"এই নাও দুটো ছাপা,পাঁচটা সিল্ক,দশটা তাঁত,দুটো বেনারসী আর ছটা সিন্থেটিক।"
শাড়িগুলো আরেকবার ভালো করে দেখে আর গুনে নেয় জয়া।কাউন্টারের ওপার থেকে বরেনবাবু বলেন,"ঠিক করে দেখে নাও,পঁচিশটা শাড়ি আছে। ভাজগুলো ঠিক রেখো সবগুলোই দামি শাড়ি আর একদম কালকেই দেওয়ার চেষ্টা করবে।"
"কালকেই লাগবে?কিন্তু কাল তো হবেনা। চেষ্টা করবো পরশু দিয়ে দিতে।"
"একটু তাড়াতাড়ি হাত চালিয়ো,বুঝতেই পারছো পুজো এসে গেলো।"
আঁচলটা ভালো করে জড়িয়ে নেয় জয়া,ভারী ব্যাগটা নিয়ে বাসে উঠতে হবে ভিড়ের মধ্যে।জয়ার শরীরের ভাজগুলো দেখে ঢোক গেলেন বরেনবাবু, সামনে থেকে দেখার পরও তাকিয়ে থাকেন পেছনের দিকে। একদিন সাহস করে বলেছিলেন,ফোঁস করে উঠেছিলো জয়া।
" কাজ না করলে জল খেয়ে থাকতে পারবো তবে সম্মান বিক্রী করতে পারবোনা,সব কিছু ফ্রীতে পাওয়ার চেষ্টা করবেননা। আর জয়া অন্যদের মত নয়।"
বাড়িতে বৌয়ের মুখটা মনে করে ইঁদুরের মত হয়ে গেলেও সাহস করে মিনমিন করে বলেছিলেন,"না না ফ্রীতে কেন?টাকা শাড়ি সব দেবো।"
"বিয়ে করতে পারবেন?"
ঢোক গিলেছিলেন বরেনবাবু," প্রথমেই হয়ত হবেনা, তারপর করবো..ততদিনে সব খরচ দেবো। কোন চিন্তা নেই।"
মেরুদন্ডহীন কাপুরুষ একটা কথাটা বলে বেড়িয়ে গিয়েছিলো জয়া দোকান থেকে। তবে দোকান থেকে শাড়ি নেওয়াটা জয়া ছাড়েনি। স্বামী চলে যাওয়ার পর সমাজে এমন অনেকে বরেনবাবুর সাথে প্রতিনিয়ত লড়াই করে বেঁচে আছে। সিঁদুরের একটা সরু রেখা বোধহয় অনেকটা বড় রক্ষাকবচ মেয়েদের সবাই জানে সে বেনামি সম্পত্তি নয়। আর জয়া এখন বোধহয় তাই..হাসি পায় মাঝে মাঝে চোখে জল এলেও।
শিবেন চলে যাওয়ার পর কুপ্রস্তাবের সাথে সাথে সুপ্রস্তাবও এসেছিলো মানে সংসারের নামে সেই দৈহিক শ্রমের চুক্তি,ষাট বছরের পুরুষমানুষ,ঘরে চারটে বড় বড় ছেলেমেয়ে,কারো বা বিয়েও হয়ে গেছে তাদের মা হয়ে থাকার।
শিবেন তাকে হয়ত সন্তান দিতে পারেনি তেমন স্বাচ্ছন্দ্যও দিতে পারেনি তবে ভরিয়ে দিয়েছিলো ভালোবাসায়। আর মা তাকে কে দেখবে?মাকে ছেড়ে তো কোথাও যেতে পারবেনা সে। জয়ার নিজের মা নেই,দাদা বৌদি আছে। শিবেনের মা একটা সময় জয়ার শাশুড়িমা ছিলেন এখন শুধুই মা। বাড়িটা নিজেদের তাই মা মেয়ের সংসার ওদের কোনরকমে চলে যায়।
আলোয় আলোয় সাজছে শহর,রাস্তায় মানুষের ভিড় উপচে পড়ছে। খুব কষ্টে শাড়িগুলো নিয়ে বাড়ি পৌঁছতে রাত্রি হয়ে গেলো। পুজোর শেষ প্রস্তুতি চলছে,সবার হাতেই নতুন জামাকাপড়। জয়ার হাতেও একব্যাগ ভর্তি নতুন কাপড় তবে ওর নিজের নয়। হয়ত জয়ার মত অনেকেই পুজোতে নিজেরা সাজতে না পেরেও জীবিকার তাগিদে মানুষ সাজানোর কাজ করছে ।
গলির মুখে ঢুকতে ঢুকতে চৌধুরীদের শিউলিগাছের থেকে শিউলিফুলের গন্ধে মনটা ভরে উঠলো জয়ার।বাগনানে ওর বাপের বাড়ির উঠোনে এমনি একটা শিউলিগাছ ছিলো। আশ্বিনের শিশির পরা ভোরে ছোট্ট ঝুড়িতে বসে বসে কুড়োতো শিউলিফুল। বিছিয়ে দিতো ঠাকুরের আসনে। চোখ বন্ধ করলে সেই সুবাস পায় এখনো।
গেটের শব্দ হতেই আওয়াজ আসে," জয়া এলি মা?"
" হ্যাঁ মা।"
ব্যাগটা নামিয়ে রেখে বাথরুমে গিয়ে গা ধুয়ে এলোচুলে গামছা জড়িয়ে আসে।
"এই রাতে স্নান করলি?কাল আবার গঙ্গায় যাওয়া আছে। শরীর খারাপ করবে তো?"
" কেউ ছোঁবেনা মা আমাকে,তুমি আছো তো। আমি মরে গেলে তোমাকে দেখবে কে শুনি?"
চোখ মোছেন আঁচলে শাশুড়িমা.." অমন কথা বলতে নেই মা। নিজের জন্যই বাঁচবি মানুষের জীবন বড়ই অমূল্য তাকে হেলায় নষ্ট করতে নেই।"
" কি জানি মা,আজকাল মনে হয় মেয়েদের জীবনের কি কোন দাম আছে? সারাদিন রাস্তায় বেরোলেই যখন দেখে আমি বিধবা সুযোগ পেলেই লোকে কুপ্রস্তাব দিয়ে শরীর পেতে চায়। সিঁদুর মুছে যাওয়ার সাথে সাথে যদি যৌবনটাও চলে যেতো ভালো হত। তাও যদি একটা ছেলেপুলে থাকতো তার মুখ চেয়ে বাঁচতাম।"
চা করে খেয়ে সেলাই নিয়ে বসে জয়া যতটা পারে কাজ এগিয়ে রাখতে হবে।পুজো চলে আসছে,অনেকগুলো শাড়ি।তারপর আবার ঐ শয়তান বরেনবাবু তাড়া দিয়েছে।দেরি করলে টাকা কেটে নেবে। লাল বেনারসীটার ওপর হাত বোলায় জয়া শাড়িটা খুব সুন্দর। ওর বিয়ের সময় দাদা দিয়েছিলো লাল বেনারসী তবে আসল বেনারসী নয়,জয়ার একটু অভিমান হয়েছিলো কিন্তু কিছু বলেনি।সত্যিই তো কোথায় পাবে অত টাকা দাদা? তবে শিবেন দিয়েছিলো বেনারসী। সেটা এখনো আলমারিতে তোলা আছে যত্নে।মাঝে মাঝে নাড়াচাড়া করে একটু গন্ধ নেয় জয়া,সেই নতুন বিয়ে বিয়ে গন্ধ এখনো ওটাতে লেগে আছে।
পরদিন ভোরবেলা রেডিওতে মহালয়ার গানে ঘুমটা ভেঙে যায় জয়ার। বিছানায় চুপ করে বসে মহালয়া শুনতে থাকে।বৌবেলার মেয়েবেলার কত স্মৃতি এই দিনটার সাথে জড়িয়ে আছে। ছোটবেলায় মায়ের কোলের কাছে শুয়ে মহালয়া শোনা তারপর বাবার গঙ্গায় যাওয়া তর্পণ করতে। একটা সময় শিবেনও গেছে তর্পণ করতে,সঙ্গে গেছে ও। ভালো লাগতো,ওখানে গিয়ে মনে করতো মা বাবার কথা। তারপর একেবারে স্নান করে ফিরে আসা একসাথে।
আজও ওকে যেতে হবে গঙ্গায় মাকে নিয়ে। মায়ের কথায়.." জল দিতে ছেলেমেয়ে কিছু ভেদ আছে নাকি। আমরাই গঙ্গায় গিয়ে আমাদের মত জল দেবো। মনটা বড় অশান্ত লাগে রে। স্নান করে অদ্ভুত একটা শান্তি পাই।"
একটু বেলাতেই যোগ তর্পণের,মাকে নিয়ে পৌঁছতে পৌঁছতে ঘাটে বেশ ভিড় জমে গেছে। ওরা গঙ্গায় নামতে নামতে জোয়ার এসেছে গঙ্গায়। অনেকেই নিজের মত তর্পণ করছে। মাকে স্নান করিয়ে ওপরে তুলে দিয়ে জলে নামে জয়া। হাত জোড় করে মন্ত্র বলে হঠাৎই গেলো গেলো শব্দে চোখ খুলেই আর কিছু না ভেবে ঝাঁপিয়ে পড়ে জলে। সাঁতরে জলের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে এলোপাথাড়ি খুঁজতে থাকে একটা হাত বুঝতে পারে।ধরতে গিয়ে মনে হচ্ছে ও নিজেই ডুবে যাবে,নিজের জীবনের ভয় পায়না জয়া তাই চললো লড়াই। বেশ কিছুক্ষণ বাদে ছেলেটাকে টেনে তুলে নিজেই এলিয়ে পড়ে জয়া।
" জয়া,এ তুই কি করলি মা?আমার যে আর কেউ নেই তুই ছাড়া।"
ওদিকে তখন দুটো দেহ পরপর শুয়ে জয়া তখনো জড়িয়ে আছে হাতটা ছেলেটার।
বেশ কিছুক্ষণ বাদে চোখ খোলে জয়া। মাকে দেখতে পায় পাশে। এদিক ওদিক তাকায়," মা বেঁচে আছে ছেলেটা?"
" হ্যাঁ মা আছে..ঐ তো।"
জয়া ভালো করে দেখে..ছেলেটা খুব একটা বড়ো নয় কত আর বয়েস হবে হয়ত পনেরো ষোলো। কি জানি কেন গঙ্গায় নেমেছিলো!
রাতে
Comments
Post a Comment