Skip to main content

গুণের দেমাক

#গুণের_দেমাক#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#

"বাহ্ সার্থক নাম আপনার মেয়ের তো! কি সুন্দর নাম নির্বাচন করেছেন আপনারা।"
....ওর বাবা না বুঝলেও কৃষ্ণা বলে ওঠে," কেন বলুন তো? নামটা নিয়ে হঠাৎ আপনাদের এত প্রশংসা?"
...." নাহ্ আসলে নাম দেখেই সবটা বুঝে নেওয়া উচিত ছিলো আমাদের। মানে কৃষ্ণা নামটা কালো মেয়েদেরই হয়। শুধু শুধু আমরা সেই কলকাতা থেকে ছুটে ছুটে বর্ধমানে এলাম।"
..."ওর বাবা আমতা আমতা করে বলে," কিন্তু ফোনে তো বলেছিলেন ছবি দেখে আপনাদের পছন্দ হয়েছে।''
...." আপনিই বা কি করে যোগাযোগ করলেন যেখানে লেখা ছিলো সুন্দরী ছাড়া পত্রালাপ নিষ্প্রয়োজন। ছবি ধুয়ে কি জল খাবো বলুন তো,আজকাল তো দেখি সবই মুখে ময়দা মাখা মেয়ে।ফটোতে এক আর সামনাসামনি আরেক।"
        ওদের কথা শুনে অসহ‍্য লাগে কৃষ্ণার,বাবা কিরকম যেন ক্ষেপে উঠেছে মা চলে যাবার পর ওর বিয়ে দেবার জন‍্য। এই ছেলেটা ভালো চাকরি করে দেখে বাবা অস্থির হয়ে যোগাযোগ করেই।ফেললেন। ও কত করে বলেছিলো চাকরির পরীক্ষাগুলো দিচ্ছে এছাড়া কোচিংও নিচ্ছে যদি ডাব্লুউ বিসি এসটা পেয়ে যায়। "বাবা আমাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে তো দাও। এখনি বিয়ের কি আছে।"..বাবা ক্ষেপে উঠে বলেছিলেন," ঐসব চাকরি বাকরি শ্বশুরবাড়ি গিয়ে করিস। এম. এ পাশ করালাম ইংরেজীতে আর কত। এরপর ছেলে পাবোনা,আমি আর পারছিনা মা। আমি চোখ বুজলে তোকে দেখবে কে শুনি?"
            অনেক কথা ওরা বলে ফেললেন,ছেলেটা মানে কুমারবাবু একপাশে বসে মিষ্টি,সীতাভোগ এগুলো খাচ্ছে। খাবোনা খাবোনা করেও গপ গপ করে গিলছে সবাই,ভালো দোকান থেকে এনেছে বাবা আগে থেকে অর্ডার দিয়ে। সত‍্যি এত কিছু বদলালো মেয়েদের বাজারে দরদাম করে কেনা বন্ধ হলোনা।
              ফেয়ারনেস ক্রীম মাখেনা কৃষ্ণা তবে মাঝে মাঝে পার্লারে গিয়ে ভ্রূ প্লাক করে আসে শুধু। অত পয়সা কোথায় এর থেকে পড়াশোনার পেছনে খরচ করা ভালো।
          তবুও পারেনা কৃষ্ণা তাই বলে ওঠে," কৃষ্ণা নামটা শোনেনি মনে হচ্ছে,দ্রৌপদীকেও কৃষ্ণা বলা হত। শুনেছি শ‍্যামলা রঙে অপূর্ব সুন্দরী ছিলেন দ্রৌপদী।মুখটা একটু ব‍্যাজার হয় ছেলের মায়ের,ওর জেঠিমা বাঙাল ভাষায় বলে ওঠেন, "চলো ওঠা যাক আগেই তো কইছি আমাগো ধলা পোলার পাশে কালা মাইয়া চলবোনা।"কে জানে বাবা যার যেমন বিচার তবে এমন অসভ‍্য পাত্রপক্ষ কোনদিন দেখেনি কৃষ্ণা,পরে খবর দেবো বললে এমন কি এসে যেত,ছি ছি। নিজেই বিরক্ত হয়ে উঠে যায়," আচ্ছা আমি উঠি এবার খাওয়াদাওয়া হলে আপনারাও আসতে পারেন এবার। তেমন হলে গাড়িভাড়াটা নিয়ে যাবেন। কারণ অনেকটা খরচ হয়ে গেলো আপনাদের।"
              পাত্রের বাড়ির সবাই ছি ছি করে ওঠে,পাত্রটিও এবার সরব হয়," মা,জেঠি চলো ওঠো তাড়াতাড়ি। ভেবেছিলাম শিক্ষিত মেয়ে,এই শিক্ষার বহর! অপমান করার জন‍্যই শুধু শুধু ডেকে আনা।
               ওরা চলে যাবার পর বাবার কাছেও জুটলো অনেক বাক‍্যযন্ত্রণা। বাবা শোন আমি বিয়ে করবোনা,তুমি আর দেখোনা আমার জন‍্য। এরপর আমি বসবোই না সেজেগুজে তারপর যা হয় হবে।"
             প্রথম দেখা,প্রথম প্রেম,প্রথম অপমান সবটাই বোধহয় বড় বেশি মনে দাগ কেটে যায়। কৃষ্ণাও তাই মনে মনে ভাবলো বিয়ের আর ওর দরকার নেই। যদি কোনদিন ভালোবাসা দিয়ে কাউকে জয় করতে পারে সেই আসবে ওর জীবনে। কবিগুরুর গানটা মনে পড়ে গেলো,'আমি রূপে তোমায় ভোলাবোনা,ভালোবাসায় ভোলাবো...'
     পরক্ষণেই হাসি পায় ওর এমন কি আর কেউ আছে? নাহ্ এখন শুধু পড়াশোনাটাই করবে মন দিয়ে,অধ‍্যাবসায়ে কি না হয়।
                 মাঝে কেটে গেছে চারটে বছর,কৃষ্ণার সত‍্যি বিয়ে আজ। বাড়ি জুড়ে ব‍্যস্ততা সবাই চারিদিকে ছোটাছুটি করছে। বৌদিরা বলছে," মাখ মাখ একটু বেশি করে হলুদ মাখ। ফরসা ফরসা লাগবে মুখটা। সারাদিন চাকরি চাকরি করে মুখের যত্ন তো কিছুই নিসনা।"...হাতে মোবাইলে তখনও কৃষ্ণা কথা বলে যাচ্ছে অফিসের ব‍্যাপারে। উহ্ ছুটি নিয়েও শান্তি নেই। উলু উলু করে পুরো বাড়ি মাতিয়েছে বৌদিরা এর মাঝেই আবার ফোন,না না এবার খোদ হবু কর্তার ফোন তাই ধরতেই হবে। ওপাশ থেকে কি যেন শুনে গালটা একটু রাঙা হয়ে যায় কৃষ্ণার। ইশ্ ফোনে সেই গানটা গাইছে রাতুল যে গানটা শুনে কৃষ্ণার ভালো লেগে গিয়েছিলো ওকে,"কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি। কালো তা সে যতই কালো হোক দেখেছি তার কালো হরিণ চোখ।"
            কৃষ্ণার সাথেই একসাথে পড়ত রাতুল। কোনদিনই ভাবেনি শেষে ঐ কালোফ্রেমের চশমা পরা ছেলেটার প্রেমে হাবুডুবু খাবে ও। দুজনেই তখন খুঁজছে একটা চাকরি,হঠাৎই দিল্লী থেকে ইন্টারভিউ দিয়ে ফেরার পথে ট্রেনে ওর সাথে দেখা হয়ে যায়। পুরোনো বন্ধুত্ব একটু একটু করে রাঙা হয় ভালোবাসার রঙে। কফি হাউসে অনেকদিন বাদে দেখা করেছিলো দুজনে। রাতুলটা যে এত ভালো গান গায় কখনো জানতোই না কৃষ্ণা আর তারপর থেকেই একটাই গান ঘুরে ফিরে আসে কৃষ্ণকলি। সত‍্যি কবিগুরু আছেন সবসময় প্রেমে,বিরহে শোকে আনন্দে।
                প্রথমে আ্যসিসটেন্ট প্রফেসারের চাকরিটা পেয়ে গিয়েছিলো রাতুলই তবুও কৃষ্ণা রাজী হয়নি বিয়ে করতে। না না বাবাকে ও কথা দিয়েছে তাই আগে চাকরি তারপর বিয়ে। একটু দেরী হয়ে গেলো,দুজনের কাছাকাছি আসতে তবুও কৃষ্ণার কালোচোখে যে প্রতিজ্ঞার আগুন দেখেছিলো তাকেই শ্রদ্ধা করে রাতুল।
                   বৌদিদের হৈ চৈ শুরু হয়,এই যে এবার ফোনটা রাখো অনেক হয়েছে। আজ মায়ের জন‍্য মনটা বড় কেমন করে কৃষ্ণার," মা গো তুমি কিছুই দেখে গেলেনা।"
                শ্বশুরবাড়িতে দুধে আলতায় পা ডুবিয়ে রঙিন পায়ের ছাপ মেঝেতে ফেলে কৃষ্ণা এলো। না আজ কৃষ্ণার রূপের সমালোচনা কেউ করেনা। ওর গুণের ছটায় কখন যে রূপ ঢাকা পরে গিয়েছিলো বুঝতেই পারেনি। কৃষ্ণা এখন ডাব্লুউ বি সি এস অফিসার হয়ত আরো ওপরে উঠবে। চারিদিকে সেটাই আলোচনা। গর্বে মাথাটা উঁচু ওর বাবারও।
                 বৌভাতের দিন চাঁপা হলুদ বালুচরীতে আর ফুলের সাজে কৃষ্ণা আজ অনন‍্যা রাতুলের চোখে। শুধু রাতুলের চোখেই কেন সবার চোখেই সে আজ সুন্দর,স্থায়ী গুণের আগুনে ছাইচাপা পড়েছে অস্থায়ী রূপ। ওদের কলেজের বন্ধুরা সবাই এসেছে, এসেছে রাতুলের কলিগরাও। বেশ জমে উঠেছে আড্ডা। হঠাৎই কৃষ্ণার শাশুড়ি আসেন," এই যে আমাদের বৌমা,সত‍্যি রাতুলের সাথে একদম রাজযোটক। বৌমা এই আমার এক ননদ আর ওর জা,আর এই যে ওর ছেলের বৌ।"..প্রণাম করতে গিয়ে বড় চেনা লাগে কৃষ্ণার কোথায় যেন দেখেছে এদের,হঠাৎই মনে পড়ে যায়। তাই বলেই ফেলে," হ‍্যাঁ মা,এনাদের আমি চিনি আমায় প্রথম এরাই দেখতে এসেছিলেন। তবে আমি কালো বলে ওদের পছন্দ হয়নি।"..অবাক হয়ে ওর শাশুড়িমা তাকায় ওদের মুখের দিকে বলেই ফেলেন," যার চাল যেখানে মাপা। তা কুমার কোথায়?"..." আর বোলোনা প্রমোশন হয়ে এই তো ট্রান্সফার হয়ে গেছে সবে তাই আসতে পারলোনা।"
              রাতুলের আদরে রঙ ধরলো কৃষ্ণার গালে সুখের পায়রা আজ ডানা ঝাপটালো ওদের শোয়ার ঘরে। মাসখানেক বাদে কৃষ্ণাকে হঠাৎই যেতে হলো একটু বাইরে একটা ইন্সপেকশন ছিলো। " এসব কি করেছেন,এই রিপোর্ট যদি আমি দিই তাহলে তো আপনার চাকরি নিয়ে টানাটানি হবে। আপনি তো অনেকটা সিনিয়র আমাকে কি আপনাকে কাজ শেখাতে হবে?"...মাথায় হাল্কা টাক আর কাঁচাপাকা চুলের কুমারবাবুর নামটাই চিনিয়ে দিলো কৃষ্ণাকে। ভাগ‍্যচক্রে কৃষ্ণাই এখন কুমারের সিনিয়ার অফিসার। তাই কিছুই করার নেই।
           রাতুল আর কৃষ্ণার বিয়ের কথাটা মায়ের কাছে শুনেছিলো একটু আপশোষের সুরে। তাই আত্মীয়তার সূত্র ধরে টানার চেষ্টা করে। তবে কৃষ্ণা পাত্তা না দিয়ে বলে," আমার ঠিক মনে পড়ছে না,তাছাড়া এটা অফিস এখানে সবটাই কাজের সাথে সম্পর্কিত।"...কৃষ্ণার জিপটা বেড়িয়ে যায় সশব্দে বেরোনোর আগে সবার সাথে কুমারও বলে নমস্কার ম‍্যাডাম। কে জানে কৃষ্ণার গুণের দেমাকের কাছে আজ সত‍্যিই কুমারের বড়  তুচ্ছ লাগলো রূপের বিচার। হয়ত একটু অপেক্ষা করলে সময়ই অনেক উত্তর দিয়ে দেয়। তাই সবার বিরুদ্ধে গিয়েও নিজের গুণটাকে শান দেওয়ার জন‍্য অপেক্ষা করেছিলো কৃষ্ণা,আজ নিজের অধ‍্যাবসায়ে কেন যেন পরিতৃপ্ত লাগে ওর‌।

সমাপ্ত:-
              

   

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...