#ফ্রেন্ডশিপ_অ্যান্ড_মোর#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
কলেজ থেকে এসে জামাকাপড় ছেড়ে ফেলে অহনা। যথারীতি একটু ঢিলেঢালা পোশাকে শরীরটা হাঁপ ছাড়ে একটু আরাম পাবার আব্দার করে। তাই একদম হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকে কিছুক্ষণ।
টিভিটা চালানো সিনেমা হচ্ছে,একদল বাচ্চা গাইছে, 'বাসে,স্কুল থেকে ফেরা বাস জানলাগুলো হাসে তোমায় যারা ভালোবাসে'...গানটা খুব ভালো লাগলো অহনার।
ক্লান্ত চোখদুটো খুলে পিটপিটিয়ে দেখলো বেশ কিছুক্ষণ আহা স্কুলের বাচ্চাদের দেখাচ্ছে।
'লাল ফিতে সাদা মোজা স্কুলের ইউনিফর্ম..নটার সাইরেন.. সিলেবাসে মনোযোগ কম।'
আজকাল মাঝে মাঝেই স্কুলের কথা খুব মনে হয় অহনার। ওর সেই ছোট্টবেলা থেকে অনেকটা সময় কাটানো স্কুল আর ফেলে আসা স্কুলের দিনগুলো। সেই টিফিন খাওয়ার টিফিনবক্স নিয়ে হুটোপুটি,ছুটোছুটি,ঝগড়াঝাটি আর বকবক।
স্কুলের গেটের কাছের হজমিগুলি ওয়ালা,ঝালমুড়ি,ফুচকার ঝুড়ি আর বন্ধুদের সাথে অনেক গল্প আর ভালোবাসা মাখা ফিসফিস কথা। উফ্ স্কুলের সেই খাট্টি মিঠ্ঠি সুন্দর দিনগুলো। আর ছিলো ওদের মত কিছু কুট্টি কুট্টি বাচ্চা যারা এখন বেশ বড় মানে রীতিমতো লেডি আর জেন্টলম্যান। সবারই শেষ মোটামুটি কলেজের পড়া অনেকেই চাকরিতে তবুও মনে আছে অনেককেই সেই ছোট্টবেলার হুটোপুটি আর দুষ্টুমিতে।
কি সুইট সুইট দিন ছিলো তখন! আজকাল মাঝে মাঝেই মনে হয় আচ্ছা ছোটবেলার বন্ধুগুলো সব গেলো কোথায়?
সবাই আছে কোথায়?
চোখ বুজে ফিরে যেতে চায় ছোট্টবেলার মিঠে দিনগুলোতে অহনা।মনে পড়ে যায় কতগুলো নেড়ু,গুবলু আর মোটু ছোটু চেহারা। অনেকের কথা মনে পড়ে,আবার অনেকের নামটাই ভুলে গেছে। তবুও মুখপত্রিকা মানে ফেসবুক ফিরিয়ে দিয়েছে অনেক বন্ধুকেই,এখন তো মেলানোই যায়না অনেককেই। গুড়গুড়ি মেখলা এখন লম্বু। অর্কটা বেশ মুটিয়েছে। নেড়ু বিন্দিয়ার মাথায় এখন লম্বা চুল ভাবলেই হাসি পায় অহনার। তবে স্কুল স্কুলই সেখানে বোধহয় সবচেয়ে বেশি জমে থাকে ঝুড়ি ঝুড়ি মিঠে অনুভূতি অনেক শাসনের ফাঁকে। সেই আনন্দের হাট কখনোই বসেনা অন্য কোথাও।
ফেসবুকে খানাতল্লাশী চালিয়ে মাস ছয়েক আগে আবার খুঁজে পেয়েছে অহনা ওর সাথে ক্লাশ টুয়ে পড়া বন্ধু অঙ্কিতকে।
অঙ্কু সেন্ট মনে করেই হেসে ফেললো অহনা...ও মজা করে সেন কে সেন্ট বলতো। আর ভীষণ রেগে যেতো অঙ্কিত। বারবার বলতো..." আমি সেন,সেন্ট নই। আমাকে সেন্ট বললে তোর সব টিফিন খেয়ে নেবো কিন্তু।" আর যেমন কথা তেমনই দুষ্টুমি ভরা কাজকম্ম ছিলো ওর। ভাবলেই এখনো মজার এত্তো বড় ঝাঁপিটা আবার খুলে যায়। সেই মোটাসোটা গোলু অঙ্কু যে সুযোগ পেলেই বলত,"আমি ভুখা আছি এই দেখ আমার টিফিন বক্সে মা শুধু একটা বিস্কিট আর সন্দেশ দিয়েছিলো ওটা তো কখনই খেয়ে নিয়েছি।"
"খেয়ে নিয়েছো? বাহ্ বেশ করেছো! এবার হাওয়া খাও"... বললেও অহনা আবার নিজের টিফিন বক্সটা খুলে দিয়ে বলতো..." নে খা একটুখানি,তবে সবটা নয়। আমারও কিন্তু খুব খিদে পেয়েছে সত্যি বলছি।"
ক্লাশ টেন পাশ করে সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছিলো অবশ্য অঙ্কুর সাথে যোগাযোগ ছিলোনা আরো আগের থেকেই। ক্লাস এইটে পড়তে একবার ওরা যখন পুরী যাচ্ছে তখন হঠাৎই দেখা হয়ে গিয়েছিলো ট্রেনে অঙ্কিতদের সাথে দারুণ মজা হয়েছিলো সেবার। ওরাও পুরী যাচ্ছে,তারপর মোটামুটি একসাথেই সীট পড়েছে ট্রেনে এসি টু আর থ্রী তাই সারাটা পথ বকবক করতে করতে যাওয়া। এখনো সেই দিনটার কথা মাঝে মাঝেই মনে হয় অহনার। বাইরের খাবার বাদ দিয়ে ওর মায়ের হাতে বানানো লুচি আলুরদম গপগপ করে খেয়েছিলো পেটুটা।
সেই সময় অবশ্য আন্টি বলেছিলো অহনাকে.." অঙ্কু তোর টিফিন খায় তাইনা রে? কি পাজি বাড়ি থেকেও নিয়ে যাচ্ছে আর তোরটাও খাচ্ছে।"
লজ্জা পেয়েছিলো অহনা," তাতে কি আন্টি,আমার বন্ধুই তো।"
নাইনে উঠে অঙ্কিত হঠাৎই স্কুল ছাড়লো সবাই বললো ওর মায়ের শরীরটা ঠিক ভালো যাচ্ছেনা তাই ওরা মামাবাড়ির কাছে চলে যাচ্ছে।
প্রথম কদিন খুব খারাপ লেগেছে অহনার, ফাঁকা লেগেছে ভীষণ ওর টিফিনে ভাগ বসানোর আর কেউ নেই। তবে একটা সময় মাঝে মাঝেই অঙ্কুর কথা মনে হলেও আবার সব কিছু চলছিলো নিজের নিয়মে।
সেই ভ্যানিশ হয়ে যাওয়া অঙ্কুকে আবার খুঁজে দিলো ফেসবুক। আসলে ফেসবুক অনেকটা সমুদ্রের মতো আদরে ফিরিয়ে দেয় অনেক কিছুই। মানে পুরোনো স্মৃতি,পুরোনো বন্ধু কখনো বা পুরোনো ভালোবাসাকেও।
*******************
তবে অঙ্কিতকে প্রথমে দেখে চিনতেই পারেনি অহনা। ধ্যাৎ কোথায় সেই গোলুমোলু ফর্সা ছেলেটা? যদিও নামটা তো ঠিক আছে স্কুলের নামটাও ঠিক। কিন্তু উরিব্বাস বেশ হ্যান্ডসাম দেখতে হয়েছে এখন। ফর্সা,লম্বা সুন্দর পেটানো চেহারা।আর মোটু অঙ্কু বলা যায়না। তবে সেন্ট কথাটা মাঝে মাঝেই বলে অহনা..প্রথমে মেসেঞ্জারে পিং করার সময়ও বলেছিলো.." হাই সেন্ট!!
ওপাশ থেকে উত্তর এসেছিলো..." এটা হিংসুটি অহনা না? যে টিফিন লুকিয়ে রাখতো।"
অহনা বলেছিলো " কি হ্যান্ডসাম হয়েছিস রে! আগের গোলগাপ্পা সেন্টকে তো খুঁজেই পাওয়া যায়না।"
ওদিক থেকে একটা লাভ ইমোজি দেয় অঙ্কিত আর সাথে লেখা 💟💬
" ইউ টু হিংসুটি...নাউ সুইট,সেক্সি এন্ড প্রেটি।"💌
অহনার গালে টোল পড়েছিলো,একটু লজ্জাও পেয়েছিলো তবুও মজা করে বলেছিলো.." বেসরম,ফ্লার্ট করতে হো মুঝে?"💔
" ঐ সব আমি করিনা,ছবি দেখে যা মনে হলো বললাম।জানিনা আবার কতটা এডিট করছিস।"👅🕶️
" ঐ পাজি এখনো খোঁচামারা কথা বলিস?"😡
সত্যিই তো অহনাও কম কি?একটু শ্যামলা হলেও একদম কাটাকাটা চোখ,নাক,মুখ।
বিশেষ করে চোখদুটো একদম মাথা ঘোরাতে পারে যে কোন ছেলেরই।
মানে যে কোন ছেলেকে বলতেই হবে অবধারিত প্রেমে পড়লে.. 'তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ।
মাসটা অবশ্য যে কোন মাস হলেই চলবে।''
অহনা অঙ্কিতের প্রোফাইল দেখে সিঙ্গেল লেখা.. মনে মনে বলে এত ফলাও করে স্ট্যাটাস দেওয়ার কি আছে শুনি? ঠিক যেন বলছে দেখুন বন্ধুরা আমি সিঙ্গেল আমার সাথে জয়েন্ট আ্যকাউন্ট খুলতে পারেন।
অহনার কথায় কথায় হাসি পায়। সিরিয়াস লাইফের মধ্যে ঐ হাসিটুকুই তো একটু নিখরচায় পাওয়া অক্সিজেন সিলিন্ডার তাই আবার ওর গজদাঁত বার করে আপন মনেই হাসে হি হি। হয়ত ছোটবেলার বন্ধুকে খুঁজে পাওয়ার আনন্দে।
মা কখন ঘরে ঢুকেছিলো বুঝতে পারেনি অহনা।
" এই মেয়েটাকে কি ভূতে ধরলো নাকি? একা একা মোবাইল দেখে হাসছে। ওরে কি হলো?"
" মা এই দেখো,এই সেই ছেলেটা। তোমাকে বলতাম না মা একটা পেটুক ছেলে আমার সব টিফিন খেয়ে যায় আমি খেতে পাইনা।"
" অঙ্কিতের কথা বলছিস?"
" তোমার মনে আছে মা? সেই কবেকার কথা।"
" মনে আছে তো,ওর নালিশ তো প্রতিদিন হতো বাড়িতে।
শেষে আমি মোটামুটি দুজনের এক্সট্রা খাবার দিয়ে পাঠাতাম। ঐটুকু বাচ্চা ছেলেকে কি বলবো শুনি? তুই কিন্তু খুব নালিশকুটি আর ঝগড়ুটে ছিলি তুলি। অবশ্য এখনও কম কি?"
মা... তুমি যে কি বলছো না? আমি ঝগড়া করি?"
" করিস তো,একটা কথা মাটিতে পড়তে পারে নাকি? অবশ্য মেয়েদের একটু তিখা হওয়াই ভালো। মানে একটু ঝাঁঝ থাকলে বেশ লাগে।যেমন আমার ধানি লঙ্কা তুলি।"
বলেই মা আদরে জড়িয়ে ধরে তুলি মানে অহনাকে।
আজকাল ফোনে অনলাইনে গল্পে গল্পে অনেকটা সময় কেটে যায় অহনার পুরোনো বন্ধু সেন্টের সাথে। অনেকটা রাতও কেটে যায় অহনার কথায় কথায়। কলকাতার একটুকরো বারান্দায় বসে আনমনা হয়ে যায় অহনা অঙ্কিতের কথা ভেবে। কত দূরে থাকে ছেলেটা বাড়ি ছেড়ে।ওর কথায় কেমন যেন একটা নষ্টালজিয়া আর কিছু চাপা দুঃখ যা হয়তো বলতে চেয়েও বলতে পারেনা অহনাকে।
অঙ্কিত বিদেশে থাকে,পাশ করার পরই চাকরি পেয়ে কিছুদিন দেশে থেকে একদম বাইরে। মাঝে মাঝেই ছবি পাঠায় অঙ্কিত সবুজে ঢাকা দেশের।কি সুন্দর সাজানো গোছানো ফাঁকা ফাঁকা সব।মাঝে মাঝেই সবুজের গালিচাপাতা আর গাছে ঘেরা মাঠ। ঐ সবুজ মাঠের মাঝের পাতাঝরা পথে মন হারিয়ে যায় অহনার তবুও মনে হয় ইশ্ এখানকার ফুচকা,কবিরাজি,বিরিয়ানি,আলুকাবলি ছেড়ে পেটুটা ওখানে আছেটা কি করে?
তাছাড়া গড়িয়াহাট আর দক্ষিণাপণের শপিং ওখানে কোথায়? ধুৎ হাঁটতে হাঁটতে উইন্ডোশপিংয়ের মজাই তো আলাদা।
অহনার পড়াশোনা এখনো চলছে ওর দৌড় অনেক লম্বা পথের। যখন প্রথম কথা হয়েছে তখন অঙ্কিত বলেছিলো..." বিয়ে হয়ে গেছে তোর হিংসুটি? মানে আর ইউ ম্যারেড?"
" খাও খাও করে ধরেছিলো অহনা,তুই তো চাকরি করিস বিয়ে করেছিস? আমার বিয়ে নিয়ে এত মাথা ব্যথা কেন রে?"
" আমি তো ছেলে,ছেলেদের এত তাড়াতাড়ি বিয়ে হয় নাকি?"
" আমিও তো ডক্টর আর পড়াশোনা করছি,ডক্টরদের এত তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়না।" বলে কলার উঁচু করে অহনা।
" ইশ্ আর কিছু পড়তে পারলিনা! পড়াশোনাতে তো স্কুলে টপাটপ মানে টপ ছিলি।"বলে অঙ্কিত।
" মানে তুই ডক্টর দের মানে এই প্রফেশন পছন্দ করিসন না? দেন কাট্টি তোর সাথে। আমি মানেই ডক্টর আর ডক্টর মানেই অহনা তাই আমার পেশাটাকে না ভালোবাসলে বন্ধুত্ব থাকবে কি করে?"
" রাগ করলি? ধুৎ আমি তা বলেছি নাকি? হিংসুটি তোকে নিয়ে আমার কোন সমস্যা নেই। তুই ডক্টর সেটা তোর ব্যাপার আমার কি?" অঙ্কিতের গলাটা কেমন যেন শোনায়।
" তাহলে বললি কেন আর কিছু পড়লামনা কেন?" অহনা বলে।
অঙ্কিত বুঝতে পারে সিরিয়াস হয়ে গেছে অহনা তাই হাল্কা করতে বলে..." পড়াশোনা শেষ করে রোজগার করতে অনেক সময় লাগবে। মানে তুই বিয়ের আগে বুড়ি হয়ে যাবি।"
" বেশ হবে,আমি তো বিয়েই করবোনা। তাই এত ভাবনা আমার নেই।"..অহনা বলে।
" ওকে..তাহলে নিশ্চিন্ত আমিও বিয়ে করবোনা ভেবেছি। আচ্ছা তুই স্কুলে গেছিস আর কখনো? সেই ফুচকা কাকু আর হজমিগুলি এখনো বসে? "
" পেটুক কোথাকার কথা শুরু করেই খাবার কথা। ইশ্ স্বভাব যায়না কিছুতেই।"
জিভ দিয়ে একটা টক করে আওয়াজ করে অঙ্কিত.."সেই কালো কালো হজমিগুলি আর ঝালঝাল ফুচকা। শোন এবার দেশে গেলে তোর ঐ স্টেথোটা গলা থেকে নামিয়ে রেখে একদম বেশ কয়েকটা দিন আমাকে দিবি। বাট আই ওয়ান্ট দ্যাট হিংসুটি ঝগড়ুটে অহনা। আবার কলকাতা দেখবো ছেলেবেলার অভ্যেসের চোখে দেখবো চেখে পুরোনো স্মৃতি।"
অহনার মন ছুঁয়ে যায় অঙ্কিতের মিষ্টি করে সাজিয়ে কথা বলা। কথার সত্যিই একটা জাদু আছে। ভালো কথা যারা বলতে পারে তারা খুব তাড়াতাড়ি মনকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে হয়ত আলতো আদরে ছুঁতে পারে অনুভূতি গুলোকেও।
" খুব মজা হবে,তুই আয়তো আগে। তারপর চোখে দেখা চেখে দেখা আর ঝালফুচকা মেখে খাওয়া সব হবে।"বলে অহনা
" সর্বনাশ! তুই তো অসাধারণ।" অঙ্কিত বলে ওঠে।
আবার লজ্জা পায় অহনা.." মানেটা কি?"
" মানে অসাধারণ কথা বলিস।"
অঙ্কিতের ওপারের বলা কথা এপারে বসে মন ছুঁয়ে যায় অহনার। কথা আর টুকরো অনুভূতি আবার নিয়ে যায় সেই ছোটবেলার পেটুক অঙ্কিতের মনের খুব কাছাকাছি অহনাকে।
কথা বলাটা আজকাল অভ্যেস হয়ে গেছে দুজনের কখনো ঝগড়া কখনো মিষ্টি স্মৃতির সিঁড়ি বেয়ে তড়তড়িয়ে ছেলেবেলার দিনগুলোতে নামা ওঠা।
কথা না বললে মিস্ করে অহনা অঙ্কিতকে চিন্তা হয় ওর জন্য।আবার অঙ্কিতের একটা ফোন কল অহনাকে নিয়ে যায় ভাসিয়ে অনেক অনেক দূরে। অহনা বুঝতে পারে ছোটবেলার টিফিন নিয়ে কাড়াকাড়ি টা এখন ফোন নিয়ে বাড়াবাড়িতে গিয়ে ঠেকেছে। একদিন ওর মা হাসতে হাসতে বলেছে.." তুলি দেখি আজকাল পাখির মত উড়ছে।মনটা কেমন যেন উড়ু উড়ু রাতে ঘুম নেই। বলি ব্যাপারটা কি? প্রেম ট্রেম করছিস নাকি? আমাকে বলিস বাপু,দেখতে হবে তো সে আমার রাজকন্যাকে ভালো রাখবে কিনা?"
" মা প্রেম করছিনা,শুধুই বন্ধুত্ব আর কিছুনা ও আমার বেস্টফ্রেন্ড মা।ওর সাথে কথা বলতে ভালো লাগে।"
" সেই অত দূরের বন্ধু তোর,কবে দেখা হবে তার তো ঠিক নেই।" মা বলে।
" সেই তো ভালো মা,ফোনে ঝগড়া আড়ি কথা।"
" হ্যাঁ তাই ভালো না হলে হয়ত মারামারি হতো দুটোর সেই ছোটবেলার মত।"
অহনা আবার হেসে গড়ায়। তবে একটু প্রেম যে হচ্ছেনা তা নয়। অহনার ভালো লাগে অঙ্কিতকে,ওকে মিস্ করে। কিন্তু অঙ্কিতটা কেমন যেন মুডি একটু ভারী ভারী কথা বলে মাঝে মাঝে ওকে কেমন যেন অচেনা লাগে অহনার। বুঝতে পারেনা এতো মুডি কেন ছেলেটা। হঠাৎই কথা বলতে বলতে বলে এখন রাখছি রে আজ ভালো লাগছেনা একটু অফ লাগছে।
" অনেকদিন তো আসিসনা বাড়িতে একবার আয় দেশে। আন্টি আঙ্কেল তো তোকে মিস্ করে নাকি?"
" হুঁ যাবো,আসলে আজকাল আর খুব একটা যেতে ভালো লাগেনা। আচ্ছা তোর সাথে কতদিন কথা বলছি বলতো?"
" কতদিন আর মাস দুয়েক হবে। কেন রে?"
" তোকে অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করে মানে একটু হাল্কা হতে ইচ্ছে করে।"
"বলনা কি বলবি?"
আরেকদিন বলবো বলে অঙ্কিত অফ হয়ে যায় মনটা কেমন যেন ভারী লাগে অহনার কি বলতে চায় অঙ্কিত? এত সুন্দর দুষ্টুমিতে ভরা ছেলেটার মনের ভেতরে কি কোন কষ্ট লুকিয়ে আছে যার জন্য ও অন্যমনস্ক হয়ে যায় মাঝে মাঝে?
কি বলতে যায় অঙ্কু ওকে?
সিক্রেট কিছু?
*****************
হসপিটাল থেকে বেড়িয়ে সেদিন গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে আছে অহনা ইশ্ ওদের ড্রাইভার বাচ্চুকাকুর সময়ের কোন ঠিক নেই এখনো পাত্তা নেই।এদিকে টিপটিপ করে বৃষ্টি নেমেছে।হঠাৎই পিঠে একটা দাম করে থাবড়া বসায় কেউ। আর কেউটা যে কে একটু চমকে গেলেও বুঝতে ভুল হয়না অহনার এ নিশ্চয় বুবু।
ঠিক যা ভেবেছে তাই।
অহনা বলে," ওরে দিন দিন তো ছোটখাটো একটা ঐ যাদের কুলোর মত কান তাদের মত হচ্ছিস তার ওপর এই রকম থাপ্পড় খেয়ে তো আমি রোগীদের সেবা করার আগেই নিজেই ওপরে চলে যাবো।"
অহনাকে রাস্তার মধ্যেই যাচ্ছেতাই রকম আদর করে বুবু বললো.." বালাই ষাট,চল চল তোর বাহন এসে গেছে। একটু চাইনিজ খেয়ে বাড়ি যাবো বুঝলি। লিফ্ট প্লিজ।"
ছোট থেকে একরকম রয়ে গেছে বুবু একদম খোলামেলা কোন রাখঢাক নেই।যা প্রয়োজন সেটা আদায় করেই ছাড়ে। ওর সাথে গাড়িতে যেতে যেতেই অহনা উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো অঙ্কিতের কথা..." তোর অঙ্কু পেটুকটাকে মনে আছে? অবশ্য তুইও তো তেমনি ছিলি।"
হাসে বুবু ..."থাকবেনা কেন? আরে ওর মামাবাড়ির পাশেই আমার কাকুরা থাকে। ওর মা নেই জানিস তো? বাবার সাথেও সম্পর্ক খুব একটা ভালোনা শুনেছি।"
অহনার মনটা কেমন যেন বাইরে ঝরে পড়া বৃষ্টির মতো মেঘলা আর কান্নাভেজা হয়ে যায়। বুবু তখনো বকবক করে যাচ্ছে.. মা মারা যাবার পর তো একদম ডিপ্রেসড হয়ে গিয়েছিল। ভীষণ মুডি,তবে ছেলেটা ভালো। কি করবে বল কেন যেন বাবার সাথেও দূরত্ব আছে শুনেছি। তাই হয়ত একেবারে দেশান্তরে চলে গেছে। ওর বন্ধু আর্য তো আমার মিউচুয়াল ফ্রেন্ড বলছিলো এখানে আর কোন টান নেই ওর তাই কি করতে থাকবে?"
বুবুকে এবার থামায় অহনা ওর আর সত্যিই শুনতে ইচ্ছে করছেনা। অঙ্কিতের তাহলে মা নেই আর এই কথাটা তো শেয়ারও করেনি ওর সাথে। শেয়ার করলে কি বা হত? হয়ত বাবার কথা আসতো তাই হয়ত বলেনি। প্রসঙ্গ এড়াতে অহনা বলে..." আজ আর খেতে ইচ্ছে করছেনা রে বৃষ্টিও নেমেছে,চল তোকে নামিয়ে আমি বাড়ি যাই।"
" আমি খাওয়াবো ইয়ার",বুবু বলে।
" সত্যি আজ ইচ্ছে করছেনা আরেকদিন খাবো। মা ভাববে রে,আর এই বৃষ্টিতে আমার মনটা কেমন যেন ভালো লাগেনা।"
" অহনা তুই আবার এতো মুডি হলি কবে থেকে? ডক্টরদের এতো মুডি হতে নেই।" বুবু বলে।
হাসে অহনা,"কেন ডক্টরদের মন থাকেনা বুঝি?"
বুবুকে নামিয়ে গাড়িতে আসতে আসতে সবুজ গাছগুলোর দিকে চোখ যায় অহনার আর মায়ের কথা খুব মনে হয়,আসলে মা তো ওর কাছে এমনই একটা সুন্দর সবুজ গাছ যে আগলে রেখেছে ওকে যত্নে শীতল বাতাস আর ভালো থাকার অক্সিজেন দিয়ে। মাকে ছাড়া তো কিছু ভাবতেই পারেনা ও। মা ছাড়া বাড়ি...আর ভাবতে পারেনা।
বাড়িতে এসেই মায়ের কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে কেঁদে ফেলে আজ হঠাৎই..." মা জানো অঙ্কিতের মা নেই বাবাও নাকি ভালোনা। আমার শুনেই মনটা খুব খারাপ হলো আজ।তোমার কোলে একটু শোবো মা?"
ওর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে মা বলে.. " সে কি রে? কবে হলো? ও কিছু বলেনি তোকে? ইশ্ আমিও তো কত দেখেছি ওর মাকে কথা বলেছি। সেবার ট্রেনে কত গল্প করতে করতে গেলাম।"
কান্না জড়ানো গলায় অহনা বলে.." তুমি ভালো থেকো মা।"
***************
অঙ্কিত কিছু না বললেও অহনার মনের একটা নিভৃত কোণে আশ্রয় পেলো যত্নে মায়ের ভালোবাসা হারানো একটা ছেলে যার বাবাও হয়তো ওকে আর তেমন চায়না। জানেনা কি সমস্যা তবুও বোঝে ছেলেটার মনে একটা চাপা কষ্ট।
" তুলি আমাকে একদিন ফোন দিবি কোন বিদেশ বিভূয়ে থাকে মা হারা ছেলেটা একটু কথা বলবো। সত্যিই তোর কাছে শুনে মনটা খারাপ হয়েছে খুব।"
" মা ও তো আমাকে ওর ব্যক্তিগত জীবনের কথা কিছু বলেনি তাই আমিও ওকে কিছু বলবোনা এমনি যেমন কথা বলি বলবো। তোমার সাথে কোনদিন যদি ও নিজে কথা বলতে চায় তখন দেবো।"
অহনা বড় হয়েছে তাই অনেক কিছুই বুঝতে পারে আর জানেও কেউ কিছু না বলতে চাইলে অযথা কৌতূহল দেখানো উচিত নয়।
অহনার অবকাশে আর অঙ্কিতের সময়ের ফাঁকে এক হয়ে যায় দেশ বিদেশের দুটো আকাশ মুখোমুখি বসে কথা বলে নিজেরা কখনো ঝগড়া করে ছেলেবেলার মতো। ছোটবেলায় অহনা টিফিনবক্স খুলে দিতো এখন খুলে দেয় ওর হাসির ঝাঁপি আর কথার ঝুলি। ওদেশে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে স্বপ্ন দেখে অঙ্কিত কলকাতায় অহনাকে নিয়ে কাটানো এক সুন্দর বিকেলের অথবা কোন সোনালী ভোরের।
হয়তো বা বুঝতে পারে মনে মনে মা না থাকলেও কেউ একজন আছে যার সাথে বেশিক্ষণ কথা না বলতে পারলে ওর মুড অফ হয়। অনেক সময় খুব রেগে যায় অহনার ওপর," এই জন্যই বলেছিলাম টপাটপ হয়েও কেন ডাক্তারী পড়তে গেলি। কোথায় ছিলি আজ সারাদিন?"
অহনার অনেকটা সময় লেগে যায় রাগ ভাঙাতে,শেষে বলে ওঠে..." এই রে এতো রাগ তোর! সর্বনাশ।"
তাই সর্বনাশই বটে,একদম অবধারিতভাবে অহনার প্রেমে পড়লো অঙ্কিত। অহনাকে সকাল সাঁঝে না দেখলে আজকাল ভুখা ভুখা লাগে অঙ্কিতের।
সেই হিংসুকুটি অহনা,ইশ্ ভাবেই নি কখনো ওর প্রেমে হাবুডুবু খেতে হবে। অঙ্কিতের জীবনের শুকনো মরুভূমিতে যেন মিষ্টি জলের ধারা অহনা।
কিন্তু মুশকিল হয়েছে এখনো বলতে পারেনি ওকে কিছু। অহনা তো বিয়েই করবেনা বলেছে। ওকে যদি ফিরিয়ে দেয়? না করে পাঠায়? অত চাপ নিতে পারবেনা,তার চেয়ে থাক প্রেম মনে মনে সংগোপনে।
" হিংসুটি শোন আমি একবার তোর সাথে দেখা করতে চাই। দেখবো তুই কত বড় হয়েছিস? এখনো সব ভাগ করে নিতে পারবি কিনা? "
অহনার বুকের ভেতরের পেন্ডুলামটা দ্রুতলয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকে তবুও একটু দুষ্টুমি করে এবার অহনা.....
" এখনো আমি হিংসুকুটি আর ঝগড়াটি তবে ভাগ করে নিতে পারি সব এখনো। তোর মনটা যেমন এখানে বসেই ভাগ করে নিয়েছি আমার মনের সাথে।"
বাইরের দিকে তাকিয়ে মনটা কেমন যেন উড়ে যায় অঙ্কিতের দূরে চার্চে কোথাও ঘন্টা বাজছে রবিবার অনেকেই যায় প্রে করতে। অঙ্কিতও মনে মনে বলে কবে থেকে সব কিছুই একা নিতে শিখে গেছে,দুঃখ সুখ কখনো বা কান্না। আজ হঠাৎই ঝগড়ুটে অহনা মনের ভাগ চাইছে। কে জানে দিতে পারবে কি না?"
অহনা হেসে বলে.." কি রে পেটু কিছু বলছিসনা কেন?"
" না রে ভাবছিলাম তোর সাথে দেখা করতেই এবার সো করে উড়ে দেশে যাবো।"
মনটা উড়ে যায় অহনারও মেঘের পালকে ভর করে। অঙ্কিতের সাথে আবার পুরোনো পথে হাঁটা,অনেক গল্প আর অল্প প্রেম।
*****************
মাঝে কেটে গেছে বেশ কয়েকটা মাস। কলকাতার রাস্তায় তখন কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়ার কানাকানি। ইডেনগার্ডেনের কাছের পলাশ ফুলের গাছটা ফুলে ফুলে রাঙা। অহনাদের বাড়ির উল্টোদিকের বড় গাছটা থেকে মাঝেমধ্যেই কোকিল ডাকছে কুউ কুউ কুউ..অহনার পাশে রাখা এফএমে মৃদুস্বরে বাজছে বাতাসে বহিছে প্রেম নয়নে লেগেছে নেশা ...বসন্ত এসে গেছে।
মনটা উড়ে যায় স্বপ্নের বসন্তের সুদূর মুলুকে অহনার।
একটা আননোন নম্বর থেকে ফোন আসে ধরতে ইচ্ছে করেনা অহনার, মুডটা এমনিতেই অফ দুদিন ধরে অঙ্কিতের সাথে কথা হয়না। কি কাজে নাকি খুব ব্যস্ত। আবার রিঙ হয়।
ধ্যুৎ এই সকালে আবার কে! গানটা শুনে একটু মনটা ভালো করছিলো। বিরক্ত হয়ে ধরে অহনা....ওদিক থেকে সোজাসুজি আক্রমণ
" ফোনটা ধরছিসনা কেন? এখনো ঘুমোচ্ছিস নাকি? অনেকটা সকাল হয়ে গেছে তো?
উঠে পড় তাড়াতাড়ি এসে গেছি আমি খুব কাছাকাছি।"
চট করে কোন কথার উত্তর না দিয়ে আগেই লাফায় অহনা.." তুই এখানে? আই কান্ট বিলিভ।"
" হ্যাঁ আমি এখানে,সেই সুদূর জার্মানী থেকে একদম বন্ধুত্বের টানে। দুটো দিন একটু ব্যস্ত থাকবো তারপর একদম ফ্রী এরমধ্যে তোর কাজগুলোও সেরে নে। আমার সাথে ঘুরতে হবে তো কলকাতার অলিগলি হেঁটে হেঁটে। আজকাল আর গরম সহ্য হয়না তবে দেখলাম বেশ আদুরে ওয়েদার আছে আর কলকাতাও সুন্দর হয়েছে আগের থেকে।"
টুকরো কথায় আর ভাবনায় কেটে গেছে দুটো দিন। মনে মনে অহনা বুনেছে কল্পনার জাল প্রথম দেখায় কি বলবে,কেমন লাগবে? কোথায় কোথায় ঘুরবে?
মেসেজ করেছে ছেলেটা দেখা করার জন্য। ওর সাথেই কাটাবে আজ সারাটা দিন অহনা। মনটা অদ্ভুত একটা আনন্দে পাখা মেলেছে কতদিন পর দেখা।ফোনে কথা বলা আর সামনাসামনি কথা বলা নিশ্চয় খুব মজা হবে।
তবে মাকে না বলে কোন কাজই করেনা অহনা মা শুনেই বললো, "আমাদের বাড়িতে আসতে বল,ও তো খেতে ভালোবাসে বাড়িতে মা নেই আমি একটু নিজের মত করে খাওয়াতে পারতাম। তা না কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াবি এই রোদ্দুরে?"
অহনা হা হা করে হাসে.." ওটাই তো কথা ছিলো মা আবার স্কুলের গেটের সামনে যাবে ফুচকা খাবে,হজমিগুলির শিশিতে লোভ দেবে। আর জমিয়ে ঝগড়া হবে। আচ্ছা আমি বলবো আসতে ওকে।"
দুধসাদা লঙগাউন পরে হাতে সাদা ব্যাগ নিয়ে যখন অহনা নামলো গাড়ি থেকে তখন অঙ্কিত যেন ঠিক মেলাতে পারলোনা। বাবা ঐ গুড়গুড়িটা তো বেশ লম্বা হয়ে গেছে একদম। ছবিতে অতটা বোঝা যায়নি...পাশে দাঁড়িয়ে একটু দেখে নেয় নাহ্ ঠিক আছে ওকে ছাড়ায়নি।
" ইশ্ এতো একদম ওয়েডিং ড্রেসে এসেছিস মনে হচ্ছে। তোর হাত ধরে স্কুলের গেটের সামনে যাবার কথা তো। হজমিগুলি খাবো,ফুচকা চাখবো।"
গম্ভীর গলায় অহনা বলে," আজ নয় বৎস সে সব কাল হবে। আজ একটা নিরিবিলি জায়গায় গিয়ে বসবো,খাবো আর জমিয়ে গল্প করবো। কাল একদম ফ্রক পরে এসে স্কুলের গেটের সামনে দাঁড়াবো।"
দুজনেই হেসে ফেলে এবার।
কত কথা কত গল্পে সময় কাটতে লাগলো একটা খুশির হালকা হাওয়ায় ছুঁয়ে গেলো মনটা। ছোটবেলার গল্প শুরু হলে থামতেই চায়না।
কথা বলতে বলতে হঠাৎই সিরিয়াস হয়ে যায় অঙ্কিত...
" তোকে এবার একটা সিরিয়াস কথা বলবো,ভালো করে ভাববি ভেবে বলবি কিন্তু।"
অঙ্কিতের কথা শুনে গালদুটো একটু লাল হয় অহনার। একদম কি মুখোমুখি প্রপোজ করবে এখানে এইভাবে? বুকের ভেতরটা একটু কাঁপলো অহনার। প্রথম ভালোবাসার আবেশে মনটা বড় ভেজা ভেজা আজ পুরোনো বন্ধুর সামনে বসে।
মুখোমুখি বসেছে ওরা,অঙ্কিতের দিকে বারবারই চোখ চলে যাচ্ছে অহনার। দেখে মনে হয় মুখটা সেই ছোটবেলার মতই রয়ে গেছে ভুখা ভুখা কিন্তু তেমন কিছুই খেলোনা।
কদিন বাড়িতে নাকি খুব খাচ্ছে এসে থেকেই তাই আর ভালো লাগছেনা।
ওকে চুপ করে থাকতে দেখে অহনাই বললো.." কি বলবি বললিনা তো?"
একটু ইতস্ততঃ করে অঙ্কিত। ঠিক যেন বলতে পারছেনা কোথাও একটা সঙ্কোচ তবুও বলে..." আমার মা নেই জানিস অহনা,আসলে তোকে বলাই হয়নি মানে পারিনি বলতে। যদিও অনেকবারই বলতে চেয়েছি। "
অঙ্কিতের চোখটা ভেজা,অহনা ওর হাতে হাত রাখে..." মায়েরা সব সময় থাকে আমাদের সাথে।নিজেকে একলা ভাবিসনা কখনো।"
অঙ্কিত মাথাটা নিচু করে বলতে থাকে.." আসলে আমিও চলে গেলাম এখানে থাকতে কেমন পাগল পাগল লাগতো। আর বাবাও একদম একা হয়ে গেছে তাই ভাবছি বাবাকে বিয়ে দেবো।"
অহনার মুখ থেকে হঠাৎই বেরিয়ে আসে..."হোয়াট?"
*******************
" তুই অবাক হলি?
হয়ত এই জরুরী কথাটাই আমার বলার ছিলো তোকে।
আসলে আমার তো মনের কথা বলার মত কেউ নেই।
তুই ভেবে বলতো বাবার একা থাকাটা কি ঠিক? তার থেকে একটা বিয়ে করে নেওয়া ভালো নয় কি?
আমি ঠিক বলিনি?
অহনা কি বলবে? ও ভেবেছিলো শহর থেকে একটু নিরিবিলি একান্তে আজ হয়ত অঙ্কিত ওকে সামনা সামনি বলবে অহনা তোকে ভালোবাসি খুব আমি ভীষণ একা আমার মনের দোসর হবি? এতো ভালো করে গুছিয়ে না বললেও আ্যটলিস্ট আই লাভ ইউ। সেখানে বাবার বিয়ের কথা! কেমন যেন সবটা এলোমেলো হয়ে যায় অহনার।
তবুও মুখে হাসি রেখে বলে..." আঙ্কেল জানেন? মানে রাজি আছেন বিয়ের ব্যাপারে?"
হঠাৎই অঙ্কিতের মুখটা রাগী রাগী হয়ে যায়.. "রাজি আছেন মানে রাজি হতেই হবে,ঐ মহিলার সাথে উনি গল্প করবেন..মহিলা আমাদের বাড়িতে এসে আমার জন্য রান্না করে রেখে যাবেন আমি যা যা ভালোবাসি। আমার ওয়ার্ডোবে শার্ট কিনে রেখে যাবেন। বাবার চেকআপ করবেন তাহলে বিয়ে করতে কি প্রবলেম আছে? আসেপাশের মানুষই বা কি বলছে?"
" আমার মনে হয় তুই খোলাখুলি কথা বল আঙ্কেলের সাথে। ওনারা বন্ধুও তো হতে পারেন,আর আঙ্কেলকে চেকআপ করেন মাঝে বুঝলাম না। হু ইজ সি?"
" সেই মহিলা যাকে রাধিকা মাসি বলে জানতাম একটা সময় এখন আর কিছু ডাকতে ভালো লাগেনা জাস্ট।"
" দাঁড়া দাঁড়া তুই ডক্টর রাধিকা রয়ের কথা বলছিস নাকি? কার্ডিওলোজিস্ট?"
" আমি অত খবর রাখিনা,বাট সি ইজ ডক্টর আ্যন্ড আমার বাবার বান্ধবী,মাও ওকে চিনতো। মাকে দেখতো,তবে আমার তো মনে হয় ওনার ভুল চিকিৎসায় মানে ইনটেনশনালি মাকে শেষ করেছে।"
অহনার সব যেন কেমন তালগোল পাকিয়ে যায়। কিছু ভাবতে পারেনা হঠাৎই।প্রেম পাওয়া ভাবটা যেন কর্পূরের মত উবে গেছে। এ সমস্ত কি বলছে অঙ্কিত ডক্টর রাধিকা রয় মানে ওদের ম্যামের সম্বন্ধে?
একটু থেমে অহনা বলে.." অঙ্কিত জাস্ট কুল ডাউন। উনি আমাদের ম্যাম আমি ওনাকে চিনি ভীষণ ভালো তোর কোথাও ভুল হচ্ছে। আর উনি তো আনম্যারেড।"
রেগে যায় অঙ্কিত.." আনম্যারেড না পরকীয়া করে প্রেমে হাবুডুবু খান!"
" অঙ্কু মাইন্ড ইয়োর লাঙ্গুয়েজ,উনি তোমার মায়ের বয়েসী একজন ভদ্রমহিলা। তাছাড়া উনি তো শুনেছি কৃষ্ণের সাথে মালাবদল করেছেন। কৃষ্ণকেই নিজের স্বামী বলে মানেন। আমার যদিও শোনা পুরোটাই।"
" সবটাই সাজানো ফেক,জানিস ঐ লেডিকে নিয়ে বাবা আমার কাছে জার্মানি পর্যন্ত গেছে। সে যে কি অসহ্য কি বলবো। ওনার নাকি সেমিনার ছিলো আর তার সাথে বাবাও চলে গেলো লাফিয়ে আমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে বলে। কদিন ওনার হাতে রান্না করা খাবার আমাকে খেতে হলো।"
এতদিন যে কথাগুলো অহনাকে বলতে পারেনি অঙ্কিত শুধু ফোনে ফোনে মিঠে শৈশবের কথাই বলেছে আজ হঠাৎই অহনাকে একটা অদ্ভুত বাস্তবের সামনে এনে দাঁড় করালো অঙ্কিত।
" তুই মাথা ঠান্ডা কর প্লিজ,ওদের জীবন ওদের মত চলতে দে তুই তো এখানে থাকিসনা।হয়ত আসবিও না আর কোনদিন দেন তোর প্রবলেম কি? আর আঙ্কেলের সঙ্গে কথা বল।"
" এই বাড়ি,রান্নাঘর,আলমারি সব আমার মায়ের হাতে সাজানো ওখানে উনি আসবেন কেন? মাকেও একদিন বলতে শুনেছি মারা যাওয়ার আগে..'তুই এখানে আসিসনা রাধিকা।'
অহনা বুঝতে পারে এই সমস্যার শিকড় অনেক গভীরে। হয়তো শুধু শুনে যাওয়া ছাড়া ওর আর কিছুই করার নেই।আর শক্ত হাতে ছেলেবেলার বন্ধুর ঘাড়ে হাত দিয়ে বলা..আছি সাথে মাথা ঠান্ডা রাখ,এতো উতলা হোসনা সব ঠিক হয়ে যাবে।
" আজ বাড়িতে যা ঠান্ডা মাথায় তুই আঙ্কেলের সাথে কথা বল যে উনি তোদের বাড়ি আসেন সেটা তোর ভালো লাগেনা। আর এইযে ভুখারাম কাল কিন্তু আমরা যাচ্ছি হজমিগুলির সন্ধানে স্কুলের গেটের কাছে। মনে থাকবে তো? চল এখন ফিরি। মা চিন্তা করবে।"
অহনা বাড়ি ফিরে আসে অস্থির মন নিয়ে,কিছু যেন ভালো লাগেনা।বারবার মনে হয় অঙ্কিতের কথা। একবার মনে হয় ও ঠিক করছেনা ফালতু মাথা গরম করছে আরেকবার মনে হয় ওর নিজের বাড়িতে যদি মায়ের জায়গায় কেউ আসে,তাহলে হয়তো ওরও রাগ হতো ভীষণ।
ফিরে এসে একটা টেক্সট হয়েছিলো তারপর আর তেমন কথা হয়নি কে জানে ছেলেটা কি করছে বাড়িতে? হয়ত একলা ঘরে একলা মনে বসে আছে।
***************
বাবার ডাকে রাতে খাবার টেবিলে গিয়ে বসে অঙ্কিত একটা সময় এই টেবিলে কত গল্প হতো,হাসিতে আড্ডায় জমে যেতো ওরা। রাধিকা রায়ও অনেকদিন খেয়েছে ওদের বাড়িতে, তখন খারাপ লাগতোনা অঙ্কিতের।
বাবা খাবার বাড়ছে...ও একটু বাধা দিতে যায়," তুমি টেবিলে রেখে দাও সব আমি নিয়ে নেবো। তুমি বসে যাও খেতে। ওখানে তো একাই খাই।"
বাবা ওর ঘাড়ে হাত রাখে.." যতদিন আমি আছি ততদিন তুই বারণ করলেও দেবো। তারপর বৌ এলে দেবে।"
রাগ হয় অঙ্কিতের " কার বৌ?"
" কার আবার? তোর।"
অহনা বলে দিয়েছে রাতে কিছু মাথা গরম না করতে এমনিতেই আজ অনেক কথা হয়েছে তাই কিছু বলেনা অঙ্কিত।
বাবা বাটি করে করে গুছিয়ে দিচ্ছে,মা এভাবেই দিতো।আর ও খুশি হত দেখে।
" এত রান্না তুমি করেছো?"
" তোর ফেভারিট ইলিশমাছ আর পাবদা মাছ।মাটনটা কাল খাস রাতে দিলামনা। নে খেয়ে নে তো আগে।"
অঙ্কিত বুঝতে পারে বাবা ওকে এড়িয়ে গেলো তাই আবার জিজ্ঞেস করে..."কিছু বললে না তো? কে করেছে?"
" এক কথা বারবার জিজ্ঞেস করিস কেন অঙ্কু রাধিকা পাঠিয়েছে সব ড্রাইভারকে দিয়ে।"
মনটা তিতকুটে হয়ে যায় অঙ্কিতের হয়ত বাবা ঠিক বলেছে জানে সবটাই তবুও জিজ্ঞেস করে... কেন?
কোনরকমে খেয়ে উঠে যায়,জানে ও না খেলে বাবারও খাওয়া হবেনা। অঙ্কিত বুঝতে পারে গতবার ওর ওখানে যখন গেছিলো বাবা তখন ওর খারাপ ব্যবহারে নিশ্চয় ভদ্রমহিলা শকড হয়েছিলেন তাই এরমধ্যে আসেননি।
বাবার খাবার দাবার মাঝে মাঝেই আসে উনার বাড়ি থেকে জানে অঙ্কিত।
অহনা ফোন করছে...ছোটখাটো টুকটাক কথা বলে কাল দেখা হবে বলে শুয়ে পড়ে অঙ্কিত যদিও ঘুম আসতে দেরি হয় মায়ের কথা খুব মনে হয় মনে মনে বলে.. তুমি এতো তাড়াতাড়ি চলে গেলে তাই সব এলোমেলো হয়ে গেলো।
অহনারও মনে আজ অদ্ভুত ওঠানামা বুঝতে পারেনা অঙ্কিতের মনটা কোথায়? ও কি করতে চায়? কেন এলো হঠাৎ। তবে শুধু মনে হলো অঙ্কিত ওকে ভরসা করতে পেরেছে তাই হয়ত মন উজাড় করে বলে ফেলেছে সবটা।
তবুও অহনা ভাবলো প্রেমটা মিসিং হলেও বন্ধুত্বের ভালোবাসাটা যেন থাকে। বালিশে মুখ ডোবায় অহনা।ঘুম নেমে আসে বালিশের নরম আদরে।
***************
পরেরদিন ওর অফ ডে তাই সুবিধাই হয়েছিলো। সকালে একবার পিং করে অঙ্কিতকে কে জানে আজ আবার মুড কেমন আছে মহারাজের। কোন উত্তর না পেয়ে বারান্দায় গিয়ে বসে কফি হাতে বুঝতে পারে হয়ত এখনও ঘুমোচ্ছে। একটু বাদেই ভিডিও কল আসে ফোনটা ধরে অহনা....ফোনটাতে ভেসে ওঠে ছাদবাগানের একটা ছবি। কি সুন্দর ফুলের গাছ! বসন্তের আদর পেয়ে রঙিন হয়ে ছাদে মাথা নাড়ছে। অঙ্কিতের মুখটা দেখতে পায় মুখটা হাসিহাসি..." দেখেছিস রুফগার্ডেন আমাদের?"
" দেখলাম তো মনটা খুব ভালো আর রঙে ভরে উঠলো।"
অঙ্কিত বলে " আমারও তাই মায়ের খুব শখ ছিলো গাছের অনেক অনেক দিন বাদে ছাদে উঠেছিলাম কুয়াশা মাখা মন নিয়ে উঠে মনটা ভালো হয়ে গেলো মায়ের ছোঁয়া পেলাম। যাক্ বাবা বাগানটা অন্ততঃ করেছে আবার।"
" খুব ভালো রাখে মনকে এই সবুজের ছোঁয়া জানিস।কতটা সময় কেটে যায় ওদের সাথে কথা বলে। আঙ্কেল খুব ভালো করেছেন। ভীষণ সুন্দর বাগানটা একদম রঙিন প্যাস্টেল। আসছিস তো আজ ঐ সময়ে?"
" হুঁ একদম আসবো।"
অহনার সাথে ভিডিও কলে কথা বলতে বলতে খেয়ালই করেনি অঙ্কিত বাবাকে। বাবা কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
বাবাকে দেখে ফোনটা রেখে দেয় অঙ্কিত।
" বাগানটা ভালো হয়েছে রে? কতদিন বাদে তুই ছাদে উঠলি।তোকে ঘরে না দেখে আমিও চলে এলাম। এবার আমার কাজে লেগে পড়ি।"
আপন মনে কথাগুলো বলে যাচ্ছে বাবা,মাঝে মাঝে আদরে হাত বোলাচ্ছে গাছগুলোর গায়ে মাটি আলগা করে দিচ্ছে। এক কোণে শিউলি গাছটা এখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে অঙ্কিতের মনে হয় শেষের দিকে সিঁড়ি ভাঙলেই মায়ের খুব শ্বাসকষ্ট হত তখন ওকেই ছোট প্লাস্টিকের ঝুড়িটা দিয়ে বলতো..." অঙ্কু যা তো শিউলি ফুল কয়েকটা নিয়ে আয় আজ তো মহালয়া মায়ের পায়ে দেবো।"
বাবা এসে ওর কাঁধে হাত রাখে.." তোর মায়ের খুব প্রিয় ছিলো এই গাছটা আসলে গ্ৰামে বড় হয়েছে তো ছেলেবেলায় তাই আমাদের দেশের বাড়ি থেকে এনেছিলো গাছটা। খুব খুশি হত ফুল ফুটলে,শরতের সন্ধ্যেয় আর সকালে কত এসে দাঁড়িয়েছে ছাদে ফুলের সুবাস পেতে।"
কেন যেন মায়ের এই স্মৃতিচারণ বাবা মন থেকেই করছে বলে মনে হলো ওর। গতবার জার্মানিতে ঐ ভদ্রমহিলার সাথে একসাথে যাওয়াটা ভুলতে চায় অঙ্কিত। তাই বললো..." সত্যিই বাগানটা খুব সুন্দর হয়েছে আমি তো ভাবলাম সব গাছই বোধহয় মরে গেছে এতোদিনে,মায়ের সাথে সাথে ওরাও গেছে।"
কথা পাল্টায় বাবা," কার সাথে কথা বলছিলি তোর বন্ধু? এখানেই থাকে?"
উত্তর দেবেনা ভেবেও উত্তর দেয় অঙ্কিত বাবাও বুঝুক ওরও কোন বন্ধু আছে যার সাথে ইউরোপে না গেলেও কলকাতার রাস্তায় ঘুরতে পারে।
" হ্যাঁ আমার স্কুলের বন্ধু অহনা।"
" বাহ্ খুব ভালো,কি করছে এখন?"
অহনা ডক্টর শুনেই মুখটা বেশ হাসিতে ভরে যায় বাবার তা কোন কলেজে আছে? কলেজের কথা শুনে যেন আরো অভিভূত হয়ে উঠলো।
" ওখানে তো রাধিকা আছে,নিশ্চয় চিনবে রাধিকাকে।রাধিকা তো এইচ ও ডি শুনেছি।"
" আমি জানিনা আমার অত মাথা ব্যথা নেই তোমার রাধিকাকে নিয়ে। আমি বেরোবো একটু বাদেই ফিরতে রাত্রি হবে।"
বাবার মুখটাতে একটু হাসির রেখা দেখা যায়..." অঙ্কু রাধিকা তোর মায়ের আর আমার কমন ফ্রেন্ড তুই মাসি বলতিস। আমার রাধিকা এসব আবার কি কথা? কার সাথে যাচ্ছিস অহনার সাথে?"
" হ্যাঁ। তোমার সাথে কিছু কথা আছে আমার রাতে বলবো।"
ছেলের কথায় খুব মনটা ভারী হয়ে যায় শান্তনুর মা চলে যাওয়ার পর ওর হাসিখুশি মুখটা যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। ছেলেটাকে ইচ্ছে করে একটু কাছে পেতে অথচ কাছে আসেনা রুক্ষ ব্যবহার করে ফোন করলে টুকটাক কথা বলে ছেড়ে দেয়। ওর সমস্যা রাধিকাকে নিয়ে বুঝতে পারে শান্তনু।কিন্তু রাধিকা তো ওদের সেই স্কুলের বন্ধু।গ্ৰামের স্কুলে একসাথে পড়তো ওরা মানে মায়া,রাধিকা আর শান্তনু। শেষের দিকে অঙ্কিতের মা মায়াও সহ্য করতে পারতোনা রাধিকাকে। ভুগে ভুগে কেমন যেন খিটখিটে হয়ে গেছিলো,সন্দেহ করতো রাধিকাকে।ওষুধ খেতে চাইতোনা। হয়ত ছেলের মনে কোনভাবে ঢুকেছে কথাগুলো।
সব মানুষের তো একটা বন্ধু দরকার হয় যে সুখ দুঃখের সঙ্গী হবে আর হয়ত রাধিকা তেমনি বন্ধু ছোটবেলার বন্ধুত্ব সত্যিই খুব মিঠে হয় কখনো বা ঝালঝাল তাই রাধিকা যখন ওর অনেক কাজের মধ্যে যখন ফোন করে রিপোর্ট দেখে বলে.." কি শুরু করেছিস? একা বাড়িতে থেকে কি রসগোল্লা খাচ্ছিস পেটপুরে? এত সুগার বাড়লো কি করে? কাল থেকে হাঁটা বাড়াবি।
আর হ্যাঁ ইকোটা করাস নি এখনো?"
রাধিকার টুকরো কথাগুলো ছুঁয়ে যায় শান্তনুর মনকে।মনে হয় একলা হয়ে যাওয়া জীবনে অন্ততঃ ওর ভালো থাকা খারাপ থাকা কাউকে ভাবায়। আজকাল শান্তনুর মনে হয় হয়ত জীবনে তার আর কোন প্রয়োজন নেই। কই ছেলেটাও ভালোবাসেনা একটা ভালো কথাও বলেনা। জানতে চায়না শরীরের কথা।
তবুও জীবনকে ভালোবাসে শান্তনু তাই মাঝে মাঝে এদিক ওদিক চলে যায় একটু ঘুরে আসে। রাধিকা সব সময় যেতে পারেনা ওর কাজ ফেলে তবে অনেক সময় ও টিকিট কেটে বুকিং করে সবটাই দেয় ওর আ্যসিসট্যান্টকে দিয়ে।
বলে..." মায়া থাকতে তো কত ঘুরে বেড়াতিস যা ঘুরে আয় মন ভালো থাকবে। সারাদিন কাজের মধ্যে থাক ভালো থাকবি।"
মাঝে মাঝে ওদের পুরোনো বন্ধুদের আড্ডাতেও চলে যায়।এইভাবে কাটছে সময়। মাঝে মাঝে মনে হয় ভাগ্যিস রাধিকা ডাক্তার তাই হয়তো এক্সট্রা সুবিধা অনেকটাই পায় শান্তনু বন্ধুত্বের সুবাদে।
*********************
যাবার আগে বাবাকে বলে চলে যায় অঙ্কিত,ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকে শান্তনু। ছোটবেলা থেকেই এইভাবে ওর মা বা শান্তনু এসে দাঁড়াতো বাইরে অঙ্কিত পেছন ফিরে হাত নাড়তো।
আজ অঙ্কিত বেশ কিছুটা এগিয়ে গিয়ে হঠাৎই পেছনে ফেরে দেখে বাবা বাইরে দাঁড়িয়ে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই হাতটা উঠে যায়। বাবার মুখে একঝলক হাসি হাত নাড়ে বাবা। মনটা ভরে যায় শান্তনুর ঐ একটুতেই,ছেলেটা ভোলেনি তাহলে।
আজ আর বাচ্চুকাকুকে আনেনি অহনা নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে এসেছে। মা যদিও বকছিলো তবুও একদম হিরোগিরি করে ফেলেছে।অহনার পরনে আজ স্কাইব্লু জিন্স আর লাল শার্ট চোখে সানগ্লাস মাথার কুচোনো অবাধ্য চুলগুলোকে আজ বাধ্য করেছে লাল ব্যান্ডের বাঁধনে।
অঙ্কিতকে গাড়িতে তুলে নেয় অহনা প্রথমেই গুটিগুটি নয় মানে হুস করে গাড়ি চালিয়ে একদম স্কুলের কাছে। অঙ্কিত বলে.." কত পাল্টে গেছি বল একটা সময় পিঠে ব্যাগ নিয়ে বাস থেকে নেমে দৌড়ে স্কুলে ঢুকতাম লাইন ভাঙার জন্য বকুনি খেতাম আর আজ গাড়িতে। তাও চালাচ্ছে ডঃ অহনা।"
তখন প্রায় টিফিনের সময় হয়ে আসছে ওরা জানে স্কুল থেকে বেরোনো যায়না। তাই ছুটির আগে দিয়ে ফুচকাওয়ালা একটু সাইড করে ওয়েট করে।
..." কিছুই পাল্টায়নি দেখেছিস,সেই চেনা মাঠ স্কুল আর দূরে ক্লাসরুম।" বলে অহনা।
" পাশে বন্ধু বসে হিংসুটি,
হয়েছি এখন দুজনেই বড় এখন
আর নই সেই ছোট্টটি।"অঙ্কিত বলে অহনার হাতে হাত রেখে। তারপর হুস হাস করে ঝালঝাল ফুচকা খেয়ে হজমিগুলি মুখে দিয়ে স্মৃতির সরণী বেয়ে কিছু টুকরো কথা বলা। আজ দুপুরে ওরা বাইরেই খাবে। অঙ্কিত আগেই বলেছিলো.." আজকাল খুব বেশি ঝাল খেতে পারিনা,চাইনিজ খাবো বুঝলি।একটা রেস্টোরেন্ট আছে ওখানে মা বাবার সাথে আসতাম ভীষণ ভালো চাইনিজ বানায়।"
অহনা শুনেছে নাম তবে আজই প্রথম এলো অঙ্কিতের সাথে। তখন একদমই ফাঁকা ওরা খাবার অর্ডার দিয়ে কথা বলতে থাকে।
অহনাই শুরু করে..." যাবার সময় আঙ্কেলের জন্য একটা পার্সেল নিয়ে যাস। ওনার ভালো লাগবে নিশ্চয় পুরোনো কথা মনে হবে।"
কথাটা অঙ্কিতেরও মনে হয়েছিলো তবে অহনা বলেছে তাই নিতেই হবে তবুও বলে..." বাবার খাবারের অত চিন্তা নেই আছেনা রাধিকা উনিই পাঠিয়ে দেন ভালো মন্দ বন্ধুর জন্য। ইভেন আমার জন্যও আসে। মোটামুটি জানে এতোদিন আসা যাওয়া করে আমি কি ভালোবাসি।বিরক্ত লাগছিলো কাল আমার মনে হচ্ছিলো না খেয়ে উঠে যাই।''অঙ্কিতের ফর্সা মুখটা লাল হয়ে যায়।
অহনা ওর হাতে হাত রাখে..." অঙ্কু জাস্ট কুল,কেউ ভালোবেসে কিছু দিলে অমন করতে নেই।তোর তো খাওয়া নিয়ে কথা।
ম্যামকে কেন তুই এরকম ভাবছিস জানিনা।কোনদিন তেমন কিছু শুনিনি।
লিভ ইট এবার বল কেন এসেছিস?"
" এই চীনে খাবারের গন্ধ নিতে,তোর সাথে হাতে হাত রেখে ঘুরতে,একান্তে বসে গল্প করতে আর দেখতে হিংসুটি কি সত্যিই সুইট,প্রেটি এন্ড সেক্সি?"
অহনা লজ্জা পায়,একটু হাসে.." শুধু বাজে বকা আর উল্টোপাল্টা কথা। কেমন যেন রাগু ম্যান হয়ে গেছিস।"
" তোর হাতটা একবার দে এদিকে?"অঙ্কিত বলে। ওর দু চোখভরা দুষ্টুমি।
অহনা হাতটা বাড়িয়ে দেয় অঙ্কিত একটা খুব সুন্দর ঘড়ি ওর হাতে পরিয়ে দেয়। আর একটা বড় চকোলেট দেয় পকেট থেকে।
" ইশ্ এগুলো আবার কেন?"
" আর বলিসনা কালই দেবো একদম ভুলে গেছি তোকে দেখে। পরিস প্লিজ ঘড়িটা এরপর তুই জার্মানি গেলে তোকে নিয়ে কু কু ক্লক দেখতে যাবো। আসলে অনেক টিফিন খেয়েছি তোর একসময়।"
"অঙ্কু এবার মারবো কিন্তু তাই শোধ দিচ্ছিস। "
" না আমাকে ভুলে যাবি তো তাই দিয়ে গেলাম। এটা পরলে আমাকে মনে হবে।"
চুপ করে যায় অহনা মনে মনে ভাবে ভুলে গেলে হয়তো এভাবে খুঁজতোনা সোশ্যাল সাইটে। কিছুই বোঝেনা হয়ত অঙ্কিত।
" এই রাগ করলি?খুব ভালো মানিয়েছে কিন্তু তোকে।" অঙ্কিত বলে।
কথা বলতে আর খাবার খেতে অনেকটা সময় কেটে যায়। " তোকে মা বলেছে আমাদের বাড়ি যেতে কাল রাতে আসবি? ডিনারে? কাল আমাকে কিন্তু কলেজে যেতেই হবে। বিকেলে ফ্রী হয়ে যাবো। আসবি কাল বাড়িতে?"
" আচ্ছা আমি জানিয়ে দেবো। কাল সকালের মধ্যেই।"
*******************
বাড়িতে ফিরে বাবার হাতে খাবারটা দেয় অঙ্কিত। নামটা দেখে বাবার মুখটা কেমন ঝলমল করে ওঠে..." ওহ্ ওখানে খেতে গেছিলি তুই? একটা সময় আমাদের আ্যনিভার্সারি থেকে তোর জন্মদিন সব অনুষ্ঠানের ডেস্টিনেশন একটাই ছিলো। অনেকদিন যাইনি ওখানে।"
" কেন তোমার বান্ধবীকে নিয়ে তো যেতে পারো মাঝেমাঝে।"
অঙ্কিতের কথার খোঁচাটা মনে বিঁধলেও ওর বাবা বলে..." কিছু স্মৃতি তুলে রাখতে হয় যত্নে। তা তোর বন্ধু অহনা যায়নি?"
" হ্যাঁ ওর সাথেই গিয়েছিলাম। তুমি এটা খেয়ে নিয়ো আর রাতে আমি কিছু খাবোনা একটু কফি আমি করে নেবো রাতের দিকে।"
বাবার খাবার সময় টেবিলে এসে দাঁড়ায় অঙ্কিত কেজানে খাবারটা গরম করলো কিনা? স্পেশালি এই ডিশটা বাবা খুব ভালোবাসতো ওখানকার ও জানে।
" তুই আমার সাথে বসে একটু খেতে পারতিস,একা তো সবদিন খাই।"
বাবার মুখে যেন কিছু ফিরে পাওয়ার একটা আনন্দের হাসি। অহনাটা সত্যিই ভালো মেয়ে ছোট থেকেই খুব কেয়ারিং স্কুলে সবসময় বেশি টিফিন আনতো। ওকে একটা থ্যাঙ্কস দিতে হবে বুদ্ধি দেওয়ার জন্য।
ছেলে আসাতে রাধিকার সঙ্গে ভালো করে কথা হয়নি যদিও প্রতিদিন একটু বেশি রাতে ফোন করে রাধিকা। গতকালও করেছিলো জিজ্ঞেস করছিলো ছেলের মাছ পছন্দ হয়েছে কিনা? আজ মনটা বেশ খুশি খুশি লাগে শান্তনুর হয়তো বাবা মায়েরা একটু মিঠে ছোঁয়া সন্তানদের কাছ থেকে পেলেই খুশি হয়। আর কিই বা চাইবে হয়ত একটু সুখানুভূতি ছাড়া।
রাধিকাকে ফোন করে..." আজ অঙ্কু চাইনিজ নিয়ে এসেছিলো।কেন যেন মনে হলো আজ খুশি আছে ছেলেটা। অঙ্কু মনে হয় প্রেম করছে বুঝলি।"
ওপাশ থেকে রাধিকা হাসে," তাই কি করে বুঝলি? আর শোন ছেলে এসেছে বলে হাপুশ হুপুশ করে ভালোমন্দ খাসনা সুগার বাড়বে।"
" ধুর ছাড়তো,সব সময় ডাক্তারি। আরে সকালে ভিডিও কলে কথা বলছিলো মেয়েটার নাম জিজ্ঞেস করলাম বললো অহনা শুনলাম ডাক্তার তোর কলেজেই পড়ছে। চিনিস?"
বাইরে জল খেতে এসে অঙ্কিত বুঝতে পারে বাবা ফোনে কথা বলছে।ঘড়ির দিকে তাকায় প্রায় বারোটার দিকে কাঁটা। বাহ্ বেশ ভালো!প্রেম মানুষকে চঞ্চল করে তোলে হয়তো বা ভালোও রাখে তাই ওর মতো বাবার চোখেও ঘুম নেই। অসহ্য লাগে ওর, মায়ের ছবির দিকে তাকিয়ে অঙ্কিতের মনে হয় কেন যে মা চলে গেলো। নিজের ঘরে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দেয়। অহনাকে মেসেজ করে যাবে কালকে খুশিতে একটা লাভ ইমোজি পাঠায় অহনা।
****************
সকাল থেকেই ছোটাছুটি শুরু হয়ে যায় অহনার তার মধ্যে মাকে বলে দেওয়া অঙ্কিত ডিনার করবে। মা অভয় দেয় কোন চিন্তা নেই বাবাকে বাজারে পাঠিয়ে সব আনিয়ে নেবে।
" মা একটু হাল্কা করে কোরো সব ও ঝাল খায় কম আর তোমার স্পেশাল ফ্রাইটা রেখো কিন্তু।আমার ফিরতে বিকেল হয়ে যাবে আজ কিন্তু আউটডোর আছে।"
সকালে অঙ্কিতকে টুকটাক মেসেজ করে একদম কুল আর ফ্রী থাকতে বলে হসপিটালে চলে আসে।আউটডোর শেষ করে রাউন্ড দিচ্ছে হঠাৎই ফাইনাল ইয়ারের একজন পিজিটি এসে বলে.." তুই অহনা? তোকে একবার আমাদের এইচ ও ডি ডেকেছেন দেখা করিস। তবে কাজ হয়ে গেলে যেতে বলেছেন।"
বুকের ভেতরটা কেমন যেন টিপটিপ করে অহনার ম্যামকে যতটা না চিনতো এই কদিন অঙ্কিত চিনিয়ে দিয়েছে অনেকটা। ম্যামের ভালো চরিত্রটা এখন অঙ্কিতের বর্ণনায় অনেকটাই সন্দেহের অহনার কাছে।
যদিও অহনা জানে ভালোবাসা এক অপ্রতিরোধ্য ঢেউয়ের মতো যে কোন বয়েসেই হয়ত আসতে পারে তা একাকীত্বের হাত ধরে। অঙ্কিত শুধু মায়ের কথা ভাবছে। এটা বুঝতে চাইছেনা উনি তো চলে গেছেন,আঙ্কেল এখন একদম একা অত বড় বাড়িতে। তাই আঙ্কেলের তো মেন্টাল সাপোর্ট দরকার।
আবার এটাও ঠিক এই বয়েসের একটা ছেলের পক্ষে বাবার সম্পর্ক মেনে নেওয়াও খুব মুশকিল।
রাউন্ড দিতে দিতে একটু টেনশন হয় অহনার। তবুও যেতেই হবে ওকে।
কি জানি কেন ডাকছেন?
হয়তো এমনিতেই, তাছাড়া উনি কি করে জানবেন অহনা অঙ্কিতের বন্ধু।
কাজের ব্যাপারে কিছু বলবেননা তো?
মনে মনে প্রশ্নমালা সাজায় অহনা।
*****************
"মে আই কাম ইন ম্যাম।"
" ইয়েস প্লিজ সিট ডাউন।"
মুখ না তুলেই বলেন ম্যাম।
অহনা না বসে দাঁড়িয়ে থাকে।
ভদ্রমহিলাকে দেখতে খুব একটা ভালো নয় তবে মাথা ভর্তি চুল আর বড় বড় বুদ্ধিদীপ্ত চোখ।খুব বেশিক্ষণ এ চোখের দিকে তাকিয়ে থাকা যায়না। আগেও দেখেছে ভীষণ ব্যক্তিত্ব ওনার।
একটু বাদে মুখ তুলে বলেন..." বলো কি বলবে?"
অবাক হয় অহনা নিজেই ডেকে বলছে কি বলবে!
" আ্যকচুয়ালি ম্যাম আপনি আমায় ডেকে পাঠিয়েছিলেন তাই এলাম।
কিছু বলবেন?"
" হ্যাঁ একটু দরকার ছিলো তুমি তো পিজিটা ফার্স্ট ইয়ার তাইনা? এখন মোটামুটি নতুন কেস কিছু এলে ভালো করে স্টাডি করে নোট কোরো আর একটা আ্যসাইনমেন্ট রেডি করে রেখো আমি পরে সব বলে দেবো ইন ডিটেইলস।"
ওকে টুকটাক আরো কিছু কথা বলে যেতে বলেন ম্যাম।
হাঁফ ছেড়ে বাঁচে অহনা।
এই প্রথম হঠাৎই উনি ডাকলেন অবশ্য এই কলেজে তো দুমাস আগেই এসেছে এম ডি করতে।
অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ভদ্রমহিলার আর খুবই ভদ্র। কেন যে অঙ্কিত এত ক্ষিপ্ত ওনার ওপর কে জানে?
ম্যাম যে ডেকেছিলেন সে ব্যাপারে অঙ্কিতকে কিছু বলবেনা ভেবে নেয় অহনা তাহলে হয়তো আজ সন্ধ্যাবেলার মুডটাই অফ হয়ে যাবে ওর।তাছাড়া এটা তো ওদের কলেজের ব্যাপার। সব জানার ওর কি দরকার?
কলেজ থেকে ফেরার সময় একগোছা গোলাপ কিনে আনে অহনা।
যত্নে সাজিয়ে রাখে গোলাপগুলো টেবিলের ওপর। ঘরটা বেশ সুন্দর হেসে ওঠে লাল গোলাপের ছোঁয়ায়। রান্নাঘরে মায়ের রান্নার মিষ্টি গন্ধ মাতিয়ে রেখেছে বাড়ি।
বাবা বোধহয় ঠাকুরঘরে ধুনো দিয়েছে ধুনোর গন্ধে সারা বাড়িতে একটা পবিত্রতার ছোঁয়া অহনা জামাকাপড় ছেড়ে হাল্কা হয়।
চায়ে চুমুক দিয়ে শরীরটা ভালো লাগে...অঙ্কিতকে আগেই জানিয়েছে ও চলে এসেছে তাই একদম তাড়াতাড়ি চলে আসতে।
******************
বাবাকে আগেই বলে রেখেছিলো রাতে খাবেনা ফিরতেও হয়ত একটু দেরি হবে।
"বন্ধুদের সাথে প্রোগ্ৰাম নাকি? তাড়াতাড়ি ফিরিস খুব দেরি করিসনা।" বাবা বলে।
গতকাল রাত্রে রাত জেগে ফোন করাতে বাবার ওপর খুব রাগ হচ্ছিলো কেন যেন অঙ্কিতের। তবুও সামলে নিয়ে বলে..." হ্যাঁ অহনাদের বাড়ি যাবো। চলে আসবো খাওয়াদাওয়া হয়ে গেলেই।"
অঙ্কিত চলে যাওয়ার পর দরজাটা বন্ধ করে ওপরে উঠে আসতেই ফোনটা বাজে।
"
Comments
Post a Comment