একবার দেখে নিস।' মনে মনে হাসে সুমন,এতগুলো মেয়ে এখনো আছে?আজকাল তো মেয়েই পাওয়া যায়না। সুন্দরীরা মোটামুটি বাজেয়াপ্ত হয়ে যায় কমবয়েসেই ওর বড়বৌদি বা ছোটবোনের মত। শুধু ওর কপালেই কেউ জুটলোনা হায়। প্রেম ফ্রেম আর হলোনা জীবনে।পাহাড়ে ট্রেকিং করেই মোটামুটি সময় কেটে যায় আর এই নিয়ে তো বেশ আছে। আবার কি?
      তবুও ছাড় নেই মায়ের অত‍্যাচারে মেয়ে দেখতেই হলো,তবে পাঁচ নয় ও ছাটাই করে ওটাকে তিন করলো। মা খুবই অনুরোধ করছিলো অন্তত চারটে দেখার জন‍্য। "মা এই তিনেই যা হবে হোক আমার আর ভালো লাগছেনা। আগেও তো দেখেছো কটা,সবাই কি আর বড় বৌদির মত সুন্দরী হবে? আবার তুমি নেবে হোমমেকার চাকরি করলে চলবেনা। সবাই যে যার মত বিয়ে করলো,আর আমার বেলাই যত গোলমাল।''
....''করলে তো বাঁচতাম,আমার ঝামেলা যেত বাপু। বছরে ছয়মাস পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ানো।সংসারে তো তোর মোটেই মন নেই।''
       তিনটে মেয়ে দেখেও সুমনের চোখ আটকে গেলো কোয়েলেই,মানে যাকে বাতিল করেছিলেন মনে মনে ইন্দু কিন্তু সুমনের হাইটটা বড় পছন্দ হয়েছিলো। বাহ্ দারুণ লম্বা তো! কুছ পরোয়া নেই ও তো ছয় ফিট সুতরাং দেখা যেতেই পারে। শুধু খুঁত খুঁত করলেন ইন্দু এতোগুলো ফর্সা মেয়ে দেখে তোর শেষে এই কালো মেয়েটাকেই মনে ধরলো? জানিনা বাপু নিজেরা সংসার করবে বুঝে নাও। দেনাপাওনাও তো তেমন কিছু দেবে বলে মনে হয়না,মা নেই বাবা আর মেয়ে থাকে দাদা বৌদির সংসারে। শুনলাম থাকে বেশিরভাগই গ্ৰামের বাড়িতে তবে গ্ৰ‍্যাজুয়েট এই যা রক্ষা।
            ওর বৌদি বললো,''কি আর করবে মা,নির্বন্ধের চোখ কানা। ওর এই বাড়িতেই চাল মাপা আছে। তবে রোগা,লম্বা ঠিকই আছে। গায়ের রঙটা ম‍্যাটার করেনা তেমন।''..মনে মনে ভাবে যাক বেশি সুন্দরী না হওয়াই ভালো।
              বৌভাতের শাড়ি কেনা নিয়ে এক দফা হলো এই রঙ নয় তো ওই রঙ। কালো মেয়ে এটা ভালো লাগবেনা,ওটা লাউড কালার। বৌদি আর বোনের কথায় বিভ্রান্ত হয়ে সুমন দোকানদারকেই ধরলো,আর উনি বললেন যে গায়ের রঙ চাপা হলে ডিপ রঙই বেশি ভালো লাগে। যাক ঝামেলা মিটলো শেষে।
          গয়নাগাটি দেখে মা একটু নাক কুচকালো,'মান্ধাতা আমলের মায়ের গয়নাগুলো দিয়েছে সব।'...'মা তবে ডিজাইনগুলো কিন্তু ভালোই বেশ, ঐগুলোই তো আবার ফিরছে নতুন হয়ে। তুমি খবর রাখোনা,আমি তো তাই দেখি।'..'তুই থামতো,আর কি ছেলে পছন্দ করেছে কিছু বলার নেই।' কোয়েল কয়েকটা কথা শুনতে পায় উত্তর দেয়না। গয়নাগুলো ওর মায়ের,বড় প্রিয় ওর,ডিজাইনগুলোও দারুণ। বৌভাতের দিন কোয়েলকে দেখে কেউ খারাপ বলেনি,ভালো পার্লার থেকে লোক এনেছে ছেলে। "শুধু রঙটা যদি একটু ফর্সা হত!"বলেন ইন্দু..."মা তাহলে বৌদিকে হয়ত টলিউডে ডেকে নিত। আজকাল এইসব কালো ফরসা ম‍্যাটার করেনা মা। ভালো হলেই হলো।''
                    ফুলশয‍্যার রাতে খুব গম্ভীর হয়ে সুমন বলে,"তুমি তো খুব আনরোমান্টিক,ফোনে একটা দুটো কথা বলেই ফোন ছেড়ে দিতে। কেন আমাকে তোমার পছন্দ হয়নি?"...হাসে কোয়েল,"বৌদি বলেছিলো বেশি কথা না বলতে বিয়ের আগে।"... বলে সুমন,''বাধ‍্য ননদ কিন্তু,আমার একটা শর্ত আছে বলছি দেখো মানতে পারবে কিনা?"..একটু চিন্তাই হয় তবুও বলে কোয়েল,"কি শর্ত শুনি?"..."শর্তটা এই যে আমার সাথে বেরোনোর সময় হিল পরে বেড়োনো যাবেনা।"...এবার আর পারেনা,হেসে ফেলে কোয়েল,সত‍্যি বোধহয় ওর বরটা খুব ভালো আর সরল। হাসলে ভারী মিষ্টি লাগে কোয়েলকে,চোখ ফেরাতে পারেনা সুমন। ইচ্ছে করে বড় কাছে এসে ওর গালদুটো আদরে ভিজিয়ে দিতে। লজ্জা পায় কোয়েল,বেনারসীটা সত‍্যিই ওকে বেশ মানিয়েছে।
         কম কথা বললেও কোয়েল বোঝে ওকে নিয়ে শাশুড়িমা খুব একটা খুশি নয়। কথায় কথায় গায়ের রঙের প্রসঙ্গ আসে। তাতে একটু ঘিয়ের ছিটে দেয় ওর বড় জা,"এত ভেবোনা মা,আগে গ্ৰামে থাকত। এখন শহরের হাওয়া লাগলেই কদিনেই রঙ ফিরে যাবে দেখো। তার উপর পার্লার আর দামি ক্রীম মাখলেই একদম জেল্লা খুলে যাবে।".."আমি পার্লারে যাইনা দিদিভাই। অতটা টাকাও বাবার ছিলোনা।"..... "সে কি! অবাক করলে তো?".."মা পছন্দ করতোনা,তারপর টাকাটাও তো লাগে।"..."হ‍্যাঁ তুমি তো আবার কিছু করোনা।" শ্বশুরবাড়িতে ঢুকে দুটো জিনিস বুঝেছিলো বড় জায়ের মত হতে হলে ওর দুটো জিনিস দরকার একটা চাকরি, আর গায়ের রঙ। তবে আপাতত দুটোই ওর কাছে অসম্ভব। কারণ ও চাকরি করেনা বলেই শাশুড়িমা মত দিয়েছিলেন। আর গায়ের রঙ সে তো ফেরানো অসম্ভব।
         এর মাঝেই ওদের বিয়ের আ্যলবাম এলো। ছেলেকে ঢাউস ব‍্যাগ আনতে দেখে অবাক হলেন ইন্দু,"কি আছেরে ব‍্যাগের ভেতর,খুব ওজন তো!"..."কি আর থাকবে মা,আছে কিছু স্মৃতি। আমাদের বিয়ের ফটো। এই এতোদিন সময় নিলো দিতে।"..."ঐ তো সিরিঙ্গি কালো বৌ তার আবার ছবি,পারেও বটে ছেলেটা। এর জন‍্য একগাদা টাকা খরচ করলো!খুব ছবির নেশা ছেলেটার ঘর ভর্তি বেড়ানোর ছবি,যা পারে করুক।"মনে মনে বললেন ইন্দু।
         রাতে সবাই এলে আ্যলবাম খুললো সুমন।বৌদি,বোন,মা,কোয়েল সবাই একসাথে বসে ছবি দেখার মজাই আলাদা। সত‍্যি বোধহয় কিছু চমক ছিলো সবার জন‍্য,কোয়েলকে তো চেনাই যাচ্ছেনা কে বলবে ও কালো!সবার থেকে ওকেই বোধহয় সবচেয়ে সুন্দর লাগছে। সত‍্যি ফটোগ্ৰাফারের হাত ভালো কি দারুণ তুলেছে ছবিগুলো মুগ্ধ হতে হয় দেখে। তেমনি সুন্দর লাগছে ক্লোজ ছবিতে ওর গয়নাগুলো।
       সুমনের বোন আর ভগ্নীপতি তো বলেই ফেললো,"দাদা ফাটিয়ে দিয়েছো!দুর্দান্ত ছবিগুলো হয়েছে। আমাদের নতুন বৌদিকে তো চেনাই যাচ্ছেনা,জাস্ট ফাটাফাটি।"
   শুধু ওর বৌদি মুখ বেকিয়ে বললো,"আজকাল সব মেকআপ আর এডিটিংয়ের কামাল। আমাদের সময় তো এত কিছু ছিলোনা।"..."তখনও ভালো ফটোগ্ৰাফার নিয়েছিলাম বৌদি, আসলে কোয়েল খুব ফটোজেনিক। স্টুডিওর ভদ্রলোক বলছিলো।"
           "সত‍্যি বোধহয় বিয়ের পর ছেলেগুলো বেহায়া হয়ে যায়। কিরকম বৌয়ের সুখ‍্যাতি করছে দেখো দেখিনি। আমাদের সময় বাপু এমন ছিলোনা।"...মনে মনে গজগজ করেন ইন্দু। বড় ছেলেটা এমন নয়,অবশ‍্য সে তো বাইরে বাইরেই থাকে।
        ..."দাঁড়াও দাঁড়াও এইবার এইটা দেখো।ওহ্
সত‍্যি দুর্দান্ত হয়েছে এটা। আমি তো কথাই বলতে পারিনি প্রথমে।"...অবাক হয়ে দেখে কোয়েল সত‍্যিই ওর বরটা শৌখিন। কি সুন্দর হাল্কা ঘোমটা দেওয়া ওর ছবিটা,মুখটা একটু কাত করা। আর ওদের দুজনের একটা বড় ছবি। ওর জা কাজ আছে বলে উঠে যায়,ননদও রাত হচ্ছে বলে শ্বশুরবাড়ি যাবার উদ‍্যোগ নেয়। শুধু ননদাই বলে,"দাদা আমি এই ছবিটা একটু মোবাইলে নিলাম। খুব ভালো লাগলো।"
         সেদিন রাতটায় সুখের পায়রাগুলো বোধহয় একটু বেশিই ডানা ঝাপটালো কোয়েলদের শোবার ঘরে। কোয়েলের কালো চোখের কাজলদিঘি তে ডুব দিলো সুমনের মুগ্ধ মনটা।
           ....সকালে ইন্দু একটু বেশিই অস্থির করতেন কোয়েলকে। তাই বেশিক্ষণ শোওয়া হতনা। এমনিতেই ওর একটু সকাল সকাল ওঠা অভ‍্যেস,বাড়িতেও সংসার সামলাতে হত সেভাবেই। জা বেরোবে তাই সবটাই গুছিয়ে দিতে হত তাড়াতাড়ি। শাশুড়িমা রান্নার দায়িত্ব খুব একটা ছাড়তেননা,তবে রান্নার জোগাড়,খেতে দেওয়া টিফিন গোছানো সবটাই করতে হত। দেখতে দেখতে এলো বিয়ের পর কোয়েলের প্রথম পুজো,এবার সুমন ওকে সাথে নিয়ে পছন্দ মত শাড়িই এনে দিয়েছে। শাশুড়িমা দেখে বললেন,"সব এত গাঢ় রঙের শাড়ি!যাক তোমাদের যা পছন্দ। এখন অবশ‍্য একটু জেল্লা এসেছে।"..আজকাল সত‍্যি বিরক্ত লাগে ওর। তারপর সুমনও পুজোর পর ট্রেকিংয়ে যাচ্ছে তাই মনটাও খারাপ। ওর কিছু করার নেই তাই ওকেই একা থাকতে হবে,আর কি করবে কদিন বাবার কাছে যাবে।
       তবে পুজোটা বেশ ভালো কাটলো,অষ্টমীর দিন ওরা সবাই মিলে গিয়েছিলো ননদের গ্ৰামের বাড়িতে। সত‍্যি খুব মজা হয়েছে,অনেকদিন বাদে গ্ৰামের গন্ধ আর শিউলির মিষ্টি সুবাসে মন ভরে গিয়েছিলো কোয়েলের। ওখানেই আলাপ হয়েছিলো মেঘার সাথে,ওর ননদাইয়ের পিসতুতো বোন। "ওহ্ বৌদিভাই,তোমাকে অনেকদিন দেখার ইচ্ছে ছিলো। সোনাদার কাছে তোমার ছবি দেখে আমি তো পুরো ফিদা হয়ে গেছি। আর তেমন সুন্দর তোমার গয়নাগুলো। একেবারে এথেনিক।"..লজ্জা পায় কোয়েল তবুও বলে,"আর এখন কি দেখছো বৌদিভাইটা একদম কালো পেত্নী তাইনা?"
.."সত‍্যি তুমি খুব ফটোজেনিক,দুর্দান্ত!আমার বন্ধু আছে অত্রি ও তো তোমাকে পেলে সমানে ছবি তুলে যাবে।"..একটু হাসে কোয়েল,যা পেয়েছে জীবনে তাই অনেক এরপর আর অন‍্যকে দিয়ে ছবি তুলিয়ে কাজ নেই। শাশুড়িমা আরও কত কি বলবেন কে জানে?
          পুজোর পরটা সত‍্যি খুব খারাপ কাটলো সুমন প্রায় পনেরো দিন ট্রেক করে এলো। একে বিরহ আর তারপর চিন্তা। দিদিভাই মানে ওর জায়ের কথা ভাবলো কোয়েল,"দাদাভাই এখানে থাকেনা অথচ দিব‍্যি আছে অফিস নিয়ে। সুন্দর সেজেগুজে থাকে। আর কিছু না করার মাশুল ওকে দিতে হয়,সবাই বেরোয় ওরই শুধু বেরোনো হয়না।
          সুমন ফিরে আসার পর খুব অভিমান হলো কোয়েলের,"তোমরা বেশ আছো,অফিস বেরোনো এইসব নিয়ে।"..."আচ্ছা দেখি এরপর ছোটখাটো ট্রেকে দেখবো তোমাকে যদি নেওয়া যায়। ওটা আমার স্বপ্ন কোয়েল,তোমাকেও খুব ভালোবাসি তবু প্লিজ বাধা দিয়োনা।"..."স্বপ্ন শুধু তোমরাই দেখতে পারো,আমরা নয়।"..কোয়েলকে আদর করে বুকের কাছে টেনে নেয় সুমন, জড়িয়ে ধরে বলে,"আচ্ছা বলো, কি করতে চাও তুমি। আমি তোমাকে হেল্প করবো।"..কোয়েল ভালো করেই জানে সকালে উঠে সবটাই ভুলে যাবে এই আকবর বাদশা। তাই আদরে ডুবে যেতে যেতে আর বেশি কথা বলতে পারলোনা কোয়েল।
               বেশ কিছুদিন বাদে আবার মেঘার সাথে দেখা হয়ে গেলো ননদের ছেলের জন্মদিনে।" ওহ্ বৌদিভাই,তোমাকে খুব মিস্ করছিলাম সেদিন তোমার কোন ফোননম্বরও নেওয়া হয়নি। অত্রিকে বলেছি তোমার কথা ওর ভীষণ ইচ্ছে তোমার সাথে দেখা করার। দাঁড়াও একদিন ওকে তোমাদের বাড়িতে নিয়ে যাবো।"...একটু ঘাবড়ে যায় কোয়েল অথচ না করতে পারেনা। .."এই যে কি ভাবছো শুনি? তুমি কখন ফ্রী থাকো বলতো।"..কোয়েল ভেবে চিন্তে দুপুরের কথাই বললো।.."ওয়াও তোমার ঝুমকোটা কি দুর্দান্ত!এটাও কি তোমার মায়ের গয়না?"....হাসে কোয়েল,"না এটা আমি ডিজাইন করে দিয়েছিলাম স‍্যাকরাকে,আর আঙটিটা। "...." ওহ্ হো আমি তো লক্ষ‍্যই করিনি। তোমার এত গুণ! একমিনিট বৌদি,ঘাড়টা কাত করে আঙটিটা গালের কাছে এনে একটা পোজ দাওনা প্লিজ।"...."এই যে মেঘা কি হচ্ছে আমার বৌঠানের সাথে চুপি চুপি। কোথায় আমি একটু ঘুরোবো টল লেডির হাত ধরে। আর তোমার কর্তাও তোমায় হারাচ্ছে চোখে গো।"..."দাঁড়া দাদা,আমি ছেড়ে দিচ্ছি তোর বৌঠানকে আর পাঁচ মিনিট। তোমার হোয়াটস আ্যপ আছে?"...."আছে তবে চালানো হয়না তেমন। বন্ধুবান্ধব তেমন নেই,সময়ও পাইনা।"
     কোয়েলের কাছ থেকে ওর নম্বর নিয়েই ছাড়লো মেঘা। সেদিন ভালোই কাটলো ওদের সবার। তারপর কেটে গেছে কয়েকটা দিন। হঠাৎই একদিন ফোন করে মেঘা।..."তুমি কি গো সকাল থেকে একবারও হোয়াটস আ্যপ খোলোনি? যাও খোলো এক্ষুণি।"..."সময় পাইনি গো,আচ্ছা আচ্ছা।"
      ফোনটা খুলে মনটা ভালো হয়ে যায় কোয়েলের,কি করেছে মেঘাটা!অনেকগুলো সুন্দর ছবি পাঠিয়ে দিয়েছে ওর। কখন তুললো ছবিগুলো? দুটো ওর সামনেই তুলেছে যদিও।
  মোবাইলে পিং,"এই যে কেমন হয়েছে বললেনা তো? ঐ গালে হাত দেওয়া ছবিটা ডিপি করো প্লিজ।" সত‍্যি মেঘাটা খুব ভালো,এত কম আলাপে ভাবাই যায়না। আসলে আমাদের চারিদিকে অনেকেই আছে যারা সারাক্ষণই আমাদের দোষ ত্রুটিগুলো চোখের সামনে দেখিয়ে আমাদের ছোট করতে চায়। কোয়েল তেমনি মানুষজন বেশি দেখেছে। শুধু মেঘাই একেবারে আলাদা।
             একটু ভয়ে ভয়েই ডিপিটা চেঞ্জ করলো কোয়েল,যদিও সুমন অতকিছু খেয়াল করেনা। কারণ কোয়েলকে সবাই তেমন কিছু গুরুত্ব দেয়না,ঘরের কাজকর্ম করছে। সব পরিপাটি গুছিয়ে রাখছে এতেই সুমন খুশি। বার বারই আজ হোয়াটস আ্যপ খুলে দেখছিলো কোয়েল। না না কোন মেসেজ কেউ করেনি। শুধু মেঘা একটা বড় হার্ট পাঠিয়েছে খুব খুশি হয়ে। রাতে সুমন পাশ ফিরে শুলো,কোয়েলের মনটা একটু কেমন করলো একটু অভিমানও হলো। পরদিনও সুমন একটু চুপচাপ। সকাল থেকে রান্নাঘরে সময় কেটে গেলো ওর। দুপুরে ফোনটা খুলে,নিজেই মুখটা ঢাকলো।...প্রথম দেখাতেই পড়েছি প্রেমে
                    আজ তো ডিপিতে ফিদা হলাম।
                     একটু আদর পাবার জন‍্যে,
                     শুধু শুধুই রাত জাগলাম।
ইশ্ জিভ কাটে কোয়েল,হোয়াটস আ্যপে ওর প্রথম প্রেমপত্র। সারারাত বেচারা,খুব ভুল হয়েছে। কোন কিছু আর লিখতে পারেনা ও মেঘার তোলা ছবিগুলো পাঠিয়ে দেয়। আজ কোয়েলের সারাদুপুরটা অনলাইনেই কেটে যায়। মাঝে একবার মেঘা মেসেজ করে,"কি গো বৌদিভাই,আজ কি দেখছি?" শাশুড়ি এসে উঁকি মারে ফোনটা রাখে কোয়েল। এভাবেই কেটে যায় দিনগুলো,গরমে সুমন আবার যাবে পাহাড়ে। এবারও কোয়েল বাদ,আসলে সম্ভব নয় যাওয়া জায়গাটা এমন।
                    সুমনের না থাকার মাঝেই একদিন মেঘা এলো অত্রিকে নিয়ে। মেয়ের ননদ তাই শাশুড়ি তেমন কিছু বললেন না। জাও বাড়ি ছিলোনা,তাই আড্ডাটা বেশ হলো। "বৌদিভাই দাদা তো নেই,অত্রি তোমার কয়েকটা ছবি নিতে চাইছে তুলবে? যদি তুমি বলো।"ওদের ছাদের বাগানে অত্রি কয়েকটা ছবি নিলো কোয়েলের।
                          বাধা দেয়না কোয়েল,সংসারে চলতে গিয়ে ও বুঝেছে আজকাল মেয়েদের রান্নাবান্না ঘর সামলানো ছাড়াও নিজেদের একটা জগতের খুব দরকার আসলে নিজেদের বৃত্তে সবাই একা। তাই আজকাল বড় ইচ্ছে হয় কিছু করার। অত্রি আ্যড এজেন্সিতে চাকরি করে শুনেছে কোয়েল,মেঘা ওকে সবটা বলেছে।
              এই বাড়িতে এসে বুঝেছিলো রূপের বিচারে ও ফেলনা। কিছু করার নেই ওর,তবে যদি গুণগুলোকে শান দেওয়া যায় ক্ষতি কি?
   পাহাড় থেকে এসে সুমন কত গল্প করে অবাক হয়ে যায় কোয়েল। "দাঁড়াও তোমার জন‍্য একটা সারপ্রাইজ আছে,যা দেখেছিনা ওহ! রাতে দেখাবো তোমায়। সেদিন রাতে কোয়েল বেশি সারপ্রাইজ দিয়েছিলো সুমনকে হয়ত বা বুঝিয়েছিলো দুপায়ে কঠিন পর্বত পার করার স্বপ্ন হয়ত সে দেখতে পারেনা। তবুও ওর মত সাধারণ রোগা কালো সিরিঙ্গি মেয়েরাও স্বপ্ন দেখে ইচ্ছেগুলোকে বাঁচিয়ে জীবনে একঝলক রোদ্দুর পাবার। অত্রির এডিট করা ছবিগুলো দেখে সুমনের মনটা একটু কেঁপে উঠলেও ঘাত প্রতিঘাতে পাহাড় জয় করা সুমন বুঝতে পেরেছিলো কোয়েলও জয় করতে চায় ওর প্রতিবন্ধকতা,স্বপ্ন দেখতে চায়। সুমনকে চুপ করে থাকতে দেখে কোয়েল বলে," তুমি রাগ করেছো?"..."ভীষণ রাগ করেছি যে আমার বৌটাকে এবার অনেকেই দেখবে ভিড়ের মাঝে।"..বলেই হেসে ফেলে। ..."কিন্তু মা,বাবা দিদিভাই,ছোড়দি ওরা কি বলবে?" মুখটা গম্ভীর করে সুমন বলে..."সে আমি জানিনা,তুমি ম‍্যানেজ করবে। আমি কি করবো?"
                     মাঝে বেশ কয়েকমাস কেটে গেছে,আবার একটা পুজো এলো। পুজোর কয়েকটা দিন খুব হৈ চৈ করে কেটে গেলো সবার।
   আর কয়েকদিন বাদেই তো ধনতেরাস আর তারপরেই কালীপুজো। সেদিন সকালে বেশ সকাল সকাল উঠেছে কোয়েল আর সুমন। চায়ের টেবিলে সবাই বসে কোয়েল চা দিচ্ছে, হঠাৎই পেপার আর ম‍্যাগাজিনটা নিয়ে আসে সুমন," মা এই ছবিটা দেখোতো,এই নাও তোমার চশমা।"...."কি ছবি? দেখি দেখি।"..হাত বাড়ায় বৌদিও। কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ। ধনতেরাসের গয়না পরে একটা নামী গয়নার দোকানের আ্যডের ছবিটা যে কোয়েলের। ইন্দু বললেন,"একবার জানালিনা আমাদের! এত কিছু করলি?"...সুমনের মুখের দিকে তাকায় কোয়েল। " না না ভেবেছিলাম তোমার কালো লম্বু বৌমাকে আবার কে নেবে আ্যডে? তাই  আমিই বিশ্বাস করিনি।"
     বৌদির মুখটা গোমড়া হলেও হাল্কা হাসির রেখা খেলে যায় ওর মায়ের মুখে," অমন বলিসনা, কালো ঢ‍্যাঙা। বেশ ঠাকুর ঠাকুর লাগছে মুখখানা গয়না পরে।"..ঠোঁট উল্টে সুমন বলে," কে জানে গয়নার দোকানের ওরা বললো কালো রঙেই নাকি সোনার গয়না সবচেয়ে ভালো লাগে। আমি অতশত বুঝিনা বাপু। জয় মা কালী,জয় মা তারা।" হাসছে তখন কোয়েলও। মেঘা ফোন করে,"বৌদিভাই আমাদের ট্রিটটা কবে হচ্ছে?"
..কোয়েলের কানে কানে সুমন বলে,"ম‍্যানেজ করলাম পুরোটা,আমার কিন্তু তিনটে শর্ত আছে।"
....মুচকি হেসে মাথায় হাত দেয় কোয়েল,"তিনটেএএ...." আর ভাবে জীবনে স্বপ্ন থাকে অনেকেরই কারো পূরণ হয় কারো বা হয়না। তবে ভালোবাসার মানুষগুলো পাশে থাকলে হয়ত অনেক কঠিন কাজই সহজ হয়ে যায়।

সমাপ্ত:-

               
          
              

               

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...