এক কাপ চায়ে
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
পিং আওয়াজে ফোনটা খোলে সুদীপা,আজ যেন রান্নাতে মনই বসছেনা। জানলায় চড়াই দুটো এসে সমানে এ ওর ঠোঁটে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে প্রেম করছে। মনটা উড়ে যায় এক নিমেষে ও বোধহয় একটু বেশিই রোমান্টিক বা হয়ত আবেগী।এদিকে কড়াইয়ের আলুগুলোতে ততক্ষণে সোনালী রঙ ধরেছে এবার টম্যাটো দিয়ে ভাজা ভাজা করে কষিয়ে মশলা ঢেলে নাড়াচাড়া করতে করতে তেল দেখা গেলেই মটরশুঁটি ছড়িয়ে দেবে। সুমন অনেক আগে অফিসে চলে গেছে।এই রান্নাটুকু হলেই ও ময়দাটা মেখে যাবে স্নানে। শাশুড়িমা গেছেন মন্দিরে উনি এলেই গরম গরম লুচি নিয়ে ওরা শাশুড়ি বৌ বসবে খেতে।
উত্তর কলকাতার একদম ঘটি বাড়ির বৌ সুদীপা। এখনও সুন্দর দেহের গড়ন মাথায় কোকড়া চুল। তবুও আজকাল মনে হয় এইসব কিছুর কোন মূল্য নেই কারো কাছে। সুমন তো তাকিয়েই দেখেনা তেমন করে কোনদিন।দাম্পত্যসুখ বলতে ঐ শরীরের সুখ যা সপ্তাহ থেকে এখন গিয়ে মাসে ঠেকেছে। সুমনের মাঝে শরীরটা খারাপ হওয়ায় প্রায়দিনই ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ওর ক্লান্ত বুকে হাত দিয়ে ঘুমোনোর সময় হস্টেলে থাকা বাবানের মুখটা মনে করে কখন যে ক্লান্তিতে চোখটা বুজে আসে বুঝতেই পারেনা। একদম খাস ঘটি বাড়ির বৌ হওয়ায় উপোস লেগেই আছে আর তার মানেই ময়দা খাওয়া। প্রথম প্রথম ভালো লুচি পরোটা না পারলেও এখন বেশ পাকাপোক্ত গিন্নী সুদীপা তাই অনায়াসে নারকেল নাড়ু থেকে পরোটা,লুচি আর কচুরী বানিয়ে ফেলতে পারে এই জাস্ট ফটাফট হাতের গুণেই।
মোবাইলটা খুলেই গালে একটু রক্তিম আভা জাগে সুদীপার ইশ্ কি রোমান্টিক কবিতা লেখে যে সত্যিই মনকে নাড়া দেয়।
' ইশারায় মন মাঝরাতেও জাগে,
তুমিও কি জেগে আছো?
ভাসছো অদেখা প্রেমের আবেগে।'
টুকরো কয়েকটা লাইন কিন্তু মনকে নিয়ে যায় যেন কোথায়। কবিতা যে এত সুন্দর হয় ভাবতেই পারেনি একটা সময় কম বয়েসে..তখন আবৃত্তি বলতে রবীন্দ্রনাথ বা নজরুলের কবিতা। কবিগুরুর কবিতার প্রেম আর ভাবটুকুও হয়ত বোঝার মত বয়েস তখন হয়নি। তখন একজন কি সব হিজিবিজি কবিতা পড়ে শোনাতো। জাস্ট হেসে উড়িয়ে দিতো সুদীপা,"এই শোন এই সব ফালতু কবিতা তোর কে শোনে আমি জানিনা।"
"কাল রাতে কতগুলো কাগজ নষ্ট করে এত কষ্ট করে লিখলাম আর তোর কাছে ফালতু বলে মনে হচ্ছে কবিতাটা! একদম বেরসিক তুই,সাহিত্য বুঝিসই না।"
" না বাবা আমার বুঝে কাজ নেই আমি বি কম পড়ছি ঐ হিসাব নিকাশই আমার ভালো লাগে।"
যদিও হিসাব নিকাশ করে প্রেম হয়না তবুও হয়ত কিছুটা ভাবনা চিন্তা করে সুমনকেই ভালো লেগেছিলো সুদীপার যখন ওর জেঠতুতো দিদি বলেছিলো," আমার দেওর তো বিয়েতে এসে তোকে দেখে পুরো ফিদা হয়ে গেছে। আর তারপরেই সুমনের এক তরফা প্রেমটা কখন যে দুতরফা হয়ে দুজনকেই ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো একটা বছর। তারপর ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েই একদম সোজা ছাদনাতলাতে।বিয়ের খবর শুনে সেই হিজিবিজি কবিতা লেখা ছেলেটা বলেছিলো," সত্যিই তুই বি কম।"
রাগ হয়েছিলো ওর.." মানে?আমার বুদ্ধি কম!"
পাজিটা মাথা চুলকে বলেছিলো," নারে তুই বোকা কম, মানে তুই খুব চালাক।তাইতো একদম বিয়ে করে পদন্নোতি। নাহলে আবার পরীক্ষার ফলে যদি ফেল আসে তার আগেই..."
" তবে রে,কি রকম পাজি আর হিংসুটে দেখেছিস! আমি বিয়ে করছি বলে হিংসেতে জ্বলছে।"
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে বলেছিলো অঞ্জন,"চিরকাল হিসেবই করলি তুই।তবুও বোকার হদ্দই রয়ে গেলি।ভালোবাসাটা কোনদিনই বুঝলি না। আর আমিও একটা ভীতুর ডিম তাই বলতেই পারলাম না ভয়ে ভালোবাসি কথাটা। আরে হিংসা না বরং দুঃখে পুড়ছি।"
বিয়ের কেনাকাটা করতে যাবে বলে ঘন ঘন ঘড়ি দেখছিলো তখন সুদীপা। তাই অঞ্জনের চোখের ভাষা পড়ার অবকাশই হয়নি তখন।
ড্যাং ড্যাং করে বিয়ে বরের সাথে কলকাতা চলে এসেছিলো সুদীপা। জলপাইগুড়ির সেই কবিতা লেখা পাগলাটে অঞ্জনটা কেমন আছে তা আর মনে হয়নি কখনোই।আসলে ওতো মনেই ছিলোনা তাই সংসার স্বামী আর বাচ্চা সামলাতে সামলাতে কখনো ক্লান্ত মনের চিন্তাতেও আসেনি অঞ্জন। আর একসময় সংসারের চাপে চাপা পড়ে গিয়েছিলো সুমন সুদীপার প্রেম। হয়ে গিয়েছিলো শুধুমাত্র অভ্যেসে পাশাপাশি থাকা।
আননোন মেসেজ জমা পড়েছিলো মেসেঞ্জারে বহুদিন ধরে। হঠাৎই একদিন অবকাশে খুলেছিলো চিঠির ঝাঁপি,আর তারপর থেকেই নিত্য অভ্যেসে খোলে। কখনো শোনে... "ভালোবাসার মানুষ এবার বদলে যাক
অনেক না পাওয়ার মাঝে।
নিজেকে একটু ভালোবেসো
যতই থাকো কাজে।"
প্রতিদিনই একটু অপেক্ষা করে থাকে কখন আসবে ছোট্ট টুকরো চিঠি। প্রোফাইলটা সার্চ করে দেখেছে অনেকদিন কিছুই পায়নি শুধু কিছু মনে দোলা লাগানো কবিতা ছাড়া। অদ্ভুত নাম প্রোফাইলের পথভোলা। তবুও যেন এক অমোঘ টানে প্রতিদিনই অপেক্ষা করে সুদীপা আজ যদি কিছু আসে। যেদিন আসেনা চিরকুট, সেদিন কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। কখনো মোবাইলে চোখ রাখতে গিয়ে তরকারির জল ফুটে ফুটে শুকোয়। মাছের ঝোলটা শুকিয়ে যায়।
" বৌমা ছেলেটাকে একটু ঝোল দাও।"
অনেক সময় নিজের খাওয়ার সময় ভাতে মাছ গড়িয়ে খেয়ে নেয় বরকে ওর ঝোলটুকু ঢালতে গিয়ে।
কি আশ্চর্য!প্রায়দিনই মেসেজে পাঠায় ছোট্ট অনুভূতির চিরকুট অথচ ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায় না। নিজে থেকে একটা প্রোফাইল পিকচার বিহীন প্রোফাইলের মালিক না মালকিন কে জানে তাকে বন্ধুত্বের আবেদন পাঠাতে ইগোতে লাগে সত্যি ওর।
সুমনের ব্যস্ততা,ছেলের হস্টেল আর সুদীপার ছোট একফালি বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাজের ফাঁকে ঐ দূরের কৃষ্ণচূড়া গাছটা দেখা আর কখনো অলস দুপুরে মোবাইলে পিংয়ের অপেক্ষা।
" তোমার আজ ফিরতে দেরি হবে নাকি? ভাবছিলাম আজ একটা সিনেমা দেখবো।"
" তুমি তো জানো আজকাল সময় কত কম পাই,তারপর সামনের সপ্তাহে আবার চারদিন থাকবোনা।"
সুদীপা জানে দুদিন অফিসের কাজ সেরে সুমন একেবারে ছেলের কাছে দেখা করে ফিরবে।শাশুড়িমা আছেন তাই ওর যাওয়া হয়না সবসময়। জানে ও সুমনের ব্যস্ততা থাকে তবুও কি সুমন একটুও সময় বার করতে পারেনা ওর জন্য নাকি সময়ের সাথে সাথে মরচে ধরে প্রেমেও। সুমনকে বললে বলে," তুমি একটু বেশিই ইমোশনাল।আরে টিনএজ বহুদিন আগেই ফেলে এসেছো।তোমার থেকে ছেলে বেশি ম্যাচিওরড্।"
কথাগুলো শুনে খুব অভিমান হয়। ছেলেগুলো এইরকম বেরসিক হয়ে যায় বোধহয় বয়েসে।
সংসারে মোটামুটি সারাদিন কেটে যায় ওর।আসলে কাজের মানুষকেই বোধহয় কাজ খোঁজে। ফেসবুকের দৌলতে কয়েকজন বন্ধুর সাথে যোগাযোগ হয়েছে। এতদিন তো ছেলে ছেলে করে কিছুই করতে পারেনি। ওরা অনেকদিন বলেছে কলকাতা এলেই দেখা করবে। সুমনকে বলতেই ও বললো," আজকাল এই একটা হয়েছে মহিলাদের কোন কাজকম্ম নেই তো বন্ধুদের নিয়ে মলে বসে আড্ডা। আমাদের মায়েদের তো এইসব ছিলোনা কোনদিন।"
সুদীপা বোঝে সুমন এক অদৃশ্য গন্ডী কেটে রেখেছে ওর চারপাশে। এক নিষেধের গন্ডী। তবুও সুদীপার আননোন মেসেঞ্জারের কবিতা কেন যেন ছোট্ট ছোট্ট কথায় এলোমেলো করে ওর মনটা।
"হাজার কাজের মাঝে নিজেকে চিনতে শেখা,
আবার ভালোবাসার আয়নায় নিজেকে দেখা।
খুব ছোট্ট দুটো লাইন তবুও ফিরে ফিরেই ছোলার ডালে ফোড়ন দিতে গিয়ে মনে হলো সুদীপার।
স্নান করে আয়নায় নিজের মুখটা আজ যেন একটু বেশিক্ষণই দেখলো।অন্যদিন ঠাকুরকে ফুল জল দেবার জন্য দৌড়য়। কানের পাশে একটু একটু রূপোলি রেখা। মুখের চামড়ায় শুষ্কতা,ঠোঁটেও রুক্ষতার ফাটল। একটু যত্ন নিয়ে মুখটাতে ক্রিম দিয়ে সিঁথিটা ভরলো সুদীপা। ছেলে এখন অনেকটা বড় তবুও যেন সময়ের ভাগে নিজের ভাগই থাকেনা আজও।
" বৌমা তোমার হলো,বেলা হলো যে পুজোটা সেরে নাও।"
শাশুড়িমা মা হাঁটু মুড়ে বসতে পারেন না মাটিতে তাই পুজোটা ওকেই সেরে ফেলতে হয়। ঠাকুরকেও একটু বেশি সময় না খেয়ে থাকতে হয়।কাজ সারা হলে তবে তো।কিন্তু দুপুরে আবার কাজ সেরে অলসতা উপভোগ করতে করতে চিরকুট খোঁজে সুদীপা। দু লাইন কখনো চার লাইন তার মাঝেই এক পৃথিবী অনুভূতি।হয়ত বা সারাদিনের একমুঠো ভালোলাগার আস্বাদ।
সেদিন কেনাকাটা করতে বেড়িয়েছিলো অনেকদিন বাদেই একা। আজকাল আর তেমন বাইরে বেরোনো হয়না। একটা সময় ছেলের জন্যই হয়ত দিনে দুবারও যেতে হত বাইরে।এখন মনে হয় সেটাই ভালো হত।
" দীপা না?ঠিক ধরেছি। ফুলে ফেঁপে আয়তনে বাড়লে কি হবে।মুখটা দেখেই চিনেছি।"
এমন করে একজনই কথা বলতো প্রীতি,একদম কাটা কাটা কথা অথচ কথায় বেশ একটা অন্তরের টান ছিলো।
রাস্তার মধ্যেই দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরে।
"উঃ কতদিন মানে কতবছর পর বলতো?"
"আচ্ছা অনেককেই পেয়েছি..তোকে দেখিনা। তুই কোথায় ছিলি এতদিন?"
মুখটা একটু ম্লান হয়ে যায় প্রীতির,"আসলে ঐসব ফেসবুকে আমি নেই রে মানে আর আসা হয়নি। চল কোথাও গিয়ে বসি।অনেক অনেক কথা হবে।"
"আমার শ্বশুরবাড়িতেই চলনা,খুব দূর নয় ওখানেই গল্প করবো।"
" সে কি রে?এখনো শ্বশুরবাড়িটা তোর বাড়ি হয়নি? আজ হবেনা রে। আজ রাতেই আমার ট্রেন ফিরবো জলপাইগুড়ি।চল চা খেতে খেতে কথা বলি।"
জলপাইগুড়ি নামটা শুনে কেমন যেন মনটা উদাস হয়ে যায় সুদীপার..ওদের গার্লস স্কুল,নদী,ওদের পুরোনো বাড়ি আর পাড়া সব কেমন ছবির মত চোখের সামনে ভাসতে থাকে।
কথায় কথায় জানতে পারে প্রীতির বিয়েটা অনেক দেরিতে হয়েছিলো। মা অসুস্থ বাবাকে কে দেখবে এই করে বিয়ে করতে বেশ দেরি হয়ে যায়। মা মারা যাবার পর দিদিই সম্বন্ধ করে বিয়ে ঠিক করে বিয়ের পর বিদেশে চলে যায় বেশ কয়েকবছর ওখানে ছিলো তবে বিয়েটা টেকেনি।"হয়ত আমিই পারিনি মানিয়ে নিতে শেষে খুব দমবন্ধ লাগায় একদম পালিয়ে বেঁচেছি। সোনার শিকলের চেয়ে ভোরের খোলা আকাশ অনেক ভালো। "
প্রীতি যেটুকু বলেছিলো আর বেশি জানতে চায়নি সুদীপা। কি হবে বেশি কিছু জেনে হয়ত সুখী দাম্পত্য অথবা অসুখী দাম্পত্যে কিছু টুকরো অনুভূতি।কখনো সুখের অসুখ,কখনো বা একাকীত্বের সুখ,হয়ত সব কিছুর সাথেই পরিচয় হয়ে গেছে এতদিন সংসার করতে করতে তাই থাক না ওসব আলোচনা। তারচেয়ে বরং সেই মেয়েবেলাতেই ডুব দেওয়া ভালো। একদম নিখাদ আনন্দ আর একমুঠো নষ্টালজিয়ায় ভরানো সুখ।
দুই সখীর গল্পে গল্লে কখন যে একঘন্টা সময় পার হয়ে গেলো বুঝতেই পারলোনা। উছলে পড়লো কত স্মৃতি চায়ে চুমুক দেবার ফাঁকে। একটা প্লেট চাট থেকে পাপড়ি তুলে খাওয়া মনে করিয়ে দিলো কলেজের দিনগুলো।
" জলপাইগুড়ি আয় না একবার, সবাইকে বলেছি।আমি তো এখন একাই থাকি বাড়িতে বেশ লাগবে তোরা এলে।"
" খুব ইচ্ছে করে রে,কত বছর যাইনি বলতো?আসলে আমরা সবাই ভীষণ একা।কেউ একে কেউ বা অনেকে। আচ্ছা দেখি যদি সম্ভব হয়।"
" মন থেকে যদি চাস নিশ্চয় সম্ভব হবে।"
প্রীতি চলে গিয়েছিলো প্রথমে মাঝে মাঝে কথা হত তারপর দুজনেই হয়ত ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলো নিজেদের নিয়ে।
মাঝে কেটে কয়েকটা মাস হাতে মোবাইল নিয়ে অলস দুপুরে ডুব দিয়েছে সুদীপা।নিজের সাথে নিজের কাটানো কিছুটা সময়ই বড্ড আদরের ওর কাছে।
" বৌমা পিয়ন এসে দিয়ে গেলো এটা..দেখোতো কি আছে?বেশ তো শক্ত মত চিঠি।"
একটা কার্ড তবে একদম অন্যরকম..সাদা মসৃণ ওপরটা শুধু এককোণে কয়েকটা পলাশের ছবি। আর মাত্র কয়েকটা লাইন লেখা ভেতরে...
...আমার রঙহীন জীবনে হঠাৎই প্রজাপতির আনাগোনা।
তোদের সবাইকে সেদিন সাথে চাই,
আসিস প্লিজ সোনা।
মনটা কেমন যেন ফুরফুরে হয়ে যায় হঠাৎই একরাশ ভালোলাগায়। প্রীতির বিয়ে! এখন? এই বয়েসে! হোক না,এলো না হয় বসন্ত অসময়ে।আবার রঙিন হয়ে উঠুক ওর রঙহীন জীবনটা অকাল বসন্তের ছোঁয়ায়।
সুমনকে বলতে হবে চলোনা ঘুরে আসি..বন্ধুর বিয়ে বলে কথা, এত করে বলেছে।
রাতে শোবার সময় আলতো আদরে সুমনের বুকের কাছে আসে সুদীপা।চিঠিটা ওকে দেখায়," শোনো না,যাবে গো।মেয়েটা খুব একা হয়ে গিয়েছিলো এতদিনে হয়ত একটা ভালো থাকার স্বপ্ন দেখছে আবার নতুন করে।"
" এই বয়েসে বিয়ে! তাও আবার ভালো থাকার জন্য? হুঁ কি সব চিন্তা। তোমারও তাই মনে হয়?এর থেকে একটা প্রেম ট্রেম করলে বরং নির্ঝঞ্ঝাট ভালো থাকতে পারতো।"
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুদীপা কত প্রেমই যে একটু আদর যত্নের অভাবে অসুস্থ হয়ে যায় তার খবর কজন রাখে?
" আমার অত শখ নেই,তোমার বন্ধুর বিয়ে তাছাড়া আমি ওনাকে চিনিওনা তেমন করে।সেখানে গিয়ে আমি কি করবো? তাছাড়া মা একা থাকবেই বা কি করে?"
সুমনের শেষ কথাটাতেই বাস্তবে পা রাখে সুদীপা।যদিও জানে সুমন অসন্তুষ্ট হবে হয়ত তবুও সাহস করে বলেই ফেলে.." তাহলে আমি যাই? ময়নার মাকে বলে যাবো ও মায়ের হাতে হাতে সব করে দেবে।"
" তুমি যাবে একা অতদূর?"
" না ইতু আর মালবিকা যাবে বলছিলো।"
" তাহলে তো সব প্ল্যান হয়েই গেছে।আমাকে আর মাঝখানে আনা কেন?"
বেশ কিছুটা মন কষাকষি একটু শীতলতা,শাশুড়িমায়ের মুখ ভার ছেলের অসুবিধার কথা ভেবে।তবুও সুদীপা এবার সাহসে পেরোলো আঠেরো বছরের গন্ডী। ছোট ট্রলি আর হ্যান্ডব্যাগে গুছিয়ে নিলো কয়েকটা পছন্দের শাড়ি আর প্রয়োজনীয় জিনিস। মনের মাঝে এই কদিন মাঝে মাঝেই উঁকি দিয়েছে চা বাগান,তিস্তা আর সবুজের হাতছানি।
যদিও যাওয়া আসা দিয়ে পাঁচটা দিন তবুও বেশ কিছু রান্না করে তুলে রাখে ফ্রীজে বরকে খুশি করার জন্য। তবে খুশি করতে আর নাম কিনতে ভাগ্য চাই সবার সে কপাল থাকেনা।
সুমন অবশ্য স্টেশনে ছাড়তে এসেছিলো একবার দেখে নিলো নিজের চোখে বৌয়ের সহযাত্রীদের। আড্ডা,গল্পে কখন যে সময় কেটে গেলো বোঝাই গেলোনা।মনে হচ্ছিলো মাঝের বছরগুলো বোধহয় ছিলোই না।মনটা একলাফে নেমে এসেছে কলেজের দিনে।
" ইশ্ আমাদের যখন শেষ তখন প্রীতিটা আবার বিয়ে করছে। বরের কথা তেমন করে কিছু বললোই না।কার্ডটাও তো হাতে লিখেছে আর একদম অন্যরকম।"
" কেন রে তোরও ইচ্ছে হচ্ছে নাকি আবার একবার সাতপাক ঘোরার?"
" আবার? রক্ষে করো। একটাকে নিয়েই বাঁচছিনা। কনেযাত্রী হয়ে যাচ্ছি এটাই মজার।আমার বর তো বলেই দিলো এই বয়েসে বিয়ে? এর থেকে প্রেম ট্রেম করলেও ভালো ছিলো।"
সে তো মনে মনে আমরা সবাই প্রেমিক।মনটাকেই বাঁচিয়ে রাখাটা আসল।
জলপাইগুড়ি পৌঁছনোর পর প্রীতির মাসতুতো ভাই ওদের নিয়ে গেলো বাড়িতে। কত পাল্টে গেছে ওদের মেয়েবেলার শহর। চেনাই যায়না যেন।
ওদের পেয়ে প্রীতি জড়িয়ে ধরে," ভাগ্যিস আবার বিয়ে করলাম তাই তোদেরও গন্ডী পেরোনো হলো। বাবা কিছু সংসার করিস তোরা।"
"কিন্তু এ কেমন বিয়েবাড়ি! প্যান্ডেল নেই,আলো নেই।শুধু লুচির গন্ধটাই আছে।"
ওদের কথাতে হেসে ফেললো প্রীতি। "ইশ্ এই বয়েসে আলো জ্বালিয়ে, প্যান্ডেল করে আমি বিয়ে করতে পারবোনা। আসলে ঘরপোড়া গরু তো আমি তাই ভয় হয়।"
কিছুক্ষণের জন্য সবাই চুপচাপ।শুনলো ফরেস্ট বাংলোতে বিয়ে হবে,নিরিবিলি চাঁদনী রাতে শুধুমাত্র কয়েকজন আন্তরিক বন্ধু আর আত্মীয়র মাঝে।
ওরা কিছুতেই শুনলোনা,ইচ্ছেমত সাজালো প্রীতিকে।চাঁপাফুলের রঙে লালপাড়ের বেনারসীতে। মাথায় দিলো লাল গোলাপ।সব বয়েসেরই বোধহয় আলাদা আলাদা সৌন্দর্য আছে তাই প্রীতিকেও অনন্যা লাগছে।
" এই যে আমরাও কম না কিন্তু।"
" ওমা তোরাও বেনারসীতে!"
আনন্দ করার একটা চান্স পেয়েছি বান্ধবীর বিয়ে বলে কথা।সুযোগ ছাড়বো কেন?"
" আমার বরটা যে কি করবে তোদের দেখে কে জানে!"
" আমরাও অপেক্ষায় আছি তোর সেই রোমান্টিক বরকে দেখার জন্য। আমাদের বরগুলো তো একেবারে গেছে।"
চারিদিকে সবুজে সবুজ একদম জঙ্গলের মাঝে ফরেস্ট বাংলো, সুন্দর ব্যবস্থা। হাসিমুখে পায়জামা পাঞ্জাবী পরে যে ওদের আপ্যায়ন করলো তাকে দেখে চমকে উঠলো ওরা।
" ওমা! এটা কে?অঞ্জন না? ও এই জন্যই প্রীতি আমাদের সারপ্রাইজে রেখেছে তাইনা?তুইও আইবুড়ো ছিলি এতদিন।কোথায় ছিলি রে?"
" আমার আর কিছু হলোনা রে,এই এখানকার মানুষদের জন্য কিছু ছোটখাটো কাজটাজ করি। হঠাৎই প্রীতিকে দেখলাম একদিন কেমন যেন পালছেঁড়া নৌকার মত ভাসছে।
তারপরেই একদিন ঠিক করলাম পড়ন্ত বেলার দিনগুলো একসাথে কাটাবো ভালোমন্দে পাশে থাকবো আমাদের ভালোবাসার শহরে।"
অঞ্জনের কথাগুলো মন ছুঁয়ে দিলো ওদের। সুখে থাক ওরা ভালো থাক বিকেলের রোদ্দুরে। বিয়ে হয়ে যাবার পর চুটিয়ে খাওয়াদাওয়া হলো একদম খাস বাঙালী রান্নায়।
বিয়ের পর বাসরঘরে আসর বসবেনা তা হয়?
প্রীতিই বললো," এবার তোর খাতাটা খোল।"
" প্রীতি বরকে তুই তোকারি করা ছাড়। অবশ্য কিই বা করবি?একটা সময় তো ওকে আমরা ছেলে বলেই মনে করতাম না।"
" ইশ্! আর ঐ জন্যই তো ওর প্রেমটা করা হলোনা। তোরা কেউ বুঝলিই না ও ভালোবাসতে পারে। তাই এই শেষবেলাতে ওর পরাণটাকে গামছা দিয়ে আমাকেই বাঁধতে হলো।"
একসঙ্গে হেসে উঠলো ওরা সবাই। অঞ্জনের কবিতাগুলো ওদের খুব চেনা কারণ অঞ্জন যে ওদের সবাইকেই চিরকুট পাঠাতো ভালো থাকার চিরকুট তবে একদম ছদ্মনামে। সেটা এবার একদমই জানাজানি হয়ে গেলো। মনে মনে হয়ত গোপনে সবাই চিরকুটের অপেক্ষায় থাকতো।
" অঞ্জন সবাইকে ফ্লার্ট করেছিস এইভাবে?"
" একদম না কবিতা মনের গভীরে কড়া নাড়তে পারে কি না তাই দেখছিলাম।" হাসে অঞ্জন,হাসে ওরা সবাই।
" দেখেছিস তো কেমন নজর রাখতো সব বান্ধবীদের প্রোফাইলে।"
শুধু সুদীপা বলতে পারলোনা অঞ্জনের চিরকুট ওর একঘেয়েমির মধ্যে এককাপ এলাচ মেশানো চা। যা পড়লে এক নিমেষে মনটা ভালো হয়ে যেত। অঞ্জনকে বা অঞ্জনের কবিতাকে একটা সময় বোঝেনি।যখন বুঝেছিলো তখন আর খোঁজার উপায় ছিলোনা।
প্রীতি আর অঞ্জনের চোখাচোখি হলো,দুজনের চোখেই মুগ্ধতা মাখানো কারণ দুজনেই দুজনের মনের সব জানলা দরজা খুলে দিয়েছে দুজনের কাছে। একটা সময় সুদীপার বিয়ে হয়ে যাবার পর অঞ্জনের ভাঙা হৃদয়ের কথাটা ও জানতো। তবে আজ সবটাই অতীত..অঞ্জনের কবিতা যদি একটু ভালো রাখে বন্ধুদের মন তাতে ক্ষতি কি?
অঞ্জন ওর জীবনে খোলা আকাশ আর বন্ধুদের জন্য না হয় রইলো ছেঁড়া চিরকুট হয়ে যার ছোটছোট টুকরোতে আছে শুধু ভালো থাকার মন্ত্র।
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment