#ভালোভাষায়_ভালোবাসা#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
"বৌমা কিন্তু তোমার দারুণ স্মার্ট হয়েছে দেখতে,আমাদের রুণা তো একদম প্রশংসায় অস্থির। ওর খুব ভালো লেগেছে,বোঝোই তো আজকালকার মেয়ে ওরা। তাইনা রে? কি যেন বললি,হ্যাঁ ঠিক একদম প্রীতি জিন্টার মত দেখতে। কি সুন্দর ব্লান্ট কাট চুল,তেমনি ফিগার আর মুখে তো একদম মিলিয়ন ডলার স্মাইল।"
এক নাগাড়ে বলে যায় মিতা। ওর কথা শুনে আলতো হাসির রেখা দেখা যায় সীমার মুখে,পুরোটা হাসতে পারেনা। মনে মনে ভাবে ঐ দিয়েই তো ভুলিয়েছে ছেলেটাকে। তবুও বলে," ইশ্ আমি তো ঐদিকটায় ছিলাম,আলাপ করেছো বৌমার সাথে?"
..." আরে হ্যাঁ গো অত ভেবোনা,যদিও মেয়েই বেশি কথা বললো ই়ংরাজীতে, আমি টুকটাক বললাম।"
দীর্ঘশ্বাস পড়লো সীমারও, ও তো ঐ টুকটাক বলার দলেই। বড় শখ ছিলো একটা মেয়ের তা হয়নি,তাই ভেবেছিলো বৌমাকে দিয়ে পূরণ করবে সেই শখ। একসাথে সিনেমায় যাবে,শপিং করবে,জমিয়ে রান্না করবে শাশুড়ি বৌ মিলে। ওকে শেখাবে ছেলের ভালোবাসার দইমাছ,চিংড়ির মালাইকারি,ভেটকি পাতুরি,চিতলমাছের মুইঠ্যা আরো কত কিছু।
ছেলেটা কি যে মাছ খেতে ভালোবাসে বলার নয়। ও আসার আগেই সীমা ফ্রিজ ভরে রান্না করে রাখতো ওর পছন্দের নানা পদের মাছ। একবার রান্নার বৌকে দিয়ে দইমাছ করিয়েছিলো,তা ছেলে মুখে দিয়েই বলেছিলো," মা এটা কে রান্না করেছে? এ তো তোমার করা নয়। তোমার হাতের রান্নার গন্ধ আমার খুব চেনা।"
ছেলে বেঙ্গালুরুতে হস্টেলে চলে যাওয়ার পর থেকেই দেবেশ বেশি মাছ আনলেই রাগ করত সীমা,"ছেলেটা ওদিকে কি খাচ্ছে তার ঠিক নেই,মা হয়ে কি গলা দিয়ে নামতে চায় এই বড় বড় চিতল মাছের পেটি।"..চিংড়ি ইলিশ আনলেও অনেক সময় খেতে বসে চোখ ছলছল করত সীমার।" এতো মনখারাপ কোরনা সীমা ছেলেটা বিষম খাবে তুমিও তো ভালোবাসো মাছ খেতে। আর আমিও তো একটা মেছো ভূত। তাই আমার জন্যই নাহয় একটু কষ্ট করে রাঁধলে।"..রাগ করে সীমা বলতো," তোমার আর কি ওদিকে আমার ছেলেটা ধোসা ইডলি আর সব দক্ষিণী খাবার খেয়ে দিনের পর দিন কাটাচ্ছে।"
....সায়ন আসলে তখন শুধু দক্ষিণী খাবারের প্রেমেই নয় দক্ষিণী সুন্দরীর প্রেমেও হাবুডুবু খাচ্ছে। চিরশ্রী ওরই সাথে এম বি এ করছিলো তখন,ওখানকার মেয়েরা বরাবরই অনেকেই নানা ভূমিকায় হিন্দী সিনেমায় এসেছে। তবে চিরশ্রীদের পরিবার কন্নড় এবং ওরা একদমই নিরামিষ ভোজী। চিরশ্রীকে দেখতে বেশ ভালো,গায়ের রঙ খুব ফর্সা না হলেও বেশ উজ্জ্বল,মুখশ্রীও সুন্দর। সীমার আপত্তি করার কোনও জায়গাই নেই কারণ ওরা দুজনেই দুজনকে পছন্দ করে। সীমা আজকালকার মা বুদ্ধিমতী। অযথা নিজেকে ছেলে বা বৌয়ের চোখের বালি করতে চায়না। তাই কোন আপত্তি করেনি। শুধু বলেছিলো," ও কি হিন্দীও জানেনা?".." ওরা হিন্দী বলেনা মা কখনোই,নিজের মাতৃভাষা অথবা ইংরেজীতে কথা বলে। এ ব্যাপারে কেন জানিনা চিরশ্রী একটু বেশিই একগুঁয়ে। আমি কিছু বলিনা মা। তাতে কি তুমি এই সুযোগে একটা স্পোকেন ইংলিশের কোর্স করে নাও মা।"...হাসে সীমা,একসময় বিয়ের পর বৌ হয়ে এই বাড়িতে এসে কত কি যে ছেড়েছে তার ঠিক নেই,হয়ত হাসি,শখ,আহ্লাদ,খুশি অনেক কিছুই ছাড়তে হয়েছে ভালো মা,ভালো স্ত্রী আর বৌমা হতে। এখন ভালো শাশুড়ি হতে গিয়ে বিদেশী ভাষাকে আপন করে নিতে হবে নিজের মায়ের ভাষার বদলে। " আচ্ছা তা না হয় হোলো,ও তো মাছ খায়না। মানে আমিষ কিছুই খায়না। তাহলে কি হবে? তুই তো খুব মাছ,মাংস,ডিম,বিরিয়ানি সব ভালোবাসিস। তাহলে?"
....হাসে সায়ন," তাহলে আর কি,আমার খাওয়া হবেনা। বাকি জীবনটা নিরামিষভোজী হয়েই কাটবে। আর মাঝে মধ্যে লুকিয়ে এসে তোমার কাছে দই রুই বা চিতল মুইঠ্যা খেয়ে যাবো। কি গো খাওয়াবে তো? ও মা বলোনা।"
চোখটা ছলছল করে ওঠে সীমার আর সেখান থেকেই একটা চাপা কষ্ট। বৌভাতের পর যে কদিন ওরা ছিলো সে কদিন বাড়িতে মাছের আর প্রবেশ হোলোনা। সীমা চিরশ্রীর পছন্দমত সব নিরামিষ পদ করে সার্টিফিকেট পেলেন,ভেজ বেঙ্গলি ফুড ইজ টেস্টি। এক সপ্তাহে ওদের মুখে চড়া পড়ে গেলো,মাঝে একদিন দেবেশ আর ছেলে গিয়ে বোধহয় বাইরে থেকে বিরিয়ানি খেয়ে এসেছিলো। বেচারা সায়ন,চিরশ্রী যে কি করে টের পেয়েছিলো কে জানে,তাই শাস্তি হিসেবে সেদিন চুমুটুমু কিছুই খাওয়া হলোনা। ওহ্ সত্যি বৌরা সাঙ্ঘাতিক হয়,তাই বোধহয় বাবা কথায় কথায় বলে বৌকে সবচেয়ে বেশি ভয় পায়।
সায়ন চলে গেলো প্রথমে ব্যাঙ্গালুরু তারপর থাইল্যান্ডে চাকরি নিয়ে। চিরশ্রীও ওখানে চাকরি নিলো। শান্তিতে বৌমার সাথে মনের কথা বলতে পারেনা সীমা,সব সময় মনে হয় আহা যদি বাংলাতে দুটো কথা মন ভরে বলতে পারতো তাহলে কি ভালোই না হত! বছরে কখনো একবার কখনো বা দুবার আসে ওরা। চিরশ্রী সোজা চলে যায় বেঙ্গালুরু মন ভরে বাড়িতে মায়ের হাতের রান্না খায়। আর সায়ন চলে আসে কলকাতায় সীমা ফ্রিজে ঠেসে রাখে মাছ আর মাংস। তাই গপগপাগপ মানে," ওহ্ মা কতদিন বাদে খাচ্ছি গো এইসব। ওহ্ মাটন ডাকবাংলোটা গ্ৰেট হয়েছে,আর মালাইকারিটাও উফফফ্ কি যে ভালো! সীমা মাছ মাংস হাতা ভরে ঢেলে দেয় বাটিতে। "মা আর দিয়োনা,সামনের সপ্তাহে চিরশ্রী এসেই বলবে প্রচুর ওজন বাড়িয়েছি ভালোমন্দ খেয়ে, বকা দেবে আমাকে।"
মনটা ভারী হয়ে যায় সীমার ছেলেটাকে কোথায় কতদিন বাদে একটু ভালোমন্দ খাওয়াবে তা না এখন বৌ যা বলবে তাই হবে। চিরশ্রী আসার দুদিন আগে থেকেই সীমার ফ্রিজ ধোয়া মোছা হয়ে যায়। আর সায়নও আমিষের ধার মারায় না,ওরে বাবা আবার যদি গন্ধ পায় তাহলেই হয়েছে। হয়ত সাতদিন কাছেই শোবেনা এবার।
সীমা আর দেবেশ মাঝে ঘুরে এসেছে থাইল্যান্ড,ওরা বলছিলো আরো কয়েকদিন থাকতে। যদিও সীমার মনে হচ্ছিলো চিরশ্রী কথায় টানে যে ওদের নিয়মগুলো অন্যরকম,মায়ের আদরে সায়ন যা খুশি তাই করছে এই কদিন। এদিকে দেবেশের আর ভাত উঠছিলোনা মুখে,কাহাতক ঐসব তরকারি খাওয়া যায়। বড় কষ্ট হয় ছেলেটার জন্য,ঐজন্যই বোধহয় ব্যাটা ভাত খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। দেবেশও বাড়ি এসে সীমার হাতের পটল ঝিঙের পাতলা মাছের ঝোল ভাত খেয়ে বাঁচলেন।
পরের ছুটিতে আর ছেলের আসা হলোনা সীমা শুনলেন চিরশ্রী মা হতে চলেছে। মনটা সত্যি খুশি হয়ে উঠলো আর তার সাথে দুশ্চিন্তাও,একা থাকে ওরা কে জানে মেয়েটার কোন অসুবিধে হবেনা তো। বৌমাকে কিছু সাবেকী নিয়মকানুন বোঝাতে গিয়ে খুবই অসুবিধেয় পরলো ভাষাগত সমস্যায়। সীমার এটা করোনা,ওটা কোরনা এমন কিছু কথাই ভুল বুঝলো চিরশ্রী। যথারীতি ছেলেই বললো," মা তুমি ওকে আবার কি বলতে গেছো,কিসব করতে নেই। শোনো এখন আর এত কিছু লোকে মানেনা। ওর মনে হয় রাগ হয়েছে। মাথায় হাত দেয় সীমা,এই হচ্ছে ভাষার গেরো,এখন যে ওকে বুঝিয়ে বলবেন ও খামোকা ভুল বুঝছে তাও মুশকিল আবার কি বুঝবে কে জানে। অগত্যা ছেলের সাহায্যে তখনকার মত মিটলো অশান্তি। তবে সব দাগ কি আর মুছে যায় মন থেকে? তাই সীমা ঠিক করলো এরপর যতটা পারবে কম কথা বলবে। তাতেও অভিযোগ এলো সীমা নাকি চিরশ্রীকে পছন্দ করছেনা আর এই নিয়ে মনোমালিন্য,কান্নাকাটি। যথারীতি সায়নকে বৌয়ের পক্ষই নিতে হলো,একেই ভাষা সমস্যা বেচারার তারপর এই অবস্থা মেয়েটার এই সময় মনের ওপর চাপ ঠিক নয়। কেন যেন শাশুড়ি বৌয়ের মাঝের অদৃশ্যরেখাটা ঠিক মোছা গেলোনা।
বাচ্চা হওয়ার সময় সীমা যেতে চেয়েছিলো,ছেলেই বারণ করলো। " মা ছেড়ে দাও,ওদের অনেক নিয়মকানুন আছে,সবটা না করলে হবেনা। তাই ওর মা বাবাই আসবে। সাথে একটা কাজের বৌ নিয়ে আসবে চিরশ্রী আর বাচ্চার যত্নের জন্য। বড় মন ছটফট করলো ওদের তবুও থাক,অযথা ভীড় বাড়িয়ে কি দরকার! চিরশ্রীর মায়ের সাথে একদমই কথা বলতে পারেনা সীমা সেভাবে, উনি আবার ইংরেজীও বলতে পারেননা তেমন কন্নড় ছাড়া।
সায়নের মেয়ে হয়েছে,খুব খুশি ওরা সবাই। সীমার বরাবরই মেয়ের খুব শখ ছিলো। একটা মিষ্টি মেয়ে ঘরের মধ্যে ঘুরবে হাসিতে কোলাহলে ভরবে ঘর। সাজবে,সুন্দর সব জামা পরবে। চিরশ্রী পছন্দ করে ওর নাম অঙ্কুশা রেখেছে। ওদের একটা অনুষ্ঠান হয় বাচ্চা হবার কিছুদিন বাদে,সেখানে গেলো সীমা আর দেবেশ। পুরো দক্ষিণী রীতি মেনেই অনুষ্ঠান,অঙ্কুশাকে সাজানো হয়েছে ওদের রীতিতেই। বাঙালীদের মত চেলি মুকুট আর আলতায় নয়। তবুও খুব ভালো লাগলো ওদের নাতনিকে ঐ পোশাকেই,ওমা কি যে মিষ্টি হয়েছে মেয়েটা,সীমা তো চোখ ফেরাতেই পারেনা। দেবেশকে জিজ্ঞেস করলো," আচ্ছা ও সায়নের মত হয়েছে না দেখতে?".." সে যা হোক, সুস্থ থাক, তুমি আবার কিছু বলতে যেয়োনা যেন।"...ওর দাদু দিদা চলে যাবার পরেও মাসখানেক থেকে যায় সীমা,যে কয়দিন থাকা যায়। বাচ্চাটাকে তো সেই কাজের লোকের কাছে থাকতে হয়। সুযোগ পেয়ে যা খুশি করে বৌটা। কি বলবে এক বর্ণও ভাষা বোঝেনা। একদিন দেখে যে নাতনির স্নানের গামলায় ডাস্টিং করার জিনিসগুলো কাচছে। বাধ্য হয়ে সেদিন ছেলেবৌকে বলেছিলো সীমা,কিন্তু তার ফল যে এমন মারাত্মক হবে বুঝতে পারেনি। সেই বৌটি কান্নাকাটি চেঁচামেচি শুরু করে তার সারবস্তু ছেলে যা বলে তা হলো,ও তো এই কয়মাস দিনরাত এক করে বাচ্চাটাকে বড় করলো আর শেষে কিনা ওর নামেই এই দোষ। ও বরং সীমার সম্বন্ধে যা তা বলেছে। সায়ন যা খুব একটা বিশ্বাস না করলেও চিরশ্রী করেছে। কারণ ঐ বৌটি তাদের অনেক আগের পরিচিত। সে নাকি হুমকি দিয়েছে এমন কাজের তার দরকার নেই,তাকে এক্ষুণি ফ্লাইটের টিকিট করে দেওয়া হোক সে চলে যাবে।
মহা অসুবিধেয় পড়ে সায়ন,চিরশ্রী বলছে কাজের লোক ছাড়া চলবেনা কিছুতেই। শ্বশুর শাশুড়ি না এলেও ওর চলে যাবে কিন্তু নান্নীআম্মা চলে গেলে কি করে কি হবে?
অনেকটা চোখের জল পড়েছিলো সীমার সেবার," তুমি তো জানো,আমি কি করেছি?ছেলেটাও আমাকে ভুল বুঝলো শেষপর্যন্ত! বাচ্চাটা ভালো থাক সেটা কি আমি চাইনা?"..সীমার কান্না দেখে খারাপ লেগেছিলো দেবেশেরও বলেছিলো," বড় বেশি সবার ভালোর চিন্তা করতে গিয়ে সবার কাছে খারাপ হও তুমি,কি দরকার দুদিনের জন্য এসে ঝামেলায় জড়ানোর? সবই তো ছাড়তে হবে সীমা,কি দরকার মায়া বাড়ানোর? ওদেরকে ওদের মত ভালো থাকতে দাও।"
মায়ের মন খারাপ দেখে ভালো লাগেনি সায়নেরও কিন্তু কিছু করতে পারেনি। একদলা কান্না আর মনখারাপের মেঘ কুয়াশায় ভাসতে ভাসতে নিজের দেশে আসার প্লেনে চড়ে বসেছিলো সীমা। আরো বেশি বরফশীতল হয়ে গিয়েছিলো শাশুড়ি বৌমার সম্পর্ক। ভুল বোঝাবুঝির ভয়ে আর তেমন কোন কথা হতনা টুকটাক কথা ছাড়া। সায়ন বেশির ভাগ কথাই সেরে ফেলতো অফিসে বসে। নাতনিটার জন্য বড় মন খারাপ করে সীমার, একটু দেখতে ইচ্ছে করে। ভয়ে সাহস পায়না সে কথা বলতে,কারণ চিরশ্রীর সামনে ভিডিও কল করলে ও আবার কি ভাববে কে জানে। সেই কবে একদিন ছেলে দেখিয়েছিলো,তা সে যা অস্থির একটু বাদেই ছুট মারলো। তবে অনেক ছবি পাঠায় ছেলে। সীমা জিজ্ঞেস করে," ওর কথা রেকর্ড করা আছে রে? পাঠাস তো। তোকে কি বলে ডাকে? কি ভাষা শিখছে?"..সায়ন একটু চুপ করে যায়। পেছন থেকে বকা লাগায় দেবেশ," সীমা,তুমি আবার বেশি কথা জিজ্ঞেস করছো কেন,ভগবান!"..এর মাঝেই উত্তর পায়," সবই বলে মা মিলে মিশে, তবে এতে একটু সমস্যা হচ্ছে। তাই ভাবছি শুধু ই়ংরেজীটা শেখাবো ভালো করে। ওটা সব দেশেই চলবে।"..আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে সীমা।
মাঝে প্রায় দুইবছর ওরা, আসেনি দেশে। দেখতে দেখতে প্রায় তিনবছর বয়েস হয়ে আসছে ওর। সামনেই গরমে ওদের আসার কথা। সেই একই নিয়মে চিরশ্রী প্রথমে বাপের বাড়ি যাবে,আর সায়ন আসবে এখানে।
অপেক্ষার সময় আর কাটেনা। ছেলে আসার আগে থেকেই শুরু হয়ে গেছে চরম ব্যস্ততা। এর মধ্যে অনেক কেনাকাটাও করেছে সীমা,নাতনির জন্য মনের সুখে এমন কি চিরশ্রীর জন্যও ওর বলে দেওয়া দোকান থেকে। ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে আবার বেরোবে। মাছ এসে গেছে প্রচুর। সায়ন আসাতেই খুশির দোলা লাগলো ওদের বাড়িটায়,রান্নার গন্ধে ম ম করছে চারধার। দেবেশের বাজার যাওয়া বেড়েছে। "ওহ্ মা,কতদিন বাদে তোমার রান্না খাচ্ছি।".." ভালো করে তো খেলিই না কিছু।".." মা আসলে অভ্যেস চলে গেছে তো তাই একসাথে এত কিছু খেতে পারিনা এখন। ও তুমি রেখে দাও আমি ঠিক খাবো।" সীমা তাই ভাবে কি আর করবে ইডলি স্যালাড সম্বর আর টকদই খেয়ে বাঙালী খাওয়া ভুলতেই বসেছে ছেলেটা।
দেখতে দেখতে কেটে গেলো কয়েকটা দিন। সীমার এবার ফ্রিজ পরিস্কার করার পালা,যদিও এখন আরেকটা নিরামিষ ফ্রিজ আছে বাড়িতে। তবুও মাছ মাংসের গন্ধ আর চলবেনা। সায়নটা অনেকক্ষণ বেড়িয়ে গেছে এয়ারপোর্টে,কখন যে আসবে। হঠাৎই দেবেশ বলে," ফোন করেছিলো ছেলে তুমি তৈরি তো,ওরা এসে পড়বে আধ ঘন্টার মধ্যেই।"
বাড়ির গেটের সামনে এসে বাড়িটাকে একটু অচেনা লাগে চিরশ্রীর বাহ্ নতুন রঙ হয়েছে। গেটের কাছটা কি সুন্দর সাজানো বেলুন দিয়ে। সায়নের কাছে জানতে চায়,বাড়িতে কোন উৎসব আছে কিনা। সায়ন বলে পুরোটাই নাতনির জন্য সাজানো হয়েছে মায়ের ইচ্ছায়।
....ঢোকার মুখে গোলাপের পাপড়ি বিছানো,ওপারে দাঁড়িয়ে সীমা হাতে শঙ্খ আর বরণডালা। " দিদিভাইকে কোলে নিয়ে আসতে বল চিরশ্রীকে। প্রথম বাচ্চা নিয়ে এলো বাড়িতে।"
চিরশ্রীকে বুঝিয়ে বলে সায়ন,দেবেশ হাতে মোবাইল নিয়ে ভিডিও করছেন। চিরশ্রী মেয়েকে কোলে করেই আসছিলো,হঠাৎই ভীষণ ছটফট করে কোল থেকে নেমে পড়ে অঙ্কুশা। পায়ের জুতোটা একপাশে খুলে রেখে,গোলাপের পাপড়ির ওপর দিয়ে একছুটে দৌড়ে সীমার কাছে এসে চুপ করে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে তাকায়। সীমা হেসে ফেলে শঙ্খে ফুঁ দেয়,দেবেশ কোলে তুলে নেন নাতনিকে। ততক্ষণে চিরশ্রী আর সায়নও এসে পড়েছে। সবাইকে অবাক করে অঙ্কুশা হঠাৎই বলে ওঠে," দাদু ঠাম্মাকে বলো আমি রসগোল্লা খাবো।"..সীমা কিছু বোঝার আগেই ওর সাজানো থালা থেকে একটা বড় রসগোল্লা একদম মুখে চালান করেছে অঙ্কুশা। রসে মেখেছে গালটাও। সীমা আজ যেন বাঁধনহারা,ঐ রস মাখানো গালটাতে নিজের গালটাও মাখিয়ে নিলেন পরম যত্নে। এই প্রথম নাতনির মুখে বাংলায় দাদু ঠাম্মা ডাক শোনা বোধহয় রসগোল্লার চেয়েও মিষ্টি।
সুন্দর মুহূর্তগুলো বন্দী হচ্ছিলো সায়ন আর চিরশ্রীর মোবাইলে। ভাষা একসময় আলাদা করেছিলো ওদের, আজ ভাষাই মিলিয়ে দিলো আবার সবাইকে একসাথে। আনন্দের রেশ কাটার পর ছেলেকে জিজ্ঞেস করেছিলো সীমা," ও বাংলা শিখলো কি করে রে?"...সায়ন মিষ্টি হেসে বলেছিলো," ওর রক্তে যে মিশে আছে বাংলা ভাষার মিষ্টতা মা,তাই বোধহয় আমাকে খুব কষ্ট করতে হয়নি।...তবে সবটাই সম্ভব হয়েছে চিরশ্রী রাজি ছিলো বলে। মা হয়ে এখন চিরশ্রীও বোঝে নিজের দেশের ভাষা আর মায়ের ভাষা না শিখলে মিঠে স্বাদটা ঠিক পাওয়া যায়না। চিরশ্রী লালপাড় চাঁপারঙের কাঞ্জিভরমটা সীমার গায়ে রেখে প্রণাম করে বলে," ডু ইউ লাইক না সরি ..মা তোমার পছন্দ?"
আশ্চর্য লাগে সীমার, থুতনিটা ধরে একটা চুমু খায় সীমা। ছেলেটা বলে ওঠে," মা আমার জন্য একটু আদর রেখো,আরে এই বাংলাগুলো ইংরেজীতে টাইপ করে আমিই তো মুখস্থ করালাম সারা রাস্তা। আমাকে অন্ততঃ কিছু তো নম্বর দিয়ো।"..হাসির রোল উঠলো আবার। সীমার কানে তখন গুণগুণ করছে একটাই বোল,ঠাম্মা। মিঠেভাষায় মিঠে বোল সবচেয়ে মিষ্টি মানুষের কাছ থেকে, তা কি সহজে ভোলা যাবে?
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment