Skip to main content

পরিতৃপ্তি

#পরিতৃপ্তি#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
"রসবড়া আর পাটিসাপটা ভাজছো মা? আমি খাবো খাবো দাওনা।"পিঠের গন্ধে চারিদিক ভরপুর সত‍্যি মনটা ভীষণ উড়ু উড়ু হত তখন ছেলেবেলায়। চোখের সামনে হাত নাড়তো রকমারি পিঠের হাতছানি। তখন এইসব ডায়েট ফায়েট ছিলোনা। তবে এক সংসারে থাকতে রুনা শিখেছিলো মায়ের কাছে কোন জিনিস ভাজতে ভাজতেই এমন আব্দার করে খেতে নেই। ঠাকুমা রাগ করবে। পৌষসংক্রান্তি বলে কথা,কত কাজ আর প্রস্তুতি চলছে কদিন ধরেই। মা কাকিমা স্নান করে পুজো করে  পিঠে বানাতে বসেছে। ঠাকুমার কড়া হুকুম ছিলো হোকনা বাচ্চা তবু মেয়েমানুষ তো তাই আগে কয়েকটা তুলে রাখতে হবে বা ছেলেরা খাবে তারপর মেয়েদের পালা।" বৌমা মেয়েরে ছোট্ট বেলা থেকে শিখাও ভালো করে,পরে ওরই ভালো হবে। নাহলে বলবে কোন আদেখলা ঘরের মেয়ে যে রাঁধে আর খায়।"
         ঠাকুমার দাপটের ঠ‍্যালায় মায়ের আর ক্ষমতা ছিলোনা মেয়ের আব্দার মেটানোর,একসময় এই না পাওয়াতেই অভ‍্যস্ত হয়ে গিয়েছিলো রুনা। নিজেই আর চাইতোনা পিঠে যতক্ষণ না ঠাকুমা দিতো। অবশ‍্য ভাইরা এই নিয়মের বাইরে ছিলো,ওরা মোটামুটি কড়াই থেকে ছোঁ মারতো বাড়িতে ভালোমন্দ হলেই।
       ঠাকুমা আহ্লাদের সুরে বলত," কি হনুমান হয়েছে ছেলেগুলো। সবসময় ওত পেতে আছে কখন কি রান্না হচ্ছে সেদিকে চোখ।"
          সময় চলে গেলো রুনা একটু একটু করে বড় হলো। রুনা তখন ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে সবেই,বাড়ি এসেছে। ঠাকুমার বয়েস হয়েছে চোখে ভালো করে দেখতে পায়না,তবুও সংসার ছাড়তে পারেনি। শুনেছিলো মাকে বলতে ঠাকুমাকে," ও বৌমা,রুনা এসেছে কটা গোকুলপিঠা ভাজো তো। দিদি আমার খুব পছন্দ করে গোকুলপিঠা।"
    বন্ধুরা ওকে গোলু,মিঠা,গোবলু বললেও গোকুলপিঠে খাওয়ার সময় নো কম্প্রোমাইজ। " আমার সামনে বসে খা দিদি,আমি দেখি।"
       ..." হঠাৎই মুখ দিয়ে বেড়িয়ে আসে ওর," আগে মা খাবে আর তুমি খাবে তারপর আমি।"
     ঠাকুমা জিভ কেটে বলেছিলো," না না দিদি,তুমি খেলেই আমাদের খাওয়া। মায়েদের আগে খেতে নেই।"..ছোটবেলার অভিমানের সুরটা টিংটিং করে বাজে মনে রুনার,"মায়েদের আগে খেতে নেই না মেয়েদের আগে খেতে নেই?"
          ঠাকুমা কোন উত্তর দিতে পারেনা দেখে রুনাই বলে," আচ্ছা ঠাকুমা এখন তুমি আমাকে আগে দিচ্ছো কেন,আমি চাকরি করছি বলে? কই মা তো আগে খায়না?"..." আমি ইচ্ছে করেই আগে খাইনা সোনা,ভালো লাগে সবাইকে খাইয়ে খেতে।" মায়ের কথা শুনে আর কেন যেন তর্ক করতে ইচ্ছে করলোনা রুনার সত‍্যিই বোধহয় মায়েরা এমনি হয়। মানে সবাইকে খাইয়ে থাকলে খেলাম আর নাহলে নয়। তবে একদিন মাও তো ওর মতই ছিলো,কি করে যে মেয়েবেলার অভ‍্যেসগুলো শ্বশুরবাড়ি এসে পাল্টে যায় কে জানে। নিশ্চয় ঠাকুমার ভয়ে ভয়ে এমন তৈরি হয়েছে মা। নিয়মের বেড়াজালে থাকতে থাকতে কখন খাঁচাটাকেই বাড়ি বলে ভেবে নিয়েছে কে জানে? না না ও অত ভালোমানুষী করবেনা,কিছুতেই নয়। তবে ও তো পিঠে ভাজতেই পারেনা,তাহলে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে কি হবে! বেশ কিছুদিন বাদে অয়নের মুখোমুখি বসে প্রেম করতে করতে বলেছিলো," আমি না ভীষণ বাজে বৌ হব। প্রথম রাতেই বেড়াল মারবো যাতে শ্বাশুড়ি ট‍্যাঁ ফোঁ না করতে পারে।"..." মুচকি হেসে অয়ন বলেছিলো," তাই নাকি তাহলে তো ভালোই হবে। আমাদের বাড়িতে এমনিতেই কোন আওয়াজ নেই যাক তবুও একটু শব্দ হবে। "
                  বিয়ের পর শব্দ আছে কিনা তা ভাল করেই টের পেলো রুনা। এ এক নতুন অদ্ভুত সংসার,বেশিরভাগই সকালে খেয়ে ওকে বেড়িয়ে যেতে হত। তবে যেদিন থাকত বাড়িতে,শাশুড়ি শুরু করত," এই যে শোন আমি অত পারিনা বাপু,খালি পেটে থাকলে আমার শরীর খারাপ হয়,তোমার শ্বশুরও জানে তাই তাড়াতাড়ি যদি স্নান সেরে আসো তো একসঙ্গে খাবো নইলে এই সব টেবিলে থাকলো,বুফে সিস্টেমে খেয়ে নাও সব।"...মনে মনে ভাবে রুনা এ আবার কি শ্বশুরবাড়িরে বাবা বাড়িতে ঢুকেই বুফে সিস্টেম।
এখানে কোন ভয় নেই, শাশুড়ির নিয়ম কানুন শেখানো নেই কিছুই নেই। তাই রুনার এখানে ঢুকে আর বেড়াল মারা হলোনা। যা ভেবে এসেছিলো তার উল্টোটা হলো। কোথায় শাশুড়িমা বেছে বেছে মাছের ল‍্যাজাটা ওর পাতে দেবে অথবা মাংসের হাড়টা দেবে বেছে বেছে ঠিক ওর ঠাকুমার মত। আর ও বেশ প্রতিবাদ করবে জ্বালাময়ী ভাষায়। যাহ্ কিছুই হলোনা তো।
          রান্না করা খাবার বেশিরভাগই টেবিলে থাকে,রান্নার লোক রান্না করে রেখে যায়। আর রুনা বুফে খায় নিজের ইচ্ছেমত। কিন্তু কেন যেন কোনমতেই সবচেয়ে ভালোটা আর সবচেয়ে বড়টা নিজের জন‍্য তুলে নিতে পারেনা। মনে হয় থাক শ্বশুরমশাই খাবে অথবা শাশুড়ি বা বর খাবে। নিজের মাঝে মাঝে বড় অবাক লাগে এমন তো হওয়ার কথা ছিলোনা। ও কি তাহলে একটু একটু করে ওর মায়ের মত হয়ে যাচ্ছে নাকি?
                অদ্ভুত মানুষ ওর এই বাড়ির নতুন মা। কেন যেন রুনার মাঝে মাঝে মনে হয় ওনার মেয়েবেলা এখনো কাটেনি। রান্নার লোক রান্না করছে মাংস। " এই কুন্তি,দে তো দুই পিস তুলে বাটিতে একটু খাই কষা মাংস।" অবাক হয়ে দেখে রুনা ভাবে এসব আবার কি,ওর ঠাকুমা দেখলেই বলত কি নোলা মেয়েমানুষের! আনমনা রুনার সামনে তখন মাংসের বাটি হাতে শাশুড়িমা," মামনি খেয়ে দেখ তো,মাংসটা কেমন হচ্ছে? এটা কি কষাই থাকবে?"..ফুঁ দিতে দিতে একটা মুখে পুরে দেন উনিও।
                 আশ্চর্য লাগে ওর,এই বাড়ি তো বাপের বাড়ির থেকেও অন‍্যরকম। এখানে বোধহয় সবাই রাজা। খুব খারাপ লাগে ওর মায়ের জন‍্য যৌথ পরিবারে থেকে মা কোনদিনই এই দিন দেখতে পেলোনা। বাপের বাড়ি এসে মাকে বলাতেই মা বললো," ঠাকুরপো,জা,ছেলেমেয়ে,শ্বশুরশাশুড়ি এদের খাইয়ে এদের কাছে ভালো কখনো বা মন্দ শুনে এত বছর কাটিয়ে দিয়েছি। আমার কোন অভিযোগ আর নেই রে।"
           রুনার সামনে ওর দুই মা একজন বাঁচেন নিজের মর্জিতে নিজের মত ছোট্ট সংসারে। যেখানে উনিই রানী সংসারের। আরেকজন যৌথ পরিবারে সবার বড়বৌদি আর বাড়ীর বড়বৌমা। একজন নিজের মত জীবনটা করেছেন আরেকজন জীবন যেমন চালিয়েছে তেমনি চলেছেন। দুজনের মুখেই হাসি, সন্তানের মুখে দুজনেই কষা মাংস অথবা পিঠে তুলে দিয়ে খুশি হয় সন্তানের মুখে। মাঝে মাঝে ভাবে কে বেশি খুশি,কোন মা? রুনা একটু করে শিখছে দুই মায়ের কাছ থেকেই কিছুটা অভিজ্ঞতা থেকে আর কিছুটা অতীত থেকে। অতীত আর বর্তমান দুই বোধহয় মানুষকে শেখায় ভবিষ‍্যতের জন‍্য প্রস্তুত হতে।
                   অয়ন জিজ্ঞেস করলো," তুমি পিঠে বানাতে পারো?" "কেন মা বানায় না?"..."মায়ের সুগার তাই বাবা আর বানাতে দিতে চায়না মাকে। মা তেমন কিছু বানাতেও পারেনা,বাবার আদুরে বৌ বলে কথা,হি হি হি। আর কেউ বানালেই বাটি করে খেয়ে নেয়।তাই পিঠেপুলি একদম নো এন্ট্রি,তবে তুমি যদি কিছু জানো তবে আমি খাবো,অনেকদিন খাইনা"....
           এবার সত‍্যি মা আর ঠাকুমার কথা বড্ড মনে পড়ে রুনার। ইশ্ শ্বশুরবাড়িতে খাওয়াবে বলে একটা সময় ভাবেই নি। কিন্তু বর বেচারার জন‍্য এবার তো কিছু শিখতেই হবে। একটু ভয় হয় পারবে তো? মাকে ফোন করে আর গুগল কাকা আর ইউটিউব মামার কাছে জেনেশুনে নোনতা মিষ্টি দুরকম পুলি বানালো রুনা অফিস থেকে এসে মুখে আর মাথায় চালের গুড়োর পাউডার মেখে অবশ‍্য কুন্তিদি অনেকটাই সাহায‍্য করেছে। এ বাড়িতে চিত্র আলাদা,অন‍্য বাড়িতে বাচ্চারা ঘুর ঘুর করে পিঠের গন্ধে,এখানে শাশুড়িমা বার কয়েক ঘুরে গেছেন তবে অয়ন আর শ্বশুরমশাই কড়া পাহারায়। শ্বশুরমশাই বলেছেন," মামনি আজ তুমি সার্ভ করবে সবাইকে প্লেটে। বুফে আজ বন্ধ থাকবে।"...হো হো করে হেসে ওঠে সবাই।
            সবাইকে আনন্দ করে পিঠে খেতে দেখে খুশির ঝলকানি মাখলো রুনার ময়দার গুড়ো মাখা মুখটা। আজ কেন যেন একটা পিঠে খেয়েই পেটটা ভরে গেলো,সবার হাসিমুখ দেখে এমনিতেই কখন যে মন আর পেট দুই ভরে গেছে বূঝতেই পারেনি। মায়ের ছোট্ট মেয়ে রুনা কখন যে মায়ের মতই হয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি।

   সমাপ্ত:-

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...