#জবাব#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
গাঢ় হলুদ জমিতে লালপাড় কাঞ্জিভরম শাড়িটা খুবই পছন্দের মুনিয়ার। ওর শ্যামলা রঙে হলুদটা মানায় ভালো বেশ ফর্সা ফর্সা লাগে। একটা সময় এই গায়ের রঙের জন্য কতই না কথা শুনেছে। কালো বলে বাবা মায়েরও বোধহয় একটু চিন্তা ছিলো তাই পাত্রপক্ষ পছন্দ করতেই সাত তাড়াতাড়ি বিয়েটা হয়ে গিয়েছিলো। তবে সেখানেও ঐ একই কথা শুনেছিলো,' কৃষ্ণ কালো আর রাধা ফর্সা হয় এই তো শুনে এসেছি। আর আমাদের বাড়ির ছেলেটা এত ফর্সা হয়েও সেই কালো বৌ! এ যে পুরো উল্টো গো।'
অথচ এক প্লেট মিষ্টি খেয়ে তিনবার পাত্রপক্ষের সামনে বসে ইন্টারভিউ দিয়ে মুনিয়া সিলেকটেড হয়েছিলো। না না প্রেমের বিয়ে টিয়ে নয়,একদম তুল্যমূল্য যাচাই করে বিয়ে। তবুও কপাল মন্দ হলে যা হয়।
মুখটা পরিস্কার করে ক্রীমের পরত দিয়ে আরেকটু উজ্জ্বল করার চেষ্টা করে। একটা সময় মুখে মাখতো স্রেফ একটু বডি পাউডার ব্যাস সাজ শেষ। সময়ের সাথে সাথে নিজেকে একটু করে ভালো করতে চেয়েছে ও তা স্বভাবেই হোক বা গায়ের রঙেই হোক। এখন ড্রেসিং টেবিলে সাজানো দিনের রাতের আলাদা ক্রীম,ফাউন্ডেশনের শিশি,আইলাইনার আরও কত কি।
কপালে ছোট লাল টিপ,চোখে একটু আইলাইনার আর ঠোঁটে লিপস্টিক ব্যাস সাজ শেষ। শাড়িটা গুছিয়ে পরে গলায় নেকলেশটা পরে নেয়। মুনিয়া এখন আর সেই নতুন বৌ নয়। বেশ অনেক বছর বিয়ে হয়ে গিয়ে অনেক পরিণত। আর কি এবার শাশুড়ি হবার পালা। মানে আজ ওর ননদের মেয়ের বিয়ে,তার মানে মামীশাশুড়ি হয়ে যাবে। সত্যি কোথা দিয়ে যে দিন চলে যায়,মনে হয় এই তো সেদিনের কথা,মেয়েটা তখন কতটুকু।
কানের দুলের পর হাতের দিকে নজর যায়। যদিও হাতের গয়না বের করেছে,কিন্তু শাঁখাটা কি খুলে ফেলবে? অদ্ভুত মায়া এই শাঁখাজোড়ার ওপর মুনিয়ার। এই নিয়ে ওর চার জোড়া শাঁখা। ভালো ডিজাইন দেখলেই বানিয়ে ফেলে। অথচ একটা সময় ওর হাত থেকে সোনাপ্যাঁচানো শাঁখাজোড়া খুলে দিয়ে খুব মন খারাপ করেছিলো। মুনিয়ার শাশুড়ি নেই,বিয়ের পর শ্বশুরমশাই শাশুড়ির নতুন বাঁধানো শাঁখাজোড়া দিয়ে বলেছিলেন," তোমার তো নেই,তুমি পরো। এটা বানানোই হয়েছিলো ও হাতে দিতে পারেনি।"
কয়েকদিনের জন্য বাপেরবাড়ি ঘুরে আসার পর শ্বশুরমশাই বলেছিলেন," ওটা তুমি খুলে রেখো। ওটার জন্য শোভা খুব অশান্তি করছে,ওটা ওকে দিয়ে দিতে হবে ওর মায়ের জিনিস।"
আর কিছু না বলে হাত থেকে সাবধানে শাঁখাজোড়া খুলে শ্বশুরমশাইয়ের হাতে তুলে দিয়েছিলো মুনিয়া। খারাপ লেগেছিলো খুবই,তবে রাগ হয়নি। এটুকু বুঝেছিলো এই বাড়িতে কোন ভালো জিনিসই ওর নয় যেটুকু নিজের ক্ষমতায় করতে পারবে সেটুকুই থাকবে। তারপর থেকে চাকরি পেয়ে একটু একটু করে সোনার দোকানে টাকা দিয়ে বানিয়েছিলো ঐ শাঁখাজোড়া অনেকটা শাশুড়িমায়ের শাঁখার মত করে। তাই অদ্ভুত একটা মায়া গয়নাটার ওপর।
তবুও ওটা খুলে রেখে নতুন বানানো শাঁখাটা হাতে পরে তারপর চূড়টা পরলো। সত্যিই ডিজাইনটা ভালো বানিয়েছে।ওর বর এসে একবার তাড়া দিয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চোখ বুলিয়ে গেলো। ওদিকে ননদও ফোন করছে," বৌদি তোমরা কতদূর? এখানে এসে বাদবাকি সাজটা সেজে নিয়ো।" যদিও সকাল থেকে ওখানেই ছিলো তবুও কথার মধ্যের বাঁকা সুরটা ভালোই বুঝলো মুনিয়া। আসলে একসময় এত কথা শুনেছে এখন চামড়াটা কেমন যেন গন্ডারের মত হয়ে গেছে। গায়েও লাগেনা আর উত্তরও দিতে ইচ্ছে করেনা।"যতই সাজুক তবুও আমাদের বাড়ির ছেলেগুলোর কপাল খারাপ,একটা বৌও সুন্দর নয়" এমন কথা শুনে শুনে কান পচে গেছে।
একদিন মুনিয়া বলেই ফেলেছিলো বিয়ের অনেক পরে,পায়ের তলার মাটিটা একটু শক্ত হওয়ার পর," একবার নয়,তিনবার দেখে গেছো তোমরা একদম সামনে থেকে মুখে চুলে গায়ে হাত বুলিয়ে তখন ভাবলেই পারতে।"...সংসার বড় অদ্ভুত জায়গা,মুখ বুজে থাকলে তোমায় ঠ্যালা মারতে মারতে একদম খাদের ধারে ফেলে দেবে লোক। আবার মুখ খুললেই জোটে দজ্জাল বা ঝগড়ুটে তকমা অপ্রিয় হতে হয় সবার কাছে। তবুও ওর মা বলেছিলো," মাঝে মাঝে একটু ফোঁস করিস। স্বয়ং ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেবও বলে গেছেন এই কথা।"..তারপর থেকে একটু গায়ের রঙের বর্ণনাটা যেন ছোট হয়ে গেছে।
বিয়ে বাড়িতে ঢুকতেই আওয়াজ ওঠে "বাবা শাশুড়িকে দেখবো না মেয়েকে দেখবো? ফাটাফাটি সেজেছো বৌদি,শাড়িটাও তো দারুণ। কি দিচ্ছো গো,সকাল বিকাল!"
মুনিয়া হেসে ফেলে মাসতুতো ননদের কথায়। সত্যি একটা সময় বড় কষ্টে কাটিয়েছে,সাজগোজ করতেও জানতোনা। তেমন সামর্থ্যও ছিলোনা,বরের একার চাকরি তখন। কতটুকুই আর মাইনে? বয়স আর দিনগুলো যেন লাফিয়ে লাফিয়ে যায়। তাই মুনিয়া আজ নিজেকে পুরোটা দেয়,নিজেকে যাতে ভালো লাগবে সেভাবেই সাজে। বিয়ের পর একসময় অনুষ্ঠান বাড়িতে এককোণে বসে থাকত চুপসে কালো হয়ে যাওয়া একটা ভয় পাওয়া সরল মুখ। আজকের মুনিয়া আত্মবিশ্বাসী, স্বাবলম্বী এখন আর কেউ কথায় কথায় অপমান করতে পারেনা।
সবারই নজর পড়ে ওর শাঁখায়,এমনকি ননদও বলে ওঠে," বাহ্ কি সুন্দর ডিজাইন! নতুন বানালে নাকি? কোথা থেকে? "
একটু হাসে মুনিয়া," বলছি,মৌ কোথায় গো? এখনও সাজছে নাকি? আগে ওকে দেখে আসি।" ননদের সাথে মৌয়ের কাছে আসে মুনিয়া,খুব সুন্দর লাগছে ওকে সেজেগুজে। ব্যাগ থেকে নেকলেশটা বের করে ননদের হাতে দেয়,যদিও জানে কাউকে কিছু দিয়ে কখনই খুশির হাসি কারো মুখে দেখার কপাল ওর নেই। আগে মন খারাপ হত এখন কর্তব্য ভেবেই করে।
" কেমন হয়েছে দেখো তো?আমার খুব পছন্দ হয়েছে ডিজাইনটা। আর এটা জামাইয়ের।"
একটু আলতো হাসির রেখা ফুটে ওঠে ননদের মুখে মৌ খুশি হয়। অন্যরাও দেখে জিনিসগুলো। সবার কথার মাঝে মুনিয়া ওর ব্যাগ থেকে একটা সোনালী বটুয়া বের করে ওর ননদ শোভার হাতে দেয়। আশ্চর্য হয়ে শোভা বলে," এটা আবার কি?"
হাসে মুনিয়া," খুলে দেখো।"
বটুয়াটা খুলে শোভা আশ্চর্য হয়ে যায়," এটা তো একদম তোমার শাঁখাজোড়ার মত,কার এটা?"
" এটা তোমার জন্য বানিয়েছি,মানে একসাথে দুজোড়া করিয়েছি। আমি জানি তো সবসময় আমি যা পছন্দ করি সেটাই তোমার ভালো লাগে। তাই তোমাদের পঁচিশতম বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আমার উপহার।"
মুনিয়া জানেনা শোভার কিছু মনে পড়লো কিনা? তবে আজ গান্ধীগিরি করে মুনিয়ার ভালো লাগলো। কিছু জবাব সময়ই দিয়ে দেয়,আর কিছু জবাব দেওয়ার জন্য একটু ধৈর্য ধরাই বোধহয় ভালো।
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment