#নই_দশভুজা#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
বাবা মাংসটা মুখে দিতেই এক মুখ লজ্জা নিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছিলো মিষ্টি। আজ প্রথম মাংস রাঁধলো,কি জানি কি রেজাল্ট হবে?
এক মুখ আত্মতৃপ্তির হাসি হেসে বাবা বলতেন,"নয়না,মেয়ে তো আমার পুরো পাকা রাঁধুনি হয়ে গেছে গো।"
খুশির হাজার বাতি জ্বলে উঠতো মিষ্টির মুখে,"সত্যি বলছো বাবা?তাহলে আমাকে কত নম্বর দেবে বলো?"
"দশে দশ,তবে আমার হাতে আরো নম্বর থাকলে তোকে আরো ঢালাও নম্বর দিতাম।"
ছোট থেকেই বাবা মায়ের কাছে দশে দশ পাওয়া মিষ্টির বিয়ে হলো সম্বন্ধ দেখেই। ঘটি বাড়ির বাটি মিষ্টি এসে পড়লো একদম বাঙাল বাড়িতে। আসলে মিষ্টির বাবা ঘটি আর মা বাঙাল তাই ও সব মিলিয়ে বাটি।
শ্বশুরবাড়ির লোকের সামনে মোটামুটি তিনবার ইন্টারভিউ দিয়ে মিষ্টি ফাইনালি সিলেকটেড হয়েছিলো। প্রথমে নাকি একটু কানাকানি হয়েছে ওর কালো রঙ আর বাটি মানে বিশুদ্ধ বাঙালআনায় মিশেল এই সব নিয়ে তবে পরে সবটাই ধুয়ে মুছে গিয়েছিলো শ্বশুরমশায়ের দূরদর্শিতায়। ভেবে দেখেছিলেন,স্বচ্ছল পরিবারের একমাত্র মেয়ে,শিক্ষিতা বয়সটাও কম।সব মিলিয়ে ঠিকঠাক আছে।
পানপাতায় মুখ ঢেকে বাবার লক্ষ্মীমন্ত,আদুরে আর পয়া মিষ্টি সাতপাকে ঘুরে,সিঁদুরদানের চোদ্দপাক একদম সফলতার সাথে অতিক্রম করে দুধে আলতায় পা ডুবিয়ে লালপাড়ের কোড়া শাড়িতে পা রেখে এলো শ্বশুরবাড়িতে।
বৌ দেখতে পাড়া প্রতিবেশীরা ভিড় করেছে প্রথমেই শুনলো..তোমাদের বৌয়ের রঙটা চাপা কিন্তু মুখটা বেশ মিষ্টি। এ বাড়ির তরফ থেকে উত্তর দিলো," হ্যাঁ, বোঝোই তো ছেলের আর ওর বাবার ভালো লেগেছে। পড়াশোনা জানা মেয়ে তাই আর কি।"
ওর বাবা বলতেন,"আমার মেয়ের মুখে তো আমি দুর্গা মাকেই দেখতে পাই। অমনই নিটোল গড়ন আমার মিষ্টির।"
মা বলতেন," ঠাকুরের সাথে কেউ মেয়ের তুলনা করে নাকি?"
"মেয়েরা তো মায়েরই অংশ,কখনো রণচন্ডী,কখনো জয়া,কখনো দুর্গা আবার কখনো কালী।"
এই বলে মায়ের দিকে তাকিয়ে হাসতেন,মায়ের রাগী হাসিমুখের ইশারাটা বুঝতো মিষ্টি।
শ্বশুরবাড়িতে এসেই প্রথমেই মিষ্টির নম্বর কাটা গেলো ওর চাপা রঙের জন্য। মানে ঐ ফর্সা ছেলের পাশে টেনেটুনে পাঁচ বা চার নম্বর দেওয়া যায়।
বরাবর পরীক্ষায় প্রথম হওয়া মিষ্টির নম্বর কমতে লাগলো। ননদ বোঝালো," বৌদি শোনো,এই হাতের নখটখ আর চলবেনা।সব্জি কাটবে,রাঁধবে। একসময় দেখবে ভীষণ অসুবিধা হচ্ছে।"
মিষ্টি তখন বেগুন আর ডাঁটা কেটে জলে চোবাচ্ছিলো। " শোনো ওগুলো অতক্ষণ জলে রেখোনা,বেগুন কালো হয়ে যাবে আর ডাঁটাগুলোও খারাপ হয়ে যাবে।"
মাঝে মাঝে ভালোমন্দ দুএকটা পদ রাঁধতে পারা মিষ্টির ট্রেনিং শুরু হয়েছিলো অনেকের হাতে। যে যেমন পারতো জ্ঞান দিয়ে যেতো। এটা এমন করতে হয় ওটা তেমন। সাতদিনের মাথায় যখন মাছের কালিয়া রাঁধলো মায়ের পদ্ধতিতে তখন বেশ পরীক্ষা পরীক্ষা ভাব। " এমা! মাছে আবার টম্যাটো দিতেছে। ঘটিরা সবেতেই টম্যাটো খায় শুনছি। কি আর রান্না ওদের,ওই তো বিউলির ডাল আর পোস্ত।"
শুকনো মুখে মিষ্টি বলেছিলো," মা করে এমনি,খুব ভালো দেখতে আর খেতে হয়।"
পরে উত্তর পাওয়া গেছিলো," মন্দ হয় নাই,তবে এ বাড়ির ছোট মেয়ে বা বড় মেয়ের কাছে শিখে নিয়ো ভবিষ্যতে কাজে লাগবে।"
বরাবর প্রথম হওয়া মিষ্টি এখানেও সেই টেনেটুনে পাশ। তবে মন খারাপ হলেও হাল ছাড়েনি মিষ্টি,পত্রিকার পেছনের রান্না, কখনো পুরোনো সানন্দার রান্না বা বাড়িতে ননদদের দেখে চেষ্টা করেছিলো এ বাড়ির মত হতে।
তাই বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই মা দুর্গার দশহাতে অস্ত্রের মত একহাতে সাঁড়াশি, আরেক হাতে খুন্তি..যাহ্ হাত তো দুটো বাদবাকিগুলো ধরবে কোন হাতে?আরে বাবা পাকা গিন্নির খেতাব পেতে লড়ে গিয়েছিল দুই হাতেই দশহাতের কাজ করতে। একদিকে উনুনে ভাত ফুটছে,ওদিকে ডালসেদ্ধ হচ্ছে। তারমধ্যেই টুক করে মাছ ভাজা বসে গেলো। তারমধ্যেই আটা মেখে টিফিনের রুটি করার ফাঁকেই ছ্যাঁক ছোক করে ডাল ফোড়ন হয়ে গেলো। হয়ে গেলো ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ করে সব্জি কাটা। তারপর দুই হাতে শতকাজ সেরে বরকে অফিসের ভাত টিফিন গুছিয়ে একটু নিরালায় কাছে দাঁড়ানো ছোট্ট একটু আদরের ভরসায়, বা যদি বাড়তি দুএকটা নম্বর পায়।
মানে খুশি হয়ে একটু বলা," আমার মিষ্টি বৌটা,কত ঘেমে গেছে। সকাল থেকে ছুটোছুটি করে। একটু আদর করে দিই।"
আদরটা জুটে যেতো মাঝে মাঝে তবে ভালো কথা জুটতোনা। কিছু পুরুষ মানুষ বিশ্বাস করে বৌকে ভালো বললে হয়ত মাথায় চড়ে বসবে বা নিজের ইগো বা পৌরুষে লাগবে। মিষ্টির বরটা তেমনি কিছুটা। এমনিতে খারাপ নয়।
বাবার আর মায়ের খুব খারাপ লাগলো," ঠিক আছে, সবাইকে খুশি করার জন্য লড়াই করছিস বেশ। কিন্তু তোর স্বপ্নগুলো?"
মিষ্টির অদৃশ্য আটটা হাত আবার হাতাখুন্তির সাথে বইখাতা সঙ্গী করে জুটিয়ে ফেলে একটা চাকরি। শ্বশুরবাড়িতে মৃদু কথা শুনেছিলো,কোন আত্মীয়মহলে..আমরা বাপু বৌকে চাকরি করতে দিইনি। মিঠে হাসিতে মুখটা ভরিয়ে মিষ্টি বলেছিলো, "চাকরি কি আর সবাই পায়?"
চাকরি সংসার আর দুই সন্তানের বড় হওয়ার সাথে সাথে কবে যে ওর মন আর স্বপ্নগুলো প্রাপ্তবয়স্ক থেকে পরিণত হয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি। এর মাঝেই ছেলেমেয়েদের সম্বন্ধে অভিযোগের প্রথমেই উঠে এসেছে তোমার ছেলে অথবা তোমার মেয়ে। আবার ভালো কাজ করলে আমাদের বংশের ছেলে মেয়ে। শ্বশুরবাড়ি সামলানোর সাথে মা বাবার কথা,স্বামী সন্তানের কথা ভাবতে ভাবতে একটা সময় মিষ্টির মনে হয় সত্যিই বোধহয় আমরা মেয়েরা কোথায় যেন দ্বিভুজা হয়েও দশভুজা বা কোথাও বা আরো বেশি।
..." মা আমার জামাটা একটু আয়রন করে দাওনা।".."মা খুব খিদে পেয়েছে,খাবার দাও।" তার মাঝেই বর বলে," শোন কাল ফেরার পথে ব্যাঙ্কের কাজটা করে সম্ভব হলে একবার ইলেকট্রিকের দোকানটা ঘুরে এসো। তারমধ্যেই মনে পড়ে কিছু বাজারও করতে হবে।
হাসিমুখে সবটা সামলাতে সামলাতে সত্যিই আজকাল মাঝে মাঝে খুব ক্লান্ত লাগে মিষ্টির। হয়ত বা একটু আদর বা যত্নের জন্য মনটা তৃষ্ণার্ত হয়ে ওঠে,সত্যিই বাবার মত কেউই বলার নেই মেয়েটা আমার সবদিক সামলায় দশহাতে।
সংসারের আসল মানুষটা মাঝে মাঝে এত কৃপণ হয়ে যায় কেন কে জানে? একদিন ছেলের এক বন্ধু জিজ্ঞেস করেছিলো ওর স্বামীকে.."আঙ্কেল কিছু বলো আজ আন্টিকে,আজ তোমাদের বিশেষ দিনে.."
হাসিভরা মুখে স্বামীর দিকে তাকিয়েছিলো মিষ্টি..দশভুজা না হয়েও দশকাজে থেকে আশা করেছিলো আজ নিশ্চয় পুরো নম্বর পাবে প্রিয় মানুষটার কাছে। নিজের হাতদুটো জড়ো করে ওর স্বামী বলেছিলো,কি আর বলবো। বিয়ে মানেই স্বাধীনতা হারানো। জিজ্ঞাসা করে বোকা বনে গিয়েছিলো বন্ধুটি। হঠাৎই হাসিখুশির পরিবেশটা একটু বদলে গিয়েছিলো অভিমানের বাষ্পে ভেজা দু এক ফোঁটা শিশিরের বিন্দু জমেছিলো মিষ্টির কাজলে মাখা চোখের কোলেও।
হেসে নিজের চোখটাকে একটু বকে দেয় মিষ্টি সত্যিই চোখটা ছেলেমানুষই রয়ে গেলো। দশকাজে থাকাটাই জরুরী, ফলের আশা করতে নেই। হঠাৎই কানে আসে ছেলে বলছে," মায়েদের কথা আলাদা করে কি বলবো। সব মায়ের মত আমার মা। সবার দিকে নজর দেয়,সবাইকে ভালোবাসে। সবার পরে খায়।" বন্ধুটি হেসে বললো," আর কিছু?"
"আসলে মা ছোট শব্দটার মধ্যে লুকিয়ে আছে এতো বড় বড় কথা,আর কাজ যেটা বোধহয় সত্যি বলা যায়না।"
ওরা বলে উঠেছিলো..আমাদের মা সবচেয়ে ভালো আর মা সব পারে।
শরতের ভোরের আকাশে নীল মেঘের মেলা,বাতাসে শিউলির গন্ধ। বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে পাশের বাড়ির সবে বড় হওয়া গাছটা থেকে শিউলির গন্ধ পেলো মিষ্টি। একটু পরেই ও স্কুলে বেরোবে,ভোরের ঠান্ডা বাতাসের শীতলতা মনটা ছুঁয়ে যাচ্ছে।
এফ এমে গান হচ্ছে শিশিরে শিশিরে শারদ আকাশে ভোরের আগমনী। আর কয়েকদিন বাদেই তো মহালয়া। গতবার মহালয়ার দুদিন বাদে ওর মা চলে গিয়েছিল চিরদিনের মত ওকে ছেড়ে বাবার কাছে অনন্তলোকে। প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে যখন কুমোরটুলি থেকে মৃণ্ময়ী মায়ের আগমন তখন ও হারিয়েছিলো ওর চিণ্ময়ী মাকে।
আর কদিন বাদেই মায়ের বাৎসরিক, ঠিক মহালয়ার পরেই। দশকাজের মধ্যে মনকে ভালো রেখে একমাত্র সন্তানের কর্তব্যটাও করতে হবে ওকে।
কখন যে ওর স্বামী উঠে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতেই পারেনি। হাতটা ওর হাতে রাখে..এইটুকুই অনেক। মনে হয় পাশে আছে।
এবার মাকে অন্যরূপে দেখবে মিষ্টি,চিন্ময়ী মা আর মৃণ্ময়ী মা যেন কোথায় একাকার হয়ে গেছে। হাতজোড় করে বলবে,
" দ্বিভুজেই মাগো আমায় দশভুজা করে রেখো,
ঘরে বাইরে,বিপদে সম্পদে সাথে তুমি মা থেকো।
শক্তি দাও, ভক্তি দাও জাগাও প্রাণে আশা।
ভালো রাখতে পারি সবাইকে,দিয়ে ভালোবাসা।"
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment