#জোনাকি#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
আলেয়া একটা সময় অন্ধকার মাঠে ছোট্ট ছোট্ট জোনাকির পেছনে ছুটতে খুব ভালোবাসতো। কি সুন্দর মিট মিট করে নীলচে আলো দিতো জোনাকি পোকাগুলো। স্মার্টফোনটা হাতে নিয়ে হঠাৎই ঐ নীলচে আলোর কথা মনে হয়ে গেলো ওর। সেদিনও ছোটবেলায় ঐ মিষ্টি আলো দেখে খুশি হত ও,আর আজও মোবাইলে টুংটাং আওয়াজ আর আলো দেখে মনে হয় ঐ তো আরেকটা জগত যেখানে কেটে যায় একলা মনের মনখারাপের ক্লান্ত দুপুর অথবা সাঁঝবেলা। কত ভালোবাসার আর ভাঙা গড়ার গল্প পড়ে আজকাল মুঠোফোনে। কিন্তু সত্যিই কি তেমন ভালোবাসা কিছু আছে যেমন ওর বাবা ওকে বাসতো অথবা মা। নাকি সবটাই প্রয়োজন? কে জানে ওর বাবা মায়ের মত হয়ত আলেয়াও নিজের সন্তানদের ভালোবাসতে পারেনি তাই একলা মনে বা হঠাৎ একলা দুপুরে মনকেমনের মেঘ এলে বাবাকে বলে ওঠে এত তাড়াতাড়ি কি ছিলো যাবার বলতো? তোমার মত যে আমায় আর কেউ ভালোবাসেনা। আলেয়ার মত এ যুগের অনেক মা একা হয়ে যায় বৃদ্ধ হওয়ার আগেই। যখনই সন্তানদের মুঠোতে আসে খুশিতে আর আনন্দে ভরা পৃথিবী ওরা সরতে থাকে দূরে। মায়েরা ভাবে ওরা বড় হচ্ছে পাল্টাবেই তো। তাই যে হাতটা স্কুল থেকে ফেরার সময় শক্ত মুঠোতে ধরতো মায়ের হাত পরম নির্ভরতায় কারণ তখন মাকে ছিলো তার বড় প্রয়োজন। স্কুল থেকে নিয়ে গিয়ে জামাকাপড় ছাড়িয়ে খাইয়ে দেবে মা। সব যত্নে গুছিয়ে তুলবে আরও কত কি। বকবক করে মাথা খেত মায়ের,সব কথা তো বলতেই হবে মাকে। সন্তানদের হাতের মুঠোগুলো বড় হয়,নিজেরাই বেশ সুন্দর শক্ত হাতে বাসের হ্যান্ডেল ধরতে পারে। মাকে বলতে হয়না,আস্তে দাদা ছোট বাচ্চা আছে। কেন যেন ওদের মুঠো বড় হয়ে যাবার পর মায়েদের অশক্ত হাতটা আর ধরতে ইচ্ছে করেনা,খুব কমই বলতে শোনা যায় আস্তে ভাই বয়স্ক মানুষ আছে। অথবা ভুলেও জানতে ইচ্ছে করেনা কেমন আছো আজ?আলেয়া বোঝে সংসারে একটু একটু করে ওর প্রয়োজন কমছে। তাহলে সত্যিই ভালোবাসা বলে কিছু হয়না, সবটাই শুধু প্রয়োজন মানে ঐ সিঁড়ির মত।এখন রাস্তা পেরোতে ওর একটু সময় লাগে,হাঁটু ব্যাথাটা বেড়েছে। সেদিন বিকেলে বাজার করে বাজারের ব্যাগটা নিয়ে দাঁড়িয়েছিলো রাস্তায়। বেশ ভারি ব্যাগটা,ডানদিকে বাঁদিকে তাকিয়ে দেখে রাস্তা পার হবে বলে পা বাড়ায়। হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন বাজারের ব্যাগটা টান দেয়। "কতবার বলেছি না এভাবে ভারি ব্যাগ নিয়ে রাস্তায় হাঁটবেনা। দাও আমাকে ব্যাগটা।"..পেছনে ফিরে একটু লজ্জা পায় আলেয়া,অফিস থেকে ফিরছে ওর বর।এই লোকটার বোধহয় এখন একটু বেশিই প্রয়োজন ওকে। একটা সময় অনেক ঝগড়া করত এখন বয়েস হচ্ছে তো তাই বোধহয় একটু সামলে রাখে ওকে। তাহলে কি এটাও ভালোবাসা নয়,শুধুই প্রয়োজন? মানে বুড়ো বয়েসে বৌকে দরকার এই আর কি।
অভিনবই বলে," এখানে একটা নতুন ক্যাফে খুলেছে যাবে নাকি? একটু টুকটাক খেতাম।".."এইভাবে বাজারের ব্যাগ নিয়ে ক্যাফেতে?".."তাতে কি? তুমি তো বাড়িতে ঢুকলে আর বেরোতেই চাওনা।" একটু ভয় পায় আলেয়া,তার সাথে আবার ইচ্ছাও করে একটু একটু। হয়ত ছেলেমেয়েরা ফিরেছে এর মধ্যেই,তবুও অভিনবর অনুরোধ ফেলতে পারেনা।বাড়িতে ঢুকতেই মুখ ঝামটা শোনে মেয়ের," কতক্ষণ কলেজ থেকে এসে বসে আছি,এত দেরি কেন তোমার? ওহ্ গলাটা শুকিয়ে গেছে একদম।"
ব্যস্ত হয়ে ওঠে আলেয়া সবটাই কি ভালোবাসা না ভয়? তাড়াতাড়ি রান্নাঘরের দিকে যায়। কাঁধ থেকে ব্যাগটা নামিয়েই কাজে লেগে পড়ে। আসলে এদেরকে তো ও নিজেই তৈরি করেছে। তাই কিছু করার নেই,হয়ত বা কখনো কেউ বলবেনা তুমি একগ্লাস সরবত খাও। কষ্ট হলেও ভালো লাগলো ভেবে যাক তবুও তো ওকে এখনও সংসারের প্রয়োজন। হয়ত বা নিজেকে সমৃদ্ধও মনে হলো এই ভেবে সংসারের প্রয়োজনে নিজেকে খরচ করার শক্তি ওর আছে।
দিনের পর দিন এইভাবেই চলে যায় আলেয়ার,কষ্ট পায় কিন্তু প্রকাশ করেনা। গলার কাছে কান্নার ডেলাটা আবার গিলে ফেলে। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে ছেলেমেয়েগুলোর ঘুমন্ত মুখটা দেখে আদর করতে ইচ্ছে করে,ভুলে যেতে ইচ্ছে করে সব কষ্ট আর অবহেলা। সরে আসে পর্দাটা টেনে,মনে মনে বলে ভালো থাক ওরা।
অফিস থেকে এসে সেদিন খুব হাসিখুশি দেখায় অভিনবকে। চা দিতে দিতে আলেয়া জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে গো?"না না কিছুনা তেমন,কাল ভোরে শান্তিনিকেতন যাবো সব গুছিয়ে নাও তাড়াতাড়ি। আলেয়া কিছু বলার আগেই ছেলে মেয়েরা বলে, "এই সময় প্রোগ্ৰাম করলে,আমরা তো যেতে পারবোনা।"..গলায় একটু জোর এনে অভিনব বলে," জানি তো তাই শুধু আলেয়া আর আমি যাবো।".."সে কি,তাহলে ঘর সামলাবে কে? দাদাটা যা ফাঁকিবাজ সবটাই আমাকে করতে হবে। না না আমি অত ঝামেলা করতে পারবোনা।"..পর্দার পাশে দাঁড়িয়ে আলেয়া বললো," আমি চিকেনটা করে রাখছি,বাদবাকি তোরা সামলে নিস। বাবা যখন মন করেছে যাবে বলে।"...ছেলে মেয়েদের কয়েকটা কথা কানে গেলেও কান বুজলো আলেয়া। সারারাত ভালো করে ঘুমই হলোনা। সংসার ছেলেমেয়ে এইসব করে কতদিন বেরোনোই হয়না।
....সকাল সকাল বেড়িয়ে পরা,ট্রেনের জানলায় খোলা হাওয়ায় মনটা বড় ভিজে গেলো আলেয়ার। নাকে এলো মাটির সোঁদা গন্ধ। লালমাটির পথ বেয়ে কখন যে সোনাঝুড়িতে পৌঁছে গেছে বুঝতেই পারেনি। "তুমি এত ভালো ঘরের খোঁজ পেলে কোথায়?কি সুন্দর খোলা সামনেটা!"আনন্দে হারিয়ে যায় আলেয়া,মুগ্ধ হয় অভিনব। হয়ত সব দাম্পত্যেই এই বিশেষ একলা থাকার জায়গাটা খুব দরকার।বিকেলে লাল সাদা খেসের শাড়িটা আর এক গোছা পলাশ তুলে দেয় আলেয়ার হাতে অভিনব,"আজ যে তোমার জন্মদিন আলেয়া,এমনি হাসিখুশি আর লক্ষ্মীমন্ত হয়ে থেকো আমার এই চওড়া কপাল জুড়ে। অবশ্য আমারও আছে এই দেখো।".."কোথা থেকে কিনলে এইসব? কিন্তু ছেলে মেয়ে দুটো।"
"ওরা ভালো আছে আলেয়া,আর কতদিন ওদের বাঙালি করে রাখবে?এবার একটু মানুষ হতে দাও।"..একফোঁটা জল চিকচিক করে আলেয়ার চোখেও সত্যিই কি ওদের মনুষ্যত্ব হয়েছে? হয়ত বা বুকটা চিনচিন করে অভিনবরও।
"জন্মদিনে মন ছোট করতে নেই,আমাদের কি প্রয়োজন ওদের ভালোবাসায়? আমাদের ভালোবাসার সবটাই তো উজাড় করে দিয়েছি ওদের। দাতা হওয়াই বেশি ভালো তাইনা?"
হঠাৎই আনন্দে উচ্ছ্বল হয়ে ওঠে আলেয়া," ঐ দেখো কত জোনাকি। অন্ধকারে নীলচে আলো ছড়াচ্ছে। জোনাকিরা আছে এখনও!"
...." সব আছে আলেয়া,ভালোবাসাও আছে। তবে আজ একটু বেশিই ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে তোমায়।"..হাল্কা লজ্জা ও শিহরণ জাগে আলেয়ার, ওর হাতে হাত রাখে অভিনব। খোয়াইয়ের পার জুড়ে তখন শুধুই নিস্তব্ধতা। পাশাপাশি দুটো চেয়ারে বসে থাকা দুটো মন বহুদিন বাদে উপভোগ করছে এক অনন্য অনুভূতি যেখানে ভালোবাসা শুধু প্রয়োজনেই নয় হয়ত হয় এমন নিবিড় আত্মিক বন্ধনে যা আমরা বুঝি অনেক দেরিতে।ইশ্ এর মধ্যে যে কখন অভিনব ওর প্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীতটা চালিয়েছে বুঝতেই পারেনি। অভিনবর মুঠোফোনে বাজছে..'ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো,তোমার মনের মন্দিরে।'
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment