Skip to main content

ভালোবাসায় পরিবার

#ভালোবাসায়_পরিবার#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#

"মা, বাবা কখন আসবে গো?এত রাত হয়ে গেলো।"
      "বাবার ফিরতে রাত্রি হবে। আয় তো তোদের খেতে দিয়ে দিই। খেয়েনে তোরা।"
           টিয়া আর তুতুল বায়না করলে ওদের বুঝিয়ে খেতে বসায় অনু। তারপর ঘুম পাড়াতে নিয়ে যায়,তুতুল তাও বায়না করতে থাকে। ওকে বকুনি দিতে গিয়ে চোখের কোলটা ছলছল করে অনুর সত‍্যি তো কতটুকুই বা বয়েস ওর। ধীমানের ওপর রাগটা ওকে দেখিয়ে কি লাভ?
     টিয়া বড় হয়ত একটু বেশি বোঝদার তাই মায়ের চোখের কোণের জলটা ওর চোখ এড়ায়না। তাড়াতাড়ি করে বলে," বোন আই তো তোকে একটু পিঠে হাত বুলিয়ে দিই দেখবি ঘুম চলে আসবে।"..লাইটটা নিভিয়ে ওদের গায়ে হাত রেখে শুয়ে পড়ে অনু। চোখটাও লেগে এসেছিলো হঠাৎই বেল বাজার আওয়াজে উঠে পড়ে। বাইরে এসে আলোটা জ্বালাতেই বেশ রাত্রি হয়ে গেছে বুঝতে পারে।
        দরজা খুলতেই ঢোকে ধীমান।" কি ব‍্যাপার সব ঘুমোচ্ছো নাকি এত দেরি হলো?"ওর মুখের থেকে একটা গন্ধ পায় অনু। আজকাল মাঝে মাঝেই পায় গন্ধটা একটা উগ্ৰ ঝাঁঝালো গন্ধ। " তুমি আজও..?"
     "শোনো বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই অশান্তি কোরোনা তো। বাইরে যতক্ষণ থাকি সেটাই ভালো।"
          " তুমি তো এমন ছিলেনা ধীমান?কত মিষ্টি সংসার আমাদের। ফুলের মত দুটো মেয়ে,ওদের মুখ চেয়েও কি তোমার একটু ইচ্ছে করেনা!"
           "কি খামতি রেখেছি তোমাদের বলতে পারো? ভালো শাড়ি গয়না,মেয়েদের নামি স্কুলে পড়ানো সব করেছি। চিরকাল কি কষ্টই করে যাবো নাকি?"
            দীর্ঘশ্বাস পড়ে অনুর হয়ত সত‍্যিই ভালো ছিলো ওদের কষ্টের সংসার। হয়ত সেখানে প্রাচুর্য ছিলোনা কিন্তু সুখ ছিলো। অনেকদিনই ওদের শান্তিপুরের বাড়িতে লোডশেডিংয়ে তালপাখার পাখা নাড়তে নাড়তে ধীমানের চওড়া বুকের ওপর কখন যে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ত অনু। সকালে ঘুম ভাঙতো পাখির ডাকে। তাড়াতাড়ি করে উঠে শাশুড়িমায়ের হাতে হাতে কাজ করত। প্রমোশন হলো ধীমানের বদলি হলো কলকাতায়,প্রথমে আসেনি অনু তারপর ফ্ল্যাট কেনার মেয়েদের নিয়ে চলে এলো পড়াশোনার জন‍্য।
                       অর্থ কি মানুষকে সত‍্যিই স্বার্থপর করে দেয়?একসময় যারা ধীমানকে পাত্তা দিতোনা তারা এখন ওর পেছন পেছন ঘোরে নিজেদের বিভিন্ন কাজের জন‍্য। নতুন অফিসে অনেক উপরি রোজগার ধীমানের। আর আজকাল ঐ উপরি টাকায় অনেক উপরে উঠতে চায় ধীমান। আরে জীবন তো একটাই সুতরাং উপভোগ করো।
          সকালে অনেকটা শান্ত লাগে ধীমানকে মেয়েরা বাবার কোল ঘেষে বসে দেখে ভালো লাগে অনুর। রাতের স্মৃতিটাকে দুঃস্বপ্ন বলে ভুলতে চায়। " মা তুমিও এসে বোসোনা আমাদের কাছে। আমরা পুরো ফ‍্যামেলি এক জায়গাতে থাকি।".." ওরে পাকা বুড়ি আমার! কত কি জানে।"
