Skip to main content

রাইবাঘিনীর থাবা

রাই বাঘিনীর থাবা
রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী

"বিয়ে ঠিক হতে না হতেই এত প্রেম। ওহ্ সোনা আর পারিনা। রাখ তো এগুলো চল আড্ডা মারি।" "তোরা যা আমি আসছি।"...ফ্রেমে ব্লাউজটা আটকে বন্ধুদের সাথে বারান্দায় বসে শিউলি।
আরে বরের সাথে কথাবার্তা নেই বেচারার যত প্রেম ননদের সাথে,বসে বসে ননদদের ব্লাউজে কাশ্মিরী কাজ করছে,তত্ত্বে যাবে।
       এখনো ভাবলে হাসি পায় শিউলির এতগুলো বছর পরে। আহত হয়েছে যে কত আবার প্রলেপও পড়েছে ক্ষতে কিন্তু কিছু কষ্ট দাগ কেটে যায় মনে যা হয়ত আবছা হলেও ভোলা যায়না।
        ছোট থেকে একটা কথা খুব শুনতো মা ঠাকুমাদের মুখে,ননদিনী রাইবাঘিনী। শুনে ভাবত সে আবার কি? ননদ মানেই তো ওর বয়সের একটা মেয়ে হবে যে হবে বন্ধুর মত। মানে ওরা একসাথে গল্প করবে,আড্ডা মারবে। একসাথে পুজোর কেনাকাটা করবে,হোটেলে খাবে আর সিনেমা দেখবে। সরলতায় ভরা সবেমাত্র কলেজ পাশ করা শিউলির মাথায় আসতোনা কখনই সম্পর্কের জটিল রসায়ন। অনেক স্বপ্ন ছিলো শ্বশুরবাড়ি নিয়ে,মানে সবাই ওকে ভালোবাসবে আর ও ভালোবাসবে সবাইকে মন ভরে।
              তখনও পড়াশুনা করছে শিউলি,মনটা হয়ত শিশুর মত সরলতায় ভরা। একটু একটু করে সেই মনটা রক্তাক্ত হতে লাগলো ননদদের ব‍্যাবহারে,ওরা বিবাহিত কিন্তু তবুও আধিপত‍্য ছিলো প্রচুর। এমনকি ওর বরও ভয় পেতো বোনেদের। সুমন শিউলিকে বুঝিয়েছিলো ওর মা নেই সুতরাং ননদদের সাথে এমন কোন ব‍্যাবহার যাতে না করে যে ওদের বাপের বাড়ি আসা বন্ধ হয়ে যায়। মাথার ওপর শাশুড়ি না থাকায়,ওদের ছড়ি ঘোরানো চলত সমানে। বিয়ের পরই সাধের নখগুলো কেটে ফেলার হুকুম হয়ে গিয়েছিলো।
  হাতে বানানো ব্লাউজ দিয়েও খুশি করতে পারেনি।শুনেছিলো এই বাড়ির ছেলেগুলোর কপালই খারাপ। একটা বৌও সুন্দর এলোনা।" বৌদি,আজ বৃহস্পতিবার তুমি আলতা পরো,তারপর আমাদের রান্নার পিশি আর কাজের মাসিকেও পরিয়ে দাও।"..পা বাড়িয়ে দিয়েছিলো ওরা,মাথা নিচু করে আলতা পরিয়েছিলো বছর একুশের শিউলি ওরা মুচকি হেসেছিলো। শ্বশুরমশাইয়ের মেয়েদের অনুমতি ছাড়া ওকে কিছু দেবার উপায় ছিলোনা। দিলেই অশান্তি শুরু হত যার ফল স্বরূপ দ্বিতীয় বিবাহ বার্ষিকীতে সকাল থেকে অনেক রান্নাবান্না করেও দুই ননদের অশান্তিতে চোখের জলে হাহাকার করে কেটে গিয়েছিলো শিউলির। খাওয়া আর হয়নি।
         শ্বশুরমশাই যখন মেয়েদের নিয়ে ঝুড়িভরা আম ছাড়িয়ে খাওয়াতেন তখন অন্তঃস্বত্তা শিউলি দাঁড়িয়ে দেখতো। অথচ কেউ বলতোনা," বৌদি তুমিও এসে বসোনা,আম খাও।"..উল্টে শ্বশুরমশাই আম আনছেন আর ওরা খাচ্ছে সে খোটা জুটতো। কথার মারপ‍্যাচ আর চিমটি কাটা কথায় অতিষ্ট হয়ে উঠত জীবন। তার সাথে আসত বাবামায়ের শিক্ষা এবং নিজের শিক্ষার তুলনা। শিউলির তখনও সন্তান হয়নি,এখন ভাবলে হাসি পায় একদিন ননদের কথার জ্বালায় ভয়ে বাড়ি থেকে পালিয়েছিলো। বাড়িতে একমাত্র ভালোবাসার মানুষ ছিলো বর,আর তার অনুপস্থিতির সুযোগে এসেই শিউলির অযোগ‍্যতার জন‍্য এই হলো আর সেই হলো শুনতে শুনতে ভয়ে অবসাদে শিউলি গুটিয়ে থাকতো। তার সাথে ইন্ধন দিতো বাড়ির পুরোনো কাজের লোক। তাই বন্ধুর বাড়ি চলে গিয়েছিলো,ফিরেছিলো বর আসার পর। সেদিন বরের কাছেও খুব বকা খেয়েছিলো," তুমি জানো আমার কত চিন্তা হচ্ছিলো?তুমি কি বোকা! কে কি বলবে কথা শোনাবে এই ভয়ে নিজের সংসার ছেড়ে চলে যাবে। একটু সহ‍্য করো আর সাহস রাখো সব ঠিক হয়ে যাবে।"..." তুমি তো কাউকে কিছু বলোনা,আমি আর একা একা কত লড়াই করবো?আজকাল খুব ভয় লাগে আমার,মনে হয় পাগল হয়ে যাবো। আমার আর সংসার করা হবেনা। আমার বাবা মাও দূরে থাকে,বাড়িতে ফোনও নেই যে একটু কথা বলবো।"বলতে বলতে কেঁদে ফেলতো শিউলি। এইভাবে কত ভালো রাত যে চোখের জলে ভিজতো তার হিসেব নেই। ওর বর বোঝাতো," আমি প্রতিবাদ করতে পারি,কেন করিনা জানো?ওদের বাপের বাড়িটা তাহলে শেষই হয়ে যাবে। আর হয়ত আসবেনা। একটু অপেক্ষা করো দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে।" চোখের জল ফেলে বরের বাহুবন্ধনে বুকে মাথা রেখে ভেবেছিলো। কে জানে কবে সব ঠিক হবে? ততদিনে হয়ত রায়বাঘিনীদের আঁচড়ে রক্তাক্ত হয়ে ও আর বাঁচবেনা।
       
একটা সময় বুঝেছিলো শিউলি কাজের লোকই আড়াল থেকে কলকাঠি নেড়ে ওকে অপ্রিয় আর অযোগ‍্য প্রমাণ করছে ওদের কাছে।  ও যখন বিএড কলেজে যায় সেই সময় কাজের লোক সব খবর পরিবেশন করে ওদের কাছে।যাতে গৃহ অশান্তি লাগিয়ে ও লাভবান হতে পারে।
            অকর্মা,কুৎসিত,বদমাশ,অলস,হিংসুটে এই কথাগুলো শুনতে শুনতে একটা সময় মনে হয়েছিলো ও বোধহয় এমনি। সত‍্যিই বোধহয় ওর কোন গুণ নেই। চরম অবসাদে কেটে যেত জীবন আর একটা একটা করে দিন,যা হয়ত ভরে থাকতে পারত রোমাঞ্চ আর ভালোবাসায়।
সত‍্যি জীবনটা যেন কেমন হয়ে যায় দিনে দিনে। কখনো এমন জীবনের স্বপ্ন দেখেনি। উৎকন্ঠায় থাকত সুমনও প্রতিদিনই এসে জিজ্ঞেস করত আজ বাড়িতে কোন অশান্তি হয়েছে কিনা? নিজের যোগ‍্যতা প্রমাণ করার জন‍্য,সকালে উঠে রান্না করে কলেজে যেতো,অনভিজ্ঞতার ফল হিসেবে কখনো হাত পুড়তো,কখনো বা কাটতো। ওদের বাড়ি গ‍্যাসও ছিলোনা,পিড়ে পেতে রান্না করতে বসে একদিন ছ‍্যাঁকা খেলো হাত বাড়িয়ে কড়াইয়ের পাশ দিয়ে মশলা নিতে গিয়ে কোমরের অনাবৃত অংশে। টলটলে ফোস্কা পড়লো কোমরে। বন্ধুরা বললো, কি করে হলো?" "আমার দোষেই হয়েছে রে,আনাড়ি হলে যা হয়।"..সত‍্যিই তো ওর কোন গুণ নেই আর রূপও নেই।
             মা বাবা দূরে থাকে ওদেরও বলতে ইচ্ছে করেনা সব কথা। অযথা মানুষ দুটো চিন্তা করবে। অথচ বাবা দেখেই ওর বিয়ে দিয়েছিলেন।
                তবে নিরীহ কুকুর বা পাখিকেও দিনের পর দিন খোঁচা মারলে সে হিংস্র হয়ে ওঠে ঠিক সেরকমই শিউলিও বিয়ের তিনবছর বাদে সন্তান হওয়ার পর ফোঁস করতে শিখেছিলো। তাতে অসভ‍্যতা আরো বেশি করে ছড়িয়েছিলো আত্মীয়মহলে। তবুও কিছু করার ছিলোনা,ও যে এখন মা হয়েছে তাই এই সংসারের নরম মাটিতে সন্তানকে কোলে নিয়ে দাঁড়াবে কেমন করে। এইভাবেই একটু একটু করে বেড়া দিতে শিখলো চারপাশে। সংসার শিউলিকে শিখিয়েছিলো নিজের পায়ের তলার মাটিটা নিজেকেই শক্ত করতে হয়। জায়গা কেউ ছাড়েনা,জায়গা করে নিতে হয়। আর তার জন‍্য সবচেয়ে আগে জরুরী নিজের পায়ে দাঁড়ানো।
           অনেক কষ্টে চাকরিটা জোগাড় হয়ে গেলো ওর,তবুও হেনস্থা চলতে লাগলো কিন্তু এরপর আর খুব একটা তোয়াক্কা করতনা। নিজের দরকার মত যা লাগত কিনে নিত। অন‍্যদেরকেও দিত,জীবনে ভালো থাকতে হলে টাকাটা বোধহয় সত‍্যিই প্রয়োজন। টাকা থাকলে হয়ত একটু হলেও মান বাড়ে। শান দিতে শুরু করলো রান্নাবান্না,আঁকা,সেলাই সবটাই নিজের মত করে। একটাই জেদ চেপে গিয়েছিলো নিজেকে প্রমাণ করতে হবে,নিজেকে একটু একটু করে গড়তে হবে যাতে কেউ ওকে আর অপমান করতে না পারে। তবে সময় লেগে গিয়েছিলো অনেক দিন,ধৈর্য ধরেছিলো শিউলি ঠান্ডামাথায়। নিজেরই অবাক লাগে একটা একটা করে তেরোটা বছর কাটিয়ে দিয়েছিলো শিউলি,অনেক সময় আঁচড় বাঁচিয়েছে বুদ্ধি দিয়ে কখনো বা রুখে দাঁড়িয়েছে ওর যোগ‍্যতার ঢাল নিয়ে।
          অনেকগুলো বছর কেটে গেছে স্বীকৃতি পেতে। আজ শিউলি ওর ননদের প্রিয় বৌদি,কখনো বন্ধু কখনো বা পরামর্শদাতা। মাঝে মাঝে ঘষামাজা করে আর যত্ন করে সম্পর্কগুলোকে আগলে রেখেছে নিটোল মুক্তোর মত। এটাই শান্তি যে অনেক পরে হলেও স্বীকৃতি পেয়েছে নিজের ধৈর্য আর অধ‍্যাবসায়ে। সুমনের মুখেও হাসি ফোটে আজকাল যখন দেখে দুইননদের মাঝখানে শুয়ে আড্ডা মারছে শিউলি হাসছে আনন্দে। ওর ছেলেমেয়েরা ওদের ছেলেমেয়েদের সাথে গল্প করছে হাসাহাসি করছে মাঝে নেই কোন প্রাচীর। আসলে সম্পর্কগুলো যে ভীষণ দামী তাই কি দরকার ভুলবোঝাবুঝিতে সেটাকে নষ্ট করার? আজও থাবা বসায় রাইবাঘিনীরা ওর কাঁধে,মানে বিজয়া বা পয়লা বৈশাখে টাইট হাগ দিয়ে গলাটা জড়িয়ে বলে," ভালো থেকো বৌদিভাই।"..এটাই সবচেয়ে বড় পাওনা মনে হয় তখন,অনেক যুদ্ধ আর ঝড়ঝাপটার পর রাইবাঘিনীদের ভালোবাসার থাবা। সুমন হেসে বলে," সত‍্যি তুমি ম‍্যাজিক জানো।"...ম‍্যাজিশিয়ানের ট্রেনিং পিরিয়ডটা বোধহয় খুব কঠিন কিন্তু একবার পাক্কা ম‍্যাজিশিয়ান হয়ে গেলেই,গিলি গিলি ছুঃ বলে যে কোন সমস‍্যা সমাধান করা যায়। আর সেটা বোধহয় শুধু মেয়েরাই পারে।
সমাপ্ত:-

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...