#শুভ_মঙ্গলা#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
"শোন এইরকম গলায় মাফলার দিয়ে বীরদর্পে এলে আমার মেয়েকে বিয়ে করবে বলে তুমি জানো তো?"
শুভার সাথে জেদ করে হঠাৎই আশীষ চলে এসেছে ওদের বাড়িতে। " না শোন রোজ এই লুকোচুরি আমার ভালো লাগছেনা। ভালোবাসায় আবার ভয় কি?" মুখটা কেন যেন শুকিয়ে যায় শুভার। " এত তাড়াহুড়োর কি আছে,সামনেই তো আমার পরীক্ষা। যাক না কয়েকদিন বিয়ে সংসার সবই তো আছে।".." আমার তাড়া আছে তারপর কোনদিন দেখবো আমার শুভলক্ষ্মী অন্য কারো হয়ে গেছে।"
সত্যিই একদম তাড়াহুড়ো করেই আশীষ বিয়ের জন্য কোমর বাঁধলো এ বাড়ী ও বাড়ীর কোন কথাই শুনলোনা। শুভার বাবা বলেছিলেন উনি কুষ্ঠি বিশ্বাস করেন,আর শুভা মাঙ্গলিক তাই একটু ভেবে দেখতে হবে ওর সাথে আশীষের বিয়েটা দেওয়া যাবে কিনা। হাতের মাসলটা ফুলিয়ে বলেছিলো," আরে মেসোমশাই আপনি এখনো এইসব বিশ্বাস করেন? আমার মাসলটা দেখেছেন তো,কোন অমঙ্গল আমি কাছে ভিড়তেই দেবোনা। কাছে এলেই ফুঃ করে উড়িয়ে দেবো। তবুও শুভার বাবা বলেন," শোন আমি একটু তোমার মা বাবার সাথে কথা বলবো। তোমার কুষ্ঠি না মিলিয়ে আমি এখনি কিছু বলতে পারছিনা।"
রাগে গজগজ করতে থাকে আশীষ," ইশ্ কি যে একখানা শ্বশুরবাড়ি পাবো,একদম কুসংস্কারে ভরা বাড়ী।"..আপত্তি একটু তুলেছিলেন আশীষের মা বাবাও কিন্তু শেষে হার মানতে হয়েছিলো ছেলের জেদের কাছে। অবশ্য আশ্বাস দিয়েছিলেন ওদের পুরোহিত মশাই। যাই হোক দোষ কাটিয়ে বিয়ে হয়ে গিয়েছিলো আশীষ আর শুভলক্ষ্মীর। লাল টুকটুকে বেনারসী পরে এক গা গয়না পরে একেবারে একটা সুন্দর মিষ্টি লক্ষ্মীমন্ত বৌ। বুক ফুলিয়ে সবাইকে আশীষ বললো," আরে পাঁচবছর ধরে ঘুরঘুর করছি পেছনে। আমার পছন্দ বলে কথা।"..মফস্বল শহরের ছেলে ও হয়ত একটু বেশিই প্রাণখোলা আর একদম উদ্দাম দাপুটে এক যুবক। নিয়মিত শরীরচর্চা করে। ওর লম্বা চওড়া চেহারার কাছে শুভা একটু ছোট পুতুল পুতুল। তাইতো একদম প্রায় কোলে তুলে পুকুর পার করিয়ে দিলো শুভাকে। লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছিলো শুভা। পাশ থেকে ওর ঠাকুমা বলেছিলো," দম আছে আমার নাতজামাইয়ের।".." আছেই তো,একসঙ্গে তোমাকে আর তোমার নাতনিকে কোলে তুলে নিতে পারি। আসবে নাকি?"..." শুভা তোর বরটার দেখি একদম লজ্জাশরম নাই,ইশ্।" জিভ কাটে ঠাকুমা।
সবাইকে মুগ্ধ করে দিয়েছিলো অল্প সময়ের মধ্যে। আর তেমনি ভোজন রসিক জামাই। খুব খুশি শুভার মা নতুন জামাইকে খাইয়ে,একদম ঘরের ছেলের মত হয়েছে জামাই।কি সুন্দর গুছিয়ে সব খেলো একদম আনন্দ করে।
আশীষ প্রথম ব্যাটেই ছক্কা আর ওভারবাউন্ডারি করলেও শুভা পারলোনা। ছোট্টখাট্টো পুতুল পুতুল শুভা যখন আলতায় পা ডুবিয়ে পায়ের ছাপ আঁকলো মেঝেতে শাশুড়িমা বললেন," দেখো মা সব যেন মঙ্গল মঙ্গল হয়। এত বোঝালাম এই ডাকাত ছেলে শুনলে তো। এই মেয়েকেই ওকে বিয়ে করতে হবে।"বুকটা একটু ছ্যাৎ করে ওঠে শুভারও,ওড়নার আড়ালে হয়ত একই প্রার্থনা ও করলো," সবার মঙ্গল করো আমার জন্য যেন কারো অমঙ্গল না হয় এই সংসারে।"..সত্যিই হয়ত কিছু কথা মানুষের মনের ভেতরে এমন ভাবে ঢুকে যায় যা সবসময় অস্থির রাখে মনকে। তবুও মনে শান্তি পায় শুভা,সব দোষ তো কাটিয়ে দেওয়া হয়েছে আবার ভয় কি।
আশীষটা সত্যি ডাকাত,ফুলশয্যার রাত্রে কোলে তুলে নেয় শুভাকে," অনেকদিনের ইচ্ছে ছিলো,ইশ্ আমাদের গ্ৰামেগঞ্জে কি আর প্রেম হয়? সবসময় ভয় এই বোধহয় কোন কাকা জেঠা দেখে ফেললো। আজ আর কোন ভয় নেই,ঐ জন্যই তো এইরকম ছোট্ট খাট্টো লক্ষ্মীঠাকুরকে পছন্দ করেছি।"
আশীষের উষ্ণতাটা অনুভব করতে বড় ভালো লাগে শুভার,নিশ্চিন্তে দুহাতে ওর গলাটা জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে ঠোঁট রাখে। একটু বাদেই আঃ করে ওঠে," ইশ্ সত্যিই কি জোর গায়ে এই জন্যই সবাই দস্যু বলে।"..একটু লজ্জা পায় ও," আচ্ছা আচ্ছা,একদম ফুলের মত আলতো করে এই যে বুকে রেখে দেবো।" হাসিতে ভরে ওঠে ওদের ঘরটা।
শুভা নিতান্তই গৃহবধূ তাই ঘরটাকে ভালোবেসেই নতুন শ্বশুরবাড়িটাকে নিজের বাড়ি করতে চেষ্টা করছে একটু একটু করে। তবুও কেন যেন বুঝতে পারে দেখতে সুন্দর চাকরি করা আশীষের আরো ভালো বউ আর দেনাপাওনা হওয়া উচিত ছিলো। একদিন আশীষকে বলে সে কথা," তুমি কেন আমায় ভালোবাসলে,জোর করে বিয়ে করলে। কত ভালো মেয়ে আর দেনাপাওনা পেতে তুমি।".." কে বলেছে এসব শুনি,মা? বলুক,কান দিয়োনা। আরে আগে তো ভালোবেসেছি খুব খুব করে তারপর তো বিয়ে। যাহ্ বাবা যাকে ভালোবাসলাম তাকে বিয়ে করবোনা তো টাকার ঝুড়ি খুঁজতে যাবো।"
দেখতে দেখতে ওদের বিয়ের এক বছর হয়ে আসছে,আশীষটার বড় তাড়া সবটাতেই তাই মা হতে চলেছে শুভা। শ্বশুরবাড়িতে শুনলো," কোথায় দুজনেরই বয়েস কম একটু আনন্দ করবে তা না এর মধ্যেই। আর কি খাটতে খাটতে প্রাণ যাবে আমার।"..সত্যিই শুভার শরীরটা বেশ খারাপ হয়েছে,ডাক্তার বলেছেন প্রথম দিকটা এমন হয়। দেখতে দেখতে ছয়মাস পার হয়ে আসছে শুভার।" ওহ্ ব্যাটা তো মহা বদমাশ,আমার বৌটাকে জ্বালিয়ে মারছে। সমানে ফুটবল খেলে যাচ্ছে,রাতেও ঘুমোয়না।".." তোমার মতই তো হবে,এত তাড়াতাড়ি করতে কে বলেছিলো শুনি।"..."আচ্ছা আমি পেটে হাত বুলিয়ে ওটাকে আর তোমাকে দুজনকেই ঘুম পাড়িয়ে দিই।"....চোখটা সত্যি লেগে এসেছিলো শুভার হঠাৎই হৈচৈ শুনতে পায়,আশীষকে বাইরে থেকে ডাকছে পাশের পাড়ায় ডাকাত পড়েছে ওরা যেন আসে। শুভা গলাটা জড়িয়ে ধরে," তুমি যেয়োনা,আছে তো অনেক লোকজন।".." আমাদের বাড়িতে লাইসেন্স করা রিভলবার আছে সবাই জানে। আমার না যাওয়া ঠিক হবেনা। ভাইকে একা পাঠাই কি করে,দেখছো তো সবাই যাচ্ছে। আমাদের এখানে এমনি,সবাই দাঁড়াই সবার পাশে। আমি চলে আসবো একটু বাদেই।"
শাশুড়ি মায়ের সাথে জেগে বসে রইলো শুভা,মনটা বড় অস্থির দুজনেরই ওরা দুইভাই বেড়িয়ে গেছে। চারদিকের দরজা জানলা বন্ধ করে বসে আছে ওরা। ভোরবেলা অনেকের আওয়াজ পাওয়া যায়,হসপিটাল আ্যম্বুলেন্স আর সবটা মনে করতে পারেনা শুভা। একবার শুধু শুনেছিলো গুলি লেগেছে আশীষের হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আশীষ আসবো বলে আর ফিরতে পারেনি। সবাই বলে অনেকদিনের আক্রোশ ছিলো ওর ওপর তাই এমন হলো,পাড়ার সবচেয়ে ডাকাবুকো ছেলেটাকে সরিয়ে দিলো। আধাঘুম আধা জেগে সবটাই শুনলো শুভা,আর এও শুনলো সব কিছুর জন্য ওই দায়ী। সত্যিই তো আজ আর কেউ বলার নেই," ছাড়তো কে কি বললো,আমি এই ভালোবেসে জড়িয়ে থাকলাম তোমাকে।"
অদ্ভুতভাবে পাল্টাতে লাগলো ওর চারদিকের পরিবেশ,ওর মা ওকে নিয়ে যেতে চাইলেও বাবা রাজি হলেননা। বাবা বললেন," এখানে ওর অধিকার ছাড়বে কেন? আশীষের চাকরি টাকা পয়সা সবই তো ও পাবে। এ বাড়ির ভাগও পাবে। মা রে তোর বাবার ক্ষমতা তো তুই জানিস। এখনো একটা ছোটভাই আর বোন আছে। তখনি বলেছিলাম ছেলেটাকে মেয়ে আমার মাঙ্গলিক।"
ও যে অমঙ্গলা সেটা বুঝতে পারছিলো প্রতিদিনের মানসিক অত্যাচারে। শ্বশুরবাড়ি থেকে চাপ আসছিলো টাকা পয়সা এমন কি চাকরি সবই যদি ওদের আর দেওরকে দেয় তাহলেই এখানে থাকতে পারবে। অনেকদিন ওর ভালো করে খাওয়া হতনা। পাশে দাঁড়ানোর মত কেউ ছিলোনা। একলা ঘরে দম আটকে আসতো শুভার হাউহাউ করে কেঁদে বলতো," এত ছটফট করিসনা সোনা,তোর খাওয়া হয়নি আমি জানি। আমাদের তো কেউ নেই আর ভালোবাসার।"শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার চরমে ওঠে একটু রুখে দাঁড়ায় শুভা," ওর টাকা আমার প্রাপ্য,আমার সন্তানের প্রাপ্য এভাবে আপনারা আমাকে বঞ্চিত করতে পারেননা।"..ফুঁসে ওঠে ওর দেওর," ও আমরা ছোটাছুটি করে সব ব্যবস্থা করবো,আর উনি ঘরে বসে প্রাপ্য বুঝবেন। কাল বিদায় হও এখান থেকে বাপের বাড়ি।"..." আমি কিছুতেই যাবোনা,সবাইকে বলবো তোমরা অত্যাচার করছো।"..সন্ধ্যেবেলায় বেড়িয়ে গিয়েছিলো শুভা ওর ভারী শরীরটাকে চাদরে ঢেকে বাপের বাড়ির উদ্দেশ্যে। কেউ বাধা দেয়নি। বাসে করে অনেকটা পথ এসে স্টেশনে পৌঁছে মনে হয়েছিলো,এভাবে চলে আসাটা ঠিক হয়নি। বাবা তো শেষ কথা বলেই গেছিলো,সত্যি তো এই একমাসে তেমন খবর তো নেয়নি। ততক্ষণে অন্ধকার নেমেছে,রেললাইন ধরে হাঁটতে থাকে শুভা,এই পথেই ওর ছোটবেলার বন্ধুর বাড়ি অনেক আগে এসেছিলো। ও যদি সাহায্য করে কোনভাবে। হঠাৎই ওর হাতধরে কে যেন জোরে টান দিয়ে চেপে ধরে রাখে একটু দূরে গিয়ে। ঝড়ের মত আওয়াজে কানটা বন্ধ হয়ে যায় শুভার অন্ধকার হয়ে যায় চোখমুখ। আর কিছু মনে পড়েনা।
....চোখটা খুলে হঠাৎই উঠে বসতে যায়,এটা কোথায় ও? কার বাড়ি এটা বন্ধুর?" আপনি শুয়ে থাকুন,গরম দুধ এনেছি।মনে হয় এটা খেলে একটু ভালো লাগবে আপনার।"..একটা অপরিচিত লম্বা একহারা কালো চেহারার মানুষ ওর সামনে। খুব অস্বস্তি হয় শুভার কিছু মনে করতে চায় পারেনা। " আপনি ব্যস্ত হবেননা,আমি ডাক্তারবাবুকে খবর দিয়েছি এসে পড়বেন।"
রেলেই চাকরি করে সুমন,হঠাৎই গতকাল শুভাকে দেখতে পায় আনমনে হাঁটছে অন্ধকারে আরে এই লাইনেই তো এক্সপ্রেস ট্রেন আসবে একটু বাদেই। একঝটকায় সরিয়ে নিয়ে বাঁচায় ওকে তারপর কয়েকজনের সাহায্যে ওকে নিয়ে আসে কোয়ার্টারে। একটু সুস্থ হওয়ার পরে শুভার কাছে জানতে পারে সবটা।" আপনাকে ওখানে তো যেতেই হবে। আশীষবাবুর যা ছিলো সবটাই আপনার আর আপনার সন্তানের প্রাপ্য।".." আপনি আমাকে একটা কাজ দেখে দিন,আর একটা বাড়ি আমার কাছে কিছু টাকা আছে আর এই গয়নাগুলো।"
" মা তোমাদের না জিজ্ঞেস করেই ইনাকে সাথে এনে ফেলেছি। আলাদা বাড়ি ভাড়া করে থাকবে বলছিলেন,আসলে আমার কোয়ার্টারে তো রাখা যায়না এ অবস্থায়।"
খুবই লজ্জা আর অস্বস্তি হচ্ছিলো শুভার কিন্তু দুদিনেই বন্ধু বলে মনে হয়েছে সুমনকে। " ওনার ইচ্ছে ভাড়া দিয়ে থাকার দেখো কি করবে। আমায় কালই চলে যেতে হবে।"..সুমনের বোন সুগতা আর মা ওকে হাত ধরে নিয়ে আসে ভেতরে।" আমরা গ্ৰামের মানুষ ভাড়া নেবো আবার কি,একসময় কত মানুষ আসতো যেতো।"
শুভা বাপের বাড়ির সাথে যোগাযোগ করেছিলো কিন্তু যাওয়া হয়নি সেখানে শেষপর্যন্ত। সুমনকে দেখতে ভালোমানুষ মনে হলেও ওর বুদ্ধিতেই আশীষের চাকরিটা হয়ে গিয়েছিলো শুভার,তবে অন্য টাকাপয়সা ও কিছুই নেয়নি,দাবি করেনি সম্পত্তিরও। ওকে যে ওর সন্তানকে বাঁচাতে হবে,তাই চাকরিটা জরুরী। সরকারী হাসপাতালেই শুভ জন্ম দিয়েছিলো ওর সন্তানকে। সুগতা,সুমন আর মাসিমা মেসোমশাই পাশে ছিলেন সবসময়। এসেছিলেন ওর বাবা মাও। তবে শ্বশুরবাড়ির কেউ আসেনি,রটেছিলো দুশ্চরিত্রা মেয়ে শুভা,বর মরতেই অন্য বেটাছেলের সাথে ফস্টিনষ্টি শুরু করেছে। আর ঐ বদমায়েশটাই এত বুদ্ধি দিচ্ছে। মধু খাচ্ছে আর কি এরপর ছিবড়ে করে ফেলে দেবে। আরও সব জঘন্য কথাবার্তা।
শুভাশীষ নামটা সুমন আর ওর বোনই ঠিক করেছিলো। চোখ দিয়ে বৃষ্টির ধারা গড়িয়ে পড়েছিলো শুভার,কত স্বপ্ন দেখেছিলো আশীষ এই ছেলেটাকে নিয়ে। বাবাকে কোনদিন দেখবেনা ছেলে এমনি ভাগ্য ওর।
কেটে গেছে মাঝে দুটো বছর,শুভা চাকরি করে এখন। আলাদা বাড়ি ভাড়া করেই থাকে ছেলেকে নিয়ে। সবসময়ের একটা লোক রেখেছে। তবে বিপদে যারা ওর পাশে ছিলো তারাই কখন যে আত্মীয় হয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি। সুমন মাঝে মাঝেই আসে হয়ত এটা নিয়েও কানাকানি হয় পাড়াতে। একদিন ওর মা বললো," বাবু এবার একটা বিয়ে কর,সুগতারও বিয়ের সম্বন্ধ আসছে। তাছাড়া চারিদিকে নানা রকম কথা হচ্ছে।"..." বোনের বিয়ে দিয়ে দাও মা,আমার এখন বিয়ে করা হবেনা।"
" বয়েশটা তো হচ্ছে নাকি? আচ্ছা তুই কি কাউকে ভালোবাসিস?".."বাদ দাও মা,এই বয়সে আবার প্রেম।"..এক ফালি হাসি খেলে যায় সুগতার মুখে," তুমি চুপ করো মা,আমি ডুবুরী নামিয়ে ঠিক বার করবো।"
মাসিমা আর সুগতার কথাতে কিছুতেই রাজি হয়নি শুভা ছেলেকে কোলে নিয়ে হাউহাউ করে কেঁদেছিলো," আর আমি কোন সংসারে অমঙ্গল করতে যেতে পারবোনা মাসিমা। আমি যে মাঙ্গলিক তাই তো ও অকালে চলে গেলো। শাশুড়িমা বলেছেন সব আমার জন্য।"..." ওমা,শুভা এ ও জানিসনা মাঙ্গলিক মেয়ে পাচ্ছিনা বলেই তো সুমনটার বিয়ে হচ্ছেনা।"..শুভা মুখ ঢেকে কাঁদছে ওর ছেলে ততক্ষণে পি পি করতে করতে সুগতার কোলে চেপেছে।" ছেলেটাকে মানুষ করতে পাশে কেউ থাকলে ভালো তাইনা? আমার ছেলেটা একটু কম কথা বলে তবে ভালো মানুষ।"
এরা গ্ৰামের মানুষ হয়ে এত বড় মন কোথা থেকে পেলো কে জানে? বিধবার আবার ঘটা করে দ্বিতীয়বার বিয়ে না না কিছুতেই পারবেনা শুভা। তাই রেজিস্ট্রী করেই বিয়েটা হয়ে গেলো ওদের। শুভা এখনো যায়নি সুমনদের বাড়িতে,সিঁদুরও পরেনি। তবে সুমন জোর করেনি কিছু নিয়েই ওর যা মন চায় তাই করুক। ছেলেটা বুকের ওপর উঠে শুলেই ওর মনটা ভরে যায়,আগে কা কা করত এখন ও বাবা বলতে শেখায়। সেদিন শুভার অফিসে মৌ বললো," তুমি সিঁদুর পরোনা কেন গো? সুমনদা কিছু বলেনা।"..চোখটা ছলছল করে শুভার," আসলে আমার হাতটা কাঁপে রে।".."রেজিস্ট্রীর সময়ই তো দিতে পারতে,না না এটা ঠিক নয়,এখন তুমি সুমনদার জন্যই পরবে। আগের কথা ভুলে যাও।"
কিছুতেই যেন স্বাভাবিক হতে পারেনা শুভা মুছে ফেলতে পারেনা ফ্যাকাশে দিনগুলোকে রঙের তুলির ছোঁয়ায়। চারদিন বাদেই সুগতার বিয়ে,তাই ওদের যেতে হবে দেশের বাড়িতে। গাড়ি থেকে ছেলেকে কোলে করে নামে শুভা,বা বা করে সুমনের দিকে হাত বাড়ায় ছেলে। উঁকি মারে পাড়া প্রতিবেশী আর আত্মীয়স্বজন কৌতূহলী হয়ে। অস্বস্তি হয় শুভার।
" দাঁড়াও বৌমা,ঐখানেই দাঁড়াও।" বড় অচেনা লাগে ওর চেনা মাসিমার গলার আওয়াজ,হঠাৎই উনি যেন রাগী শাশুড়ি হয়ে গেছেন। " বাবু এদিকে আয়তো,কতদিন আর বোবা হয়ে থাকবি শুনি? ওর কি যা ইচ্ছে তাই করবে,হলই বা চাকরি করা বৌ। নে ধর এগুলো।"
....বাড়ির দরজা থেকে কাপড় পাতা হয়েছে,ওখানেই সুগতা দাঁড় করিয়ে দেয় ওকে। " ঘরের লক্ষ্মীর হাতে শাঁখা সিঁদুর থাকবেনা তা হয়! আর চারদিন বাদে বিয়ে বাড়িতে। বৌমার হাতে শাঁখা পরিয়ে ছেলের হাতে রূপোর সিঁদুর কৌটোটা ধরিয়ে দিয়ে বললেন," একদম একমুঠো সিঁদুর দিয়ে ভরিয়ে দে তো সিঁথিটা একেবারে লাল করে। তারপর মাথায় ঘোমটা তুলে দিবি। বাড়ির বৌয়ের একি অনাছিষ্টি।"..মুখটা ফিরিয়ে হাসেন ওর শাশুড়িমা। সুমন ততক্ষণে গাঢ় লাল রঙে রাঙা করেছে শুভার অযত্নে পড়ে থাকা সাদা সিঁথিটা। ঘোমটা মাথায় শুভা যেন আবার বৌ হয়েছে অসহ্য বৈধব্য যন্ত্রণার পর। " এবার এসো বৌমা,দুধে আলতায় পা রাখো। আর ছেলেকে কোলে নাও এবার।"
পাশের থেকে একজন বলে ওঠে," দুজনেই আসুকনা,ছেলে কোলে কেন?"..."কেন ছেলে কোলে আসবেনা,ওই বাচ্চার জম্ম,কম্ম সবই তো এই বাড়িতে। ও কি ফ্যালনা নাকি,কত রাত জেগেছি আমরা ওই দুষ্টুটার জন্য।"...বুকের ভেতরটা বড় হাল্কা লাগে শুভার ঘোমটা ভালো করে তুলে আড়াল করে গাঢ় লাল রঙটাকে,কারো যেন নজর না পড়ে ওর সাজানো সংসারে,শুভাশীষকে যে ওকে ভালো করে বড় করতে হবে। মুগ্ধ চোখে একবার তাকায় সুমন ওর দিকে, ভালোবাসার রঙের ছোঁয়ায় আজ বড় সুন্দর আর অন্যরকম লাগছে শুভাকে। " এই যে বৌদি এবার আঁচলটা কোমরে বাঁধো ননদের বিয়ের সব দায়িত্বই কিন্তু তোমার। অনেক কাজ আছে পড়ে চলো চলো।" ছেলেকে সুমনের কাছে দিয়ে হাসতে হাসতে ননদের সাথে এগিয়ে যায় শুভা ওর নতুন ঘরের দিকে। মাথায় হাত ঠেকান শাশুড়িমা।
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment