#পর_পুরুষ#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
তুঁতে শাড়িতে সোনালী পাড় ,গলায় সোনার ছোট্ট গণেশের লকেট আর মাথায় বেলফুলের মালা জড়িয়ে যখন রাই ঘরে এলো তখন ধীমানের মনে হলো রমা বাড়িতে যতই চোটপাট করুক না কেন ছেলের বৌ হিসেবে রায়ানের পাশে ভালোই মানাবে মেয়েটাকে।
ছোট থেকেই মুম্বাইয়ে বড় হয়েছে রাই। রায়ানের সাথে আলাপ চাকরির জায়গাতেই। ফেসবুকে ছবি দেখে ঠোঁট উল্টেছিলো রমা," সারাক্ষণই তো প্যান্ট শার্ট,স্কার্ট পরে ঘুরছে। এই মেয়ে কি বাঙালী ঘরের বৌ হবার মত?"
দুজনেই মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন নাহ্ বেশ ভালো লাগছে মেয়েটাকে আজকের অন্যরকম সাজে। কিন্তু মেয়ের মা কোথায়? মাসিই তো সরবত দিয়ে কথা বলছে।
" কিছু মনে করবেননা আমার একটু দেরি হয়ে গেলো,আসলে ওর বাবার জন্য একটু বেরোতে হয়েছিলো। আপনারা তো সবই জানেন।"
রাইয়ের বাবার শরীর ভালোনা ক্যান্সারের পেশেন্ট। মাকেই সবটা সামলাতে হয়। রায়ান তো পঞ্চমুখ ওনার প্রশংসায়। ছেলের কথা শুনে বুঝেছে শাশুড়িমাকে দেখেই নাকি রাইকে ওর পছন্দ হয়ে গিয়েছিলো। একজন মহিলা যে সংসারে কতটা দিতে পারে তা হয়ত ওনাকে দেখেই বোঝা যায়। রাগ হয়ে গিয়েছিলো রমার শুনে,নিজে দিনরাত সংসারে খাটছেন অথচ সে বেলায় ছেলের চোখে পড়েনা।
ইরা রাইয়ের মা,ভালো নাম ইরাণী ওর বাবার রাখা। হয়ত একসময় সুন্দর টানা চোখ আর নাক আর তেমনি ফর্সা রঙের জন্যই বাবা ভালোবেসে রেখেছিলেন। এখনও বয়েস হলেও সুন্দর লম্বা চেহারা,মাথায় লম্বা চুল আর টিকোলো নাক। চোখে রিমলেস চশমা।
"ছেলেমেয়ে তো নিজেরাই নিজেদের পছন্দ করে নিয়েছে। তাই আমরা শুধু নিজেরা গল্প করবো এবার। আর রাইকে যদি কিছু জিজ্ঞেস করতে চান তাহলে করতে পারেন।"
ওদের টুকটাক কথার মধ্যেই ধীমানের চোখে পড়লো বইয়ের আলমারির দিকে। প্রচুর বই সুন্দর করে সাজানো,দেওয়ালে রবীন্দ্রনাথ,বিবেকানন্দ আর বিদ্যাসাগরের ছবি।
" বইগুলো কি পড়া হয়? না শুধু সাজানোর জন্য?"..ধীমানের কথা শেষ না হতেই রাই বলে ওঠে," মা তো বইয়ের পোকা,মা ইন্টারনেটে থাকেনা খুব একটা। মায়ের একদিকে সংসার আরেক দিকে বই। হাতে ভালো বই পেলে ভাত তরকারি সব পুড়ে যায়।"
মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসে ইরা,"তাই নাকি রে ?রোজ অফিসে যাওয়ার সময় এখনও খাইয়ে দিই। সব গুছিয়ে দিই এমন কি ড্রেসটাও। থাক আর বলবোনা। দিদি ভাববেন এই মেয়ে তো একদম আলসে।"
" আমার ছেলেকেও তো সব গুছিয়ে দিতে হয় হাতে হাতে। চাপ পড়লে সবই করবে তখন। এখনি তো করছে এখানে।"
ইরা সবটাই জানে,ওদের ফ্ল্যাটের কয়েকটা বাড়ি পরেই তো রায়ান থাকে। রাইয়ের সাথে ভাব হওয়ার পর ইরা তো কখনও একা রাইয়ের খাবার পাঠায়না। এছাড়া তো আজ এটা কাল সেটা আছেই। ছেলেটাও বড় মন কেড়ে নিয়েছে,প্রথম দিন থেকেই মামণি বলে ডাকে। রাই হিংসে করলে বলে এখন থেকে ষাট ভাগ আদর আমার আর চল্লিশ ভাগ তোমার।
"আমার চল্লিশ কেন শুনি? আমার আশি তোমার কুড়ি।"ওদের ঝগড়ার মাঝেই ইরা বলতো আচ্ছা বাবা আধা আধা।"
মেয়ের কথার মাঝে ওর বাবাও বলে ওঠে," আসলে একটা সময় আমিও হিংসে করেছি ওর বই পড়াকে। অফিস থেকে এসে ওকে বই নিয়ে থাকতে দেখলেই রাগ হত। অনেক কিছুই ছেড়েছে আমাদের জন্য,এখন ভাবলে খারাপ লাগে।"
ইরাই কথাটা ঘুরিয়ে দেয় খাবার নিয়ে আসে এর মধ্যেই। রমা একটু বিব্রত হয় এত রকম খাবার দেখে।" এসবের আবার কি দরকার। আমাদের দুজনেরই.."
"আমি জানি দিদি,রায়ানের কাছে শুনেছি। ও তো সবসময় আপনাদের গল্প করে। সত্যি এত ভালো ছেলে দেখা যায়না আজকাল।"
খাবার খেয়ে উচ্ছ্বসিত হয় ধীমান,রমা মন খুলে প্রশংসা করতে পারেনা। তবে বোঝে পুরুষের মন জেতার সব কিছুই বোধহয় এই মহিলার আছে। তাই ছেলে বাড়িতে গিয়ে ওনার গল্পই বেশি করে। মাঝে মাঝে সত্যিই আদিখ্যেতা মনে হয়,দুঃখও হয় যাকে এতদিন মানুষ করলেন সে কি না চট করে অন্য একজনকে আপন করে নিলো। ধীমান ঠিকই করে গিয়েছিলেন রাইয়ের গান শুনবেন,ছেলের কাছে শুনেছেন রবীন্দ্রসঙ্গীত জানে তবে গিটার বাজিয়ে গায়।
রাই আপত্তি করেনি,তবে আধুনিক ঢঙে গাওয়া গান। " মা তুমিও করোনা,এটা তো তোমার কাছেই শেখা।" একটু অপ্রস্তুত হয়ে স্বামীর দিকে তাকায় ইরা,ঘাড় নাড়েন উনি।
"আসলে বহু বছর অভ্যেস নেই,মাঝে মাঝে মেয়েকে তুলে দিতে হয় দু একটা। আচ্ছা দেখছি।"
ইরার অনভ্যাসের রবীন্দ্রসঙ্গীত শুধুই মুগ্ধতা রেখে গেলো সবার মাঝে।
" অনেক কিছুই তো কথা হলো,তত্ত্বটা কি করবেন বলুন? আর যদি কিছু বলার থাকে।"না বলে পারেনা রমা। এদের শুধু অন্য আলোচনা,আর তেমনি মেয়ের মা। মেয়ে বললো আর উনি গান গাইতে শুরু করলেন!
" আমার তো ঐ একটাই মেয়ে,সব গুছিয়ে দেবো,যা যা নিয়ম বলবেন।ওর বাবার শরীরটা ভালো না থাকলে কি হবে আমি তো আছি।"
সত্যি তাই নিজে আর ছোটবোন মিলে সব গুছিয়ে সাজিয়ে সুন্দর করে মেয়ের বিয়ে দিলো ইরা। তত্ত্ব দেখে ছেলের বাড়িরও সবাই খুশি। রমার শুধু মনে হলো নিজেকে একটু বেশিই জাহির করতে চায় ওর বেয়ান,মানে নাম কিনতে চায়। শুধু মেয়ে বিদায়ের সময় আর ধরে রাখতে পারলোনা নিজেকে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললো। " ও তো আমার সব কিছু ছিলো,বড় একলা হয়ে গেলাম আমি।"
রায়ানের মনটাও বড় খারাপ হলো,সত্যি এই অনুভূতির হয়ত কোন ভাগ হয়না।
" মামণি,তুমি আমাকে বেটা বলোনা,তাহলে এত কাঁদছো কেন দুজনে। আর আমরা তো এখানেই থাকবো তোমার কাছেই।"
রাইকে দেখে সবারই পছন্দ,প্রবাসী বাঙালী কিন্তু খুব মিশুকে আর সরল। শুধু নিয়ম কানুন পালন করতে একেবারে নাটাঝামটা খেলো বেচারা। মাকে ফোন করে বললো," ম্যারেজের রুলস্ রেগুলেশন মানতে মানতে আমি বোর হয়ে যাচ্ছি। ওহ্ আগে জানলে.."
ওপাশ থেকে ইরা বলে," আগে জানলে কি হত বিয়ে করতিসনা বুঝি?"
ছেলের বাড়ির অনেকেই ইরাকে দেখেনি। বৌভাতের দিন দেখলো। অনেকেই রমাকে বলে ফেললো," তোমার বেয়ানকে তো বৌমার থেকেও বেশি সুন্দরী। ও মনে হয় ওর বাবার মত তাইনা?"
সবার কান বাঁচিয়ে রমাও বললেন," এ কি ভাই আমাদের মত সংসার অন্ত প্রাণ! গাড়ি নিয়ে বেরোচ্ছে,পার্লারে যাচ্ছে। আরও কত কি করে কে জানে! যাক্ ছাড়ো আমাদের বৌমা ভালো হলেই হলো।"
বিয়ের দিন পনেরো বাদেই রাই আর রায়ান ফিরে এসেছে মুম্বাইয়ে। ধীমান রমার মনটা খারাপ,এই কয়েকটা দিন বেশ বাড়িটা ভরা ছিলো। বেয়ানের ভাগ্য ভালো এ যেন উল্টোটা মেয়ের মা মেয়ে জামাই সবাইকে পেলো একসাথে। ছেলের মায়ের ঘর শূন্য হলো।
মাঝে কেটে গেছে দুই বছর,রাই মা হতে চলেছে। এই সময়টা বেশিরভাগ মায়ের ফ্ল্যাটেই থাকে। একদিকে অসুস্থ স্বামী আরেকদিকে মেয়ে দুজনকে সামলাতে হচ্ছে ইরাকে। তবে রায়ান একদম ছেলের মত,জোর করে ইরার অনেক বাইরের কাজ করে দেয়। এর মাঝে রমা আর ধীমানও বৌমাকে দেখতে এসেছিলো।
"দেখেছো,আমার ছেলেটাকে কেমন হাতের মুঠোয় রেখেছে। অফিস থেকে ফেরার সময় গাদা গাদা বাজার করে আনছে শ্বশুরবাড়িতে।
" কি করবে বলো,আমরা এসেছি ওরা আছে এইটুকু না করে দিলে বেয়ান পারবে কি করে?"
কয়েকমাস বাদে বাড়িতে এলো নতুন অতিথি,রাইয়ের ছেলে কিন্তু তখনও ইরার মন শান্ত হলোনা। রাইয়ের বাবা খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। চারদিকের চাপ ছুটোছুটিতে এক একটা সময় কেমন যেন বুকের মধ্যে চাপা কষ্ট হত ইরার। নিজের সময় বলতে যেন আর কিছু নেই। বই ছিলো ইরার নির্ভরতার পরম আশ্রয়। কতদিন ছুঁয়ে দেখতে পারেনি ওর বন্ধুদের। যমে মানুষে টানাটানি হলেও মুছে গেলো ইরার জীবনের সব রঙ। রমা বললেন,"তবুও বেয়াইয়ের ভাগ্য ভালো নাতিকে দেখে গেছেন, ওকে নিয়েই আপনাকে ভালো থাকতে হবে। আমি তো নাতিকে কাছেই পেলামনা।"
চুপ করে শুনলো ইরা,কি করে বোঝাবে যা যায় তা শুধুই যায়। এটা সেটা নিয়ে আমরা ভুলি কিন্তু সত্যি কি ভোলা যায়?
এই সব কারণে নাতির মুখেভাতও হলোনা। ঐ ঠাকুরের কাছের প্রসাদ এনে ঠেকালো রমা। ছেলে বৌমা কারও মত নেই অনুষ্ঠানে। তাই ঠিক হলো আরও ছয়মাস বাদে একেবারে জন্মদিন হবে।
ইরার হাতে এখন অঢেল সময়। এখন বই নিয়ে বসলে কেউ বলবেনা কিছু,গান গাইলেও বিরক্ত হবার কেউ নেই। অথচ একটা সময় সুন্দরী বৌকে নজরে রাখতো সবসময় মানুষটা। যাতে বেশি বাইরে মন উড়তে না পারে। একএক সময় ইরা বলে ফেলত," তুমি এত আগলাও কেন আমাকে? সারাদিন এত সংসার আমার ভালো লাগেনা। করছি তো তবুও আমার সবটা দিয়ে, আর কত খাঁচায় পুরতে চাও?"
আজ খাঁচার দরজা খোলা,ইরা এখন বিধবা। কতদিন আলমারী খোলা হয়না। থরে থরে সাজানো কত শাড়ি। গাঢ় রঙ খুব পছন্দ ছিলো। আজকাল সত্যি নাতিকে নিয়েই কাটে ওরা অফিস যাওয়ার সময় রেখে দিয়ে যায় যদিও আয়া আছে। নাহলে কাটে শুয়ে,আসলে ডানাগুলোই অসাঢ় তাই আর ঝাপটানোর ইচ্ছেও নেই। রাইও কাঁদে রায়ানের কাছে মায়ের জন্য। ওরাও চায় মা আবার আগের মত হাসিখুশি থাক,বই পড়ুক,গান শুনুক।
নাতির জন্মদিন ওরা সবাই কলকাতায়। বেশ কয়েকদিনের ছুটি এবার কাটবে কলকাতায়। ইরা কিছুতেই আসতে চায়নি,কিন্তু রায়ানের জেদের কাছে হার মেনেছে। মামণি না গেলে জন্মদিনই হবেনা। এই অবস্থায় মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে, কে জানে কি বলবে আত্মীয়স্বজন। মেয়েই আলমারি খুলে গুছিয়েছে শাড়ি ব্লাউজ,কিছু কিনেছেও পছন্দ করে। মেয়েকে বকেছে ইরা," আমার ভালো লাগেনা আর কিছু রে। কত শাড়িই তো আছে,আবার কেন?"
অনুষ্ঠান বাড়িতে একটু আড়ালে আড়ালেই কাটালো ইরা। রমাও একটু অবাক হলো ইরাকে দেখে সত্যি এই কয়েকটা মাসের মধ্যে অদ্ভুত একটা ভাঙন এসে গেছে মানুষটার মধ্যে। তবুও রায়ান জোর করে এনেছে সবার সামনে,মেয়ে সাজিয়েছে ওর মনের মত করে।
অনুষ্ঠান শেষ ওদেরও ফেরার সময় হয়ে আসছে প্রায়। রায়ান সেদিন সকালে হঠাৎই বায়না ধরলো," মামণি,আজ তোমায় নিয়ে একটু বেরোবো। আমার কয়েকটা জিনিস কেনার আছে। আর এখানে এসে তো শুধুই ঘরে বসে থাকলে,কোথাও তো গেলেনা।"
ইরা যতই বোঝান রাইকে নিয়ে যেতে। কিছুতেই রাই রাজি হলোনা ছেলের জন্য যেতে।সত্যি কি অবস্থা! অগত্যা রমাকেও বললেন,কিন্তু সবার নাকি অনেক কাজ,কারো বা পায়ে ব্যাথা।
বাড়ির গাড়িটা নিয়ে বেড়িয়েছে রায়ান পেছনে বসতে দেয়নি ইরাকে। একদম পাশের সীটে বসিয়ে সিটবেল্ট বেঁধে দিয়েছে। মায়ের অবস্থা দেখে হাসছে রাই। গাড়ি স্টার্ট করে গানটা চালিয়ে দেয় রায়ান..'এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়।'অদ্ভুত এক ভালোলাগায় ভরে ওঠে ইরার মনটা,জানলা দিয়ে চোখটা চলে যায় বাইরে। শীতের কলকাতা শহর,সুন্দর লাগছে প্রকৃতি আর আবহাওয়া দুটোই। অনেকদিন বাদে খোলামেলা প্রকৃতির শীতল স্পর্শ।
"এসো মামণি প্রথমে এখানে ঘুরে তারপর কেনাকাটা আর যা কাজ আছে করবো।কলেজে পড়ার সময় আসতামই এখানে নিয়ম করে। এবার যখন সুযোগ পেয়েছি তাই আর মিস্ করলাম না।"...ইরার স্বপ্নের রাজ্য বইমেলা,একসময় বাবার সাথে তারপর বন্ধুদের সাথেও এসেছে কত। বিয়ের পর একবার এসেছিলো,আর হয়নি আসা।
বই দেখতে দেখতে সব ভুলে গিয়ে কেমন যেন সেই মেয়েবেলায় ফিরে গিয়েছে। উচ্ছ্বল হয়ে রায়ানকে বলে," ইশ্ একটা সময় পাগল ছিলাম এই বইগুলো পড়ার জন্য।"
"নাও মামণি যদি কিছু কিনতে ইচ্ছে করে কেনো।"মেলায় ঘুরতে ঘুরতে মনটা হারিয়ে গিয়েছিলো ওদের দুজনেরই। ইরার মন খারাপগুলো বইয়ের পাতায় ভ্যানিশ হয়ে ফিরিয়ে দিয়েছে কত রঙিন ছবি। রায়ান ফোনে কথা বলছে মনে হয় রাই ফোন করেছে।
" ইরাণী না? যদি খুব ভুল না করে থাকি?"
বইয়ের পাতা থেকে মুখ তোলে ইরাণী অনেকদিন আগের একটা খুব চেনা মুখ। মাথায় কাঁচাপাকা চুল চোখে কালোফ্রেমের চশমা পরনে পাঞ্জাবী।
" আরে আমি.."
"বুলবুল..তাইতো?"
এর মাঝেই আসে রায়ান,ইরাণীই আলাপ করিয়ে দেয়,"আমার বেটা। আর ইনি আমার ভবঘুরে পাগল ক্ষ্যাপাটে বন্ধু বুলবুল। একসময় দেখলেই খাওয়াতে বলতো। পকেট সবসময় গড়ের মাঠ থাকতো।"
ওদের কথার মাঝেই কথা বলেন বুলবুল," আজ আর গরীব নই রে। এই যে পকেট ভারী। আজ আমি খাওয়াবো।"
অনেকদিন বাদে মামণির চোখমুখের উচ্ছ্বলতা দেখছিলো রায়ান। এর নামই বোধহয় বন্ধুত্ব,বন্ধুকে পেলে বয়েসটা বোধহয় এক ধাক্কায় ছুট্টে কমে যায়।
কাছেই একটা রেস্তোরাঁয় বসে আড্ডা দিতে দিতে ইরাণীর মনে পড়ে যায় ক্লাশ ইলেভেনের দিনগুলোর কথা। ক্রাশ খাওয়া টাওয়া তখন জানা ছিলোনা। শুধু ভালো লাগা ছিলো। তবুও কোনদিন বাবাকে বলতে পারেনি,ঐ চালচুলোহীন ছবিওয়ালা ছেলেটার ওকে ভালো লাগত,কোন এক বর্ষার বিকেলে ওর বইয়ের পাশে রেখেছিলো এক মুঠো বকুল ফুল। বরং একটা সময় এড়িয়ে গেছে আর সম্পর্ক রাখেনি। তারপর আর যোগাযোগ ছিলোনা। ফেরার সময় রায়ান বার বারই বলে দিলো ওনাকে ওদের বাড়ি আসতে।
ইরাণীরা মুম্বাই চলে যাওয়ার আগের দিন বুলবুল এলেন ওদের বাড়িতে। কিছুক্ষণ বসে সবার সাথে আলাপ করেই বেরোলেন প্রায় জোর করেই ইরাকে সঙ্গে নিয়ে রায়ান আর রাইকে জিজ্ঞেস করেই। ওনার আ্যকাডেমিতে ছবির প্রদর্শনী হচ্ছে সেখানে। ওরা চলে যেতেই ধীমানকে বললেন রমা," কিছু বলতে পারিনা,তোমার ছেলে ফোঁস করে উঠবে। বিধবা মানুষ বলা নেই কওয়া নেই পরপুরুষের সঙ্গে চললেন।"
"আস্তে বলো বৌমা শুনতে পাবে। ওরা ছোটবেলার বন্ধু,এর মধ্যে খারাপ কি আছে শুনি?আর বেয়ানের যথেষ্ট বয়েস হয়েছে,দিদিমা হয়ে গেছেন।"
মুখ ব্যাকায় রমা," এখনও পরপুরুষের মাথা ঘোরাবার ক্ষমতা রাখে। আমি হলে পারতে যেতে দিতে?"
" আমি তো তোমায় কোনদিনই আটকাই নি,তুমি ভালোবেসেছিলে সংসার বেরোতে চাওনি বাইরে। একসময় ওটাই তোমার জগত হয়ে গিয়েছিলো। উনি হয়ত অতটা সংসারী নন মনের দিক দিয়ে। যদিও কোন কাজে ত্রুটি রাখেননি।"
একটু রাতের দিকে ইরাণীকে নামিয়ে দিয়ে গেলেন বুলবুল বলে গেলেন আবার দেখা হবে বন্ধু হঠাৎই কোনদিন। রায়ান রাইকে বললো," এখনও কি সুন্দর মনটা ওনার,লাল পাঞ্জাবীতে দারুণ লাগছিলো আসলে শিল্পী মানুষ তো। এতো পজেটিভ যে ভালো লাগে।"
শাশুড়িমায়ের দুএকটা কথা রাইয়ের কানে এসেছে। ওর মা ফিরে আসার পর সবার বাঁকা চাউনি, মায়ের চকচকে খুশি মাখা মুখটা সব কিছু দেখে ওর কেমন যেন মনটা খারাপ হয়ে গেলো।
মনে হলো কি দরকার নতুন করে বন্ধুবান্ধব করার,বাবা তো এগুলো পছন্দ করতনা।
মাঝে অনেকগুলো মাস কেটে গেছে,ইরাণীও এখন অনেকটা সামলে উঠেছে। নাতির সাথে ছোটাছুটি করে অনেকটা সময় কেটে যায়। রাতে বই পড়া,টুকটাক ভালোমন্দ রান্না করা। রায়ানের জুলুমে ওদের সাথে একটু বেড়াতে যাওয়ি এই সব নিয়ে চলে যাচ্ছে দিন। আজকাল হোয়াটস আ্যপও করতে হয়,বুলবুলের জন্যই খুঁজে পেয়েছে বেশ কিছু পুরোনো বন্ধু।
বিকেলে টেবিলের মাঝে পেতলের রেকাবিতে আবার সাজায় ফুল,কখনও নাড়াচাড়া করে হারমোনিয়াম।
সেদিন রাই আর রায়ান অফিস থেকে ফেরার পর ইরাণী রাইকে বলে," আসছে রবিবার বুলবুল মুম্বইয়ে আসছে ওর একটা প্রদর্শনী আছে। হোটেলেই উঠবে বলেছে,তোদের সবাইকে নিয়ে যেতে বলেছে। যাবি তো? আর আমাকে একটা শাড়ি পছন্দ করে দিয়ে যাস কি পরলে ভালো লাগবে।"
মায়ের এত উচ্ছ্বাস রাইয়ের যেন ভালো লাগেনা অথচ বলতেও পারেনা কিছু। " আমার সময় হবেনা এখন। পরে দেখে দেবো সময় হলে।"
ফ্ল্যাটে ফিরে অদ্ভুত একটা রাগ হয় মায়ের ওপর,রায়ানকে বলে," সবটাই তোমার জন্য। কি দরকার ছিলো ওনাকে আমাদের বাড়িতে আনার? শুনেছি তো বিয়েও করেননি। আমার আর এরপর শ্বশুরবাড়িতে মুখ দেখানো যাবেনা।"
চুপ করে রাইয়ের কথাগুলো শোনে রায়ান। খাবার খাওয়ার পর ছেলে ঘুমিয়ে পড়লে রাইকে কাছে টেনে নেয়। " রাই মামণি সংসারটাকে ভালোবেসে করেছে। বাপিকেও ভালোবাসত,আমাদেরও খুব ভালোবাসে। এখনও সবটুকু দেয় আমাদের জন্য। মেয়েদের কাছে সংসারটা প্রথমে ভালোবাসা আর পরে অভ্যাস হয়ে যায়। বন্ধুত্বটা একটা খোলা জানালা,যে জানালা খুলে দিলে হু হু করে ঢোকে দক্ষিণের খোলা হাওয়া যা মনকে ভালো রাখে। ফিরিয়ে দেয় হারানো দিনের সুখস্মৃতি। এতদিন মামণি ঐ জানালাটা বন্ধ রেখেছিলো আমাদের সবার জন্য। আজকে বড় একা হয়ে যাওয়া মানুষটার জীবনে আবার খুলে দাওনা দক্ষিণের জানালাটা।"
আজ রায়ানকে আবার নতুন করে ভালোবাসতে ইচ্ছে করলো রাইয়ের। সত্যি বোধহয় মা ওরই ষাটভাগ আর রাইয়ের চল্লিশ। এতটা বোঝে ও মাকে? রায়ানের বুকে মুখ রেখে বলে," আর আমার খোলা জানালা?"
"আমি তো সেটা প্রথমদিন থেকেই খুলে দিয়েছি রাই। তোমার বন্ধু হয়েছি,অধিকার করতে চাইনি। ভালোবেসেছি তোমায় কিন্তু বাধ্য করিনি ভালোবাসতে। বন্ধুদের সাথে তুমি আড্ডা দিলে ভালো লাগে। স্পেশটা বোধহয় খুব জরুরী।"
সেই রাতে ইরাণীরও ভালো ঘুম হয়না,ভোরের দিকে রবীন্দ্রসঙ্গীত চালিয়ে দেন। দক্ষিণের জানালাটা খুলে বাইরের দিকে তাকিয়ে বসে থাকেন। রাইয়ের মুখটা আর কথাগুলো মনে পড়ে বারবার। বুলবুলকে বলে দিতে হবে বিশেষ কাজের জন্য যাওয়া হবেনা।
রাতে অফিস ফেরত একটু দেরি করেই ঢোকে রাই। আজ শাড়ি পরে ওকে খুব সুন্দর লাগছে,মাথায় সুন্দর ফুলের মালা জড়িয়েছে আজ নাকি পার্টি ছিলো অফিসে।
" মা এদিকে এসো তাড়াতাড়ি, এই ব্যাগে সব গুছোনো আছে। তুমি খুলে একটু দেখো তো। অনেকটা দেরি হয়ে গেছে আমি নামছি,ও নীচে অপেক্ষা করছে।"
মায়ের শুকনো মুখটার দিকে বেশিক্ষণ তাকাতে পারেনা রাই। হাতে ব্যাগটা ধরিয়ে মেয়েটা যে কি বলে চলে গেলো কিছুই বুঝলোনা ইরা।
ও চলে যাবার পর ব্যাগটা খোলে ইরা। সরু সোনালী পাড়ের চন্দন রঙের সাথে রানীর মেলবন্ধনে মাইশোর সিল্কের সাথে টেম্পল জুয়েলারী। সাথে ম্যাচিং পার্স গুজরাটি কাজের।
হঠাৎ করেই ফোনটা বেজে ওঠে..ভেসে ওঠে উচ্ছ্বল একটা গলায় কয়েকটা শব্দ," মা দেখেছো? তোমার পছন্দ তো? আমরা কিন্তু সবাই যাবো সেদিন।"
ঝড়ের গতিতে কথা বলে ফোনটা কেটে দেয় রাই। শাড়িটাতে হাত রাখে ইরাণী মনটা তখনও গানে ডুবে আছে..' তোমার খোলা হাওয়া,লাগিয়ে পালে।'
রাই ছেলেকে নিয়ে আগেই চলে এসেছিলো। অনেকদিন বাদে মাকে সেই আগের মত লাগলো,মায়ের আঁচলটা গুছিয়ে দিয়ে নিজে শাড়িটা পরে ফেলে। " এদিকে আয়তো ঠিক করে দি শাড়িটা। কিচ্ছু শিখলোনা মেয়েটা।"
" তুমি আছো কি করতে শুনি?"
নীচের থেকে রায়ানের গাড়ির হর্ণ শোনা যায়। মাকে নামতে বলে ছেলেকে নিয়ে নামে রাই। " ইশ্ আমি তো চোখ ফেরাতে পারছিনা। এবার তাহলে খুশি তো? মামণিকে আমরা পরপুরুষের কাছে নিয়ে যাচ্ছিনা। মামণির মনের জানালাটা একটু খুলে দিতে যাচ্ছি তাইতো? বন্ধুত্ব মুছে দেয় অনেক মনখারাপ।"
" কার বন্ধুত্বের কথা বলছিস রে তোরা?"
"এই যে মামণি আমাদের মা ছেলের বন্ধুত্ব,এই হিংসুটিটা এর মধ্যেও ঢুকতে চাইছে।"
আজ আর রাগ হলোনা বরং চোখটা একটু রুমাল দিয়ে মুছে নিলো রাই। সত্যিই বোধহয় সবার ওপরে বন্ধুত্ব,আর এখন রায়ানই তো ওর সবচেয়ে ভালো বন্ধু। ভালো থাক মাও হারিয়ে যাওয়া বন্ধুত্বের রঙে নিজের সাদা মনের ক্যানভাসটা একটু রাঙিয়ে।©ইচ্ছেখেয়াল
কলমে-রুমাশ্রী সাহা চৌধুরী
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment