Skip to main content

ছত্রিশ বছর পরে

#ছত্রিশ_বছর_পর#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#

বোর্ডিং পাসটা নিয়ে লাগেজগুলো দিয়ে একটু নিশ্চিন্ত লাগে সুব্রতবাবুর। এই কদিন বেশ একটা অদ্ভুত উত্তেজনা হয়েছে মনের মধ‍্যে। এরমধ‍্যে দুই ছেলে অনেকবার ফোন করেছিলো যে বাবা ঠিক করছে তো কাজটা? এই বয়েসে সত‍্যিই বাবার বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ পেয়েছে এমন কথাও শুনতে হয়েছে তাকে।
                
                      ফ্লাইট ছাড়তে এখনো প্রায় দু ঘন্টার বেশি বাকি। স্মৃতির অতলে উঁকি মারে জীবনের সায়াহ্নে পৌঁছনো ক্লান্ত মন। মনে হয় যেন এই তো সেদিনের কথা তখন যাদবপুর থেকে পাশ করে চাকরি করছেন। গ্ৰামের বাড়িতে গেলে হৈ চৈ পড়ে যেত ওকে নিয়ে সবাই বলত গ্ৰামের গর্ব এই ছেলে, কত বড় ইঞ্জিনিয়ার! তারপর যেদিন ভালো চাকরি আর ভালো থাকার জন‍্য বিদেশে পা রেখেছিলেন সেই ফেলে আসা নিজের দেশকে অনেক পেছনে। আসার সময় মা চোখটা মুছে বলেছিলো," সেই দূরে চলে গেলি বাবা,তাও তো সপ্তাহে মাসে একদিন দেখতে পেতাম। মাঝে মাঝে বাড়ি আসতিস,এখানে কিছু ভালো পেলিনা না রে বড় খোকা?"..সেদিন ওর কম পড়াশুনা জানা মাকে খুব সুন্দর করে বোঝাতে পেরেছিলো ওদেশে সব ভালো,এখানে তেমন সুযোগ কই।বাবা হেসে বলেছিলেন," যা বাবা অনেক বড় হ। তুই আমাদের গর্ব।"..চার ভাইবোনের সবচেয়ে বড় সুব্রত আর পেছন ফিরে তাকায়নি, চোখে তার অনেক স্বপ্ন তখন। নতুন দেশ,নতুন চাকরি আর নতুন জীবন ডাকছে তখন। দুহাতে মুঠো করে ধরবে সুখ,বাঁচবে প্রাণভরে। সত‍্যি তো কি আছে এই দেশে? ফোন করলে মা জিজ্ঞেস করতো,"কেমন আছিস বাবা?ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করছিস তো।না কি তোর সেই আগের মত পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে যাওয়ার অভ‍্যেস এখনো আছে? আচ্ছা ঐ দেশটা কি আমাদের এই দেশের থেকে অনেক বেশি সুন্দর?এই তো সেদিন কচুর লতি রান্না করেছিলাম চিংড়ি মাছ দিয়ে, তোর কথা খুব মনে পড়ছিলো।"..পাশ থেকে বাবা তাড়া দিতো," ছাড়ো ছাড়ো,আরে অনেক বিল উঠে যাচ্ছে তো ছেলেটার। ছাড়ো তো তোমার কচুর লতির গল্প।"
    "মাকে বলে দাও এখানে সব পাওয়া যায় এমনকি কচুর লতিও। কিন্তু আমাকে কে রান্না করে দেবে এইসব।"
   তখন মোবাইল ফোন আর ইন্টারনেট ছিলোনা। ওদের বাড়িতে অনেক পরে এসেছিলো ল‍্যান্ডফোন। তাই মা হয়ত বসে থাকতো ছেলের গলা শোনার অপেক্ষায়। ভাই বোনদের উৎসাহের অন্ত ছিলোনা। কত কিছু তাদের যে জানতে আর শুনতে ইচ্ছে করত তার ঠিক নেই।
            ছেলের কথার ইঙ্গিত মা বাবা বুঝতে পেরেছিলেন। একদিন বড় বোনই বলে," দাদা তোর চাকরি থেকে একটু বেশিদিনের ছুটি নিয়ে দেশে আয় এবার একদম মেয়ে দেখে বিয়ে করে ফিরবি। আর তোর যদি কিছু পছন্দ থাকে..."
                  ঘটকালিটা দেশে থাকতেই ইলাবৌদি করেছিলো ওরই বোনের সাথে। ভালো লেগেছিলো সুব্রতর নন্দাকে, দেখতে বেশ সুন্দরী শিক্ষিতা। তাই বিয়েটা হতে খুব একটা দেরি হয়নি। বিয়ের পরই নন্দাকে সাথে নিয়ে একেবারে ওদেশে।শ্বশুরবাড়িতে দশদিন থেকেই হাঁপিয়ে উঠেছিলো নন্দা। ওহ্ চিরকাল শহরে থেকে গ্ৰামের বাড়িতে থাকা!চারিদিকে একগাদা লোক,সবসময় শাড়ি পরে লক্ষ্মী বৌ হয়ে থাকা আর কেউ এলেই শাশুড়ির নির্দেশে প্রণাম করা।সুব্রত বলেছিলো," আর তো কটা দিন একটু মানিয়ে নাও।"...বাপের বাড়ি দুদিনের জন‍্য এসে বেঁচেছিলো নন্দা মা বাবা আর দিদি গুছিয়ে দিয়েছিলো ব‍্যাগভর্তি জিনিস আর জামাকাপড়।
লাগেজ গোছাতে গোছাতে হঠাৎই সুব্রতকে বলেছিলো,"এগুলো তো আর ঢুকছেনা,সত‍্যি তোমার মাও পারে তিলের নাড়ু,নারকেলের নাড়ু,তালপাটালি যা পেরেছে ঢুকিয়েছে। কয়েকটা বার করে রাখছি।"
          আচমকা একটু ধাক্কা খেয়েও বলে উঠেছিলেন,"না না ওগুলো থাক,মা অনেক কষ্ট করে বানিয়েছে। জানিতো এখন মায়ের শরীরটাও খুব ভালো যায়না।"..অসন্তোষের হাসি হেসে নন্দা বলেছিলো," আমি কিন্তু এগুলো একদম ভালোবাসিনা। চিনি আর গুড়ের ডেলা। তুমি খাবে তো?"..ঘাড় নেড়েছিলো সুব্রত হয়ত সাথে করে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো মায়ের যত্ন আর আদরের স্পর্শ। একটু একটু করে পাকা গিন্নি হয়ে গিয়েছিলো নন্দা। ভুলিয়ে দিতে চেয়েছিলো সুব্রতকে মায়ের আঁচলের গন্ধ অথবা  হাতের স্নেহের স্পর্শের নরম পরশ। রান্না বান্না ঘর গোছানো উইকএন্ডে বন্ধুদের খাওয়ানো সবটাই সামলাতো একা হাতে। দেশে যাওয়ার বছরের মধ‍্যে ফারাক একটু একটু করে বেড়েছিলো। আগে বছরে একবার,তারপর দুবছর,তিনবছর করে কখনো চারবছরও হয়ে যায়।
          মায়ের গলার স্বরটা কেমন যেন ফোনে ফ‍্যাসফেসে শোনায়,যদিও বলে ভালো আছে।"বুড়ো হচ্ছিনা নাকি? তোরা এবার আয় দাদুকে দেখতে খুব ইচ্ছে করে। কৌটো করে কত বড়ি দিয়ে রেখেছি তুই ভালোবাসিস বলে।"..স্পিকারে ফোনটা দেওয়া মুখ বাঁকায় নন্দা মনে মনে বলে এই হচ্ছে মায়েরা, অতদূর থেকেও ছেলেকে সেন্টিমেন্টাল সুড়সুড়ি দিচ্ছে। সবে একবছর বাচ্চাটার বয়েস,ঐ ধুলো কাদায় ভরা গ্ৰামে গিয়ে যদি শরীর খারাপ হয়!
                 গিয়েছিলো ওরা কিছুদিন বাদে,নন্দা পুরো সময়টা কাটিয়েছিলো বাপের বাড়িতে। মাঝে একদিন গাড়ি করে গিয়ে কোনরকমে একটা রাত থেকেই ফিরে এসেছে। সুব্রতটা সত‍্যি পাল্টালোনা,এই তো ওর বন্ধুরা দিব‍্যি আছে এদেশে। আজ এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর বাড়ি গেলেই ভাইবোনগুলো নিখরচায় বিদেশ ঘোরার ধান্ধায় থাকে। এমনকি ওর শাশুড়িমাও বার বার এক কথা বলে," খুব সুন্দর নারে ঐ দেশটা। তোর বাবা আর আমি আ্যলবাম দেখছিলাম। কত বড় বাড়ি কিনেছিস। আর কত্ত বড় গাড়ি। বৌমা কি সুন্দর গাড়ি চালায় শুনলাম।"
           বিরক্ত লাগে নন্দার যত সব আদেখলাপনা,একবার বললেই এখানে চলে আসে আরকি। ও সাফ বলে দিয়েছে," টাকা পাঠাচ্ছো বাড়িতে ঠিক আছে আর বেশি কিছু করতে যেয়োনা,চিরকাল তোমাকে ব‍্যবহারই করে গেলো এরা।"
                দুই বোনের ভালো বিয়ে হয়ে গেছে ওরা কলকাতায় থাকে। ভাইও চাকরি করছে কলকাতায়। মা আর বাবা এখনও দেশের বাড়িতে। বড় মনে পড়ে সুব্রতর কাজের ফাঁকে গ্ৰামের কথা,লালমাটির কথা। মায়ের রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে ওর জন‍্য অপেক্ষা করার কথা। বেশ অনেকগুলো বছর কেটে গেছে। সুব্রতর আর নন্দার দুই ছেলে। ওরাও বড় হচ্ছে,ওদের পড়াশোনা নিয়ে খুব ব‍্যস্ত ওরা। ছেলেরাও খুব একটা পছন্দ করেনা বাবা মায়ের দেশে যেতে। বড় দূষণ ওখানে আর সারাক্ষণ চিৎকার চ‍্যাঁচামেচি। সবটা নিয়েই বাড়াবাড়ি করে ওদেশের লোক,কখনো গাদা গাদা রঙে ভূত সাজে। কখনো বা ঠাকুর কাঁধে করে নাচে। জোরে মাইক বাজায়,একদম অসহ‍্য।
                যার ফলে একদম যাওয়া কমে গেছে একসময় বাবাও চোখ বুজেছে,কাজে গেছিলো সুব্রত। মাকে বড় অসহায় লেগেছিলো ঐ সময়। ফেরার সময় এক কৌটো নাড়ু,বড়ি আর কিছুটা পাটালি দিয়ে বলেছিলো," এখন আর বেশি কিছু করতে পারিনা বাবা হাত কাঁপে।"..সুব্রত বলতে পারেনি চলোনা মাসছয়েক ঐ দেশে গিয়ে আমার কাছে থাকবে। কোনদিনই তো সেভাবে বলেনি ওদেরকে যাবার কথা। মায়েরা বোধহয় মনের সব কথা বুঝতে পারে, তাই দূর্বল হাতটা মাথায় রেখে বলেছিলো," ভাবিসনা,মিনু আর ছোটখোকা প্রায়ই আসে। পাশে নিধিরা দীনুরা আছে তো।"
        বছর ঘুরলো এভাবেই সুব্রতর তখন প্রাচুর্যে ভরা সংসার। একটা কাপের সেটে এক মাসের বেশি চা খেতে ইচ্ছে করেনা। মাঝে বড় বোন,জামাই ছেলেকে নিয়ে ঘুরে গেছে ওরা তো সবটা দেখে মুগ্ধ। " দাদা তুমি কি করেছো!সত‍্যি এতো স্বর্গ। এই স্বর্গ ছেড়ে কেউ ওদেশে যায়!"
                         আচমকা সম্বিত ফেরে সুব্রতর,কখন যে অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। প‍্যাসেঞ্জাররা সবাই লাইন দিয়েছে সময় প্রায় হয়ে এলো। এর মাঝে উনিও হ‍্যান্ডব‍্যাগটা নিয়ে এসে দাঁড়ালেন এবং এরপর একদম নিজের জায়গায়। এবার অনেকটা সময়। মনে পড়ে গেলো নন্দা আর ছেলেদের নিয়ে দেশে আসার কথা। নন্দা বাপের বাড়ির টানে আসতে চাইলেও ছেলেরা আর বড় হওয়ার পর তেমন আসতে চাইতোনা। তখন ঐদেশেই ওদের সবটুকু হয়ত সেটাই স্বাভাবিক। ভারতের আর আত্মীয়স্বজনের ওপর কোন টানই ওদের ছিলোনা। আসলে তেমন আত্মিক যোগাযোগ গড়ে ওঠার সুযোগই হয়নি কখনও।
              মায়ের টানে সুব্রতর মন ছুটে যেত মাঝেমাঝেই। মায়ের একাকীত্ব আর জীর্ণশীর্ণ চেহারা মাঝে মাঝেই উঁকি দিতো অনেক ব‍্যস্ততার মাঝেও। হঠাৎই একদিন ঘুমটা ভেঙে যায় রাতে মনে হচ্ছে মা যেন বলছে কতদিন দেখিনি তোকে বাবা কবে আসবি?নন্দাকে বলতে নন্দা বিরক্ত হয়ে ওঠে,"এই তো দুদিন আগেই ফোনে কথা বলেছো। হ‍্যাঁ দিভাই বলছিলো মায়ের শরীরটা খারাপ হয়েছিলো। এখন তো ঠিকই আছে। ছেলেদের সামনেই পরীক্ষা এখন এতো সেন্টিমেন্টাল হলে হবে?"
               ছেলেদের জন‍্য সত‍্যিই সেন্টিমেন্ট আর আবেগকে শক্ত আগল দিতে হয়েছিলো সুব্রতকে। সত‍্যিই তো আগে সন্তানদের ভবিষ‍্যত। তাই ছোটভাইয়ের কাছে মায়ের মৃত‍্যুসংবাদ পেয়ে কাঁদতে পারেননি ফোনে শুধু বলেছিলেন," আমার যাওয়া বুঝিস তো বললেই তো হয়না। খুবই খারাপ লাগছে কিন্তু কি করবো।"..ওদিক থেকে ভেসে আসে,"শ্রাদ্ধে এসো দাদা,মা তোমাকে সবার উপরে রাখতো। আমরা ছোটবেলায় রাগ করলে বলতো আগে আমার গণেশ,তারপর লাইন দিয়ে আমার দুগ্গামায়ের মত লক্ষ্মী,সরস্বতী আর কার্তিক। ছিঃ দাদাকে হিংসে করতে নেই।"..বলেই কেঁদে ফেলে ভাই। মনে পড়ে গেলো ওর নাদুস নুদুস চেহারার জন‍্য মা আদর করে গণেশ বলত।
                 অনেক চেষ্টা করে কাজের সময় একা যেতে পেরেছিলেন একটু দাম্পত‍্য অশান্তিও হয়েছিলো এই নিয়ে। মায়ের ফাঁকা খাটটায় বসে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করেছিলেন কতটা কর্তব‍্য করলেন মা বাবার জন‍্য?কতটা সময় দিলেন ওদের? ওরা তো পুরো যৌবন থেকে বার্ধক‍্যই দিয়েছিলেন ওদের। না কি নিজের জীবনের স্বপ্নগুলোকে নিখুঁত তুলির টানে সাজাতেই এতগুলো বছর কেটে গেলো? সত‍্যি কি সন্তানের কাছ থেকে কোন প্রত‍্যাশা থাকেনা মা বাবার?নাকি সন্তানের কোন দায় থাকেনা মা বাবার প্রতি?শুধুই পনেরো দিনের নয় হয়ত বা অনেকদিনের জমানো কান্নাটা বাধ ভাঙলো আজ। মনে পড়ে গেলো অনেক পুরোনো কথা।
                             মাঝে কেটে গেছে অনেকগুলো বছর, ছেলেরা চাকরি পেয়েছে। অনেকদিনই ওরা আর থাকেনা ওদের কাছে। মানে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরের থেকেই। এর মাঝে নন্দাও মা বাবাকে হারিয়েছে। আজকাল নন্দার কেন যেন সংসারে আর মন নেই। কখনও ভালো করে রান্নাও করেনা,খায়না ভালো করে। বেশিরভাগই শুয়ে থাকে। উইকএন্ডে কোথাও যেতে বললেও যায়না। এর মাঝেই ওদের কাছাকাছি দুএকজন বন্ধুবান্ধব ওল্ডএজ হোমে চলে গেছে। নন্দা রাজি হয়নি। ছেলেরা খুব ব‍্যস্ত,দুজনেই ওদেশের মেয়েই বিয়ে করেছে। ওদের সংসারে দুএকবার গেছেন ওরা। তবে কখনও পাননি প্রাণের ছোঁয়া। সত‍্যি সবটাই যেন কেমন বদলে গেলো।আজকাল প্রায়ই মনে হয় সুব্রতর সংসার কি সত‍্যিই অসার নাকি আমাদের কর্মফলের প্রতিচ্ছবিই একসময় ভবিষ‍্যতের আয়নায় প্রতিফলিত হয়।
                      মানে ইংরেজীতে বলতে গেলে বলতে হয় ওরা আর belong করেননা ছেলেদের জীবনে। সাদা বাংলায় এই যে নিজেরা ভালো থাকতে আর ছেলেদের সুশিক্ষায় উচ্চশিক্ষিত করার জন‍্য তারা একসময় দেশের মাটি আর মা বাবাকে ছেড়ে চলে এসেছিলেন স্বপ্নের সিঁড়িতে পা রেখে।আজকাল বুঝতে পারেন তাদের সন্তানদের জীবনেও আর বাবা মায়ের কোন ভূমিকা নেই। নন্দার শরীরটা বেশি খারাপ হওয়ার জন‍্য ওকে ডাক্তার দেখিয়েছিলেন। নন্দাকে আ্যসাইলামে দেওয়ার কথা ডাক্তার বলেছে,নন্দার এই অসুখটা নাকি বংশগত,ওর বাবাও অবসাদে ভুগতেন। ছেলেদেরও তাই মত মায়ের চিকিৎসা হওয়া দরকার,দরকার আ্যসাইলামে দেওয়ার।
নন্দা ছাড়া বাড়িটা বড় ফাঁকা হয়ে গিয়েছিলো,দেখা করতে গেলে ভালো করে কথাও বলতনা নন্দা। অদ্ভুত চুপচাপ হয়ে দূরের গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতো। অথচ একটা সময় ছেলেদের সাথে যত ছোটাছুটি ওই করত। সুব্রতও কোনদিন বলেননি নিজেকে সময় দাও নন্দা। সত‍্যি তো সংসারের চাপে নিজে ভালো করে সাজতোও না। অথচ বিয়ের আগে খুব স্টাইলিশ ছিলো ও। একা হাতে সব সামলাতে জেরবার হলেও মুখে থাকতো জয়ের আর আত্মতৃপ্তির হাসি। আজ কতদিন মানে কতমাস নন্দা হাসেনা।
                আ্যসাইলাম থেকে আর নন্দা ফেরেনি মানে ফেরাতে পারেননি সুব্রত। চলে গিয়েছিলো নন্দা,কি ছিলো ওর মনে তাও বলেনি কোনদিন। তাহলে কি শূন‍্যতা নাকি একটা সময় নিজের কাছেই নিজে অপ্রয়োজনীয় হয়ে গিয়েছিলো নন্দা। নিজের বড় একা মনে হত সুব্রতর,নাম খ‍্যাতি যশ সবই বোধহয় একসময় তুচ্ছ হয়ে যায়। হয়ত তুচ্ছ হয় প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তির হিসেবও। জীবন খাতায় লেখা সব হিসেবনিকেশই তখন বড় এলোমেলো লাগে। মাঝে ছেলেদের কাছে গিয়েছিলেন দুজনে থাকে দুইপ্রান্তে। তারা বড় ব‍্যস্ত,বাবার মনের খোঁজ যে তারা রাখতেই শেখেনি। ওরা বড় বেশি স্বাবলম্বী,ওদের বানিয়ে রাখা খাবারগুলো বড় বিস্বাদ লাগে সুব্রতর।কখনো নিজেকেই খাওয়ার বানিয়ে নিতে হয় এই করে অনেকদিনই খাওয়া হয়না ভালো করে। একেকদিন নাকে ভেসে আসে মায়ের হাতে বানানো ডাঁটা পটল দিয়ে পাতলা মাছের ঝোলের গন্ধ,উঃ কি যে স্বর্গীয় তার স্বাদ!
               কিছুদিন থেকে আবার ফেরা নিজের বাড়িতে। আজকাল এত কাজ করতে পারেননা হাফ ধরে যায় বড্ড। অনেকদিন ধরে মনের মধ‍্যে একটা ইচ্ছে ভিড় করে...ঐ মহাসিন্ধুর ওপার থেকে যেন কে ডাকে। আচ্ছা এ কি মৃত‍্যুর ডাক?নাকি অন‍্য কিছু?
           ছোট ভাইয়ের থেকেও দুই বোনের সাথে কথা বলতে বেশি ভালো লাগে সুব্রতর। বড় বোনের সাথে কথা বলে যেন মায়ের ছোঁয়া পান। ওদেরও ছেলে মেয়েরা বড় হয়েছে বিয়েও হয়েছে তবে কাছাকাছিই থাকে। এক ভাগ্নে থাকে দিল্লিতে,মাঝে মাঝে বিদেশেও যায়। আজকাল ওদের হাসি স্নিগ্ধতা দেখে মনে হয় ওরাই হয়ত অনেকটা বেশি ভালো আছে সবাইকে কাছে নিয়ে আর দেশের মাটির গন্ধ মেখে। একসময় মনে হত কি আছে ঐ দেশে ধুসস্ কোন ভবিষ‍্যত নেই। কেন যেন জীবনের সায়াহ্নে বড় ডাকে দেশের মাটি। কিন্তু কে আছে সেখানে মা বাবা কেউই তো নেই। যারা একসময় উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠত ছেলের আসার খবরে চোখ মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠত আনন্দে। আবার বিদায় বেলায় টলটল করত চোখের কোলে জল।
                              দেখতে দেখতে সফর প্রায় শেষ। আর আধঘন্টা বাদে বিমান ছুঁয়ে যাবে দেশের মাটি। কয়েক মাস আগে একদিন বড় বোনকে বলে ফেলেছিলেন তার মনের কষ্ট,আর একাকীত্বের কথা। সব অহংকার ধুলোয় মিশিয়ে বলেছিলেন," আচ্ছা বুয়া আমি যদি আবার ফিরে আসি। আমায় থাকতে দিবি তো?"..স্পীকারটা অন করা ছিলো। ঠাকুরকে ফুল দিচ্ছিলেন বুলা,দাদা আদর করে ডাকতো বুয়া। মনটা অদ্ভুত একটা আনন্দ আর বিষাদে ভরে ওঠে। কি হলো দাদার এমন করে কথা বলছে।"কেন থাকতে দেবোনা দাদা,আমি আর টুয়া তো কাছাকাছিই থাকি। দুজনেই এখন একদম ফাঁকা,ছেলেমেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। তুমি সত‍্যিই আসবে দাদা?"....ওপারে সুব্রত কিছুক্ষণ চুপ করে বলেন," ভাবছি।".." খুব ভালো হবে আমরা আবার সেই ছোটবেলার মত ভাইবোনেরা মিলে.." কথা বলতে বলতে একটু চুপ করে যান বুলাও সত‍্যিই কি ছোটবেলার দিন ফিরে আসে? না কি যা যায় তা শুধুই চলে যায় আর ফেরেনা কোনদিনও।
                    কলকাতা বিমানবন্দরে পা রাখেন সুব্রত। আজ আর ঘুরতে আসেননি,ফিরে এলেন দীর্ঘ ছত্রিশবছর পর। এয়ারপোর্টের বাইরে অপেক্ষা করছে অনেকগুলো হাসিমুখ। কবিগুরুর গানের একটা লাইন মনে পড়ে গেলো..'দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে যাবেনা ফিরে এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।'
                    এয়ারপোর্ট থেকে সোজা আগে গ্ৰামের বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিলো। লালমাটির ধুলো ওড়ানো পথে সবুজ মাঠের স্নিগ্ধতা ছুঁয়ে গেলো মনটা। মা মারা যাবার পর তো আসাই হয়নি আর। রাস্তায় এসে হাসিমুখ নিয়ে অপেক্ষা হয়ত আর কেউ করবেনা। বাটি ভরে ক্ষীর আম দুধ দেওয়ার মানুষটা আর নেই। তবুও এই মাটি,পথ ঘাট,গাছপালা সবই যে তার খুব চেনা। বুয়া আর টুলু হৈ হৈ করে ওঠে.." ঐ তো ভাই দাঁড়িয়ে আছে বাইরে। কত কি পাল্টে গেছে দেখেছো দাদা। চল ভেতরে গিয়ে এবার বিশ্রাম নেবে,অনেক ধকল গেলো তোমার।"
                  মা বাবার ছবিতে টাটকা ফুলের মালা জড়ানো। হাতজোড় করে প্রণাম করেন সুব্রত। কে যেন কানে কানে বলে যায়..'আজ কি আনন্দ,গণেশ লক্ষ্মী কার্তিক সরস্বতী সবাই এসেছে আবার মাটির টানে। ভালো থাক বাছারা।'
    মা যে সবসময় বলতেন," আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে।"
সমাপ্ত:-
                 

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...