#নতুন_করে_পাবো_বলে#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
"পিয়ালী এদিকে একবার আসবে তো..বাবা একটু রেডিওটা কম করো সারা পাড়া জানছে আজ রবীন্দ্রজয়ন্তী।"
পিয়ালী জানে বাবা কেন আওয়াজটা বাড়িয়েছেন। ও গান শুনতে ভালোবাসে বলে,অথচ এই সময় ওর এক জায়গায় দাঁড়ানোর সময় নেই ছুটোছুটি করছে নীলের অফিসের রান্না টিফিন,ছেলের খাবার টিফিন সব বানানোর জন্য।
নাইটিতে হাত মুছতে মুছতে এসে দাঁড়ায় পিয়ালী। "একি তুমি খোড়াচ্ছো কেন? এরমধ্যেই বুড়িদের মত হাঁটুব্যাথা বাঁধিয়ে ফেলেছো! যাক্ আমি বলবোনা কিছু, ঘরে শুয়ে বসে থাকলে এমনি হবে। আচ্ছা আমার রবীন্দ্রনাথের মোটিফের পাঞ্জাবীটা কোথায় জানো?"
রান্নাঘরে গিয়ে গ্যাসটা বন্ধ করে আসতেই শুনতে পায় গুছিয়ে রাখার ঠ্যালায় কোন কিছু পাওয়াই মুশকিল। কোন কথা না বলে পাঞ্জাবীটা বার করে দেয় ও।
রেডিওতে তখন গান বাজছে এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়। ঘামে তখন ওর নাইটিটা ভিজে গেছে কড়া রবির কিরণ তখন ওর
রান্নাঘরে উঁকি দিয়েছে। যদিও আকাশটা চোখে পড়েনা এখান থেকে তবুও এখানেই মুক্তি খোঁজে ওর হাজার কাজের মাঝে। যদিও নীলেন্দুর কাছে এগুলো ফালতু কাজ না করলে না করো।
একটা সময় এই দিনে ওরা দুজনে জোড়াসাঁকো বা রবীন্দ্রসদনে যেতো। অফিস থাকলেও নীলেন্দু ছুটি নিয়েছে। লাল সাদা ঢাকাইয়ে খোঁপায় জুঁইফুলের মালা দিয়ে সাজতো পিয়ালী হাতে হাত রেখে নীলেন্দু শুনতো ..আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ সুরের বাঁধনে। রবীন্দ্রসদনের নিরালায় বসে নীলেন্দু তখন ওর ভরাট গলায় মাঝে মাঝে দু একটা লাইন গাইতো..'আমি যখন তাঁর দুয়ারে ভিক্ষা নিতে যাই তখন যাহা পাই সে যে আমি হারাই বারে বারে.."
পিয়ালী হেসে বলত," ভিক্ষা দেওয়ার মত আর আমার কিছু নেই আজ আমি নিজেই ভিখারিনী।"
হাসিতে উচ্ছ্বল হয়ে উঠত দুজনেই.." তুমি কিছু সুন্দর কথা বলতে পারো পিয়ালী। আর ঐ জাদুতেই তো আমি একদম", বলেই শুরু করত মায়াবন বিহারিণী হরিণী গহন স্বপন সঞ্চারিণী। বিয়ের প্রথম প্রথম কত না ঘুমোনো রাত কাটিয়েছে রবীন্দ্রনাথের গান শুনে..পিয়ালীকে কাছে টেনে বলেছে আমার পরাণ যাহা চায় তুমি তাই। আদরে আদরে ভরে ওঠা পিয়ালী গাইত 'তুমি সুখ যদি নাহি পাও। যাও সুখের সন্ধানে যাও।'.."ইশ দিলে তো সবটা মাটি করে এত আদরের মধ্যে এমন কথা কেউ বলে?"
মাঝে মাঝে যখন ভালোবাসা আর অনুভূতিগুলো নিঃশব্দে ভাঙে পিয়ালীর মনে হয় নীলেন্দুর সুরে সুরে সাজানো সংসারে ও নিজেই বোধহয় বেসুরো। একটা সময় সংসারের চাপে হাঁপিয়ে উঠে পুরোনো হারমোনিয়ামটা নিয়ে বসলে শ্বশুর মশাই বলতেন," এত সঙ্কোচ কিসের? মনের আনন্দে গান গাও..জানোতো সঙ্কোচের বিহ্বলতায় নিজের অপমান।"
পাঞ্জাবীটা আয়রন করে বোতাম লাগিয়ে বিছানায় রেখেই ছুটে আসে নীলকে খেতে দিতে। তার মধ্যেই ছেলে ডাকে আবার ছুটে যায়। নীলের বেরোনোর সময় সামনে দাঁড়ানোটা বহুদিনের অভ্যেস।একটা সময়ে লুকিয়ে আদর করে যেত নীল। ঘামে ভেজা নাইটিটা গায়ে চেপে বসেছে ওর টিফিনটা ব্যাগে ঢুকিয়ে একটু দাঁড়ায় দরজার কাছে। পিয়ালীকে দেখে আর কোন মুগ্ধতা জাগেনা নীলের। নিজের ঢিলেঢালা স্থূল শরীরের চর্বি আর খাঁজগুলো লুকোনো থাকে ঐ ঢিলে বস্তাটার মধ্যে। মা রাগ করতো বলে শাড়ি পরত,মা মারা যাবার পর ঐসব পাট চুকিয়ে দিয়ে নাইটি পরে।
অফিসে গিয়ে মনে হয় এই যাহ্ পাঞ্জাবীটা না নিয়েই চলে এলো! সাথে সাথেই ফোন করে পিয়ালীকে বলে," কি আশ্চর্য! অতক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলে একবারও মনে পড়লোনা তোমার? নাকি ইচ্ছে করেই.."
ও পারে পিয়ালীর গলাটা এতটাই নির্বিকার আর ঠান্ডা ছিলো তাই আর কিছু বলতে পারেনা।
" কি হয়েছে? তোমরা ছেলেরা বড্ড মাথা গরম করতে পারো। একটা পাঞ্জাবী কিনেই তো নিতে পারো।"..মৌমিতা নীলেন্দুর কলিগ,যদিও ডিভোর্সী কিন্তু খুব পজেটিভ আর স্টাইলিশ। ঠোঁটে লিপস্টিক লাগাচ্ছে ও। এক মুহূর্তের জন্য ওর ঐ লালটুকটুকে ঠোঁটদুটোর পাশে পিয়ালীর সাদাটে ঠোঁটদুটোর কথা মনে হলো।
অফিসের পর ওর সাথেই রবীন্দ্রসদনে যাওয়ার কথা। এই নিয়ে কোন অপরাধবোধ হয়না নীলের আরে প্রেম তো করছেনা। অফিস কলিগের সাথে যেতেই পারে ফাংশান দেখতে।
" আমি বেড়িয়ে যাবো বিকেলেই,শো শুরু হবার আগেই চলে আসবো রেডি হয়ে বাড়ি থেকে। অফিস থেকে একসাথে বেরোনোটাও ঠিক নয়।যা সব পাবলিক এখানে!"
দু তিনবার বেল বাজাচ্ছে অথচ খোলার নাম নেই বড্ড বিরক্ত লাগে নীলের এই গরমে। বাহ্ কি নিশ্চিন্তে পিয়ালী ভাত ঘুম দিচ্ছে!
.." এ কি বাবা তুমি দরজা খুলতে এলে? পিয়ালী কোথায়?
"কোথায় যেন একটু বেরোলো।"..একটু ফ্রেস হয়ে পাঞ্জাবীটা পরে আয়নার সামনে নিজেকে দেখে নীল। মনে পড়ে কোন একটা বুটিক থেকে পিয়ালীই এনে দিয়েছিলো পাঞ্জাবীটা।
রবীন্দ্রসদনের সামনেই দাঁড়িয়েছিলো মৌমিতা বেশ অন্যরকম লাগছে ওকে। এরমধ্যেই চেঞ্জ করে নিয়েছে। সত্যি মেয়েটা পারেও,এমনটাই তো হওয়া উচিত।
পাশাপাশি বসেছে ওরা,মৌমিতার হাল্কা পারফিউমের গন্ধ আর আঁচলের ছোঁয়া বারবারই স্পর্শ করছে অনুভূতিকে। অনুষ্ঠান শুরু হবে আলোগুলো নিভে যায়। মঞ্চের নিভু নিভু আলোগুলোর মধ্যে শুনতে পায়...
'আজি হতে শতবর্ষ পরে কে তুমি পড়িছো বসি আমার কবিতাখানি কৌতূহল ভরে'..... নিজের মতো করে কবিগুরু রচনা করে গেছেন তাঁর জন্য আর সবার জন্য। তাই আজ কবিকে প্রণাম জানাই তাঁর সৃষ্টি করা সুধাময় গানে। এখনি শুরু হবে আমাদের আজকের গীতিসুধা আর আপনাদের সাথে আছি আমি'..হঠাৎই মঞ্চের আলোগুলো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে নীলেন্দুরও যেন স্বপ্নভঙ্গ হয়..পিয়ালী!
কপালে ছোট্ট টিপ,পরনে সাদা লাল ঢাকাই খোঁপায় জড়ানো বেলফুলের মালা। পিয়ালীর ঠোঁটেও আজ হাল্কা লিপস্টিক। চোখদুটো কাজলের ছোঁয়ায় বড় উজ্জ্বল আর মায়াবী। সকালে অবজ্ঞায় আর বিরক্তিতে যাকে দেখতেই ইচ্ছে করেনি এখন যেন তার থেকে চোখ ফেরানো যাচ্ছেনা। সংসারে বেসুরো পিয়ালী আজ বড় সুরেলা ঠিক আগের মত হয়ত বা আরও বেশি পরিণত আর ব্যক্তিত্বময়ী। অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার একটু আগেই মাথা যন্ত্রণার ছুতোয় বেড়িয়ে আসে নীল। আজ আর মেট্রোতে উঠতে ইচ্ছে করেনা,ট্যাক্সিতে বসে শরীরটা এলিয়ে দেয়। ক্রসিংয়ে হঠাৎই জানলা দিয়ে বাচ্চা মেয়েটা হাত বাড়ায় "ফুলের মালা নিবেন বাবু"? ওর হাত থেকে এক গোছা মালা নিয়ে বাড়িতে ঢোকে নীল।বেল বাজাতেই দরজা খোলে পিয়ালী তখনও সেই মনোমুগ্ধকর সাজে।হয়ত মেট্রোতে ফিরেছে বলে আগে এসেছে। অবাক হয়ে তাকায় নীল একটু হাসে পিয়ালী। " একটু গিয়েছিলাম এক জায়গায়। তোমার সরবত করা আছে আমি আসছি।"
নীল বলতে পারেনা আমি জানি তুমি কোথায় গিয়েছিলে। বুঝতে পারে নিজেকে খুঁজতে চায় পিয়ালীও আবার। হয়ত ওর অবহেলাই আহত করেছে একটু একটু করে।
হাত বাড়িয়ে মালাটা ওর হাতে দেয় অনেকদিনের চেনা একটা প্রেমের গন্ধ ধারাবাহিক একঘেঁয়ে অপ্রেমে উঁকি দেয়। হাসে পিয়ালী ,"হঠাৎ জুঁই ফুল?".."ইচ্ছে হলো তাই আনলাম।"
তবে আজকের রাতটা কবিগুরুর সাথে আবার একবার জাগতে ইচ্ছে করলো নীলের। আজ আবার পিয়ালীর বড় কাছে এসে গাইতে ইচ্ছে করলো..আমার পরাণ যাহা চায়। সারা ঘরে তখন জুঁইফুলের মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়েছে। ভালোবাসারও বোধহয় একটু আদর যত্নের প্রয়োজন হয় মাঝেমাঝে।©ইচ্ছেখেয়ালে শ্রী
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment