Skip to main content

কালিমা মুক্তি

#কালিমা_মুক্তি#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#

"মিষ্টিগুলো খাওয়া হয়ে গেছে আপনাদের?মানে এই মোহনভোগ,সরভাজা,ক্ষীরকদম আর ঐ নোনতা ক্ষীরের কচুরী সব তো। আচ্ছা এবার তাহলে আসুন,আমার বোন ফেলনা নয়।"
   " ছি ছি দেখেছিস কি অবস্থা!সামান‍্য কথাতে একেবারে লঙ্কাকাণ্ড।"
পাশের থেকে বলে ওঠেন রঞ্জনের কাকা।
" ছাড়ো কাকু,অনেক হয়েছে আর নয়। এরপরেও এখানে থাকার আর কোন মানে হয়না।"
  ওদের কথার মধ‍্যে আমি যে কি করবো ভেবে পাচ্ছিলামনা। আমি অঙ্কুশ...রঞ্জন মানে যে পাত্র সে আমার বন্ধু কাম সহকর্মী। আজ ছুটির দিনে কলকাতা থেকে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে এই রাজগঞ্জে মেয়ে দেখতে আসা। আর এখানে এসে যা কান্ড আর বলার নয়।
             ফটো দেখে ওদের পছন্দ হয়েছিলো,আমিও দেখেছিলাম সেই ফটো "বেশ ভালোই তো দেখতে মেয়েকে বলেছিলাম।"
        মেয়ের বাড়িতে আদর যত্নের কোন ত্রুটি ছিলোনা,মেয়ের বাবা কাকা এরা বেশ ভালো। অনেক রকমের মিষ্টি,চা,সরবত কিছুরই কমতি ছিলোনা। খাওয়াদাওয়ার মাঝেই মেয়ে এলো।
এমনিতে ঠিকই ছিলো। কচুরী খেতে খেতে রঞ্জন আমাকে একটা হালকা চিমটি দিলো,কানের কাছে বললো,"ফটোতে তো বোঝা যায়নি,এতো বেশ কালো রে..''
    আমি এদিক ওদিক তাকাই,একটু অস্বস্তি হয়। আমার দিভাইকে এই কালো রঙের অজুহাতে যে কত পাত্র একটা সময় নাকচ করেছে। শেষে বেশ কিছু বছর আগে বেশ অনেকটা পণ দিয়ে বাবা মুক্ত হয়েছে কন‍্যাদায় থেকে। তাও দিদি মাঝেমাঝেই দুঃখ করে," এত কাজ করি তবুও সেকথা কেউ বলেনা। সুযোগ পেলেই গায়ের রঙ নিয়ে কথা শোনায়।"
    হেসে বলি," সেকি রে সাদা টাকাতেও তোর কালো রঙ ধুতে পারলোনা!"
  "তোর জামাইবাবুকে মাঝে মাঝে দিই শুনিয়ে। কত আর চুপ করে থাকবো? তবুও শাশুড়ি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এক কথা বলে,'আমাদের বাড়িতে যা সবার রঙ সেখানে তোমার রঙটা একদমই অন‍্য রকম'।"
    " শোন দিদি,হোয়াইট মানি না হয়ে ব্ল‍্যাকমানি হলে বোধহয় তোর ব্ল‍্যাককালার হোয়াইট হয়ে যেতো।"
          দিদির কথাগুলো মনে হয় হঠাৎই। ততক্ষণে শুনতে পাই মেয়ের বাবা বলছেন,"এই আমার ছোটমেয়ে উমা। কাজে কর্মে সব কিছুতেই খুব ভালো। বি.এ পাশও করেছে। আসলে আমার মা খুব ব‍্যস্ত নাতনির বিয়ে দেখবেন বলে।"
              উমার দিকে এবার আমিও তাকাই,ঠিকঠাকই আছে সব,বেশ লম্বাও মেয়েটা। তবে হ‍্যাঁ ছবির সাথে গায়ের রঙের পার্থক‍্য আছে।
         রঞ্জনের কাকা,কাকিমা নানা প্রশ্ন করতে করতেই বলছেন," আমাদের ভালো বংশের ঘরোয়া মেয়েই দরকার। তবে একটু সুন্দর মেয়ে হলেই ভালো। ফটো দেখে তো আমাদের পছন্দ হয়েছিলো তাই ভাবলাম দেখে আসি কিন্তু এখানে  এতদূর এসে সামনাসামনি দেখে কালোই মনে হচ্ছে। আমরাও বিয়ের তাড়া করছি আসলে আমার জাও খুব অসুস্থ,নতুনবৌকেই সংসারের হাল ধরতে হবে। কিন্তু যা দেখছি। কই এদিকে এসো দেখি তো মা.."
      ততক্ষণে রঞ্জনের কাকিমা উঠে এসেছেন মেয়ের কাছে। হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে দেখছেন মেয়ের হাত হয়ত বা ঘষে। আমার কেমন লাগছিলো,আসবোনা বলেছিলাম তবুও রঞ্জনের চাপে আসতে হয়েছিলো।
          হঠাৎই কথাটা কানে আসে.."আচ্ছা মেয়ের ফটোটা মানে যেটা পাঠিয়েছিলেন সেটা কোথায় তুলে এডিট করিয়েছিলেন? আসলে আজকাল তো সবই এডিটিংয়ের যুগ।"
                 রঞ্জনের কাকা কথাগুলো বলছেন,যার ওপর ওর অগাধ ভরসা। "আসলে ফেসবুকে সব ছবি দেখি তো পেত্নীদেরও পরী লাগে, তা এখানে তুলেছেন ছবি না কলকাতায়?"
        " এখানে অত ভালো স্টুডিও নেই কাকা,ওনারা নিশ্চয় কলকাতাতেই করেছেন,তাইনা?"
             উমার বাবা কেমন যেন চুপ করে যান,তা দেখে মুখ টিপে হাসে রঞ্জন আর ওর কাকা।
" না মানে ইয়ে,ওর ছবি এমনিতেই খুব ভালো ওঠে..."
              কথাটা শেষ না হতেই ঘরে যেন বাজ পড়ে। আস্তে আস্তে ঢুকে আসেন একজন বয়স্ক ভদ্রমহিলা তার সাথে আলাপ হয়েছে প্রথমেই, পাত্রীর ঠাকুমা। আর তার পাশ দিয়েই ঝড়ের গতিতে লম্বা ছিপছিপে চেহারার হলুদ কুর্তিতে মোটামুটি ঘোর কৃষ্ণবর্ণা এক ঘূর্ণিঝড়। ক্ষমা করবেন আমাকে,আসলে উমা যদি কালো হয় তাহলে হয়ত ও কালী তাই বলে ফেললাম। মানে তখন মনে হয়েছিলো।
                 মুহূর্তে একটা ঝড় উঠলো ঘরে," আশাকরি আপনাদের খাওয়া শেষ হয়েছে এখন আসুন। এডিটিংয়ের ঠিকানাটা আমি পাঠিয়ে দেবো পরে। নিজেদেরকে কি মনে করেন আপনারা? আমার বোনকে দিয়ে করাবেন তো আয়া আর রাঁধুনির কাজ তার জন‍্য এত কথা কিসের?"
                      রঞ্জন আর ওর কাকার উত্তপ্ত উত্তরের মধ‍্যেই একটা ঠান্ডা অথচ দৃঢ় আওয়াজে সবটা চুপচাপ হয়ে গেলো,ঘূর্ণিঝড়ও থামলো।
  " চলে আয় উমা,তুই থাম কালী আর কিছু বলিসনা। আপনারা এখন আসুন,অনেকটা পথ যেতে হবে।আসলে ভদ্রলোকের বাড়ি এসেছেন এইটুকু আতিথেয়তা আমরা করতামই। আমাদের পাত্র পছন্দ হয়নি প্রথমেই দেখে। আমরাও তো ছবিই দেখেছি তাই বুঝিনি ছেলে ভীষণ বেঁটে,মাথার পেছনে টাক আমার উমা অনেকটা লম্বা মাথা ভর্তি চুল ওর পাশে মানাবেইনা। পরে বলতুম ভালোভাবে,সে সুযোগ আর পেলুম কই। আপনাদের কথা শুনে আমার কালী যা ক্ষেপেছে,এখন তাকে সামলানোই মুশকিল।"
                       ঘূর্ণিঝড়ের মধ‍্যেও আমার হাসি পেলো এবার। এই যাহ্ মনে মনে যা ভেবেছিলাম তাই হলো শেষে! এ যে সত‍্যিই কালী! মানে ওর নামই কালী,তাহলে উমার বড় দিদিও আছে? কিন্তু এর তো বিয়ে হয়নি মনে হচ্ছে। অবশ‍্য তখন আর এতকিছু ভাবার সময় নেই প্রচন্ড রাগে অপমানে ফুঁসছে তখন রঞ্জন আর ওর কাকা তাই আমিও ওদের সাথে একদম বাড়ির বাইরে। ঘরের ঝড় অবশ‍্য ঠাকুমার এক ধমকেই থেমে গিয়েছিলো। বেরোনোর সময় হঠাৎই আবার চোখ পড়ে গেলো কালীর দিকে,চোখে তখনো তার আগুন জ্বলছে,কালো গাল দুটো চকচক করছে।নাহ্ আর সাহস হয়নি। খোদ কলকাতার ছেলে হয়েও বেশ ভয় পেয়েছিলাম। আসলে আমি ছোট থেকেই একটু ভীতু,দিদিই আগলাতো আমাকে।কোন পাড়ার ছেলের সাথে ঝামেলা হলে ও গিয়ে ঝগড়া করে আসতো। মা বলতো,"ভোদাই একটা"।
                   স্টেশনে এসে যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে। উফফফ, বাবা আর জীবনে মেয়ে দেখতে যাবোনা। কারো জন‍্যই যাবোনা,এমন কি নিজের জন‍্যও যাবোনা। দরকার হলে বিয়েও করবোনা কখনোই।প্রথমে নিজেকে শান্ত করে বন্ধুকে শান্ত করি বলি,"ছাড়তো যা হয়েছে ভালো হয়েছে,বাবা বাঁচিয়েছে ভগবান তোকে।"
    তবুও ঠান্ডা করা যায়না ওদের,"কি সাহস বলতো!একটা গ্ৰামের মেয়ে কত ওস্তাদ ভাব। যেন মনে হয় মারবে। আসলে সত‍্যি কথা বলেছি তো। এডিট করা ফটো দেখিয়ে চালাকি করে মেয়ের বিয়ে দেওয়া,ভাবে বোধহয় কিছু বুঝিনা।
                  ট্রেনে বসে জানলার পাশে মনে হলো যাক আগেই যা হওয়ার হয়ে গেছে এরপর যদি রঞ্জনকে বেঁটে,টেকো ইত‍্যাদি বলে রিফিউজ করতো তাহলে তো হয়েছিলো একদম যা তা।
     হঠাৎই নিজেকে একবার দেখতে ইচ্ছে করলো একবার। মাথায় হাত বোলালাম,নাহ্ এখনো টাক পড়েনি। রঙটা মোটামুটি ঠিক আছে আমার তবে ইয়ে আমার আবার নাকটা বোঁচা। মহা মুশকিল,একসময় শুনেছি ছেলেরা হলো গিয়ে ইয়ে সোনার আঙটি তাই সব সময় দামি। এখন তো দেখছি মেয়েরাও কম নয়,নাহ্ থাক বাড়িতে বলে দেবো আমার বিয়ের কথা বললেই একদম না। তবে এটা ঠিক যাচাই শুধু ছেলেরাই করবে কেন?মেয়েরাও নিশ্চয় করবে,একটা সুন্দরী মেয়ে তারপাশে ভুঁড়িওয়ালা,টেকো,বেঁটে,কালো বর নিয়েই বা ঘুরবে কেন? ঠিকই তো,এরমধ‍্যে তো কোন অন‍্যায় নেই।
                            বাড়িতে এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম,পথেই রঞ্জনকে বললাম আর মেয়ে দেখাতে আমি নেই বাপু আমার পাত্রী ফোবিয়া বা ঐ জলাতঙ্কের মতো বিয়েতঙ্ক হয়ে গেছে। ইশ্ কি ঝামেলা!বাড়িতে এসে মাকে সাফ জানিয়ে দিলাম,বাবা যেন আমার মেয়েটেয়ে না দেখে যদি কোন মেয়ে স্বেচ্ছায় আমার প্রেমে হাবুডুবু খায় তাহলেই বিয়ে হবে।
          মা সব শুনে হেসে বলে," ছেলেটা আমার ভোদাই রয়ে গেলো চিরকাল।"
মাঝে একবছর কেটে গেছে,গত শীতে রঞ্জনের বিয়েটা হয়ে গেছে মোটামুটি পাত্রীর সাথে,মানে বেচারা বোধহয় আর সুন্দরী খোঁজার সাহস পায়নি। আমার বাড়িতে দিদি আর মা মাঝে মাঝেই খোঁচায়,তবে আমি এখনো ঘাড় পাতিনি। সবে তো ত্রিশ হলো। এই বেশ আছি মেসবাড়ির মেজাজে,যখন খুশি আসছি।যেখানে খুশি যাচ্ছি।ছুটি পেলেই পাহাড়ে পর্বতে বেড়াতে চলে যাচ্ছি বন্ধুদের সাথে একদম অক্সিজেন নিয়ে ফিরছি। কেউ দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখেনি। এই তো বেশ ভালো। সামনের গরমে প্ল‍্যান হয়ে গেছে ট্রেকে যাবার তাই মনটা বেশ ফুরফুরে। মাকে বলতেই মা কিছুক্ষণ বকবক করলো," ধম্মের ষাঁড় হয়ে ঘুরে বেড়াও আর কি! এদিকে বাবা আর কতদিন সংসারের ঘানি টানবে শুনি?"
     বাবা চিরকাল একটু চুপচাপ ঠান্ডা মাথার কিন্তু ভালো মানুষ তাই হেসে বললেন,"ছাড়ো এই তো বয়েস। এখন একটু ঘুরবে না?তবে ওষুধপত্র সাথে নিয়ে যাস ঠিকমত বুঝলি।"
                           দেখতে দেখতে যাওয়ার দিন চলে এলো। ট্রেনে উঠে বেশ যাচ্ছিলাম,মাঝ রাস্তা থেকে উঠলো একটা দল মেয়েদের দল দেখে আমার বন্ধুরা বেশ উৎসাহিত হয়ে উঠলো। মজা করলো," সফরটা ভালোই হবে বুঝলি। একজনকে জিজ্ঞেস করে জানলাম,মানে সাথের ঐ ভদ্রলোককে সব ট্রেকিংয়ে যাচ্ছে। আমাদের ঐদিকেই যাচ্ছে বুঝলি।"
                    সত‍্যিই বুঝেছিলাম দারুণ উপভোগ‍্য মেয়েদের দলটা দুপুরে খাওয়ার পর। প্রথমে কথা কাটাকাটি আর তারপর চিৎকারে।কৌতূহল মেটাতে অন‍্যদের সাথে আমিও উঁকি মারি।
      " কেন আপনি প্লাস্টিক আর খাবারের প‍্যাকেটটা এখানে ফেললেন?"
  "ওখানে জায়গা হচ্ছিলোনা।"
"কে বললো জায়গা হচ্ছিলোনা?আমি দেখেছি আপনি ওখানে হাতই দেননি। কতগুলো প্লাস্টিকে মোড়া খাবারের প্লেট,প‍্যাকেট এখানে ফেলে চলে যাচ্ছিলেন।"
হ‍্যাঁ যাচ্ছিলাম তাতে আপনার কি?আপনি সাফাই করবেন?না আপনি রেলমন্ত্রী শুনি,যত্তসব।"
      " আমি একজন সচেতন নাগরিক,নিজের দেশকে ভালোবাসি পরিচ্ছন্ন রাখতে চাই। আপনি নোংরা তুলে ফেলুন জায়গায়।"
" যান তো মশাই অনেকক্ষণ ধরে লেকচার মারছেন,মেয়েমানুষ নিজের বাড়ি গিয়ে ঝাড়পোছ করুন। এত কথা কিসের?রেলের লোকেরা বুঝবে।"
আর যায় কোথায় এবার বোমা ফাটলো,
"মেয়েদের সম্মান করে কথা বলুন,আপনার মা আপনার মত কুসন্তানকে জন্ম দিয়েছিলো বলে আজকে এখানে দাঁড়িয়ে বড় বড় কথা বলছেন। মেয়েদের মধ‍্যে আপনার মাও পড়ে।"
            ততক্ষণে আমার আর চিনতে বাকি নেই মেয়েটা কে? আর এত সব কিছুর মধ‍্যে জয় হলো ওরই।কারণ এক সময় পুরুষেরাও ওর পক্ষেই এলো। সবাই বললো প্রথমে অসম্মানজনক কথা ঐ ভদ্রলোকই ব‍্যবহার করেছেন। তবে আমি ওকে চেনার পরই গুটিগুটি সীটে এসে বসে পড়েছি,মানে মোটামুটি বাঙ্কে উঠে পড়েছি। কোনভাবে যদি আমাকে চিনে ফেলে তো রক্ষা নেই। হে ভগবান এদের আমাদের সাথেই এক ট্রেনে উঠতে হলো। বাঁচাও আমাকে।
        সত‍্যিই ভগবান মুখ তুলে তাকালো,ওদের রুট বোধহয় আলাদা তাই স্টেশনের পর আর দেখা হলোনা। কিন্তু কালী আমাকে কেন যেন ছুঁয়ে গেলো,হয়ত এই রকম সাহসী মেয়েরই খুব দরকার আজকের সমাজে।যে দরকারে হাতে খড়্গও তুলে নিতে পারে। বিয়ের বাজারে নিজেকে সুন্দরী,ফর্সা আর গৃহকর্মনিপুণা প্রমাণ করার জন‍্য মুখে বেসন বা ময়দা দুধের সরের রূপটান না নিয়ে ট‍্যান পড়া চামড়ায় আর উজ্জ্বল চোখ আর দৃপ্ত মুখে সত‍্যি কথাটা মুখের ওপর একদম ঠিকঠাক বলতে পারে। অসম্মানিত হলে দরকারে যোগ‍্য জবাব দিতে পারে।
          লুকিয়ে লুকিয়ে ট্রেনে দু একবার দেখেছি ওকে, কালো কিন্তু ধারালো। টানা চোখে কাজলের বদলে তেজই বেশি। তবুও বন্ধুদের সঙ্গে যখন হেসে গড়িয়ে পড়ছিলো তখন মুক্তো ঝরছিলো সাজানো দাঁতের সারিতে।
                   পাহাড়ে ট্রেকের ফাঁকে অনেক সময় কোন দল দেখলেই খুঁজেছি ওকে। কিন্তু না আর দেখা হয়নি। মনটা হারিয়ে গিয়েছিলো ট্রেনের কামরায়,হঠাৎই দেখা হয়েছিলো চিনেও ফেলেছিলাম কিন্তু ভয় পেয়েছিলাম।ভয়ে কোন কথাই বলতে পারিনি,ইশ্ পরে মনে হচ্ছিলো আলাপ করলে হত। আর কি সত‍্যিই আমি ভোদাই,দিদিটা ঠিকই বলতো।সময়ে কিছুই করতে পারিনা, আমার কিছুই হবেনা।
         মাঝে কেটে গেছে কয়েকটা মাস। এরমধ‍্যে বেশ কয়েকবার কালী উঁকি দিয়েছে সংগোপনে। একবার যাবো নাকি ট্রেনে করে বাড়ি তো আমার চেনা পরক্ষণেই আঁতকে উঠি।
                       মাঝে বাবা একদিন দিদিদের এক খুড়তুতো দেওরের বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলো মানে যেতেই হয়েছিলো মেয়ের শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়ের বিয়ে বলে কথা। তারপর থেকেই বাড়িতে ফিরে একটা ফিসফাস শুরু হয়েছে,মনে হচ্ছে কোন ষড়যন্ত্র চলছে। দিদিকে জিজ্ঞেস করাতে কোন পাত্তাই দিলোনা।সোজা বলে দিলো " বাচ্চা ছেলেদের বড়দের কথায় আসতে নেই।অনেক কিছু হয়েছে জল অনেকদূর গড়িয়েছে এখন দেখা যাক।"
  বারবার অনুরোধ করলাম বলনা দিদি,ও কি চিরকালই দিদিগিরি খাটিয়ে যাবে আমার ওপর? ইশ্ ভগবান এরা নিশ্চয় আমার বিয়ে দেবার চেষ্টা করছে। কিন্তু আমি তো বিয়ে করতে চাইনা।
                            যাক দুর্গাপুজো ভালোই কাটলো বন্ধুদের সাথে মজা করে,টানা কয়েকদিন ঠাকুর দেখলাম আর মায়ের হাতের ভালোমন্দ খেলাম। রঞ্জনের সাথে বন্ধুত্বটা একটু আলগা হয়েছে ওর বিয়ের পর।
                                বাবা হঠাৎই দুদিন আগে তলব করলেন," শোনো কালীপুজোতে তো তোমার ছুটি।এতোদিন বন্ধুদের সাথে ঘুরে বেড়ালে একটু তো আত্মীয়বাড়িও যেতে হয়।এবার টুকুর শ্বশুরবাড়ির পুজোতে যেতে হবে।টুকুও তোমাকে বলবে ফোনে।তিনজনেই যাবো আমরা।"
      দিদির শ্বশুরবাড়ি তাই কোন সমস‍্যা নেই,তাছাড়া শুনলাম ভাইফোঁটা এবার ওখানেই হবে তাই একেবারে সব সেরে ঘুরে আসা।
                দিদিদের পুরোনো বাড়ি,পরপর লাইন দিয়ে সব জ্ঞাতির বাড়ি কালীপুজো এক সাথেই করে ওরা। আমরা সকালে গিয়ে পৌঁছলাম, দুপুরে ভালোই খাওয়াদাওয়ার আয়োজন হলো।
   খাওয়ার পর দিদি ফিসফিস করে বললো," বাবা,তোর জন‍্য একটা মেয়ে পছন্দ করেছে। তুইও দেখবি জানিনা তোর কেমন লাগবে।"
       ভীষণ মাথাটা গরম হয়ে গেলো,এতো রীতিমতো চক্রান্ত,আর বাবা শেষে এমন করলো!
আমার তখনই ফিরে যেতে ইচ্ছে করছিলো কলকাতায়।
                ওদের ওখানে পঁচিশ হাতের কালী হয়,মাকে আমি পঁচিশবার প্রণাম করে বললাম মা আমাকে এই মেয়ে দেখার হাত থেকে বাঁচাও দরকারে তোমায় পাঁঠা বলি দেবো। না পারলে একটা ছোটখাটো পায়রা তো দেবোই। সারা বিকেল উচ্ছেভাজার মত মুখ করে ঘুরলাম। অনেক রাতে পুজো হলো,আমি জাগতে পারলাম না এসে ঘুমিয়ে পড়লাম। স্বপ্নে দেখলাম মা কালী এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলছে ভয় পাসনা আমি তো আছিই। কিন্তু ঠাকুরের মুখটা বড় চেনা,আমার দেখা জ‍্যান্ত কালীর মত। সঙ্গে সঙ্গে ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো,ইশ্!
                                       পরের দিন আমি মা আর দিদির ওপর খুব রাগ করলাম,চলে যেতে চাইলাম। কিন্তু বাবা কথা দিয়েছেন তাই মেয়ে দেখে যেতেই হবে শুনলাম। পরের দিন সন্ধ‍্যেবেলা খাওয়াদাওয়া আর মজা করে সবাই,গানবাজনাও হয়। আমাকেও যেতে হলো সবার সাথে,কিছুক্ষণ থেকে আর ভালো লাগছিলোনা একটু দূরে গিয়ে সিগারেট ধরাই। হঠাৎই কানে আসে অদ্ভুত সুন্দর গান নজরুলগীতি..'আমার কালো মেয়ে রাগ করেছে,কে দিয়েছে গালি। তারে কে দিয়েছে গালি..রাগ করে সে সারাগায়ে মেখেছে তার কালি।'
        সত‍্যিই অপূর্ব গাইছে,একসময় আমিও কিছুদিন দিদির সাথে সাথে গান শিখেছিলাম। দু এক পা করে এগিয়ে আসি একটু কাছে খুব ভালো লাগে..কিন্তু গানের থেকে যখন গায়িকার দিকে মন দিই পা দুটো মাটিতে আটকে যায়। লাল শাড়িতে জড়ির পাড় আর হলুদ ব্লাউজ পরা স্বয়ং কালী গাইছে গান। হে ভগবান এ তো কালকের স্বপ্নের সেই ঝগড়ুটে কালী। তবুও সরতে পারলামনা দেখলাম আবার দেখলাম। এ তো দেখি নানা রূপে আবির্ভূতা কখনো মোহিনী,কখনো ধূমাবতী আবার কখনো কালিকা। রাতে ভালো করে ঘুম হলোনা,দিদিকেও জিজ্ঞেস করতে পারলামনা ওদের শ্বশুরবাড়ির পুজোতে এই মেয়েটা কেন তাহলে আমাকেই নানা জবাব দিতে হবে। তবে কাল খোঁজ খবর একটু করতে হবে। সকাল হতেই দিদি তাড়া দিলো,সকালেই মেয়ে দেখতে যাওয়া।
        আমি একটু জোর গলাতেই বললাম," বাবাকে বল আমি যাবোনা। আমি বিয়ে করবোনা। আমার..."
  কথাটা শেষ হলোনা,বাবার গলা শুনলাম,
     " আমার শ‍্যামাকে পছন্দ,টুকুরও খুব পছন্দ। আমি কথা দিয়েছি সেইজন‍্য তুমি যাবে। তোমার পছন্দ নাহলে কোন জোর নেই।"
              অগত‍্যা যাওয়া,কি একটা নাম শ‍্যামা, মানে গ্ৰাম তো ঐ শ‍্যামাসুন্দরী হবে। আমি সোজা বলে দেবো আমার পছন্দ হয়নি ব‍্যাস।
                   দিদির এক খুড়শ্বশুরের বাড়ি যাওয়া হলো,গল্প করছে সবাই। কিছুক্ষণ বাদে মেসোমশাই হাঁক মারলেন," আরে নিয়ে এসো মেয়েকে এবার। এক সাথে গল্প হোক বসে।"
               আমার তখন যা তা অবস্থা,উফ্ শ‍্যামাসুন্দরী আসছেন বয়েই গেছে দেখতে। পেপারে মন দিলাম মাথা নিচু করে।
           " ভাই,দেখ এবার ঐ যে ঢুকছে।"
কি দেখবো আবার? বলে ওকে একটা ঠ‍্যালা দিলাম। তবে এবার বোধহয় ঠ‍্যালা সামলাবার সময় আমার। কাকে দেখছি! একমাথা ঘোমটা দিয়ে কালীকে নিয়ে উমা ঢুকছে। উমাকে সত‍্যিই চিনতে পারিনি। সবটাই আমার কাছে জলের মত পরিস্কার হয়ে যায় এবার। উমার দিদি শ‍্যামা আর গায়ের রঙ আর মেজাজের জন‍্য বোধহয় কালী ঠাকুমার দেওয়া নাম। আমি মোটামুটি তখন বোল্ডআউট। দিদির ফিসফিস করে কথাগুলো কানে ঢুকছেনা ঠিক," শোন ভাই,ভীষণ ভালো গান গায়,পড়াশোনায় ভালো,পাহাড়ে চড়ে আরো অনেক গুণ। আমি হাঁ করে দেখতে দেখতে ভাবলাম তা আমি ভালো করেই জানি অনেক গুণ আর তাতেই তো আমি পুরো ফিদা হয়ে গেছি।
        " একটা শ‍্যামাসঙ্গীত গাও মা ঐ জন‍্যই তো শ‍্যামা মাকে দেখতে আসা।"
শ‍্যামা গান ধরেছে..'সকলি তোমারি ইচ্ছা ইচ্ছাময়ী তারা তুমি।তোমার কর্ম তুমি করো মা লোকে বলে করি আমি।'
              সত‍্যিই বোধহয় মা কালী আর ব্রহ্মা এইভাবেই গোপন কম্মটি সারেন। তবু ভালো আমায় চিনতে পারেনি। তবে বিয়েতঙ্ক দূর করে বিয়েটা বোধহয় এবার করতেই হবে কারণ তখন মন বলছে (কালীর) মায়ের পায়ের জবা হয়ে ওঠনা ফুটে মন।
                     দিদির আর মায়ের উৎপাতে বলতেই হলো আমি রাজি বিয়েতে। মেয়ে পছন্দ আমার। দিদি বললো," ওর বোনের বৌভাতে এসে আমার শাশুড়িমাকে চুপ করিয়েছিলো ও জানিস। ওখানে শাশুড়িমা কথা তুলেছিলেন..' আমার বৌমার মতই এই বৌমাও তো দেখি ময়লাই।'
  ও উত্তর দিয়েছিলো,' বাইরের রঙ ময়লাতে কি এসে যায় মাসিমা,মনটা ময়লা না হলেই হলো। আপনার হাঁটু ব‍্যথা বৌমা কি সুন্দর হাত ধরে নিয়ে এলো যত্নে তাকে ময়লা বলেন কি করে?"
       অবাক হয়েছিলাম আমি,বাবাও ওখানে ছিলো। শাশুড়ি তো বাবাকে শোনাতেই চেয়েছিলো। তখনই বাবার ভালো লাগে মেয়েটাকে।
       ওদের কথার মাঝে কখন যে বাবা চলে এসেছিলেন," আমার বাড়ির মেয়ে কালো বলে একগোছা সাদা টাকা দিয়ে পার করেছি নিরুপায় হয়ে তবে শ‍্যামা মাকে আমি বিনা পণে ঘরে তুলবো। ওর কালো রূপের ছটাতেই আমার ঘর আলো হবে।"
          আজ খুব প্রণাম করতে ইচ্ছে করলো বাবাকে। এমন বাবা,মা,দিদি সবার ঘরে ঘরেই হোক যাতে কালীর মত কালো মেয়ে আলো করে আসতে পারে শ্বশুরঘরে। বিজয়া হয়ে গেছে তাতে ক্ষতি কি,ঢিপ্ করে একটা প্রণাম করে ফেললাম।
জয় মাকালী সামনে পুজোতে তোমাকে এক হাড়ি মিষ্টি দেবো কালীকেই আমি যেন সাতজন্ম..না না আপাততঃ এই জন্মেই যেন পাই।
সমাপ্ত:-
   
             

          
     

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...