Skip to main content

আলোর দিশা

#আলোর_দিশা#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#

"মা,কালকে স্কুলে দিদিমণি ডেকেছে। চলে যেয়ো কিন্তু,আজকেই কাজের বাড়িতে বলে রেখো।"
"ওমা তুই এখন বলছিস!দু একদিন আগে বলবি তো?"
    একটু ঝাঁঝিয়ে ওঠে পুতুল," আমার অত মনে ছিলোনা,দিদিমণি ডাইরিতে লিখে দিয়েছিলো বটে কিন্তু তুমি তো আবার পড়তে পারোনা। তোমাকে দেখিয়েই বা কি হত শুনি? এখন মনে পড়লো বলে দিলাম।"
   " দেখি ওবেলা গিয়ে বলতে হবে বাবুর বাড়িতে তারা আবার কি বলবে কে জানে?"
  "কি আবার বলবে?বলে দিয়ো একটু দেরি করে যাবে আবার কি?যেয়ো না হলে আমাকে ক্লাস করতে দেবেনা।"
             পুতুলের স্কুলে গিয়ে এদিক ওদিক উঁকি মারে সন্ধ‍্যা। কত দিদিমুণি সব বসে আছে কে জানে ওদের কেলাসের কথা কে বলবে?মেয়েটাই বা কোথায় গেলো কে জানে!
      পুতুল বলেছে গতবারের দিদিমুণি নয় এবার নতুন কেলাসে নতুন দিদিমুণি,সে নাকি নতুন এসেছে সবে কয় মাস হলো। ভয়ে ভয়ে এদিক ওদিক তাকায় সন্ধ‍্যা,অন‍্য সময় মোটেই স্কুলের কাছে আসেনা। মেয়ে বস্তির মেয়েদের সাথেই স্কুলে যায়।
      " কাকে খুঁজছেন আপনি?কার গার্জেন?মেয়ে কোন ক্লাসে পড়ে?"
     "দিদিমুণি,গতবার ছয় ক্লাসে ছিলো। ঐ যে পুতুল,আমি ওর মা।"
    "ঐ যে দিদিমণিকে দেখছেন আপনি ওখানে চলে যান।"
     যাক রক্ষা মেয়েটা এসে গেছে,ও সাথে করেই নিয়ে গেলো।
        নতুন দিদিমুণি খুবই কড়া খুব চ‍্যাটাং চ‍্যাটাং কথাও বলে। মেয়ের সম্বন্ধে তো একগাদা নালিশ করলো পড়ায় মন দেয়না,পাকা পাকা কথা বলে,ক্লাশে আড্ডা মারে। লেখা দিলে লেখেনা আরও কত কি।
    " দিদি আসলে আমি তো সারাদিন লোকের বাড়ি কাজ করি,একলা ঘরে শুধু আড্ডা মারে। অবশ‍্য রান্নাও করে ও স্কুল থেকে গিয়ে।"
    " তাতে কি তাই বলে পড়াশোনা করবেনা? মূর্খ হয়ে থাকলে কি করে হবে?"
  চমকে ওঠে সন্ধ‍্যা,এই মূর্খ কথাটা যে কতবার ওর এইট পাশ করা বরের কাছে শুনেছে তার ঠিক নেই,এমনিতে বলে মূর্খ মেয়েছেলে। আর মদ খেয়ে যখন পশুর মত শরীরে চড়াও হয়ে পেটায় তখন ওটা মাগীতে পরিণত হয়। চোখের সামনে আসলে অনেক কিছুই দেখে মেয়েটা আজকাল ও বলে,"পড়াশোনা জানোনা আবার বলো পড় পড়। তুমি কি বোঝো পড়ার?"
    এই প্রশ্নের কোন জবাব নেই সন্ধ‍্যার কাছে। তাই চোখের জল মুছে বলে," ওদের জন‍্য এত কষ্ট করতিছি দিদিমুণি। মারবেন,খুব মারবেন।"
   " বাহ্!আপনার মেয়েকে আমি মারবো?জানেন এইসব এখন বন্ধ হয়ে গেছে? এরপর আমি গিয়ে কাঠগড়ায় দাঁড়াবো নাকি? মারতে হবে কেনো,আপনি একটু বোঝালেই পুতুল বুঝবে আর আমরা তো আছিই।"
     সন্ধ‍্যার গলার কাছে ডেলা পাকায় কান্না আর কিছু কথা। সবটা বলতে পারেনা।
  " আচ্ছা নিন,এখানে সই করুন।''
এদিক ওদিক তাকায় সন্ধ‍্যা,মেয়েকে ইশারা করে।
" দিদিমুণি আমি সই পারিনা,ঐ কালিটা থাকলে দিননা টিপ দিবো।"
      পুতুলের দিকে কটমট করে তাকায় ওদের দিদিমণি," একি পুতুল মা সই করতে পারেননা কেন? তুমি শেখাওনি? তোমাদের বলেছি না কমপক্ষে একজনকে সাক্ষর করবে তোমরা। না না তাহলে বাবাকে নিয়ে আসবে। আমি কিছুতেই টিপ সই আ্যলাউ করবোনা। তাছাড়া তোমার বাবাই তো গার্জেন।
     সন্ধ‍্যার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরে," ওর বাবা বাড়ি থাকেনা দিদি,অনেক রাতে ফেরে। আমাকে আর ওকে মেরে রাখবেনা। এমনিতেই মূর্খ বলে এরপরে...."
      পরেরটা বোধহয় আর বুঝিয়ে বলতে হলোনা নতুন দিদিমণিকে। " আচ্ছা আসুন এবারের জন‍্যই শুধু তবে এরপরের মিটিংয়ে কিন্তু নয়। পুতুল তোমার দায়িত্ব রইলো,নাহলে কিন্তু সত‍্যিই বাবা আসবে পরের বার।"
           স্কুল থেকে বেড়িয়ে দমটা ছাড়ে সন্ধ‍্যা পড়াশোনা কি বড় কথা! ধুস্ এই বয়েসে এইসব আবার হয় নাকি?তবুও পড়াশোনাকে ভালোবাসে সন্ধ‍্যা তাইতো পুতুল আর পুলককে ভর্তি করেছে স্কুলে, লেখাপড়া শিখে ওরা বড়মানুষ হবে। ওর মতো ঝি নয়। কিন্তু এখন কি হবে কড়া দিদিমুণি তো আর ওকে টিপ দিতে দেবেনা বলেছে।
           পুতুলের মাথাতেও চিন্তা ঢোকে মাঝে মাত্র তিনটে মাস এর মধ‍্যে কি করে মাকে সই করাতে শেখাবে? কিন্তু আর যদি ঢুকতে না দেয় স্কুলে ওকে,তাহলে কি হবে?
       মেয়ের মাথায় হাত রাখে সন্ধ‍্যা," আমি চেষ্টা করবো রে পুতুল। তুই স্লেটে লিখে দিবি আর আমি দেখে দেখে লিখবো।"
                  মাঝে কেটে গেছে তিনটে মাস। পুতুল এখন পড়াশোনা করে,এই পরীক্ষায় বেশ ভালো ফল করেছে। মনটা ভালো হয় মেধার,ওর বলাতে কাজ হয়েছে বেশ কিছুটা।
      মাথা নিচু করে রেজাল্টগুলো দেখছিলো মেধা। " দিদিমণি মা এসেছে।"
       আজ সন্ধ‍্যা বেশ গুছোনো,পরনে একটা নতুন ছাপা শাড়ি। কাজের বাড়ি থেকে ছুটি নিয়েছে আজ। মেয়ের রেজাল্টটা হাতে নেয়,খুঁজতে থাকে। না কোন লাল কালির দাগ নেই কোথাও। দিদিমুণি আজকে ভালো করে কথা বলছে,খুশির ছোঁয়া লেগেছে পুতুলের গালে।
  "দেখেছেন,বলেছিলাম না পুতুল পারবে। এবার অনেক ভালো করেছে। এর পরের পরীক্ষায় আরও ভালো করবে।"
       এদিক ওদিক তাকায় সন্ধ‍্যা,পারবে তো? এবার তো দিদিমুণি হাতে কলমটা ধরিয়ে দেবে।
  ইশারা করে পুতুল,মায়ের হাতে কলমটা দেয়। শক্ত হাতে ধরে সন্ধ‍্যা একটু কাঁপে হাতটা যদিও কাল অনেকবার লিখেছে হাসে মেধাও," কই সইটা করুন এবার।" কাঁপা কাঁপা হাতে সন্ধ‍্যা লেখে সন্ধ‍্যা দাস। উজ্জ্বল হয়ে ওঠে আরও দুটো মুখ সন্ধ্যার শিক্ষার আলোয়।
        মেধা বলে," শুধু সই না,আপনাকে পড়তে শিখতে হবে মুছে ফেলতে হবে সব অপমান। পুতুল আমাকে সব বলেছে। কেন পড়াশোনা জানেননা বলে সবার পায়ের তলায় থাকেন বলুন তো?মুছে যাক আপনার অশিক্ষার অন্ধকার।
        কাজের বাড়ির হেনাবৌদিদের এনজিওতে তাই তো বলে। না সত‍্যিই শুধু সই নয় ওকে পড়তে শিখতে হবে হিসেব বুঝতে হবে। সব হিসেব।
               মাঝে কেটে গেছে কয়েকটা মাস। কাল রাতে বরের অত‍্যাচারে সকালে বিছানা থেকে উঠতে পারেনি সন্ধ‍্যা,পুতুলেরও যাওয়া হয়নি স্কুলে। ভাইকে জড়িয়ে ঘুমের ভান করে ভয়ে চোখ বুজেছিলো। এতো অত‍্যাচার মা কি করে সহ‍্য করে! কেন বাবাকে তাড়িয়ে দেয়না। মারধোর খায় নিত‍্যদিন,সবশেষে বাবা মায়ের মুখে চাপা দিয়ে,উঃ ভগবান! অন্ধকারে সবটা বোঝে পুতুল,ওর গায়ে কাঁটা দেয়।
        হয়ত সন্ধ‍্যার মত নিরক্ষর কতশত বৌ একচিলতে সিঁদুর আর শাঁখাপলার জন‍্য পরে থাকে নিত‍্য শরীর আর মনের ধর্ষণ সহ‍্য করে।
                    লড়াই করতে করতে সন্ধ‍্যার পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে। সেদিন ওর বর এনেছে অনেকটা মাংস। মাংসের গন্ধে ভরপুর ওদের ছোট খুপরি ঘরটা। খাওয়ার পর সন্ধ‍্যার দিকে কাগজটা এগিয়ে দেয় সুভাষ," আর কোন খারাপ কাজ করবোনা বুঝলি। দেশের সব সম্পত্তি তোর নামে করে দেবো।নে সইটা কর চট করে।আজ মনটা খুব ভালো।"
           সুভাষের কাছ থেকে কাগজটা নেয় সন্ধ‍্যা।
" কি দেখছিস এত?তোর মত মূর্খ মেয়েমানুষের মাথায় এত কিছু ঢুকবেনা। সইটা কর।"
             পেছন থেকে ততক্ষণে আঁশবটিটা হাতে তুলে নিয়েছে সন্ধ‍্যা। " তুই আমাকে কি ডিভোর্স দিবি? আমিই তোকে ছাড়বো,তবে আমার চরিত্র খারাপ এই বদনাম নিয়ে নয়। চরিত্র তোর খারাপ, অন‍্য মেয়েছেলের কাছে তুই যাস।"
            সন্ধ‍্যার এমন মূর্তি বোধহয় সুভাষ এর আগে দেখেনি,অনেকক্ষণ ফ‍্যালফ‍্যাল করে তাকিয়ে থাকে। শিক্ষার জ‍্যোতি আর তেজে এ এক অন‍্য সন্ধ‍্যা যে দেবী দুর্গার মত করতে পারে অসুর নিধন।
সমাপ্ত:-

         

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...