            কিছুদিন বাদে হঠাৎই ধীমানের শরীর খারাপ হলো বুকে ব‍্যাথা,বেশ অনেকবার বমি করলো। সঙ্গে সঙ্গে ছুটোছুটি করে ডাক্তার দেখিয়ে চিকিৎসা শুরু করলো অনু। শুরু হলো বিভিন্ন পরীক্ষা,ডাক্তারবাবু বলে দিলেন। হার্টে ব্লকেজ আছে এছাড়া প্রেসার সুগার সবই হাইয়ের দিকেই। ওজনও কমাতে হবে,নাহলে সমস‍্যা বাড়বে। আর ড্রিঙ্কিং স্মোকিং বন্ধ। বেশ কিছুদিন চললো এভাবে,আজকাল নিজে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল হয়েছে অনু ধীমানের খাওয়াদাওয়ার ব‍্যাপারে। ছয়মাস বাদের রিপোর্ট ঠিক ঠাক আসে। খুশি হয় অনুর ডাক্তারের কথা শুনে।
   " ডাক্তারবাবু এবার তো একটু আধটু পার্টিতে..মানে আপনি যদি বলেন যা কড়া গার্জেন আমার!"..বরের দিকে ঠোঁট ফুলিয়ে তাকায় অনু।
" আচ্ছা ঠিক আছে তবে মাসে এক দুবার এক আধ পেগ। স্মোকিং কিন্তু নয়।"
            অনু জানেনা কিন্তু দিনে একটা দুটো সিগারেট খেতোই ধীমান আর মাঝে মধ‍্যে দু এক পেগও।সুস্থ আছে জেনে পরিমাণ বাড়লো আবার তার সাথে হয়ত উপচে পড়া স্বাচ্ছল‍্যে আরও কিছু। আজকাল অফিসের জন‍্য একটু আগেই বেড়িয়ে যায় ধীমান ফিরতেও রাত হয়। জিজ্ঞেস করে জেনেছিলো কাজ আছে। তবে পরে ধীমানই বলেছিলো রুমনাকে ড্রপ করতে একটু দেরি হয়ে যায়। ছোট বাচ্চা নিয়ে সেপারেশনে আছে মেয়েটা খারাপ লাগে,একটু লিফ্ট দিলে ক্ষতি কি?
                       একটু একটু করে ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিলো অনু। আজকাল আবার ধীমান ঐ গন্ধটা নিয়ে বেশি রাতে ঢোকে। কখনও প্রতিবাদ করলে আরও বেশি জোর খাটায় অনুর ওপর। মেয়েদের ঘুম ভাঙবে বলে মুখ বুজে অনেককিছু সহ‍্য করে অনু।
    ..." শোনো সামনের মাসে আমরা সিঙ্গাপুর যাচ্ছি।"
..." সামনের মাসে তো মেয়েদের পরীক্ষা তখন কি করে যাবো?"
      ..."তুমি তো শুনলেই না ভালো করে। এটা অফিস ট‍্যুর। তাই তোমার যাওয়ার.."
       মুখটা শক্ত হয়ে যায় অনুর.." রুমনা যাচ্ছে?"
" হঠাৎ এই কথা? ঘরের সঙ্গে সঙ্গে অফিসটাও সামলাবে নাকি?"
" সামলাতেই পারি,তুমি যা ইচ্ছে করবে তা তো হয়না।"
  চিৎকার করে ওঠে ধীমান," আমার কি কোন স্বাধীনতা নেই। সারাদিন এত চাপ আর বোরিং সংসার! এত সন্দেহবাতিক মহিলার সাথে জাস্ট থাকা যায়না।"
       " আমি চোখ বন্ধ করে থাকাতে একটু বেশিই স্বাধীনতা পেয়ে গেছো বোধহয় তুমি।ঠিক আছে আমি চলে যাবো।"
" তাই যেয়ো।"
  ধীমানের চিৎকারে আর অনুর কান্নায় ঘুম ভেঙে যায় মেয়েদের। ভয় পেয়ে এসে ওরা মাকে জড়িয়ে ধরে।
         অন্ধকার রাতের পর আবার একটা দমবন্ধ করা সকাল। আজ আর কথা বলতে ইচ্ছে করে ধীমানের সাথে। মাঝে মধ‍্যেই কালকের কথাগুলো হাতুড়ি পিটে মাথায়। অফিসে বেড়িয়ে যায় ধীমান। কোন কাজেই মন বসেনা অনুর শুধু কান্না পায়। দুই মেয়েই বাড়িতে,বোনকে আজ বেশিই সামলাচ্ছে টিয়া হয়ত বোঝে মায়ের মন ভালো নেই।
              বাথরুমে শাওয়ারের তলায় দাঁড়িয়ে চোখের জলের বন্যা নেমেছে অনুর।
" মা মা দরজা খোলো ফোন এসেছে।"
" বলে দে মা বাথরুমে এখন কথা বলতে পারবেনা।"
" ওমা খোল না,বাবার অফিসের ফোন তোমাকেই চাইছে।"
         কোনরকমে বেড়িয়ে ফোনটা ধরে অনু..." বৌদি বলছেন,ধীমান আজ অফিসে চ‍্যাঁচামেচি করতে করতে অজ্ঞান হয়ে গিয়ে পড়ে যায়। আপনি তাড়াতাড়ি আসুন।"
...তারপর ধীমানের ম‍্যাসিভ হার্ট আ্যাটাকে কোথা দিয়ে যে একুশটা দিন কেটে গেছে বুঝতেই পারেনি অনু। নার্সিংহোম,বাড়ি,মেয়েদের স্কুল পাঠানো সবটাই সামলেছে ।অবশ‍্য শান্তিপুর থেকে শ্বশুর শাশুড়িও এসেছেন খবর পেয়ে। প্রথম দিকে কয়েকদিন অফিসের লোকজন এসেছে তবে পরে ফোন করেই কর্তব‍্য করেছে। রুমনাও এসেছিল একদিন।তবে বোধহয় ধীমানের প‍্যারালাইজড হাত আর বেঁকে যাওয়া মুখটা দেখে আর আসেনি।
              আচ্ছন্ন অবস্থা কেটে যাওয়ার পর ধীমান
দেখতো ওর পাশে অপেক্ষারত একটা ছোট হয়ে যাওয়া ক্লান্ত মুখ। প্রথমে কথা বলতে পারতোনা স্পষ্ট করে ইশারায় জিজ্ঞেস করত খেয়েছে কিনা? ভেজা চোখে ওর হাতে হাত রেখে অনু বলত," তুমি সুস্থ হয়ে বাড়ি এসো তাহলেই হবে।"
                    একটু একটু করে অফিসের সাথে যোগাযোগ ক্ষীণ হলো। মাঝে মধ‍্যে একটা দুটো টেলিফোন। দেখতে দেখতে প্রায় চারমাস কেটে গেছে। কঠোর নিয়ম কানুন ওষুধপত্র আর ফিজিওথেরাপি তে অনেকটাই ভালো এখন ধীমান। এক এক সময় হাসি পায় ওর যেন এক বাধ‍্য শিশুর মত অনুকে চোখে হারায় ধীমান।
    " তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে নাও,আবার অফিসে যেতে হবে তো নাকি?"
..." আমি পারবো অনু আবার আগের মত সব করতে?"
   "নিশ্চয় পারবে ধীরে ধীরে,তবে আগের মত সব করতে চাও আবার?"
     অনুর হাতদুটো চেপে ধরে ধীমান," হয়ত ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন‍্য। আর সেই জন‍্যই আমি আবার আমার মিষ্টি পরিবারকে ফিরে পেয়েছি। বিপদে বোধহয় পরিবারই পাশে থাকে।"
                  " বন্ধুরাও থাকে,কিন্তু যদি তারা সত‍্যিকারের বন্ধু হয়। যারা তোমায় ইন্ধন দিয়ে খারাপ করে সুবিধা নিতে চেয়েছিলো বা ক্ষতি করতে চেয়েছিলো তেমন কেউ নয়।"
                    সামনের সপ্তাহে ধীমান অনেকদিন বাদে আবার অফিসে যাবে। শান্তিপুরে শাশুড়িমা ছেলের জন‍্য পুজো দিচ্ছেন তাই ওরা সবাই এসেছে ওখানে। মেয়েদুটোও খুব খুশি অনেকদিন বাদে বেরোতে পেরে। আজ ওরা ঠাম্মুর কাছে শুয়েছে। ধীমানের খুব কাছে বুকে মাথা দিয়ে শুয়ে সেই অনেক বছর আগের মত অনু। যদিও এর মধ‍্যে হয়ে গেছে হৃদয়ে অনেক রক্তক্ষরণ তবুও কানপাতে অনু। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে,একফালি আলো জানলা দিয়ে ওদের বিছানায়। হঠাৎই ধীমানের ফোনটা বেজে ওঠে স্ক্রীনে নামটা ভেসে ওঠে রুমনা। ফোনটা কেটে দেয় ধীমান।
       অনু দেখেও কিছু বলতে পারেনা,ধীমানের আদরে ওর ঠোঁটদুটো বন্ধ তখন।
সমাপ্ত:-

                  

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...