Skip to main content

লোহার কাঠি

#লোহার_কাঠি#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#

মেয়ে আমাদের মোটামুটি পছন্দ,যদিও এমন করে কেউ বলবেনা,সময় নেবে। তবুও আমি মুখের ওপরেই বললুম।...তবে কি যেন বলছিলেন না মেয়ে আপনার যেন কি পাশ?মনেও থাকেনা ছাই।"
          সুকন‍্যার বাবা ব‍্যস্ত হয়ে এগিয়ে এলেন হবু বেয়ানের কাছে," হ‍্যাঁ, পলিটেকনিক পাশ,বুঝলেন দিদি ওখানে খুব ভালো রেজাল্ট করেছে। ওতো দারুণ..."
  বাকিটা আর কুড়ি বছর আগে আর শোনেননি সুমনার শাশুড়িমা। " শুনুন দাদা,আমরা হচ্ছি গিয়ে বনেদী বাড়ির বৌ,আমাদের বাড়িতে বৌয়েরা লেখাপড়া জানে,অশিক্ষিত নয় এটাই যথেষ্ট। এখানে এর বেশি আর দরকার নেই।আপনারা হলেন গিয়ে আমার মামাবাড়ি সূত্রে পরিচিত তাই আর না করতে পারলুম না। কি গো তাই না?"
        সুকন‍্যার শ্বশুরমশাই বড় চমচমে কামড় বসাতে বসাতে মাথা নাড়লেন। ওর মা তখন ওনার পাতে আরো চারটে লুচি দিয়ে গেলো।
                  সুকন‍্যা মিত্র,বৌবাজারে বনেদী দত্ত বাড়ির বৌ হয়ে এক গা গয়না পরে এসেছিলো এখন থেকে প্রায় কুড়ি বছর আগে। যদিও পরে জানতে পেরেছিলো সব গয়নাগুলো ওর নিজের নয়। এই বাড়িতে এমনই নিয়ম,মান রক্ষের জন‍্য জেঠতুতো,খুড়তুতো জায়েদের বা শাশুড়ির গয়না দিয়ে সাজিয়ে আনা হয়। ওর মধ‍্যবিত্ত বাবা,মেয়েকে ঘাড় থেকে নামাতে পেরে খুশি হয়েছিলেন। কারণ তখন ছোটমেয়েও বেশ বড় হয়ে উঠেছে। আর ছেলেটাকেও তো মানুষ করতে হবে।
         শাশুড়িমা মনে রাখতে পারেননি ওর পড়াশোনার কথা তাই বাড়িতে লোকজন এলেই বলতেন," আচ্ছা বৌমা,তুমি যেন কি পাশ বলেছিলে? বি.এ পাশ শুনেছি বাপু,ডাক্তারি,ওকালতি,ইঞ্জিনিয়ারও শুনেছি। আমার বাপু মনে থাকেনা এই সব খটমট নাম।"
        মনে মনে একরাশ অভিমান জমলেও তখন নতুন বৌ সুকন‍্যা নরম করেই বলেছিলো," এটাও একধরনের ইঞ্জিনিয়ারিং মা,পলিটেকনিক।"
       " আচ্ছা আচ্ছা যাও বাপু, অনেক হয়েছে। একটু চা করে আনো দিকিনি তোমার কাকিমার জন‍্যে। আর তারপর ময়দাটা ভালো করে ময়ান দিয়ে ঠেসো,বাবু এলে আর তোমার শ্বশুরমশাই এলে গরম লুচি ভাজবো। ওরা আবার আমার হাতেরটা ছাড়া খেতেই পারেনা।"
          পান চিবুতে চিবুতে শাশুড়ির আত্মতৃপ্তির গল্প শুনতে শুনতে রান্নাঘরে ঢোকে সুকন‍্যা।
           পাশ করার পর বিয়েটা হয়ে গেলো,একটু বেশি পড়ার ইচ্ছা ছিলো চাকরিরও ইচ্ছে ছিলো কোনটাই হয়নি করা। অথচ কলেজে থাকার সময় ওর বানানো প্ল‍্যানের আর ড্রইংয়ের কতই প্রশংসা করতেন স‍্যারেরা।
    সুকন‍্যার বরের অফিসের চাকরি,আর শ্বশুরমশাইয়ের দোকান। বর বেড়িয়ে যেতো সকালেই সেদ্ধভাত খেয়ে তারপর বেশ বেলার দিকে শ্বশুরমশাই বাজার করে আনতেন,যখন সকাল থেকে রান্নাঘরে যুদ্ধ করে রান্না মোটামুটি শেষের দিকে মানে উনি মাছটা আনলেই হয়ে যাবে। তখন উনি মাছের সাথে এনে হাজির করতেন রাজ‍্যের বাছাই করা পচা সব্জি কখনো বা চুনো মাছ। সেগুলো ধুতে বাছতেই দিন কেটে যেতো সুকন‍্যার। তারপর শাশুড়িমার সাথে রান্নাঘরে মাছের পদ রান্না,আনাজ কোটা, বিকেলের ময়দা মাখা ইত‍্যাদি। সব শেষ করে খেয়েদেয়ে ঘরে ঢুকতে বিকেল হয় হয়।
           তার মাঝেই সুকন‍্যা কিনেছিলো গোপনে ওর ড্রয়িংয়ের জিনিসপত্র আর কিছু এনেছিলো বাপের বাড়ি থেকে। কাজের মাঝে সময় বার করতে পারলেই বসে গোপনে ড্রয়িং করতো। নিজের মনের পরিতৃপ্তিতে আঁকতো স্বপ্নের বাড়ির ডিজাইন। খুব ছোট ছিমছাম বাড়ি,বাথরুম আর রান্নাঘরটা ওর একদম মনের মত। আর হ‍্যাঁ একটা সুন্দর বারান্দা থাকবে যেখানে ও মনের মত করে বাহারি টবে বসাবে কিছু গাছ। এই বৌবাজারের পুরোনো বাড়ির মত স‍্যাঁতসেতে কলতলা আর বাথরুম না। একদিন ওর নিজের বাড়ি ও বানাবে ওর স্বপ্নের মত করে একদম নিজের প্ল‍্যানে।
                     " ও বৌমা,তোমার শ্বশুরের হাত থেকে ব‍্যাগটা ধরো। আমি কলতলায় তো। কি হলো শুনতে পাচ্ছোনা নাকি?"
     সত‍্যিই আঁকাতে বিভোর হয়ে সুকন‍্যা শুনতে দেরি করে ফেলেছিলো। ব‍্যাগ হাতে করে ওপরে উঠে,ভেজানো দরজার ফাঁক দিয়ে শ্বশুরমশাইয়ের নজরে পড়েছিলো মেঝেতে মাদুর পেতে বিভোর হয়ে বৌমা কি যেন আঁকছে। বাজারের ব‍্যাগটা ছিটিয়ে ফেলে ডেকে এনেছিলেন ওর শাশুড়িকে। "শোন,আমি বাজার করবো,দোকান করবো। আর তোমরা সব বসে বসে খাবে,তবুও হাঁফিয়ে উঠে কাউকে পাবোনা ব‍্যাগ ধরতে এসব এখানে চলবেনা। কি করো তোমরা? আজ আসুক বাবু।"
         বাবু আসার পর যা হয়েছিলো তা ভোলেনি সুকন‍্যা। সারাদিন শাশুড়ির বাক‍্য যন্ত্রণায় বিদ্ধ সুকন‍্যা কোন সমর্থন পায়নি বর অংশুমানের কাছেও। "শোনো বাবা এই বয়েসেও অনেক করছেন,আমি তো সকাল আটটায় বেড়িয়ে যাই। তোমার এতো কি কাজ একটু বলবে,যে কোন কথাই তোমার কানে আসেনা?"
           আরো অনেক কথা হয়েছিলো,সুকন‍্যাও কিছু কথা বলেছিলো। লাভ হয়নি,অশান্তি বেড়েছিলো। বাধ‍্য হয়ে চরম রাগে দুঃখে নিজের কাগজপত্র ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিলো সুকন‍্যা। তারপর থেকে রান্নাঘরের নোনাধরা দেওয়ালে ওর ডিজাইনগুলো কখন যে হারিয়ে গিয়েছিলো বুঝতেই পারেনি।
                 রাতে আগে নিজের ঘরে বসেও অনেক সময় ডিজাইন করতো,অংশুমান ওর শরীরটাকে আদর করে ঘুমিয়ে পড়লে। দুএকদিন চোখ খুলে বলতো," কি করো বলতো আলো জ্বেলে এতো রাত অবধি? ঘুমিয়ে পড়ো রাত হয়েছে। সেদিন বাবা বলছিলেন ইলেকট্রিক বিল বেশি আসছে। কি করি এতো রাত জেগে?লজ্জায় আমার মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিলো।"
       অংশুমানের কথাটা পুরো শেষ হওয়ার আগেই লাইট নিভিয়ে বালিশে মুখ ঢাকে সুকন‍্যা। চোখের কোলে জমে বিন্দু বিন্দু জল। ও শুতেই ওর গায়ে পা তুলে অংশু ঘুমিয়ে পড়ে। সুকন‍্যার অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে।
          সুকন‍্যা এখনো রাত জাগে তবে অন্ধকারে। অংশুমান অন্ধকারে ওর শরীরটা জাপটে ধরে নিজের ইচ্ছেমত কখনো আদর করে কখনো বা জড়িয়ে ধরে ঘুমোয় শান্তিতে। স্বামীর আদরের স্বর্গসুখে নিজের আত্মসুখকে বিসর্জন দিয়ে সুকন‍্যা এখন কন‍্যাসন্তানের জননী। মেয়েকে একটু বড় করে স্কুলে পাঠাতেই আবার সুসংবাদ,এবার ছেলে। প্রথমবার নাতনির মুখ দেখে অখুশি শাশুড়িমা এবার খুশি বংশধর পেয়ে।
             ছেলেমেয়ে,শ্বশুরবাড়ি ওদের পড়াশোনা সামলাতে সামলাতে কখন যে এতগুলো বছর পার হয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি। ওদেরকে নিজেই পড়িয়েছে একটা বয়েস পর্যন্ত। রেজাল্ট ভালো করলে শাশুড়িমা বলতেন,"আমাদের বংশের তো,ওদের বাবাও তো ভীষণ ভালো তাই আমাদের বাবুর মতই হয়েছে নাতনি।" আর ছেলে ভালো না করতে পারলে বলতেন," মায়ের ধারা পেয়েছে,দিনরাত বসে আঁকাঝোকা করা। পড়াতে মোটেই মন নেই। আর তেজেও মায়েরই মত।"
                    সুকন‍্যার দুই আদরের ধন,শাসন করলে হাজার কথা শোনে শাশুড়ির কাছে। আবার দুষ্টুমি করলেও শোনে আস্কারা দিচ্ছে। এখন অবশ‍্য দুটোই বেশ ভালো হয়েছেপড়াশোনাতে,বড় হচ্ছে তো।
          সুকন‍্যার ষোলো বছর বয়েসের মেয়ে একদিন মাকে বলেছিলো,"আচ্ছা মা,আমাদের স্কুলে অনেকের মা চাকরি করে। ওদের কি মজা,সব বায়না মায়ের কাছে করে। মা কত জিনিস কিনে দেয়,বেড়াতে নিয়ে যায়। আর তোমাকে কিছু বললেই বলো বাবাকে বা দাদুকে বলতে। কেন তুমি কিছু করোনা মা?"
          সাথে সাথে ছেলেও বলেছিলো," ধুসস্ ভালো লাগেনা। বাবার কাছে কিছু চাইলে তো দিতেই চায়না বলে 'পড়াশোনা মন দিয়ে কর পরে পাবি।' তুমি একটা চাকরি করোনা মা।"
                            সুকন‍্যার মনটা কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিলো একসময় কত ইচ্ছে আর স্বপ্ন ছিলো চোখের পাতায়। এখন ও উড়তে ভয় পায়,ডানাতে সেই শক্তি আর নেই। এখন আর চাকরি কে দেবে ওকে? মাঝে মাঝে ছেলেমেয়েদের খাতায় আঁকিবুকি কাটে ঠিকই তবুও চাকরি খোঁজার থেকে কচুরী বানানো বা আমের আচার করা অথবা মাছ রান্না এখন অনেক সহজ ওর কাছে।
                 বাপের বাড়ি ভাইফোঁটাতে গিয়ে কথাটা বলে ফেলেছিলো হাসতে হাসতে। অংশু থাকলে কি বলত জানেনা তবে ওর ভগ্নিপতি কিন্তু ব‍্যাপারটা মোটেই ঠাট্টা ভাবেনি। " সত‍্যিই তো দিদি,ছেলেমেয়েরা তো ঠিকই বলেছে মাকে আর্থিক স্বাবলম্বী হয়ত ওরাও দেখতে চায়। আপনার কিছু কাজ আমি দেখেছিলাম এই বাড়িতেই,সুনন্দা দেখিয়েছিলো। করবেন কিছু সত‍্যি?"
         অন‍্যমনস্ক সুকন‍্যার মনটা তখন ঘুড়ি হয়ে উড়ে গেছে বৌবাজারের পুরোনো বাড়ি থেকে একদম মেঘের দেশে।
        ছেলেমেয়েদের সাথে রাত জাগে সুকন‍্যা। দুটো ছেলেমেয়েরই পরীক্ষা প্রায় এসে গেছে। ঐ ঘরেরই এককোণে বসে,সুকন‍্যা খোঁজে ওর হারিয়ে ফেলা ভালোবাসার শখটাকে,ওর চিরকাল তাচ্ছিল্যের চোখে দেখা অকেজো বিদ‍্যাকে। ওর ভগ্নিপতি কিছু কাজ দিয়েছে ওকে একটা প্রোজেক্টের, খুবই অল্প কাজ শুধু দেখা কেমন হচ্ছে কাজটা পরের ব‍্যাপারটা অন‍্যরকম করে ভাবা যাবে। ছেলেমেয়েদের পড়াতেও খুব মন,মা যে ওদের সাথেই বসে পড়ছে। বেশ অন‍্যরকম মজা একটা,শ্বশুরমশাই এখন বৃদ্ধ যদিও দাপট যথেষ্ট তবুও এখন আর ইলেকট্রিক বিল নিয়ে কথা হয়না। নাতি নাতনিরা পড়ছে,উঁচু ক্লাশের পড়া তাই সারারাত আলো জ্বললেও সমস‍্যা নেই। তাই সেই সুযোগটা কাজে লাগায় সুকন‍্যাও।
                         তবে কোন কিছুই বোধহয় বেশিদিন চাপা থাকেনা। সুকন‍্যার নামে যখন রেজেস্ট্রী খাম এলো শ্বশুরমশাই সই করে নিলেন। অংশুমান যদিও অনেকটাই জানে,সময়ের সাথে সাথে অংশুও বোঝে আর্থিকভাবে স্বচ্ছ্বলতা কতটা প্রয়োজন। বাবার ব‍্যবসার অবস্থাও খুব একটা ভালোনা,ওদের বাড়িটার অবস্থাও জরাজীর্ণ সারাতে গেলে প্রচুর টাকার দরকার। কোনরকম করে তালি দিয়ে চলছে। এদিকে ছেলেমেয়েদের পড়ার খরচও বাড়ছে দিন দিন। তাই প্রথম জীবনের ইগো এখন প্রয়োজনের তাগিদে মুছে গেছে। অংশু বলতে না পারলেও মনে মনে চায় বাড়িতে বসে যখন কিছু করছে করুক না সুকন‍্যা।
                   " বৌমা বাড়ি নেই নাকি?কিসের চিঠি এলো আবার কে জানে?"
     " আমার হয়েছে যত জ্বালা,কাজে আজকাল তার তেমন মন নেই প্রেসারে ফুসফাস সিটি মেরে রান্না করে বেড়িয়ে যায়। নিজের শরীরে বাত ধরেছে তাই যা রান্না করে তাই খেতে হয়।"
         " খুলে দেখবো নাকি কি চিঠি?"
  " থাক বাপু,যদি ছেলেমেয়েদের স্কুলের কিছু হয়,খুলোনা। এলে তোমার সামনেই খুলতে বোলো একেবারে।"
           খামটা শ্বশুরমশাইয়ের সামনেই খোলে সুকন‍্যা। তখন অংশুও এসে গেছে অফিস থেকে। সুকন‍্যার প্রথম উপার্জন দশহাজার টাকা। অনেকদিন বাদে হাসিটা একদম মনের ভেতর থেকে হাসে সুকন‍্যা,ওর প্রথম উপার্জন!
     ছেলেমেয়ে দুটো জড়িয়ে ধরে ওকে,"ওরে বাবা দশহাজার টাকা! মা আমাদের কিন্তু খাওয়াতে হবে।"
         " তা কি করছো শুনি? কোথা থেকে এলো এই টাকা?"
       সুকন‍্যা অপ্রস্তুত হয়,অসন্তুষ্টও। আজ আর থামালেও ও থামবেনা ওর মরা সোতায় আবার জোয়ার এসেছে।
     অংশু বোঝাতে শুরু করে বাবাকে। "বাবা ও তো খুবই ভালো প্ল‍্যান,ডিজাইনিং,ড্রয়িং এইসব করত। একটা সময়ে যদিও কিছু করতে পারেনি সংসারের জন‍্য। তা এখন ছেলেমেয়েও বড় হচ্ছে তাই যদি কিছু করে করুক। মানে ওর ভগ্নিপতিই
ব‍্যবস্থা করে দিয়েছে।ওদের কোম্পানির কিছু কাজ করে এই আরকি।"
          সুকন‍্যার শাশুড়িমা বলেন," কি জানি বাপু,এখনকার মেয়ে বৌদের এত টাকা কিসে লাগে জানিনা। আর কি ভালোই..."
         পরের অংশটুকু এবার সংসার লাটে উঠবে বলতে বলতে বিদায় নিলেন মুখ ব‍্যাজার করে।
             কয়েকদিন বাদে রবিবার সুকন‍্যা শ্বশুরমশাই বাজার যাবার সময় একহাজার টাকা ওনার হাতে দিতে যায়," বাবা বলছিলাম আজ এটা দিয়ে পাঁঠার মাংস আর ঘোষের দোকান থেকে একটু দই আর মিষ্টি আনবেন।"
         " থাক বৌমা,আমরা বাপ ছেলে মিলে যা আনি তাতে আমাদের দিব‍্যি চলে যাচ্ছে তো এতোদিন। আমিই পারবো ওটুকু আনতে। ও তুমি রেখে দাও পরে কাজে লাগবে।"
       কিছু মানুষ হয়ত মচকায় তবুও ভাঙেনা। ওর শ্বশুর শাশুড়িও বোধহয় তেমনি।
          এরপর থেকে সুকন‍্যার ব‍্যাঙ্কের আ্যকাউন্টেই জমা হয়ে যেতো ওর প্রাপ‍্যটা। আর শ্বশুরমশাইকে হাতে টাকা দিতে যায়নি তবে বরকে দিয়ে মাঝে মধ‍্যে ইচ্ছেমত আনিয়েছে একটু ফল মিষ্টি বা রাবড়ি।
          সুকন‍্যা এখন আর লুকিয়ে কিছু করেনা,কুড়িবছরে পায়ের তলার মাটি অনেকটাই শক্ত। শুধু মনে হয় অনেকগুলো বছর নষ্ট হলো এইভাবেই..কেবলমাত্র ভালো বৌয়ের খেতাব পেতে। এত কিছু ছেড়ে দিয়ে সত‍্যিই কি ও ভালো বৌ হতে পেরেছে? নাকি সারাজীবনটাই শুধু ট্রায়াল এন্ড এরর? মনে মনেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে কম্পিউটারে বাকি কাজগুলো শেষ করতে থাকে। এখন ওর পরিশ্রম অনেকটা বেড়ে গেছে তবুও কোথাও যেন একটা শান্তি বা পরিতৃপ্তি কিছু করতে পারার। যখন অংশুকে,ছেলেমেয়েকে অথবা শাশুড়িমাকে কিছু দিতে পারে ভালো লাগে। দেওয়াতেও যে সুখ আছে তা বুঝতে পারে।
             মাঝে কেটে গেছে কয়েকটা বছর। সেদিন রাতে বাড়ির সবাই তখন ঘুমিয়ে ওরা হঠাৎই মনে হচ্ছিলো বাড়িটা কেমন যেন নড়ছে ওদের। তাহলে কি ভূমিকম্প হচ্ছে নাকি? অংশু নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে।বাইরে হৈচৈ শুনতে পায় সুকন‍্যা। বুঝতে পারে নিশ্চয় কোন বিপদ ঘটছে। তাড়াতাড়ি অংশুকে তুলে বাইরে বেড়িয়ে জানতে পারে মেট্রো রেলের কাজের জন‍্য হেলে পড়েছে ওদের পাশের বাড়ি। আর তার ধাক্কায় ভেঙেছে ওদের একপাশের বারান্দাও। পরদিন ভোর পর্যন্ত কোনরকমে অপেক্ষা করে কাটিয়ে,কোনরকমে তারমধ‍্যে নিজেদের কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস গুছিয়ে সবাই বেড়িয়ে আসে বাড়ি থেকে। মানে বাধ‍্য হয় বেড়িয়ে আসতে পুলিশের তাড়ায়। শ্বশুরমশাই আর শাশুড়িমা খুবই জেদ করছিলেন আর কান্নাকাটি করছিলেন নিজেদের ভিটে ছাড়বেননা বলে কিন্তু ছাড়তেই হলো নাহলে হয়ত বাড়ি চাপা পড়েই মরতে হত।
                       ততক্ষণে বাড়িতে কত জিনিস নষ্টের ক্ষতিতে কপাল চাপড়ে কাঁদছে কত মানুষ। কত জিনিসপত্র,প্রেস,সোনার গয়না বানানোর মেসিন সব তখন চাপা পড়েছে ধ্বংসস্তূপের তলায়।
   চোখে জল আসে সুকন‍্যারও,ওরও তো কত কিছু রয়ে গেলো এখানে। ছেলেমেয়েদের সামনে পরীক্ষা। শ্বশুরমশাইয়ের শরীরটাও ভালোনা।
    ..." আমরা এবার কোথায় যাবো বাবু,এতদিনের পুরোনো বাড়ি ছেড়ে। হায় ভগবান এই দিনও দেখতে হলো! কি এমন কাজ করছে ওরা পাতালে যার জন‍্য আমাদের পাড়াটা পুরো শেষ করে দিলো।"
      " বাবা,ওরা আমাদের আপাততঃ হোটেলে ব‍্যবস্থা করেছে।"
      কেঁদে ওঠেন ওর শাশুড়িমা," ও বাবা গো,হোটেলে থাকা! আমার গোপালের কি হবে? কোথায় রাখবো তাকে?"
           এই কদিন একঘরের মধ‍্যেই পাশাপাশি বিছানায় ওরা ছয়জন আছে হোটেলে। শাশুড়িমা মাঝে মাঝেই কাঁদছেন আর শ্বশুরমশাই মোটামুটি নির্বাক আর অসুস্থ। অংশুর মাথায় নানা চিন্তা। সুকন‍্যার কাজকর্ম সবই বন্ধ মোটামুটি। তবুও সেদিন বেড়িয়েছিলো সুকন‍্যা।
           সন্ধ‍্যেবেলা অংশু ফেরার পর বলেছিলো,''একটা কথা বলবো,যাবে তোমরা সেখানে?''ওরা সবাই জানতে চেয়েছিলো কোথায়।
          "আমার আঁকা স্বপ্নের বাড়িতে,আমি কথা বলেছি।এখনো খালি আছে কয়েকটা,এখন সব টাকা দিতে হবেনা, কিছুটা দিলেই হবে। তারপরে ইনস্টলমেন্টে মাসে মাসে। কিন্তু বৌবাজারের মত এত জমজমাট জায়গা নয়,একটু দূরে। তবুও হোটেলের থেকে ভালো তাইনা?"
               সবাইকে বোঝাতে আর ব‍্যবস্থা করতে কয়েকটা দিন কেটে গিয়েছিলো। তারপর একদিন ওরা সবাই গিয়েছিলো দেখতে সুকন‍্যার আঁকা ছোট্ট বাড়ি। ছুটে গিয়েছিলো সুকন‍্যা,চারপাশে কত গাছ আর ফাঁকা ফাঁকা পরিবেশ। ও নিজেই তো প্ল‍্যানটা করেছিলো,দেওয়ালে আর বারান্দার গ্ৰীলে হাত রাখে সুকন‍্যা..অজান্তেই মুখ থেকে বেড়িয়ে আসে স্বপ্নের বাড়ি।
              "যে কদিন বৌবাজারের বাড়িতে যাওয়া না যাচ্ছে সে কদিন এখানে ভালোই থাকা যাবে তাইনা মা?"
        ওর শাশুড়িমা মাথায় হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করে বলেন,"সবটাই ঠাকুরের আশীর্বাদ বৌমা,হোটেলে কি ঠাকুর থাকতে পারে? তবে জায়গাটা দূরে হলেও মন্দ নয়।"
                     সুকন‍্যা তখন ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে ওর স্বপ্নকে আর ভাবছে কত মেয়েরই হয়ত কত স্বপ্ন হারিয়ে যায়। অনেক সময় স্বপ্নের খোঁজে ভাঙে সম্পর্ক আর সংসার অথবা আপোষে আর আফসোস কেটে যায় জীবন। দেরিতে হলেও সুকন‍্যা পেয়েছে একটা ছোট্ট লোহার কাঠি যা খুলে দিয়েছে ওর মরচে ধরা স্বপ্নের বাক্সের তালাটা।
সমাপ্ত:-
               
        

          

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...