#চেতনা#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
বিছানা থেকেই শুনতে পায় অমিতা কাজের লোকের সাথে শাশুড়ির ঝগড়া। দুজনের কেউই কম নয়। একটা দিন শরীর খারাপ হলেও শুয়ে থাকার উপায় নেই।
" মালতী তোকে না বলেছি আমার শরীরটা খারাপ তবুও কি শুরু করেছিস তোরা।"
"বৌদি মাসিমাকে বলো আগে,বাসন ভালো করে ধুচ্ছি তাও বলে আরও জল ঢাল। আবার ধুয়ে নে। ঘর মোছার জল পাল্টাচ্ছি তাও বলে পাল্টাসনি। শোনো তোমরা লোক দেখো। এত খিটিমিটি আমার পোষাচ্ছে না।"
বিপদের আঁচ পায় অমিতা,এরপর এই অত্যাচারটা শুরু হবে ওর ওপর। আর মালতী চলে গেলে কে করবে এত কাজ!
"একি মা! সব জলগুলো ফেলছেন কেন! কালই তো আমি ভরে রাখলাম।"
"ওগুলো বাসি জল বৌমা,কি দরকার ওগুলো খাওয়ার? আমি কিছুটা টাটকা জল ধরে রাখছি।"
"এই না বলছিলেন আপনার পায়ে ব্যাথা বেড়েছে। আর জলের ট্যাঙ্ক থেকেই তো জল আসে মা। তাতে আবার টাটকা বাসির কি আছে শুনি?"
" বৌমা তোমার কিপ্টেমি আর গেলোনা,খাবারদাবার নিয়ে করো তার সাথে জল নিয়েও শুরু করেছো!
একি তোমার বাপের বাড়ির মত রাস্তার কল থেকে জল টেনে আনা বালতি করে। না টিউবওয়েল শক্তি দিয়ে পাম্প করে জল বার করা? আমরা থাকি গিয়ে টালায়,একদম জলের সমুদ্দুরে। চব্বিশ ঘন্টা কলে জল আছে যত খুশি নাও। তোমার বাবা তো আমাদের এই জল খেয়েই আঃ বলেছিলো।"
" মা কথায় কথায় বাপের বাড়ির কথা বলবেননা। সত্যিই আমাদের জলের কষ্ট তবে এখন তো বাড়িতে জল এসেছে।"
"জানি মা কত জল এসেছে,তাই তো তুমি ওখানে শ্যাম্পুও করতে পারোনা। আমার নাতনিগুলো একটু ভালো করে স্নান করতে পারেনা। এখানে আসতে পারলে বাঁচে দাদুর বাড়ি থেকে। বলে দাদুর বাড়িতে বেশি লোক যাওয়া মানেই জলের কষ্ট শুরু। আর দাদু টেনশনে ভুগতে থাকে জল নিয়ে।"
" তাই বলে বালতি ভরা জল ফেলে দেবেন বাসি বলে!তেমন হয়েছে আমার মেয়ে দুটো বাপরে বাথরুমে গেলে টানা একঘন্টা।"
" আর খিটখিট করোনা তো বাপু সকালে উঠেই। যত নষ্টের গোড়া ঐ মালতীটা কাজে ফাঁকি দেবে ভালো করে বাসন ধোবেনা আর বললেই চিৎকার করে মাথা খাবে। ব্যাস উনি সাধু হলেন,তুমিও ওকেই তোয়াজ করলে আর খারাপ হলাম আমি। যত্তসব!"
ঘুমের বারোটা বাজলো অমিতার আর কি শরীর আর কে বুঝছে কাজে লেগে পড়তে হবে এবার।
চা বসিয়ে জল খাবারের ব্যবস্থা করতে গিয়ে দেখলো শাশুড়িমা আবার এক বালতি জল এনে উঠোনে ঢাললেন। ওদের পুরোনো বাড়ি,উনি জল ঢেলে আরেকবার শুদ্ধ করলেন উঠোন তুলসীতলায় যাবেন বলে। নাহ্ এতো রোজকার কথা বলে লাভ নেই। " মণি ব্রাশ করছিস বেসিনের কলটা খুলে রেখেছিস বন্ধ করে কাজ কর। এই জন্যই ঐ বাড়িতে দাদু বলে দিদিভাই কল বন্ধ করে মুখ ধোও।".." মা এরপর তুমি দাদুর বাড়ি গেলে আমি আর যাবোনা, দিদিও যাবেনা।দাদু দিদা জল নিয়ে বড় খিটখিট করে।"
চুপ করে যায় অমিতা মণি আর রিণি কোনদিনই বুঝবেনা কুয়ো থেকে জল টেনে কাজ করার কষ্ট। ওর মায়ের তো কোমরের সমস্যাই হয়ে গেছে এখন, সমানে কলসি করে খাবার জল টেনে। ছোটবেলায় বৃষ্টির জল ঘরের ছাদ বেয়ে পড়লেই মা বসিয়ে দিত বালতি আর গামলা। ঐ জলেই বাসনমাজা আর কাপড়ধোয়ার কাজ হয়ে যেত। ওরা দুইবোন কত শ্যাম্পুও করেছে বৃষ্টির জলে,চুল একদম চকচক করত।
ওর শাশুড়ির কাছে এইসব গল্প করলেই হেনস্থা ওতে হয়। মুখ টিপে হেসে বলেন," ঐ জন্যই তো বেয়াই মশাই একদম মেয়ের শ্বশুর বাড়ি দেখে দেখে টালা ট্যাঙ্কের কাছে করেছেন। এরপর বাপের বাড়ি গেলে পাঁচ লিটারের একটা জার ভরে নিয়ে যেয়ো মানুষটা একটু জল খেয়ে বাঁচবে। তোমাদের জলে চায়ের রঙও তো ভালো হয়না।"
উনি এমন করে বলেন অমিতাকে যেন ওনার ছেলের ঘাড়ে জোর করে চাপিয়েছে ওর বাবা।শুনতে শুনতে আজকাল ওর মুখও চলে। বিরক্ত হয় রঞ্জিত," বাড়িতে হয়েছে চারটে মেয়ে,মালতীকে নিয়ে পাঁচজন। তোমাদের চিৎকারে আমি আর বাবা তো কথা বলতেই ভুলে গেছি।"
সেবার পুজোর ছুটিতে ওরা সোমনাথ দ্বারকা যাচ্ছে। অমিতার বিয়ের পর এই প্রথম এতটা দূরে যাওয়া। অবশ্য সবটাই শাশুড়ির আব্দারে,ওনার তিন ধাম দর্শন হয়েছে এটি দেখা হলেই পরিপূর্ণ হয়।অবশেষে একঘেঁয়ে সংসার থেকে মুক্তি,খুশির হাসি সবারই মুখে। অমিতার বড় মেয়ে মণির বয়েস নয় আর রিণির সাত,দুই মেয়ের ঝক্কি পড়াশোনা সবই আছে। তবুও শাশুড়ির কথা শুনে হাঁ হয়ে গেলো। " আমি তো বাপু দ্বারকানাথকে বলবো আমার নাতিনগুলো যেন ভাইফোঁটা দিতে পারে সে ব্যবস্থা কোরো।"।
এর আগে বংশরক্ষার কথা বলতে গিয়ে ছেলের কাছে বকা খেয়ে এখন আবার ঘুরপথে একই কথা বলা। মেয়েদের কাছে সংসার কত কি যে চায় কে জানে। সব ইচ্ছে পূরণ সব কিছু সামলাবার দায়িত্ব বোধহয় মেয়েদেরই।
ব্যাগ ভর্তি খাওয়ার দাওয়ার গুছিয়েছেন শাশুড়িমা। ট্রেনের খাবার আবার ওনার চলেনা,পেঁয়াজ রসুনের ঠেকার বাতিক ওনার যথেষ্ট। তার সাথে টালার জল প্রচুর পরিমানে। "আচ্ছা মা খাবার না হয় তুবি খাবেনা তবে জল এত নিয়েছো! এর জন্য যে একটা পুরো ঠ্যালাগাড়ি ভাড়া করতে হবে।আরে জল ট্রেনে পাওয়া যাবে কিনে নেবো।".."ছয়জন লোকের খাবার জল কতটা লাগবে হিসেব করেছিস দুদিন ট্রেনে। খরচও তো হবে,তাছাড়া আমি বাপু টালার জলই খাবো।"
হাসি পায় অমিতার এরপর কোন জল খাবেন উনি?বেশ হৈ চৈ করে কেটে গেলো দুটো দিন। এইজন্যই অমিতাকে ভালো লাগে রঞ্জিতের অমিতার মুখে হাসির রেশটুকুই ওর মধ্যবিত্ত জীবনে একফালি রোদ্দুর।
সোমনাথ মন্দির দর্শন করে খুব খুশি শাশুড়িমা।সমুদ্রের পাড়ে কি সুন্দর মন্দির আর শিবলিঙ্গ!দেখে মনটা জুড়িয়ে যায়। তবে শুধু বালি বালি চারিদিকে আর স্নানের জলও নোনা। এ কেমন দেশ মাগো,শ্যাম্পু করেও চুলের আঠা যায়না।কোন জল খেয়েই যেন শান্তি হয়না ওনার। ছেলে মাকে খুশি করার জন্য ব্যস্ত কিন্তু কোন জলই পোষাচ্ছেনা ওনার।" বাবা গো,তেষ্টা আছে কিন্তু মন ভরছেনা,কবে যে দ্বারকানাথ দর্শন করে বাড়ি ফিরবো।"
দ্বারকায় গিয়ে মন্দির সংলগ্ন একটা বাড়িতে ওরা উঠলো। রঞ্জিতের অফিসের একজন খোঁজ দিয়েছিলো। ওখান থেকে চট করেই মন্দিরে যাওয়া যায় আরতি দেখতে। বাড়িটা একটা গুজরাটি পরিবারের। বেশ বাড়ি বাড়ি একটা অনুভূতি হলো ওদের ওখানে। এখানে জল খেয়ে শাশুড়িমা বললেন," এই জলটা তবুও মিষ্টি লাগছে। গরম থেকে এসে খেতে বেশ ভালো লাগছে বৌমা। আসলে কৃষ্ণের দেশের জল তো তাই স্বাদই আলাদা।"
মায়ের কথা শুনে হাসছিলো রঞ্জিত,অনিতা ইশারা করলো চুপ করতে। হঠাৎই ওর শ্বশুর মশাই বললেন," দিদিভাই তোমার ঠাম্মিকে একটু কেষ্ট ঠাকুরের দেশের পুকুরটা দেখিয়ে দাও। যেটা আমায় দেখালে সকালে।"
" ঠাম্মি এদিকে এসোনা,তোমাকে একটা জিনিস দেখাবো।"..সবটুকু দেখার আর জানার পর কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন শাশুড়িমা। ছাদের থেকে বৃষ্টির জল জমা হয় সিঁড়ির তলার ট্যাঙ্কে, আর সেই জল পরিশোধিত হয়ে খাওয়ার কাজে ব্যবহার করা হয়। তাহলে কাল থেকে বৃষ্টির জল খাচ্ছেন? তাই জন্যই স্নানের জলে নোনতা ভাব থাকলেও খাওয়ার জলটা মিষ্টি।
এখন আধুনিক ব্যবস্থা হলেও অনেক বাড়িতেই এভাবে বৃষ্টির জল জমিয়ে কাজে লাগায় ওরা। " মা কেষ্টঠাকুরের জলের ভান্ডার দেখলে তো? এবার থেকে আমাদের টালার বাড়িতেও এমন করে নেবো। জলের স্তর নামছে,এরপর আমাদেরও হাহাকার করার দিন আসছে সচেতন না হলে।"
চারধাম দর্শন করে পরিতৃপ্ত শাশুড়িমার পরিবর্তন দেখে আশ্চর্য হয়ে যায় অমিতা।
" মালতী,ফালতু জল ফেলবিনা বারবার, ঐ গামলার জলেই বাসনগুলো ধুয়ে নে ভালো করে। আর শোন গাদা গাদা জল দিয়ে উঠোন ধুবিনা।".." ও মাসিমা চাপ নিয়োনা আমি হোয়াটস আ্যপে জেনেছি গো জলের আকাল আসছে। তবে টালার ট্যাঙ্ক তো সমুদ্দুর তুমিই তো বলো।".." ওরে পাগলী অপচয় করলে সমুদ্দুরও শুকিয়ে যায় এক সময়। এই জন্যই দেশ বিদেশ বেড়াতে হয়। কত কি দেখা যায় আর শেখা যায়।"
অমিতার মুখে হাসি ফোটে যাক দেরিতে হলেও উনি যে বুঝেছেন সেটাই অনেক। সারাদিনে অন্তত কুড়িলিটার জলের অপচয় বাঁচবে,বছরে অনেক হাজার লিটার। এমন যদি সবাই ভাবতো!
মাঝে কেটে গেছে কয়েকটা মাস " মা চৈত্র সংক্রান্তির দিন তো বাসি জল টুকুও আপনি নেননা,কিছুটা জল আছে কি করবো?".." বাথরুমে ঢেলে রাখো বৌমা হাত পা ধোয়া যাবে। আর রঞ্জিত কাল মিস্ত্রীকে আনবে তো?".." কেন মা?".." উঃ ঐ যে বলেছিলাম বৃষ্টির জল জমানোর একটা ট্যাঙ্ক করবো বাড়িতে। শুভ কাজের শুরু বছরের প্রথম দিনেই করতে হয়।".." মনে আছে মা।"
কপালে হাত ঠেকান শাশুড়িমা তার সাথে সাথে অমিতাও জয় বাবা দ্বারকানাথ সত্যিই তুমি মায়ের বিবেক বুদ্ধি জাগিয়েছো। এমন সচেতনতা আসুক সবার একটু একটু করে।
সমাপ্ত:
Comments
Post a Comment