ছেলে নাকি প্রেম করছে,কিছুই বলার নেই যদিও শুনে খুব একটা খুশি হতে পারলেননা সুষমা। এদিকে ওর শাশুড়ি সমানে ইন্ধন দিয়ে যাচ্ছে নাতিকে," ওরে নাতি,নাতবৌকে দেখিয়ে আন সোনা। কবে মরে যাবো পট্ করে তখন আর দেখাই হবেনা।"গজগজ করে সুষমা," যত সব আদিখ্যেতা,উনি এখন ছুটবেন মেয়ের বাড়িতে মেয়ে দেখতে।"
কিছুই করার নেই কারো তাই ইচ্ছে না থাকলেও যেতেই হলো মেয়ের বাড়ি যদিও ছেলে ছবি দেখিয়েছিলো তাতে আর কতটা কি বোঝা যায়,শাশুড়ির শখ উথলে উঠেছে সামনে থেকে হবু নাতবৌকে দেখবে বলে।
ওরে বাবা এ কি মেয়ে রে! মেয়ে দেখতে এসে একটু চমকে যায় সুষমা। কোথায় একগাল হাসি নিয়ে হলুদ শাড়ি আর গয়না পরে মেয়ে চা নিয়ে ঢুকবে তা নয় এই মেয়ে সোফায় বসে বেশ পা দুলিয়ে আড্ডা মারছে বাড়ির অন্যদের সাথে। ওদের দেখে উঠে দাঁড়ানোর প্রয়োজনও বোধ করলোনা। ছেলে না বললে বুঝতেই পারতোনা ওই হচ্ছে পাত্রী ইচ্ছা,ভালো নাম ইচ্ছামতী। মনে মনে ভাবলেন কি ছিরি দেখো চুড়িদার পরে দিব্যি আছে। এই বৌ কি আর কখনো শাড়ি পরে থাকবে শ্বশুরবাড়িতে। কি যে সব যুগ এলো!
সুষমা ইচ্ছার উল্টোদিকে বসে ভালো করে খেয়াল করলেন,মনে মনে ভাবলেন এমনিতে মুখশ্রীটা খারাপ নয় তবে গায়ের রঙটা আরো ফর্সা হলে ভালো হত। এতো কালোই বলা হয়। শাশুড়ির আদিখ্যেতা দেখে গা টা জ্বলে গেলো,একেবারে মেয়ের গায়ে ঘেঁষে বসেছে আর বকবক করেই যাচ্ছে। খাবার দাবার সবই ওর মা আর বৌদি এনে পৌঁছে দিলো। আর কি উনি চাকরি করেন দেখে মাথা কিনেছেন তাই অন্যেরা যখন খেটে মরছেন তখন উনি বসে গল্প করছেন।
এই বৌ কি আর শ্বশুরবাড়ি গিয়ে কাজ করবে? যাক গে ওনার আর কি মিয়া বিবি যখন রাজী তখন আর কি করা যায়। সহবত শিক্ষাও তেমন নেই একবার পায়ে হাত দিয়ে প্রণামও করলোনা। হাতজোড় করেই প্রণাম শেষ। অগত্যা সুষমাই বলে," একবার এদিকে এসো তো দেখি, তোমার সাথে একটু কথা বলি ভালো করে।"
আস্তে আস্তে বেশ কষ্ট করে উঠলো ইচ্ছা ওর বৌদি একটু সাহায্য করলো,তারপর পা টা টেনেটেনে এলো সুষমার কাছে। এসে ওর পাশে বসলো।
থমকে যায় আর বাকরুদ্ধ হয়ে যায় সুষমা,একি! এই মেয়ে তো হাঁটতেই পারেনা ভালো করে,কোনরকমে পা টেনে টেনে হাঁটে। নাহ্ আর ও ভাবতে পারছেনা। শেষে এই খোঁড়া বৌ!
না বলে পারেনা," তোমার কি পায়ের সমস্যা আছে? এইটুকু আসতেই তো খুব কষ্ট হলো দেখছি।"..." আপনি জানেননা প্রবাল কিছু বলেনি আপনাদের? আমি তো বলেছিলাম বারবার ওকে আমার সম্বন্ধে সবটা বলে দিতে বাড়ীতে।"
.." না ও আমাদের কিছুই তো বলেনি,প্রেম ভালোবাসার কথাই তো আমি জানতামনা কিছু,একটা সম্বন্ধ আসাতে বললো ওর নাকি তোমাকে খুব পছন্দ এখানেই বিয়ে করবে।"
হঠাৎই প্রবালের ওপর ভীষণ রাগ হয়ে যায় ইচ্ছার মনে হলো এখনি ফোন করে ওকে। বরাবরই স্পষ্টবক্তা ও ,তাই বললো," আমার ডান পা টা জন্ম থেকেই বেশ সরু। ছোটবেলায় অনেক দেরিতে পা ফেলা শিখেছি। বাবা অনেক চিকিৎসা করেছেন এখন কিছুটা ভালো আছি তবে হাঁটতে এখনো বেশ অসুবিধে হয়। এভাবেই অফিস যাতায়াত করি তবে প্রতিবন্ধীর সিটে বসিনা। যদিও প্রতিবন্ধী সার্টিফিকেট একটা আছে আমার। বাবাই বের করেছিলো একসময়,ভেবেছিলো খোঁড়া মেয়ের যদি একটা চাকরি জুটে যায় এভাবে। নাহলে কে বা দেখবে ওকে। চাকরি অবশ্য আমি করি একটা।"..হঠাৎই যেন পরিবেশটা একটু থমথমে হয়ে যায়। অস্বস্তি হয় ইচ্ছার মা বাবারও। মেয়েটা বরাবরই একটু বেশি কথা বলে,এত বলার কি দরকার। ছেলে যখন ওকে পছন্দ করে বিয়েটা তো হবেই।
সুষমারও খুব রাগ হয় ছেলের ওপর,শুধু শুধু এতগুলো কথা শুনতে হলো মেয়েটার কাছে। আগে থেকে বললেই পারত। সেদিন বাড়ী ফিরে ছেলেতে মায়েতে খুবই মন কষাকষি হয়।" বললেই পারতিস আগে থেকে মেয়েটা খোঁড়া তবুও ওকেই বিয়ে করবি। আমার দরকারই ছিলোনা দেখতে যাওয়ার। বাবা মেয়ের পা না চললে কি হবে মুখ চলে রীতিমত। কতগুলো কথা শুনিয়ে দিল।'' কথা বলতে বলতে সুষমার চোখের কোণটা ছলছল করে ওঠে। এদিকে ইচ্ছাও ফোন করে একচোট কথা শোনালো প্রবালকে। ওর প্রেমটেম মাথায় উঠেছে। বিয়ে করা তো দূরের কথা প্রেমেও থাকবেনা বলছে। কি যে করে!
অনেক বুঝিয়ে একদিন দেখা করলো অফিসের পর। " না না আমি সহানুভূতির পাত্র হয়ে থাকতে পারবোনা। আমার পায়ের সমস্যা আছে বলে কি তুমি আমায় দয়া করছো? দরকার নেই এমন বিয়ের আমার।"...দুই পক্ষকে অনেক বুঝিয়ে শেষে একটা বিয়ের দিন ঠিক হলো দুমাস পরে। নাহ্ আর বেশি দেরি করা ঠিক নয় শুভকাজে। কখন আবার ইচ্ছার মুড খারাপ হয়ে যাবে কে জানে। বাড়ীর সবাই বললো চাকরির জন্যই বিয়েটা করছিস তাহলে। " কি আর বলবো,আমি ওকে পছন্দ করি। চাকরিটা তো আছেই। আমার মাইনে খুব একটা বেশি নয় জানোই তো। দুজন কাজ করলে ভালো থাকতে পারবো।" সুষমা নিশ্বাস ফেলে বলেন," আমার আর কি নিজের ভালো বোঝ তাহলেই হবে। তবে ও বৌ আমার কোন কাজে লাগবেনা।"
বিয়ের মন্ডপে হাতটা শক্ত করে ধরে প্রবাল ইচ্ছার,ভালো করে দুহাতে জড়িয়ে কুলো থেকে আস্তে নাড়িয়ে খই ফেলে আগুনে। যত্নে পার করায় পুকুর। ইচ্ছার ভালো লাগে,হয়ত এতটা কাছে থাকার অনুভূতি ছুঁয়ে গেলো ওর অশান্ত মনটাও তাই নিশ্চিন্তে হাতটা বাড়িয়ে দেয়।
হয়ত প্রবালই পারফেক্ট ওর জন্য মনে মনে হাসে ভেবে রাজযোটক।
শ্বশুরবাড়িতে এসে গাড়ি থেকে হাতটা ধরেই নামায় ওকে প্রবাল বলে," আস্ত পা ফেলো নতুন জায়গা তো।"..কথাটার কি আরো কোন ইঙ্গিত ছিলো? খুব যেন গভীর ছিলো কথাটা। ইচ্ছা বুদ্ধিমতী তাই দুধে আলতায় পা ডুবিয়ে আস্তে আস্তেই পা ফেললো। যাক সবটাই ভালো করে হয়ে গেলো। শাশুড়ির মনটা যে খুব একটা ভালো নেই তা বুঝতে পারলো ও তবে ওর দিদিশাশুড়ি কিন্তু বেশ ভালো। " ওরে আমার নাতিটা তো তোকে ছাড়েইনা। একদম পাহাড়া দিয়ে রেখেছে। আজ কিন্তু আমার কাছে শোওয়া।"
" শোন বৌভাতের দিন বেশি এদিক ওদিক কোরোনা। এক জায়গায় বসেই কথা বোলো।"..কোন উত্তর দিলোনা ইচ্ছা একটা কথাই মনে হলো নতুন জায়গা আস্তে চলতে হবে তাই মাথা নাড়লো। ভালো ভাবেই মিটে গেলো সবটা। আদরে আনন্দে আর গল্পে দুজনে মিলে গেলো দুজনের সাথে। যদিও প্রবাল বলছিলো তোমার অনেক ধকল গেছে আজ ঘুমিয়ে পড়। কাল সকাল সকাল না উঠলে আবার...ওর বুকে মাথা রেখে আদর খেতে ইচ্ছে করে ইচ্ছার।
পরদিন সকালে একটু আশ্চর্য লাগে সুষমার একি রান্নাঘরে কি খুটখাট করছে মেয়েটা। একেই হাঁটতে পারেনা ভালো করে তার ওপর এই সকালে। ছেলে দেখলে হয়ত উল্টে ওদের ওপরেই বিরক্ত হবে। একটু বিরক্ত হয়েই বলে," নতুন জায়গা,এত সকালে উঠেছো কেন? কোথায় হোঁচট খাবে আবার।".." সকালের চা টা বাড়িতে আমিই করতাম মা,পায়ের কিছু ব্যায়াম করি আমি সকালে তাই অভ্যেস হয়ে গেছে। চিন্তা করবেনানা মা হোঁচট খাওয়া আমার অভ্যেস আছে।"
একটু একটু করে মানিয়ে নিয়েছিলো ইচ্ছা প্রবালদের বাড়িতে। প্রবালের প্রথম দিনের কথাটা আজও মনে পড়ে আস্তে চলতে হবে। টেবিলে বসে ছুরি দিয়ে শাশুড়িকে আনাজপত্র কেটে দেয়। সুষমা এই কদিনে বেশ বুঝেছেন পা আস্তে চললেও এই মেয়ের হাত বেশ চলে। মুখটাও চলে বেশ দরকারে তবে আগের ইচ্ছা এখন অনেক সংযত। তবুও একটা চাপা অভিযোগ হয়ত আছেই সুষমার হয়ত বা পাড়া প্রতিবেশীও কিছু বলে।
দেখতে দেখতে কেটে গেছে প্রায় দুটো বছর,এখনো ওদের মাঝে কেউ আসেনি। ইচ্ছা মাঝে মাঝে বলে," আর কত প্ল্যান করবে,এবার হয়ত মা বলবেন আমি এইদিকেও প্রতিবন্ধী।".."না না এবার প্রমাণ করে দিতেই হবে আমার বউ সব পারে ওর ইচ্ছাশক্তি দিয়ে।"..প্রবালের আদরে ডুবে যেতে যেতে হাসে ইচ্ছা। আনমনা হয় প্রবাল ইচ্ছাকে বলতে পারেনি ওদের কোম্পানীর হাল খুব একটা ভালোনা। কখন যে কি খবর আসবে কে জানে। তাই তো সন্তানের কথা ভাবতে পারছেনা এখনি। ইচ্ছা ঘুমোলেও ঘুম আসেনা ওর চোখে।
সত্যি মাসদুয়েক পরে হঠাৎই একদিন বন্ধ হয়ে যায় ওর কোম্পানী। ধাক্কা খায় ইচ্ছাও তবুও হাতে হাত রেখে বলে," আমি তো আছিই চিন্তা কোরনা। আমার চাকরিটা তো ভালোই। মাকে এখনি কিছু বলার দরকার নেই।" অবাক হয়ে যায় প্রবাল,খুবই খারাপ লাগে। মায়েরা বোধহয় সবচেয়ে বড় গোয়েন্দা তাই টের পেয়ে যায় সুষমা কিভাবে যেন। ছেলেকে বলে," ইশ্ শেষ পর্যন্ত বৌমার টাকায় ভাত খেতে হবে!".." মা একটু সময় দাও সব ঠিক হয়ে যাবে। ও কি কোনদিন তোমাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে?"...তা নয় হয়ত একটু বেশিই ভালো ইচ্ছা তাই সুষমার এটাও বেশি বেশি মনে হয়। " তোর বাবার পেনশনে যা হয় চলে যাবে কষ্ট করে।"..সংসারে হাত লাগায় ইচ্ছা সুষমা না চাইলেও। " মা আমিও তো এখানে থাকি খাই,ও যদি টাকা দিতে পারে আমি দেবোনা কেন? কেনই বা আপনাদের টাকায় খাবো? সবার আত্মসম্মান আছে আমার নেই? ছেলেরা সংসার চালাবে মেয়েরা কিছু করবেনা তা কি করে হয়?"
..." তাহলে তো আমাকেও টাকা দিতে হয় বৌমা,তবে আমি তো চাকরি করিনা।"..." আপনি যে সারাদিন সংসারটাকে দেখছেন সেটা কি কিছুনা?"..প্রবাল আশ্চর্য হয়ে যায় ইচ্ছার বুদ্ধি দেখে,ঠাকুমাও বলেন,ঠিকই বলেছে তো নাতবৌ। ও তো এই বাড়িরই মেয়ে এখন।
মনোমালিন্য আর অভাব কোনটাই আসতে দেয়নি ইচ্ছা সংসারে। লোন করে বুদ্ধি খাটিয়ে কিনেছিলো একটা গাড়ি। ওদেরও কাজে লাগত আর ভাড়াও খাটতো। প্রবাল আর ওর মধ্যে আসতে দেয়নি ইগোকে। প্রবালের পরিশ্রম আর ইচ্ছার বুদ্ধিতে এখন ওদের অনেকগুলো গাড়ি। ব্যাবসাটা ভালোই বুঝেছে প্রবাল বেঁধেছে বাণিজ্যলক্ষ্মীকে। এক হাতে গৃহলক্ষ্মী আর বাণিজ্যলক্ষ্মী ভালোই সামলায়। আদর করে ইচ্ছাকে বলে," বাবা হতে একটু দেরি হয়ে গেলো তবে সুদে আসলে সবটা শোধ করে দিয়েছি মানে এক সাথে দুটো।" পাশে শুয়ে থাকা যমজ ছেলেমেয়ে দুটোকে আদর করে ওরা,দুটোই ঘুমোচ্ছে।
আজ হয়ত আর সুষমার কোন অভিযোগ নেই ইচ্ছাকে নিয়ে। সবাইকে বলেন," বাপরে ঐ মেয়ের যা বুদ্ধি,ভাগ্যিস প্রবাল অমন বৌ পেয়েছিলো তাই সবটা সামলালো।" তবুও ভালো সুষমা স্বীকার করলেন। অনেক শাশুড়ি এই কথাটাই বলতে পারেননা মন খুলে।
সব মেয়েকেই বোধহয় কোন না কোন অগ্নিপরীক্ষার মধ্যে দিয়ে সংসারে আসতে হয় সীতার মত। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিজের ইচ্ছেশক্তি আর বুদ্ধি দিয়ে জয় করে ভালো আছে ইচ্ছা। আজ আর নিজের খারাপ দিনগুলোর কথা মনে করতে ইচ্ছে করেনা। জীবন যে বড়ই ছোট, তাই ইচ্ছাও forget and forgive এই মানসিকতা নিয়ে বেশ আছে।©ইচ্ছেখেয়ালে শ্রী
সমাপ্ত:-
#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...
Comments
Post a Comment