#বিদ্যারূপেণ#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
দুর্গা,গণেশ,সিংহের মুখোশগুলো পরপর সাজিয়ে রাখে রাধা। রঙ করে ফেলতে হবে তাড়াতাড়ি, কি আর পারে এইটুকু ছাড়া। সামনেই তো আসছে বসন্তকাল,শীতের ঠান্ডার ওম কাটিয়ে পলাশে পলাশে রাঙা হবে ওদের পুরুলিয়া। তখন কত জায়গা থেকে লোক আসে এখানে আর সেই সময়ই ওদেরও হয় কিছুটা বাড়তি রোজগার।তাই মুখোশগুলো খুঁটিয়ে দেখে রাধা। রঘুটা এখন নেই সেই নেশা করে বেপাত্তা হয়ে আছে দুদিন,রাধা জানে ঐ যে নদীর ওপারের গ্ৰামে হয়ত সেই রঙ্গিনী মেয়েটার কাছে আছে।আবার পেটে টান পড়লেই রাধার কাছে এসে বলবে,"কই রে শুধু দিন রাত খাচ্ছিস,তবুও তো ঐ কাঠ গতরে লাগেনা কিছু।কোন সুখই তো দিতে পারলিনা।টাকা দে,শিগগির টাকা দে।"
না দিলেই শুরু হয়ে যায় চিৎকার, অসভ্যতা এগিয়ে আসে ওর বড় শরীরটা নিয়ে রাধার দিকে। শুরু হয় অপমান আর অত্যাচার।কখনো জোর করে চেপে উঠে বসে শরীরটার ওপর,গা গুলিয়ে আসে রাধার আজকাল ওর সাথে শুতেও ভালো লাগেনা। মনের ভেতরটা কাঁদে নষ্ট পুরুষের শরীরের অত্যাচার চুপ করে মেনে নিতে। রঘু বলে,"বড় ত্যাজ নাকি তোর?হাতের কাজ ভালো বলে নাকি?হুঁ মেয়ে মানুষের আবার বুদ্ধি?ঐ তো দশহাতেই ল্যাংটা।"
ক্লাশ এইটে পড়তে পড়তে যখন ওর বাবা জোর করে বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলো খুব কেঁদেছিলো রাধা।"বাবা আমাকে স্কুলের পাশটুকু দিতে দাও।স্যারেরা বলে আমি ভালো পড়াশুনা করি।বই পড়তে আমার খুব ভালো লাগে।"
কেউ শোনেনি ওর কথা,শিক্ষিত ছেলে রঘু মাধ্যমিক দিয়েছে ওদের ছৌ নাচের মুখোশের ব্যাবসা তাই এই পাত্র হাতছাড়া করা যাবেনা কিছুতেই। পরে এখন হাসি পায় রাধার,ও ক্লাশ এইট আর রঘু মাধ্যমিক ফেল তবুও কত দেমাক ও নাকি লিখা পড়া জানে।ব্যাঙ্কের কাগজ ভরতে জানে।
ভাবতে ভাবতে দুর্গার মুখোশটা হাতে নিয়ে মনটা যেন কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলো ওর।
পেছন থেকে শক্ত হাতের বাঁধনে মুখ ফেরায় রাধা। ওরে বাবা ওর লক্ষ্মী গণেশ স্কুল থেকে এসে গেছে যে। ঐ ছেলে মেয়ে দুটোর মুখ চেয়ে রঘুর অত্যাচার সহ্য করে রাধা।এইতো সেবার ওদের দিদিমুনি বলছিলো,"ওদের বাবাকে তো কোনদিনই দেখিনা স্কুলে আসতে। অথচ গার্জেনের ঘরে বাবার সই। জানেন তো এখন মায়েরা গার্জেন হতেই পারে কোন বাধা নেই।"
মুখে হাসি থাকলেও রঘুর কথাগুলো মনে পড়ে যায়,"বাপের বাড়ি থেকে লিয়ে এসেছিস নাকি ও দুইটাকে শুনি।আমার খাচ্ছে আর আমার নামে ভড়কাচ্ছিস ওদের তাইনা?আমার কাছে আসেনা দুটা।সেদিন তো ছেলেটা ফোঁস করে উঠলো। এরপর যদি করে একদম মেরে শুইয়ে দেবো।"
হঠাৎই রাধার চোখমুখ কেমন যেন বদলে যায়। রঘু একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলো সেদিন। শান্ত রোগা রাধার চোখ দুটো জ্বলে উঠেছিলো.."আমার থেকে কেউ খারাপ হবেনা সেদিন।এমনিতেই তোমার অত্যাচারে ওদের পড়ালিখা নষ্ট হয়। আমি যদি না দেখতাম তাহলে তো।"
ব্যাঙ্গ করে উঠেছিলো রঘু,"কত বড় বিদ্যেবতী রে,হুঁ ঐ তো কেলাস এইট হাঁটুতে বুদ্ধি।তাই নিয়ে ফড়ফড় করা। ওরা একটা পাশ দিলেই গণশা ব্যাবসা দেখবে আর লক্ষ্মীকে আমি বিয়া দিব।"
"একদম না,আমি বেঁচে থাকতে কিছুতেই না।"
"কেন রে পটুয়ার বাড়ির ছেলেমেয়ে কি জজ ব্যারিস্টার হবে নাকি রে?আর মেয়েটা সে কি হবে শুনি?"
বাবা মায়ের ঝগড়ায় ভয়ে মুখ ঢেকেছে লক্ষ্মী আর গণেশ রাধার দুই ছেলেমেয়ে। টিনের দরজাটা বাইরে থেকে আটকে রাধা বাইরে এসে কখনো মার খেয়েছে কখনো বা কেঁদেছে।
" মা আমাদের রেজাল্ট বার হয়েছে গো,আমরা সবার থেকে বেশি নম্বর পেয়েছি।"
ছেলে মেয়ে দুটোকে দুইহাতে জড়িয়ে ধরে রাধা। ওরা যেন ওর দুই হাত,ডানহাত আর বাম হাত।
একটু একটু করে লুকিয়ে পয়সা জমায় রাধা,কিছুতেই ওদের পড়াশোনা বন্ধ করা যাবেনা। ওদের বড় হতে হবে,পড়তে হবে ভালো মানুষ হতে হবে। দেশের জন্য কিছু করতে হবে।এই পুরুলিয়ার জন্য কিছু করতে হবে।
সরস্বতী পুজোর আগে একটা ছোট ঠাকুর বানিয়ে দিতেই হয় রাধাকে ওর ছেলেমেয়েদের জন্য সেই কবে থেকে। গাছ থেকে ফুল বেলপাতা পেড়ে নিয়ে এসে বাতাসা কদমা দিয়ে পুজো সাজায় ওরা।আসে আসে পাশের ছোট ছেলেমেয়েও কিছু।প্রত্যেকবারই ওরা একটা কথাই বলে,"মা ঠাকুরের মুখটো যেন একদম তোমার মত দেখতে।"
আগে থেকেই বলতে থাকে,"মুখটো তোমার মত হবে তো মা।"
রঘু শুনে ক্ষেপে উঠেছিলো.."ঠাকুরের সাথে মায়ের মুখের তুলনা,এই পড়াশোনা শিখছিস বটে। যা মুখ! কোথাও এক ফোঁটা মধুও নাই।"
মাথাটা গরম হয় রাধার,যত মধু ঐ রঙ্গিনীর আছে তাই উখানে গিয়ে মজে থাকে।
এবারও ঠাকুর তৈরী করা হয়ে গেছে রাধার।কালই তো পুজো।ওর ঠাকুরের মুখ মুখোশের মতই,অমনটাই পারে রাধা। তাতেই খুশি ছেলে মেয়ে দুটো।
"মা,মা স্কুলে তোমাকে নিমন্ত্রণ দিয়েছে। এই দেখো কার্ড বড় দিদিমণি দিয়েছে।"
কার্ডের ওপর রাধারাণী মাহাতো লেখা,দেখে কেমন যেন বুকটা কাঁপে রাধার।ওর নাম কার্ডে!
"তোদের পুজোতে আমি কি করবো বাপ?ঘরে কত কাজ।"
'না না বড় দিদিমণি তোমাকে যেতেই বলেছে।"
ছেলেমেয়েদের বায়নায় সকাল সকাল পুজো করে স্কুলের দিকে পা বাড়ায় রাধা। কি সুন্দর সাজিয়েছে স্কুলকে।ওমা কত বড় সরস্বতী ঠাকুর। ইশ্ কত লোকজন, কেমন যেন লজ্জা করে রাধার। দিদিমণি এগিয়ে এসে রাধাকে নিয়ে এক জায়গায় বসান। ওদের পুজো হয়ে গেছে তবুও কত লোকজন,কি হবে এখানে?
সবাই চেয়ারে বসে,বড় দিদিমণি কিছু বলছেন কিন্তু রাধার চোখের জলে সবটা ধুয়ে মুছে যাচ্ছে কেন?চোখটা ঝাপসা তার মধ্যেই রাধা দেখছে ওর দুই যমজ ছেলেমেয়ের হাতে দুটো সোনার মত দেখতে সরস্বতীর মূর্তি।ওরা প্রাইজ পাচ্ছে।কিন্তু ওকে মাইকে দিদিমুণি ডাকছে কেন। কাঁপা পায়ে এগিয়ে যায় রাধা,এগিয়ে আসে লক্ষ্মী গণেশ দিদিমণি শিখিয়েছেন সত্যিকারের সরস্বতী ঠাকুরের পায়ে সরস্বতী পুজোর দিন অঞ্জলি দিতে।ওদের হাতে মুঠো করা বাসন্তী গাঁদা ফুলগুলো ছড়িয়ে দেয় রাধার পায়ে।মাকে প্রণাম করে ওরা। রাধার দুচোখ আজ বড় ভেজা,জড়িয়ে ধরে দুই ছেলেমেয়েকে কোথায় হারিয়ে যায় এইট পাশ করা মুখে মধুহীন রাধারাণী মাহাতো যে এখনো স্বপ্ন দেখে যে কাজ সে করতে পারেনি করবে তার সন্তানেরা।দিদিমণি তখন বলছেন,"একজন সচেতন মা সুসন্তান গড়ে তুলতে পারে। যেমন রাধারাণী দিনের পর দিন নিজের জেদ আর আত্মবিশ্বাসে সুশিক্ষা দিয়ে গড়ে তুলছেন সন্তানদের।প্রকৃত বিদ্যার দেবী,জ্যান্ত সরস্বতী হয়ত এমন মায়েরাই যারা নিজেদের শ্রম,স্বপ্ন চেষ্টা আর শিক্ষা দিয়ে সন্তানদের গড়ে তোলেন যারা হবে একদিন দেশের আর দশের ভবিষ্যৎ।
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment