#ওরাও_ভালো_রাখে#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
দুদিন ধরে কথা বলা বন্ধ,রাতে বিছানায় উপলের গায়ে পা দিয়ে না শুলে ঘুম আসেনা অঙ্কিতার তবুও অভিমানে পাশ ফিরে শুয়েছে গত দুই রাত্রি। কই ও তো দিব্যি পাশবালিশ জড়িয়ে ঘুমিয়েছে একবারও তো জড়িয়ে ধরেনি ওকে,আদরও করেনি। রাগ শুধু ওরই থাকতে পারে আর কারো থাকতে পারেনা। অঙ্কিতা কয়েকটা কথা বলেছিলো ঠিকই, কিন্তু তার উত্তরও পেয়েছিলো কড়া ভাষায়। খারাপ লেগেছিলো,খুব খারাপ লেগেছিলো। মেলাতে পারেনি ওর ভালোবাসার বরটাকে এই বাজে লোকটার সাথে,রাগের চোটে দুজনেই দুজনকে ছি ছি করেছিলো। এর আগেও তো কত ঝগড়া হয়েছে তবুও উপলই মান ভাঙিয়েছে,কখনো বা অঙ্কিতাও সরি বলেছে কিন্তু এবার রাগের পারদ যেন নামছেই না গত দুদিনেও।
অবশ্য দুজনেই দুজনের কাজ ঠিকঠাক করে যাচ্ছে। অঙ্কিতা খাবার দিচ্ছে টিফিন গুছোচ্ছে আর উপল বাজার করে আনছে। শুধু মাঝের খুনশুটি,দুজনে চায়ের কাপ নিয়ে পাশাপাশি বসে পেপারের কোন টপিক নিয়ে কথা সবটাই বন্ধ। একদম যেটুকু না হলে নয় সেটুকু চলছে।
মনটা ভালো রাখতে চাইলেও ভালো রাখতে পারছেনা অঙ্কিতা,মাঝে মাঝে চোখের কোণায় বাষ্পও জমছে। আজ সকালে উঠে পেপারে চোখ রাখতেই চোখে পড়লো আজ বিশ্ব পুরুষ দিবস। ইশ্ একদম ভুলে গেছে,আচ্ছা একবার কি কাছে গিয়ে উইশ করবে? তারপরেই মনটা ফুটো বেলুনের মত চুপশে গেলো...ধ্যাৎ নারীদিবস, পুরুষদিবস এইসব আবার কোন ভূমিকা রাখে নাকি ওর কাছে? এই তো গতবারই ওর বন্ধু মেখলা,সুমনা কত গল্প করলো,ওদের হাবিরা নারীদিবসে খাওয়াতে নিয়ে গেছে,গিফ্ট দিয়েছে,ফুলের বোকে আর কার্ড দিয়ে সারপ্রাইজ দিয়েছে এইসব কত কি। আর ও বেরসিক বরটাকে বলতেই বলে উঠলো.."যত্তসব ন্যাকামি,এই ফেমিনিজম করে। আরে মেয়েরাই তো সমাজকে মোটামুটি ধরে রেখেছে স্নেহ,মায়া,মমতা আর যত্নে।প্রতিদিনই মেয়েদের দিন।এই ধরোনা,আমার সকালে চায়ের চুমুক থেকে রাত্রের চুমুতে তুমিই তো আছো।"
"কথায় তোমার সঙ্গে পারা যাবেনা,যত্তসব বাজে কথাবার্তা। সবাই কত গিফ্ট পেয়েছে,খেতে যাচ্ছে বাইরে।"
" তোমার গিফ্ট চাই?কি নেবে বলো?আমিই তো আছি তোমার গিফ্ট হয়ে মানে আমার পকেটটা ফর লাইফটাইম। যা চাইবে তাই দেবো তবে নারীদিবস পালনের জন্য নয়।ও সব বেশি বেশি দেখানো।"
আর বেশি কথা বলতে ইচ্ছে করেনি অঙ্কিতার।
রাতে ফিরে এসে অঙ্কিতার হাতে প্যাকেটটা ধরিয়ে দিয়েছিলো উপল।খুব আশাতে উঁকি মেরেছিলো ও,হয়ত কোন সারপ্রাইজ গিফ্ট হবে। কাগজের মোড়কটা খুলে খুব রাগ হয়েছিলো,"ইশ্ জঘন্য একটা লোক তুমি..আমি ভাবলাম কি না আছে এত যত্নে মোড়ানো।"
"তুমি বলেছিলে তোমার স্যানিটারি ন্যাপকিনট লাগবে,আর এটা আমার মানে আমাদের ভালোর জন্য যাতে তোমার পি এইচ ডি শেষ না হওয়ার আগে আমাদের মধ্যে কেউ এসে তোমার এত কষ্টটা পন্ড না করে।"
হেসে ফেলেছিলো অঙ্কিতা উপলের কথায়। " আমি মেয়েদের ছোট ছোট চাহিদাগুলো বুঝতে চাই অঙ্কিতা একদম অনুভূতি দিয়ে। আর খাবার আসছে খুব তাড়াতাড়ি একদম বাইকে চেপে। এসো একটু আদর করি।"
নাহ্ থাক পুরুষদিবস পালনের অত ঘটার দরকার নেই,যে দুদিন কথাই বলেনা তার সাথে আবার অত উইশ্ বিনিময়ের কি আছে! রোবটের মত আজও নিজের কাজগুলো সেরে নেয় অঙ্কিতা,শুধু একদম পাল্লা মেপে দুটো একটা কথা।
মাঝে একটু বাইরে গিয়ে তাড়াতাড়ি ফিরেছে অঙ্কিতা। ফেসবুকটা খোলে,দু এক জায়গায় দেখলো পোষ্ট করেছে কেউ কেউ,আসলে মুশকিল এটাই যে নারীদিবসে যেমন খুব একটা পুরুষেরা ঢাকঢোল বাজিয়ে মেয়েদের নিয়ে কিছু বলেনা সেই রকম নারীরাই বা কি বলবে। বেশিরভাগই তো মেয়েরাই বলে মেয়েদের কথা,এই যেমন মেয়েরা সব পারে অথবা আমরা নারী,আমরাই পারি। ছেলেরা আর কি বলবে,অনেকেই সব কাজ পারেনা অথবা পারলেও করেনা মানে মেয়েদের কাজ মেয়েরাই করুক হয়ত এইসব ভেবেই। যাকগে সেই মেয়েরাই লিখেছে কিছু কিছু।
উপল যা তা একটা কিছু এনে সাজিয়ে অনেক কথা বলতে পারে,ওর ওসব আসেনা তাই আজ একটু রাগের রেশে অনুরাগের ছোঁয়া মিশিয়ে রান্না করলো। ভাবলো রাতে ফিরলে উইশ করে খাবারটা দিয়ে আজ ভাব করেই নেবে আর ভালো লাগছেনা।
রান্নাটা শেষ করে নিজে একটু ফ্রেশ হয়ে নিজেকে সাজায় অঙ্কিতা। মনখারাপ হলে নাকি নিজেকে সাজালে মন ভালো থাকে।
হঠাৎই বেলটা বেজে ওঠে...দরজা খুলে দেখে অনিকেতদা উপলের অফিসেই কাজ করেন। কেমন যেন লাগে অঙ্কিতার.." আপনি কেন?এখনো তো ছুটি হয়নি!ও কোথায়?"
" আছে আছে সব ঠিক আছে,অত ভেবোনা। উফ্ আমার ঘাড়ে যত দায়িত্ব। এই তো তুমি রেডি হয়েই আছো। চলো,চলো একবার অডিটোরিয়ামে যাবে, দেরি করোনা। আমাকে আরো কয়েকজনের বৌকে তুলতে হবে।" হাসি পেয়ে যায় এবার অঙ্কিতার। সত্যি আরো কয়েকজনের বৌকে তোলা হলো।অনিকেতদা ব্যাচেলর তাই এই দায়িত্বটা তাকেই দেওয়া হয়েছে। বাকিরা চলে যাবে নিজে নিজে শুনলো।
"হঠাৎই ঠিক হয়েছে?নাকি আগেই ঠিক ছিলো?"
"আমি জানিনা বাপু,আমাকে আসামীদের বৌদের বাড়ি তুলে আনতে সাহেব অর্ডার দিয়েছেন তাই অগত্যা।"
অডিটোরিয়াম বেশ সেজেছে,ভালো লাগছে অঙ্কিতারও বেশ সবাই এক জায়গায় হয়েছে গল্প হচ্ছে।কিন্তু উপল কোথায়,ছেলেদের কাউকেই তো তেমন দেখছেনা!
প্রথমে ওদের ম্যানেজারের ছোট্ট কয়েকটা কথা দিয়ে শুরু হলো..."মেয়েরা সব পারে আর আমরা কিছুই পারিনা এমনটা প্রায় শুনে থাকি। আজ বিশ্ব পুরুষ দিবসে তাই আমরাও একটু বলবো আমাদের কথা।
গানবাজনা, আবৃত্তি,ছোট নাটক অনেক কিছুই এইটুকু সময়ের মধ্যে হয়ে গেলো।
তবে অঙ্কিতার চোখ খুঁজছিলো উপলকে,একবার একটু দেখেছে দূর থেকে। ঐ তো অবশেষে মঞ্চে.." আমার কবিতা একটু এলেও অন্য কিছু তেমন আসেনা। আমরা পুরুষ,জন্ম যদিও নারীদের গর্ভেই তাই সম্মান করি মাকে আর দেশকে। ভালো থাকতে চাই,ভালো রাখতে চাই হতে চাইনা শাসক,ধর্ষক বা প্রতারক বরং দরকারে হতে চাই রক্ষক,ভক্ষক নয়। একটু বেশিই কথা বলে ফেললাম। বাবাকে দেখেছি,পুরুষ দিবস জানতেননা তবুও আমার পাতে বড় মাছটা দিয়ে খুশি হতেন। মাকে দেখেছি সংসারটা আগলাতে তবুও এখন মনে হয় একটু যদি ওরা নিজেদের কথা ভাবতো। তবে আমার পছন্দের মানুষের চোখে আমি কেমন পুরুষ হয়ত সেটা সেই বলতে পারবে,তবে ওর ছোটছোট অনুভূতি আর রাগ দেখে বুঝি একটু বেশিই ভালোবাসে আমাকে। রুমাল থেকে আলমারির ওডিকোলনে সবটাই ওর গন্ধমাখা। হয়ত বা ব্যালকনির গাছগুলোও সবুজ পাতা সাজায় ওরই আদরে।
প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে থাকতে চাইনা,চাই পরিপূরক হয়ে থাকতে।"
অঙ্কিতাকে একটু আস্তে ঠ্যালা মারে সুমনা,অঙ্কিতার চোখে তখন জল। দুদিনের জমে থাকা বরফ কখন যে জল হয়ে গলে গেছে বুঝতেই পারেনি।"
বেডরুমের আলোটা জ্বলছে হাল্কা নীল রেখায়.." ইশ্ কিসব বললে অফিসে! কিছু কথা বলতে পারো তুমি!"
" যাক তবুও ভালো আমি কথা বলতে পারি,একদম গুড ফর নাথিং নই।"
আদরে উপলের বুকে মাথা রাখে অঙ্কিতা, কেন যে রাগ হলেই আমরা কথা বলিনা।অথচ একটু টুকরো টুকরো ভালো কথা হয়ত এক ছুট্টে মনখারাপের দরজা খুলে নিয়ে আসতে পারে খুশির ঝুড়ি।
হ্যাপি মেনস্ ডে..বলবে? না থাক ছোট্ট বেলায়,দাদুন,বাবা,দাদার মত উপলও তো ওর জীবনের ভালো পুরুষ। আর ওরা আছে বলেই তো আজও আমরা সমাজ সংসারে স্নেহের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে স্বপ্ন দেখি এক সুন্দর পৃথিবীর।
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment